হাওর বার্তা ডেস্কঃ বাংলা লোকসংগীতের মতো সমৃদ্ধ আর কোনো সংগীত লক্ষ্য করা যায় না। বিচিত্র নাম ও শ্রেণীকরণ লোকসংগীতে ফুটে উঠেছে। যেমন আলকাপ, ওন্নিগান, কবিগান, খেমটা, ক্ষেত্র নিড়ানীর গান, গম্ভীরা, গাজন, গাজীর গান, ঘোসা গান, ঘেঁটু গান, চটকা, ছাদ পেটানোর গান, জাগ গান, জারি গান, ঝাঁপান, ঝুমুর তর্জা, ধান কাটার গান, ধান ভানার গান, ধামানী, ধূয়া গান, নাটুয়া গান, নৈলা গান, বৃষ্টির গান, নৌকা বাইচের গান, টুসু, পটুয়া গীত, বাউল গান, বাঘাই শিরনীর গান, বারবাসি, বিচার গান, বিচ্ছেদের গান, বেদের গান, বৈঠকী গান, বোলান গান, ব্রতের গান, ভাওয়াইয়া, ভাটিয়ালী, মারফতী, সারি, মাইজভাণ্ডারী গান ইত্যাদি।
বাংলা বাউল সংগীতের কদর আলাদা। আত্মার সঙ্গে পরমাত্মা, সৃষ্টির গূঢ় রহস্য নিয়ে ভাবনা বাউল সংগীতে প্রতিফলিত হয়। বাউলদের অনেকে অক্ষরজ্ঞান ও শিক্ষা না থাকায় তাদের সৃষ্টিকে লিপিবদ্ধ করতে পারেন না। কেবল স্মৃতির ওপর নির্ভর করে বাউল সম্প্রদায় তাদের সৃষ্টি লালন ও বহন করেন। আমজনতার এ সম্পদ সময়ের স্রোতে প্রবাহিত হয়ে এসে তার ভাষা সমুদ্রে বিচরণ করে। লালন ফকির ও হাছন রাজা কত হাজার গান রচনা করেছেন তা বোধহয় কোনো গবেষকই এখনো হলফ করে বলতে পারেননি। জীবন, সংসার, জগৎকে অনিত্য দুঃখময় ভেবে বাউলরা আধ্যাত্মিক জগতের মধ্যে শান্তি ও মুক্তি খোঁজেন। কেউ সরাসরি সৃষ্টিকর্তার কাছে প্রার্থনা করেন, কেউ গুরু মুর্শিদের কাছে আবেদন-নিবেদন করেন। খাঁচার ভিতর অচিন পাখি কেমনে আসে যায়-এতো লালনের গান। মাটিরও পিঞ্জিরার মাঝে বন্দি হইয়ারে-এতো হাছন রাজার গান, শাহ্ আবদুল করিম লিখেছেন ‘আগে কি সুন্দর দিন কাটাইতাম, ‘কেমনে ভুলিব আমি বাঁচি না তারে ছাড়া, ‘আমি কুলহারা কলঙ্কীনি, ‘গাড়ি চলে না, চলে না, চলে না রে, ‘বন্ধে মায়া লাগাইছে পিরিতি শিখাইছে, ‘মন কান্দে প্রাণ কান্দে রে, কান্দে আমার হিয়া, ‘বসন্ত বাতাসে সইগো, বসন্ত বাতাসে’ ইত্যাদি। অত্যন্ত দুঃখের বিষয়, আমাদের দেশের অনেক নামি-দামি শিল্পী শাহ্ আবদুল করিমের গানকে ‘সংগ্রহ’ কিংবা নিজের বলে চালিয়ে বেশ খ্যাতি পেয়েছেন, আয় করছেন প্রচুর অর্থ অথচ যার গান তিনি সুনামগঞ্জ জেলার দক্ষিণে দিরাই থানার এক পর্ণ কুটিরে বাস করতেন।
শাহ্ আবদুল করিমের দর্শন হলো- মানবপ্রেমই বড় ধর্ম। সৃষ্টিকর্তাকে পেতে হলে আগে মানুষকে ভালোবাসতে হবে। মানুষের মাঝেই সৃষ্টিকর্তার অবস্থান। অভাব-অনটন, দুঃখ-দারিদ্র ছিল শাহ্ আবদুল করিমের জীবনসাথী। কিন্তু কখনো নুয়ে পড়েননি তিনি। তাকে বেশ কয়েকবার জিজ্ঞেস করা হয়েছিল যে, আপনার লেখা ও সুরারোপিত গান গেয়ে আজ অনেকে মস্তবড় শিল্পী বনে গেছেন অথচ আপনি কোনো প্রতিবাদ করছেন না। তার জবাব- আমি বেতার শুনি না, টিভি দেখি না, আমার ভাঙা ঘরে এসব নেই, আমার গান গেয়ে কেউ যদি নামি-দামি হয় তাতে আমার কী, আমি এসবের ধার ধারী না। আমি হলাম রাখাল। আধপেটা কিংবা উপোসে কেটেছে আমার জীবন। রাখালের চাকরি ছেড়ে ধলবাজারে মুদির দোকানে কাজ করেছি। দিনে চাকরি আর রাতে হাওর-বাঁওড়ের ধারে ঘুরে ঘুরে গান গেয়েছি। শাহ্ আবদুল করিম নিজের এলাকাসহ বিভিন্ন স্থানে গান গাইতে শুরু করেন। করিম বাউলের হাঁক-ডাক বাড়ে। কিন্তু পকেট ভরে না। বাউল সংগীতে নয়, ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলনে নিজেকে জড়িয়ে ফেলেন। এমনকি এদেশের স্বাধিকার আন্দোলনেও করিম বাউলের গান উৎসাহ জুগিয়েছে। ভাসানী-সোহরাওয়ার্দী-বঙ্গবন্ধুর সান্নিধ্য পেয়েছেন শাহ্ আবদুল করিম গানের জন্য। তিনি নিজের পরিচয় উপস্থাপন করেছেন এভাবে-‘কেউ বলে শাহ আবদুল করিম, কেউ বলে পাগল/ যার যা ইচ্ছা তাই বলে বুঝি না আসল-নকল/বসত করি দিরাই থানায় গ্রামের নাম হয় ধল/ধল একটি প্রসিদ্ধ নাম দূরদূরান্তে আছে নাম/এই গ্রামের জয় জিলাম নাই কোনো সম্ভল/গানের উস্তাদ করমুদ্দিন, ধল আশ্রমে বাড়ি/পরে সাধক রশীদ উদ্দিন, উস্তাদ মান্য করি/বাউল ফকির আমি একতারা সম্ভল/সবলাকে সঙ্গে নিয়া আদি উজান ঢল।’ বাউলিয়ানার মাধ্যমে শাহ্ আবদুল করিমের নাম ছড়িয়ে পড়ে। সর্বত্র তাকে বাউল সম্রাট হিসেবে ভূষিত করা হয়।
১৯৫৬ সালে তার লেখা প্রথম গ্রন্থ, ‘আফতাব সংগীত’ প্রকাশিত হয়। এরপর একে একে প্রকাশিত হয় ‘গণসঙ্গীত’, ‘কালনীর ঢেউ’, ‘ধলমেলা’, ‘ভাটির চিঠি, ‘কালনীর কূল’ ইত্যাদি গ্রন্থ। বাউল সম্রাটের জীবন গাড়ি থেমে যায় গত ১২ সেপ্টেম্বর ২০০৯। তার উপর নির্মিত হয় প্রামাণ্য চিত্র ‘ভাটির পুরুষ’। দার্শনিক আরজ আলী মাতুব্বর, শাহ্ আবদুল করিম-এদের দু’জনের মাঝে মিল খুঁজে পাওয়া যায়। উভয়েই মৃত্যুর পূর্ব মুহূর্তে পরিচিতি লাভ করেছেন। তারা গ্রামে বাস করতেন, বড় কোনো ডিগ্রি নেই সেজন্য মূল্যায়ন করা হয়নি। তবু শেষতক গাড়ি স্টেশনে থামার আগে কিছুটা হলেও উপস্থাপিত হয়েছেন।