শিশু হত্যাকারীদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি চাই

একদিকে শিশু নির্যাতন অন্যদিকে শিশু হত্যা। এ যেন একে অপরের পরিপূরক। তাই নিঃসন্দেহে একথা বলাই যায় শিশু শব্দটি এখন বড়ই মলিন। শিশু শব্দটির সঙ্গে মিশে আছে আদর, সোহাগ আর ভালোবাসা। একটু চিন্তা করলে, যখন শিশুর মুখে প্রথম বুলি ‘মা’ শব্দটি উচ্চারিত হয়, তখন সেই ‘মা’ই বলতে পারেন ‘মা’ হওয়ার কী আনন্দ। আর সন্তান যখন বাবার জন্য অধীর আগ্রহে পথ চেয়ে বসে থাকে, কখন বাবা আসবে ঘরে। বাবা ঘরে এলে সন্তান যখন গোমরা মুখে অভিমান করে বসে থাকে, তখন সেই বাবাই বলতে পারেন সন্তানের ভালোবাসা কাকে বলে? সন্তানের অভিমানের মধ্যে যে কতোটুকু ভালোবাসা লুক্কায়িত সেটি কেবল বাবা-মা-ই ভালো বলতে পারেন।

কিন্তু এখন এই শিশু বা সন্তান শব্দটির সঙ্গে নতুন করে যুক্ত হয়েছে হত্যা। যেখানে যুক্ত হওয়ার কথা শিশুর প্রতি ভালোবাসা সেখানে প্রতিনিয়ত যুক্ত হচ্ছে হত্যা। শিশু হত্যা যেন এখন একটি নৈমিত্তিক ঘটনা। পত্রিকার পাতা উল্টালে বা টিভির সুইস অন করলে প্রায়ই শিশু হত্যার সংবাদ চোখে পড়ে।

আমাদের দেশ সোনার বাংলাদেশ একটি স্বাধীন দেশ। কিন্তু যে দেশে দিনের পর দিন শিশু হত্যা করা হয় আর যখন সেই হত্যার কোনো বিচার হয় না। তখন সেই দেশ কিভাবে স্বাধীন দেশ হয়। সেটি আজ বড় জানতে ইচ্ছে করে? শিশুর প্রতি সহিংসতা, নির্যাতন কমছে না বরং শিশু হত্যা, ধর্ষণ এবং শ্লীলতাহানির মত ঘটনা ঘটেই চলেছে। সহিংসতার শিকার এই শিশুদের বড় একটি অংশই নিম্নবিত্ত পরিবারের।

যখন একটি শিশুর মায়ের কোলে খেলার কথা কিংবা মায়ের কোলে মাথা রেখে ঘুমানোর কথা তখন নিম্নবিত্ত পরিবারের শিশুদের পেটের টানে রাস্তায় নামতে হয়। খাবারের সন্ধানে রাস্তায় নামা কিংবা একটি কাজের সন্ধানে টইটই করে মানুষের দ্বারে ঘোরা এটি কি তাদের অপরাধ? কাজ করে দু’মুঠো ডাল-ভাত খাওয়া এটি কি তাদের অপরাধ? সামান্য রোজগারের অর্থ দিয়ে পরিবারকে সাহাষ্য করা এটি কি তাদের অপরাধ? দিনে কাজ আর রাত্রে বাসায় গিয়ে পড়ালেখা করা এটিও কি তাদের অপরাধ? তাদের বড়ই অপরাধ তারা দরিদ্র পরিবারে জন্ম গ্রহণ করেছে।

সিলেটের রাজন ও খুলনার রাকিবের পর এবার বরগুনায় শিশু রবিউল আউয়াল (১০) নির্মম নির্যাতনে প্রাণ হারালো। গত মঙ্গলবার রাতে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল এলাকায় সুটকেসের ভেতর এক শিশুর লাশ পাওয়া যায়। তার শরীরে ছ্যাঁকা ও জখমের চিহ্ন পাওয়া গেছে। কয়েকদিন আগে মাগুরায় ছাত্রলীগের এক সংঘর্ষে গর্ভবতী মায়ের পেটে গুলি করে গুলিবিদ্ধ করা হয়েছে এক শিশুকে। শিশুটির পিঠ দিয়ে গুলি ঢুকে বুক দিয়ে বেরিয়ে চোখে আঘাত করে বুলেট। তবুও বিধাতার অশেষ রহমতে বেঁচে আছে শিশুটি। শিশুটির নাম রাখা হয়েছে সুরাইয়া। জন্মের আগেই গুলিবিদ্ধ হওয়া শিশুটির নাম গণমাধ্যমে আসে বুলেট কণ্যা হিসেবে। কিন্তু যে দেশে জন্মের আগেই মায়ের গর্ভে গুলিবিদ্ধ হতে হয় সে দেশে বাঁচার কী দরকার ছিল ওর?

এদিকে শিশু হত্যা নিয়ে যখন গোটা দেশ উত্তাল তখন খোদ আওয়ামী লীগ অফিসে আবারো শিশু নির্যাতনের ঘটনা ঘটেছে। চুরির অভিযোগে লালমনিরহাটের হাতীবান্ধার সানিয়াজান বাজারে শিশু আব্দুল জব্বারকে (১১) নির্মমভাবে পিটিয়ে জখম করার অভিযোগ পাওয়া গেছে। নির্যাতনের শিকার জব্বার এখন রংপুর মেডিকেলে মৃত্যুর সঙ্গে পাঞ্জা লড়ছে। বাবা-মায়ের ভাষ্য জব্বার বাঁচবে কি না কে জানে?

নির্মম নির্যাতনে নিহত হওয়া রাজন, রাকিব ও রবিউলের মধ্যে দারুণ একটা মিল রয়েছে। এই তিন জনের নামের শুরু যেমন ‘র’ দিয়ে। অন্যদিকে লেখাপড়াও করত একই শ্রেণিতে। তিন জনই চতুর্থ শ্রেণিতে লেখাপড়া করত। আবার এই তিন জনের বয়সও প্রায় সমান, রাজনের ১৩, রাকিবের ১২ আর রবিউলের (১০)। তিনজনই গরীব পরিবারের- এক কথায় কথ্য ভাষায় বলতে গেলে এরা সবাই ‘ফকিন্নির পুত’। আর ‘ফকিন্নির পুত’ হিসেবে এই ভূবনে জন্ম না নিলে হয়ত এভাবে নির্মম নির্যাতনে অকালেই না ফেরার দেশে এদের পাড়ি দিতে হতো না।

রাজন হত্যার কথা আমরা সবাই জানি এবং সোশ্যাল মিডিয়ায় রাজন হত্যার ভিডিও দেখেছি। চুরির অপবাদে রাজনকে খুঁটির সঙ্গে বেঁধে নির্যাতন করা হয়েছিলো। ২৮ মিনিটের ভিডিওটিতে কতোই না বাঁচার জন্য আকুতি করেছিলো রাজন। মামা আমারে ছেড়ে দেন। আমারে পুলিশে দেন। মামা আর মারলে আমি মইরা যামু। বাঁচার জন্য কতোই না আকুতি কিন্তু মন গলেনি নরপশুদের।

গত সোমবার বিকেলে নতুন কর্মস্থলের হয়ে রাকিব রঙ কিনতে বের হয় সাইকেল নিয়ে। পুরাতন কর্মস্থল শরিফ মোটর্সের সামনে দিয়ে যাওয়ার সময় শরিফ তার সাইকেল টেনে ধরে আটকে রাখে। পরে রাকিবকে দোকানের ভেতর নিয়ে হাওয়া দেওয়ার কমপ্রেসার পাইপ মলদ্বারে ঢুকিয়ে হাওয়া ছেড়ে দেয়। কি রোমমহর্ষক অত্যাচার। ডাক্তারদের ভাষ্য, রাকিবের শরীরে অস্বাভাবিক পরিমাণ বাতাস প্রবেশ করানোয় তার পেটের নাড়ি-ভুঁড়ি ছিড়ে যায়, ফুসফুসও ফেটে যায়। শরীরের বিভিন্ন অঙ্গ-প্রতঙ্গ অকেজো হয়ে যায়। একটু ভাবুন? কি নির্মম অত্যাচারই না করা হয়েছে ছেলেটির ওপর। একটু বাঁচার জন্য কতোই না আকুতি করেছিলো রাকিব। মামা আর দিয়েন না। আমি মরে যাবো। আর মৃত্যুর আগে রাকিব তার মাকে বলেছিলো, মা আমারে বাঁচাও। মামা আমারে অনেক নির্যাতন করছে। পেটের ভেতরে বাতাস ঢুকায়ছে। আমি বাঁচব না মা। সন্তান হারানোর যন্ত্রনা কী সেটা হয়ত রাকিবের বাবা-মা’ই ভালো বুঝতে পারছেন। আমরা কি সন্তান হারানোর যন্ত্রনা বুঝি? রাকিবের মায়ের এই যে আর্তনাদ, আমার বাচ্চাডারে… আরে আল্লারে, পাছার মধ্যি নল ঢুকোইয়ে দেছে, গ্যাস দিয়ে দেছে। আহারে, কয় আমারে একটু বাঁচাও। আরে আর্তনাদ করিছে আমার বাচ্চাডা। রক্ত…রক্ত ভাইসে গেছে রে…’। কে দিবে এই আর্তনাদের জবাব? কে দিবে সন্তানহারা এই মায়ের বুকে রাকিবকে ফিরিয়ে?

রাজনের হত্যাকারীদের মতো রাকিবের হত্যাকারীরাও শিশুর উপর নির্যাতন চালিয়ে এক পৈশাচিক আনন্দ পেয়েছে। যে আনন্দ হয়ত তারা আগে কখনো পায়নি। ভাবলে আমার মাথা নুয়ে পড়ে। কতো বড় পাষণ্ড আর নরপিশাচ হলে তারা শিশুদের উপর নির্মম অত্যাচার করে হত্যা করতে পারে।

অপরাধীরা তখনই পার পেয়ে যায় যখন অপরাধ করেও তাদের কোনো বিচার হয় না। তখন জন্ম নেয় আরো দশ অপরাধীর, তাদের সাহস বেড়ে যায়। আর সাহস তো বাড়ারই কথা, অপরাধ করছি কিন্তু বিচার নেই তাহলে কেনো অপরাধ করব না? তখন তাদের মনে হয়, গরীব মারলে কিসের বিচার? গরীবেরা কোনো মানুষ নয়, তারা হলো পশু। পশুকে যেমন যখন ইচ্ছা মেরে ফেলা যায়। গরীবও ঠিক তেমনই। পশু যেমন নিরুপায় গরীবও তো অসহায়। তাহলে বিচার হবে কোথায়?

শুনেছি দেশে শিশু আইন আছে, শিশু অধিকার সনদ আছে। শিশুকে শারীরিক তো নয়ই, মানসিকভাবেও নির্যাতন করা নিষিদ্ধ। শিশুশ্রমের বিপরীতে কঠোর শাস্তির বিধানও আছে। তবে এসবের প্রয়োগ কোথায়? কাগজে কলমে আর মুখে মুখে? বাস্তবে এই আইনের কোনো প্রয়োগই দেখা মেলে না। তা না হলে মাসে মাসে রাজন, রাকিব ও রবিউলরা কেন প্রাণ হারায়? ভূমিষ্ঠ হওয়ার আগেই কেন গুলি খেতে হয় শিশুকে?

দেশে কত সন্ত্রসীকে ক্রসফায়ার করা হয়, এনকাউন্টারে হত্যা করা হয়। আমি অন্তত একটিবার ‘বিচার ছাড়া বিচারে’ সমর্থন দিতে চাই। চাই আমি ক্রসফায়ার, চাই আমি এনকাউন্টার। কে কি বললো সেটি আজ আমার দেখার বিষয় নয়, আমি চাই প্রকাশ্যে শিশু হত্যাকারীদের বিচার হোক। আমি চাই রাজন, রাকিব ও রবিউলের হত্যাকারীদের মৃত্যু। তাদের লাশ রাস্তায় গলে পচে শকুনের খাবার হোক আর শকুন তাদের মরদেহ ফুর্তি করে খাক এটাই আমার চাওয়া।

Print Friendly, PDF & Email

     এ ক্যাটাগরীর আরো খবর