জয়পুরহাটের জামালগঞ্জ কয়লাখনির আরও প্রায় ১৫ কিলোমিটার এলাকাজুড়ে দ্বিমাত্রিক (টু-ডি) জরিপ পরিচালনা করতে যাচ্ছে বাংলাদেশ পেট্রোলিয়াম এক্সপ্লোরেশন অ্যান্ড প্রোডাকশন কোম্পানি (বাপেক্স)। বড়পুকুরিয়া কয়লা খনি কোম্পানি লিমিটেডের (বিসিএমসিএল) সঙ্গে একটি চুক্তির মাধ্যমে এ চিন্তা করা হচ্ছে। জামালগঞ্জ কয়লা খনি থেকে কয়লা উত্তোলনের সম্ভাব্যতা যাচাইয়ের লক্ষ্যে এই উদ্যোগ গ্রহণ করেছে সরকার। এই ১৫ কিলোমিটার এলাকায় থাকার ফলে নওগাঁ জেলার কিছু অংশও জরিপের আওতায় আসবে।
পেট্রোবাংলা সূত্রে জানা যায়, দেশে পাঁচটি কয়লা খনি থাকলেও উত্তোলন পদ্ধতি নিয়ে দ্বিধাদ্বন্দ্ব থাকায় বড়পুকুরিয়া ছাড়া অন্য খনিগুলো থেকে কয়লা তোলা যাচ্ছে না। একমাত্র বড়পুকুরিয়া খনির কয়লা দিয়ে বড়পুকুরিয়ার ৫২৫ মেগাওয়াট ক্ষমতার তিন ইউনিটের কয়লা বিদ্যুৎকেন্দ্রটি পরিচালনা করা হয়। অথচ দেশে বিদ্যুৎ উৎপাদনে কয়লার ওপর বড় ধরনের নির্ভরতা আছে। এর মধ্যে দেশের তিনটি বড় বিদ্যুৎকেন্দ্র
পায়রা ১৩২০ মেগাওয়াট, রামপাল ১৩২০ মেগাওয়াট এবং এস আলম গ্রুপের একটি ১২০০ মেগাওয়াট ক্ষমতার কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্রের জন্য হাজার হাজার কোটি টাকার কয়লা নিয়মিত বিদেশ থেকে আমদানি করতে হচ্ছে।
পেট্রোবাংলা সূত্র জানায়, ‘জামালগঞ্জ কয়লা ক্ষেত্র ও এর পশ্চিমাংশে জয়পুরহাট ও নওগাঁ জেলার ১৫ কিলোমিটার এলাকায় খনি উন্নয়নের প্রাথমিক সমীক্ষা’ শীর্ষক প্রকল্প হাতে নেওয়া হয়েছে। অর্থাৎ জরিপটি পরিচালনা করা হবে জয়পুরহাট ও নওগা জেলায়। জরিপের ফলাফল পাওয়ার পর সেখানে উন্মুক্ত না ভূগর্ভস্থ পদ্ধতিতে কয়লা উত্তোলন করা হবে, সে সিদ্ধান্ত নেবে সরকার।
বিসিএমসিএল সূত্রে জানা যায়, প্রকল্পটির প্রস্তাব ইতোপূর্বে পেট্রোবাংলার ৫৮৭তম বোর্ডসভায় অনুমোদন হয়েছে। প্রথমে ৫০ কোটি টাকার বৈদেশিক মুদ্রসহ যার ব্যয় নির্ধারণ করা হয়েছে ১০০ কোটি টাকার উপরে। পরে সেটার ব্যয় আরও কিছু বাড়িয়ে চূড়ান্ত করা হয়েছে।
বিষয়টি সম্পর্কে জানতে চাইলে বড়পুকুরিয়া কয়লা খনির ব্যবস্থাপনা পরিচালক মো. সাইফুল ইসলাম সরকার আমাদের সময়কে বলেন, জামালগঞ্জ খনি এলাকার আরও ১৫ কিলোমিটার এলাকায় সম্ভাব্যতা সমীক্ষাসহ বাপেক্সকে দিয়ে কয়লাক্ষেত্রের ১৫ কিলোমিটার টু-ডি সিসমিক সার্ভে পরিচালনার সিদ্ধান্ত হয়েছে। বিষয়টি নিয়ে বিসিএমসিএল ও বাপেক্সের মধ্যে সর্বশেষ সিদ্ধান্ত অনুযায়ী চূড়ান্ত কাজ শুরু হওয়ার অপেক্ষায় আছে। দুটি কোম্পানি শিগগিরই একটি চুক্তি স্বাক্ষর করবে। তিনি বলেন, সব কিছুর চূড়ান্ত রিপোর্ট আসার পর জ্বালানি বিভাগের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী কয়লা উত্তোলন করা হবে। সেটা ভূগর্ভস্থ পদ্ধতি নাকি উন্মুক্ত পদ্ধতিতে হবে, পরে সরকার নির্ধারণ করবে।
এদিকে জ্বালানি বিভাগ সূত্রে জানা যায়, প্রকৃত পক্ষে জামালগঞ্জে কয়লা কী প্রক্রিয়ায় তোলা হবে সেটা নিয়ে এখনও চূড়ান্ত কোনো সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হয়নি। তবে নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক জ্বালানি মন্ত্রণালয়ের এক কর্মকর্তা আমাদের সময়কে বলেন, ভূর্গভস্থ কোল গ্যাসফিকেশন বা (ইসিজি)-এর মাধ্যমে কয়লা খনি থেকে গ্যাস আহরণের বিষয়ে ভাবছে জ্বালানি বিভাগ। ফলে সম্ভাব্যতা যাচাইয়ের লক্ষ্যে সমীক্ষা প্রস্তাব তৈরি করাসহ বিভিন্ন দিক বিশ্লেষণে কাজ করছে জ্বালানি বিভাগ। ইতোপূর্বে এ সংক্রান্ত একটি কমিটি ছিল, গত অক্টোবরে আবারও কমিটি নতুন করে পুনর্গঠন করা হয়েছে।
প্রসঙ্গত, বাংলাদেশে প্রায় ৬ হাজার মেগাওয়াট ক্ষমতার কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র আছে। একই সঙ্গে দেশে ৫টি কয়লা খনি রয়েছে। সরকারের বিভিন্ন প্রতিবেদন সূত্রে জানা যায়, এসব খনিতে অন্তত ৭৮৩২ মিলিয়ন টন কয়লা মজুদ আছে, যা ২০০ টিসিএফ গ্যাসের সমান। এ রিজার্ভ কয়লা দিয়ে ৫০ বছরের জ¦ালানি নিশ্চিত করা যাবে।
বিদ্যুৎ বিভাগ সূত্রে জানা যায়, দেশে বিদ্যুৎ উৎপাদনের যে সক্ষমতা রয়েছে তার মধ্যে প্রায় ২৫ শতাংশ হলো কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র। সরকারি হিসাবে প্রায় ২৬ হাজার মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদন সক্ষমতার মধ্যে ৫ হাজার ৯০৭ মেগাওয়াট কয়লাভিত্তিক। এ ছাড়া পরিকল্পনা অনুযায়ী সেটা সাড়ে ১১ হাজার হবে।
দেশে এখন পর্যন্ত পাঁচটি কয়লা খনি আবিষ্কার হয়েছে। সবই উত্তরাঞ্চলে। এসব খনিতে ৭ হাজার ৮২৩ মিলিয়ন টন কয়লার মজুদ আছে। জ্বালানি বিভাগ সূত্রে জানা যায়, কয়লার ২০ শতাংশ উত্তোলনযোগ্য হলেও পরিমাণ দাঁড়াবে ১ হাজার ৫৬৪.৬ মিলিয়ন টন। এ পরিমাণ কয়লা ৪০.৬ ট্রিলিয়ন ঘনফুট গ্যাসের সমান জ্বালানি চাহিদা পূরণ করতে সক্ষম।
জানা গেছে, দেশের পাঁচটি খনির মধ্যে দিনাজপুরের বড়পুকুরিয়া থেকে ২০০৫ সালে কয়লা তোলা শুরু হয়। এ খনিতে মজুদ আছে প্রায় ৪১০ মিলিয়ন টন কয়লা। উত্তোলনযোগ্য মজুদ ২০০ মিলিয়ন টন। দিনাজপুরের নবাবগঞ্জের দীঘিপাড়া কয়লা খনির মজুদ ৭০৬ মিলিয়ন টন। উত্তোলনযোগ্য মজুদ ৯০ মিলিয়ন টন। এখানে ভূগর্ভস্থ পদ্ধতিতে বছরে ৩ মিলিয়ন টন কয়লা তোলা যাবে। রংপুরের খালাসপীরে কয়লার মজুদ আছে ৬৮৫ মিলিয়ন টন। উত্তোলনযোগ্য মজুদ ৮০ মিলিয়ন টন। দিনাজপুরের ফুলবাড়ীতে মজুদের পরিমাণ ৫৭২ মিলিয়ন টন। উত্তোলনযোগ্য মজুদ ৪৭০ মিলিয়ন টন। দেশের সবচেয়ে বড় কয়লা খনি জয়পুরহাটের জামালগঞ্জে। এখানে মজুদ আছে ৫৪৫০ মিলিয়ন টন। তোলা যাবে ১০০৫ মিলিয়ন টন।