আয়ুর্বেদের জন্মলগ্ন থেকেই হলুদের সঙ্গে এই শাস্ত্রের নাড়ির সম্পর্ক। আর কেন হবে নাই বা বলুন! সেই হাজার বছর আগেও তৎকালীন আয়ুর্বেদ বিশেষজ্ঞরা একথা বুঝে গিয়েছিলেন যে এই প্রকৃতিক উপাদানটি হল পুষ্টিকর উপাদানের একটি পাওয়ার হাইজ, যাকে ঠিক ঠিক উপায়ে যদি কাজে লাগানো যায়, তাহলে শরীরকে নিয়ে আর কোনও চিন্তাই থাকবে না।
এমন ভাবনা যে ভিত্তিহীন ছিল না, তা আজকের নানা গবেষণাতেও প্রমাণ মেলে। একাধিক স্টাডিতে দেখা গেছে হলুদের অন্দরে রয়েছে প্রচুর মাত্রায় অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট, অ্যান্ট-ভাইরাল এবং অ্যান্টি-ব্য়াকটেরিয়াল উপাদান। সেই সঙ্গে মজুত রয়েছে অ্যান্টি ফাঙ্গাল এবং অ্যান্টি-কার্সিনোজেনিক প্রপাটিজও, যা নানাভাবে শরীরকে মজবুত রাখতে এবং কঠিন থেকে কঠিনতর রোগ-ব্যাধিকে দূরে রাখতে বিশেষ ভূমিকা পালন করে থাকে। ঠিক এই কারণেই তো চিকিৎসকেরা ৮ থেকে ৮০ সবাইকেই প্রতিদিন সকালে, খালি পেটে এক কোয়া করে হলুদ খাওয়ার পরামর্শ দিচ্ছেন।
১. ডায়াবেটিসের মতো রোগ দূরে থাকে: একাধিক গবেষণায় দেখা গেছে নিয়মিত সকালে উঠে কাঁচা হলুদ খাওয়া শুরু করলে দেহের অন্দরে এমন কিছু উপাদানের মাত্রা বৃদ্ধি পেতে শুরু করে, যার প্রভাবে ইনসুলিনের কর্মক্ষমতা বৃদ্ধি পায়। ফলে রক্তে শর্করার মাত্রা নিয়ন্ত্রণের বাইরে যাওয়ার সুযোগই পায় না। তাই তো বলি বন্ধু এমন মারণ রোগে আক্রান্ত হতে যদি না চান, তাদের রোজের ডায়েটে এক টুকরো কাঁচা হলুদকে জায়গা করে দিতে ভুলবেন না যেন!
২. ক্ষতের চিকিৎসায় কাজে আসে: কাঁচা হলুদে উপস্থিত কার্কিউমিন এবং আরও নানা সব অ্যান্টি-ইনফ্লেমেটরি উপাদান যে কোনও ধরনের ক্ষতের যন্ত্রণা কমাতে যেমন বিশেষ ভূমিকা পালন করে থাকে, তেমনি দ্রুত চোট আঘাত সারাতেও দারুন ভাবে সাহায্য করে। এই কারণেই তো ছোট বাচ্চাদের নিয়মিত কাঁচা হলুদ খাওয়ানোর পরামর্শ দিয়ে থাকেন চিকিৎসকেরা। প্রসঙ্গত, এক্ষেত্রে আরেকভাবেই হলুদকে কাজে লাগানো যেতে পারে। কীভাবে? ক্ষতস্থানে অল্প পরিমাণে হলুদ বেঁটে লাগিয়ে দিলেও কিন্তু সমান উপকার পাওয়া যায়।
৩. দেহের অন্দরে ইনফ্লেমেশনের মাত্রা কমবে: দেহের অন্দরে প্রদাহের মাত্রা বাড়তে শুরু করলে শরীরে প্রতিটি অঙ্গের কর্মক্ষমতা কমতে শুরু করে। সেই সঙ্গে মাথা চাড়া দিয়ে ওঠে নানান রোগ। তাই তো এমনটা যাতে কোনও সময় না হয়, সেদিকে খেয়াল রাখা একান্ত প্রয়োজন। আর এই কারণেই নিয়মিত হলুদ খাওয়া উচিত। কারণ এই প্রাকৃতিক উপাদানটির অন্দরে মজুত রয়েছে প্রচুর মাত্রায় অ্যান্টি-ইনফ্লেমেটরি উপাদান, যা প্রদাহ কমাতে বিশেষ ভূমিকা পালন করে থাকে।
৪. মাথা যন্ত্রণা মতো সমস্যা ধারে কাছেও ঘেঁষতে পারবে না: এবার থেকে মাথা যন্ত্রণা হলেই এক কাপ হলুদ মেশানো দুধ খেয়ে নেবেন। দেখবেন কষ্ট কমতে একেবারে সময়ই লাগবে না। কারণ হলুদের অন্দরে থাকা কার্কিউমিন এবং অ্যান্টি ইনফ্লেমেটারি উপাদান শরীরের অন্দরে প্রদাহ কমায়। ফলে মাথা যন্ত্রণা কমতে সময় লাগে না। প্রসঙ্গত, শুধু মাথা যন্ত্রণা নয়, যে কোনও ধরনের ব্যথা কমাতেই এই পানীয়টি বিশেষ ভূমিকা পালন করে থাকে। আর যেমনটা আপনাদের সবারই জানা আছে যে শীতকালে চোট-আঘাত লাগার আশঙ্কা বাড়ে। তাই এই সময় হলুদ-দুধের সঙ্গে বন্ধুত্ব করা মাস্ট!
৫. রোগ প্রতিরোধ ব্যবস্থা আরও শক্তিশালী হয়ে উঠবে: ওয়েদার চেঞ্জের সময় আমাদের মধ্যে অনেকেই এত অসুস্থ হয়ে পরেন কেন জানেন? কারণ নানা কারণে আমাদের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা দুর্বল হয়ে পরে। তাই তো নানা রোগ ঘারে চেপে বসে। এই কারণেই তো এই সময় নিয়মিত এক গ্লাস দুধে কয়েক চামচ হলুদ খাওয়ার পরামর্শ দিয়ে থাকেন চিকিৎসকেরা। আসলে এই পানীয়টিতে উপস্থিত একাধিক উপকারি উপাদান, ইমিউনিটিকে মারাত্মক বাড়িয়ে দেয়। ফলে কোনও রোগই ধারে কাছে ঘেঁষতে পারে না।
৬. ওজন নিয়ন্ত্রণে চলে আসবে: বেশ কিছু গবেষণায় দেখা গেছে নিয়মিত হলুদ খাওয়া শুরু করলে শরীরে বিশেষ কিছু উপাদানের মাত্রা বাড়তে শুরু করে, যার প্রভাবে হজম ক্ষমতার উন্নতি ঘটে। আর একবার মেটাবলিজম রেট বেড়ে গেলে স্বাভাবিকভাবেই ওজন হ্রাসের প্রক্রিয়াও ত্বরান্বিত হয়। তবে এখানেই শেষ নয়, হলুদে কার্কিউমিন নামে একটি উপাদান থাকে, যা শরীরে উপস্থিত ফ্যাট সেলেদের গলানোর মধ্যে দিয়ে অতিরিক্ত ওজন কমিয়ে ফেলতে বিশেষ ভূমিকা পালন করে থাকে।
৭. শরীর থেকে টক্সিক উপাদানেরা সব বেরিয়ে যাবে: শরীরকে ডিটক্সিফাই করতে হলুদ বিশেষ ভূমিকা পালন করে থাকে। আসলে এই প্রকৃতিক উপাদানটির মধ্যে থাকা কার্কিউমিন, রক্তে উপস্থিত ক্ষতিকর টক্সিক উপাদানদের বের করে দেয়। ফলে ব্লাড ভেসেলের কোনও ধরনের ক্ষতি হওয়ার আশঙ্কা তো কমেই, সেই সঙ্গে নানাবিধ রোগভোগে আক্রান্ত হওয়ার সম্ভাবনাও হ্রাস পায়। এবার বুঝেছেন তো শীতকালে হলুদ খেতে কেন বলে থাকেন চিকিৎসকেরা।
৮. লিভারে ক্ষমতা বৃদ্ধি পাবে: লিভারকে চাঙ্গা এবং কর্মক্ষম রাখতে হলুদের কোনও বিকল্প হয় না বললেই চলে। কারণ এর মধ্যে থাকা কার্কিউমিন নামক উপাদানটি লিভারের কর্মক্ষমতা এতটা বাড়িয়ে দেয় যে কোনও ধরনের লিভারের রোগই ধারে কাছে আসতে পারে না। এমনকি ফ্য়াটি লিভারের মতো রোগে আক্রান্ত হওয়ার আশঙ্কাও কমে। শুধু তাই নয়, হলুদে উপস্থিত বেশ কিছু উপকারি উপাদান লিভারে জমে থাকা বর্জ্য পদার্থ বের করে দিতে বিশেষ ভূমিকা নেয়। ফলে লিভারের কোনও ধরনের ক্ষতি হওয়ার আশঙ্কা একেবারে কমে যায়।
৯. বারে বারে হাঁচি-কাশি এবং জ্বরের খপ্পরে পরার আশঙ্কা কমবে: হলুদে উপস্থিত অ্যান্টি-ভাইরাল এবং অ্যান্টি-ব্যাকটেরিয়াল প্রপাটিজ একদিকে যেমন নানাবিধ সংক্রমণে আক্রান্ত হওয়ার আশঙ্কা কমায়, তেমনি এর মধ্যে থাকা অ্যান্টি-ইনফ্লেমেটরি প্রপাটিজ রেসপিরেটারি ট্রাক্ট ইনফেকশন এবং সর্দি-কাশির প্রকোপ কমাতেও বিশেষ ভূমিকা পালন করে থাকে। এই কারণেই তো বছরের এই একটা সময় বাচ্চাদের নিয়মিত হলুদ খাওয়ার পরামর্শ দেওয়া হয়ে থাকে, বিশেষত রাতে ঘুমতে যাওয়ার আগে।
১০. পিরিয়োডের সময়কার নানা কষ্ট দূর হবে: মাসের এই বিশেষ সময়ে নানা ধরনের শারীরিক সমস্যা দেখা দেয়, যা কোনও কোনও সময় এতটাই কষ্টকর হয় যে সহ্যের বাইরে চলে যায়। এমন পরিস্থিতিতে যদি অল্প করে হলুদ খেয়ে নেওয়া যায়, তাহলে কিন্তু দারুন উপকার মেলে। কারণ এই প্রাকৃতিক উপাদানটিতে উপস্থিত অ্যান্টি-ইনফ্লেমেটরি উপাদান পিরিয়োড সংক্রান্ত কষ্ট কমাতে বিশেষ ভূমিকা পালন করে থাকে।
১১. ত্বকের সৌন্দর্য বাড়বে: নিয়মিত হলুদ মেশানো দুধ খেলে ত্বকের অন্দরে থাকা টক্সিক উপাদান বেরিয়ে যায়। সেই সঙ্গে কোলাজেনের উৎপাদন বেড়ে যায়। ফলে ত্বক এত মাত্রায় উজ্জ্বল এবং প্রাণচ্ছ্বল হয়ে ওঠে যে বলি রেখা কমতে শুরু করে। সেই সঙ্গে ব্রণ, অ্যাকনে এবং কালো ছোপের মতো সমস্যাও কমতে শুরু করে। এক কথায় শীতকালেও যদি ত্বকের সৌন্দর্য ধরে রাখতে চান, তাহলে আজ থেকেই হলুদ দুধ খাওয়া শুরু করুন। দেখবেন উপকার মিলবে। প্রসঙ্গত, বেশ কিছু গবেষণায় দেখা গেছে অ্যাকজিমার মতো ত্বকের রোগের চিকিৎসাতেও হলদি দুধ বিশেষ ভূমিকা পালন করে থাকে।
১২. হজম ক্ষমতার উন্নতি ঘটবে: একাধিক স্টাডিতে দেখা গেছে নিয়মিত হলুদ খাওয়া শুরু করলে হজমে সহায়ক পাচক রসের ক্ষরণ বেড়ে যায়। ফলে বদ-হজমের আশঙ্কা যেমন কমে। সেই সঙ্গে গ্যাস-অম্বল এবং অ্যাসিড রিফ্লাক্সের মতো সমস্যা কমাতেও বিশেষ ভূমিকা পালন করে থাকে। প্রসঙ্গত, গ্যাস্ট্রোইনটেস্টাইনাল ইনফেকশন কমাতেও এই পানীয় বিশেষ ভূমিকা পালন করে থাকে।
তথ্যসূত্র: বোল্ড স্কাই