পুরান ঢাকার ত্রাস হাজী সেলিমের দুই পুত্রের ঔদ্ধত্যপূর্ণ আচরণ ও দুঃসাহস দেখে রীতিমতো বিস্মিত ও হতবাক সাধারণ মানুষ। হাতকড়া পরিহিত অবস্থায় আদালত প্রাঙ্গণে তার বড় ছেলে সোলায়মানের ‘জয় বাংলা’ সেøøাগান এবং এর আগে গ্রেফতারকালে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যদেরকে মেঝ ছেলে ইরফানের হুমকির বিষয়টি ভাবিয়ে তুলছে সবাইকে। আ.লীগ সরকারের পতনের পর গ্রেফতার হয়েছেন হাজী সেলিম। এরপর হত্যা মামলায় গত বুধবার রাতে গ্রেফতার হন তার বড় ছেলে সোলায়মান। কিন্তু এখনো অক্ষত রয়েছে হাজী সেলিমের অবৈধ সাম্রাজ্য-সন্ত্রাসী কার্যক্রম। হাজী সেলিমের তিন পুত্রের মধ্যে দুই পুত্রের সন্ত্রাসী কার্যক্রমের পাশাপাশি আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সাথে ঔদ্ধত্যপূর্ণ আচরণে এবং আদালত প্রাঙ্গণে সোলায়মানের ‘জয় বাংলা’ সেøøাগান এবং শেখ হাসিনা ফিরে আসবেন এমন হুঙ্কারে পুরান ঢাকার মানুষের মধ্যে যেন আরো আতঙ্ক ভর করছে। এখনো ভয়ে মুখ খুলতে পারছেন না কেউ। বিশেষ করে হাজী সেলিমের দুই পুত্রের মধ্যে ভয়ঙ্কর সন্ত্রাসী ইরফান এখনো রয়েছে ধরাছোঁয়ার বাইরে। ছোট ছেলে আগে থেকেই অবস্থান করছেন অস্ট্রেলিয়ার মাটিতে। স্থানীয়রা জানিয়েছেন, হাজী সেলিমের চেয়েও তার পুত্ররা আরো বেশি ভয়ঙ্কর। পাষণ্ড খুনি। হাজী সেলিম অসুস্থ হওয়া এবং কার্যত চলাফেরায় অক্ষম হলে তার অবৈধ উপায়ে গড়ে তোলা বিশাল সাম্রাজ্য নিজেদের অনুকূলে রাখতে তার পুত্ররা হেন কাজ নেই যা করেন না।
২০২০ সালের ২৫ অক্টোবর। সেদিন সন্ধ্যায় নীলক্ষেত থেকে বই কিনে স্ত্রীসহ নিজের মোটরসাইকেলে যাচ্ছিলেন নৌবাহিনীর এক কর্মকর্তা। ধানমন্ডি এলাকায় সংসদ সদস্য লোগো-সম্বলিত একটি গাড়ির পেছনে তার মোটরসাইকেলের ঘষা লাগে। সঙ্গে সঙ্গে গাড়ি থেকে বের হয়ে আসেন কয়েকজন। এদের মধ্যে একজন হাজী সেলিমপুত্র ইরফান। তারা ওই কর্মকর্তাকে মারতে থাকেন। তিনি নিজের পরিচয় দেয়ার পরও ইরফান ও তার সহযোগীরা ওই কর্মকর্তাকে বলেন, ‘তোর নৌবাহিনী-সেনাবাহিনী বের করতেছি, তোর লেফটেন্যান্ট-ক্যাপ্টেন বের করতেছি। তোকে এখনই মেরে ফেলব।’ এরপর বের হয়ে ওই কর্মকর্তাকে মারধরসহ তার তার স্ত্রীকে অশ্লীল ভাষায় গালিগালাজ করেন। এ ঘটনায় মামলা হলে ইরফানকে ধরতে র্যাবের টিম মাঠে নামে।
পরদিন ইরফানের অবস্থান নিশ্চিত হয়ে র্যাব-১০ এর একটি টিম অভিযান চালায় পুরান ঢাকার ২৬ নম্বরের ‘চাঁন সর্দার দাদাবাড়ি’ ভবনে। সেখানে অভিযান চালাতে গিয়ে র্যাব রীতিমতো হতবাক হয়ে পড়ে। বাড়িটি যেন বিশেষ কোনো বাহিনীর সদর দফতর! যেখানে ছিল আলাদা ওয়্যারলেস নেটওয়ার্ক; ছিল বিশেষায়িত ড্রোন থেকে পর্যবেক্ষণের ব্যবস্থা। ছিল অস্ত্রাগার, শত শত ওয়াকিটকি আর টর্চারসেল এবং আয়নাঘর-সদৃশ গোপন কুঠুরি। ছিল মদের বারসহ নানা বিলাসী আয়োজন। এ সময় একটি কক্ষ থেকে বের হয়ে ইরফান র্যাবের নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট ও কর্মকর্তাদের দেখে বলতে থাকেনÑ হু আর ইউ? অ্যাম আই এ ক্রিমিনাল? উইল ইউ অ্যারেস্ট মি?
র্যাব জানায়, ওই বাড়িটিতে হাজী সেলিমের দুই পুত্র অবস্থান করেন। তারা ওয়াকিটকি দিয়ে পুরো এলাকা নজরদারি করেন। একটি ওয়ারলেস নেটওয়ার্ক স্টেশন দিয়ে সন্ত্রাসী কার্যক্রম চালাতেন। সেখান থেকে উদ্ধার করা উচ্চ ক্ষমতাসম্পন্ন ওয়াকিটকি যেগুলো সাধারণত আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরা ব্যবহার করেন। এছাড়া ড্রোন দিয়ে পুরো পুরান ঢাকা পর্যবেক্ষণ করে তারা সন্ত্রাসী কার্যক্রমের পাশাপাশি চাঁদা আদায় করতেন।
ওই ঘটনার পর কিছুদিন বাড়িটি ঘিরে সন্ত্রাসী কার্যক্রম বন্ধ ছিল। পরে ইরফান সেলিম জামিনে মুক্তি পান। অপরদিকে ইরফানের বড় ভাই সোলায়মান গত জাতীয় সংসদের বিনা ভোটে এমপি হন। এরপর ওই বাড়ি থেকে আগের মতোই সন্ত্রাসী কার্যক্রম চলতে থাকে। ৫ আগস্ট ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানের পর গ্রেফতার হন হাজী সেলিম। এরপর সেই বাড়ি থেকে অনেক কিছুই সরিয়ে নেয়া হয় বলে দাবি সংশ্লিষ্টদের।
পুলিশ জানায়, সোলায়মান সেলিমের বিরুদ্ধেও বাবা হাজী সেলিমের মতোই অবৈধ দখল, চাঁদাবাজির সাম্রাজ্য রক্ষা, বিভিন্ন ব্যক্তিকে ভয়ভীতি দেখানোর অভিযোগ রয়েছে। পুরান ঢাকার বাসিন্দাদের অভিযোগ, হাজী সেলিমের হয়ে বাদামতলী, চকবাজার, ইসলামপুর, চকমোগলটুলী, বুড়িগঙ্গার বিভিন্ন ঘাটে চাঁদাবাজদের আলাদা গ্রুপ রয়েছে সোলায়মানের। ৫ আগস্ট-পরবর্তী সময়ে হাজী সেলিম ও তার লোকজন আত্মগোপনে চলে যান। এখন মোশাররফ হোসেন ওরফে কালু হাজী সোলায়মানের হয়ে পুরান ঢাকায় তাদের নিয়ন্ত্রিত এলাকায় চাঁদাবাজির নিয়ন্ত্রণ নেন।
বহুল আলোচিত হাজী সেলিমকে নিয়ে প্রচলিত রয়েছে অনেক গল্প। এক সময়ে পুরান ঢাকার কুলি সর্দার হাজী সেলিম ১৯৯৪ সালে বিএনপির সমর্থনে ঢাকা সিটি করপোরেশনের ৬৫ ও ৬৬ নম্বর ওয়ার্ডে কমিশনার (কাউন্সিলর) নির্বাচিত হন। ১৯৯৬ সালের জাতীয় সংসদ নির্বাচনে বিএনপির টিকিট না পেয়ে যোগ দেন আওয়ামী লীগে। আ.লীগের হয়ে লালবাগ, হাজারীবাগ ও কামরাঙ্গীরচর থানা নিয়ে গঠিত আসন থেকে এমপি নির্বাচিত হন তিনি। ক্ষমতার বসে সম্পদের পাহাড় গড়েন তিনি। ১৯৯৬-পরবর্তী সময়ে হাজী সেলিম নিজ এলাকার পঞ্চায়েত চালু করেন। জমি বা বাড়ি-সংক্রান্ত বিরোধ নিয়ে তার কাছে গেলে সেগুলো নামমাত্র মূল্যে কিনে দখল করে নিতেন। ক্যাডার বাহিনী দিয়ে জোরপূর্বক উচ্ছেদ করে তিনি বিভিন্ন ব্যক্তির ঘরে বা ব্যবসা-প্রতিষ্ঠানে তালা ঝুলিয়ে দিতেন। ওই কারণে তিনি ‘তালা হাজী’ নামেও পরিচিতি পান। চাঁদনীঘাটে ওয়াসার পানির পাম্পের জমি দখল করে সেখানে পেট্রোল পাম্প বসান সেলিম। সোয়ারিঘাটে নদীতীর দখল করে স্থাপন করেন চাঁদ সরদার কোল্ড স্টোরেজ। নবাববাড়ি এলাকায় জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রাবাস দখল করে সেখানে গুলশান আরা প্লাজা নামে বিশাল ভবন নির্মাণ করেন। আরমানিটোলা এলাকায় এক নারীর সম্পত্তি দখল করে তৈরি করেন এমটিসি টাওয়ার। নলগোলায় ভাওয়াল এস্টেটের জমি দখল করে নির্মাণ করেন ভবন। চকবাজারের ফ্রেন্ডশিপ মার্কেট ও জেলখানার পাশে ব্যবসায়ীদের উচ্ছেদ করে সেখানে মদিনা আশিক টাওয়ার এবং হাজী সেলিম টাওয়ার নামে দুটি বহুতল শপিংমল তৈরি করেন। দখলের সময় ক্ষতিগ্রস্ত ব্যবসায়ীদের নতুন দোকান দেয়ার প্রতিশ্রুতি দিলেও কাউকেই তিনি দোকান দেননি। জানা যায়, দোকান না পেয়ে ক্ষতিগ্রস্ত দুই ব্যবসায়ী আত্মহত্যা করেছিলেন।
এভাবেই হাজী সেলিম রাজধানীর পুরান ঢাকার বাদামতলী, নবাববাড়ি, আরমানিটোলা, মিটফোর্ড রোড, নবাবপুর রোড, ইমামগঞ্জ, ইসলামপুর, লালবাগ, কামরাঙ্গীরচর, হাজারীবাগ, ধানমন্ডি, গুলশান, নারায়ণগঞ্জের পাগলা, ফতুল্লা এলাকায় বিপুল স্থাবর সম্পত্তির মালিক হন।
১৯৯৯ সালের মধ্যেই হাজী সেলিমের মদিনা গ্রুপের বার্ষিক টার্নওভার ৬০০ কোটি টাকার বেশি হয়। এরপর তা আরো বাড়তে থাকে।
২০০৮ সালের এপ্রিলে ২৭ কোটি টাকার জ্ঞাত আয়বহির্ভূত সম্পদ অর্জনের জন্য ১৩ বছরের জেল হয় সেলিমের। আর সেই সম্পদ নিজের কাছে রাখার জন্য তিন বছরের সাজা হয় তার স্ত্রী গুলশান আরার।
পুরান ঢাকার এক ব্যবসায়ী বলেন, যেখানেই চোখ পড়ত হাজী সেলিমের, সেটিই দখল করে নিতেন তিনি। তার হাত থেকে রেহাই পায়নি প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শন কিংবা কারাগারের জমিও। দখল করেন নবাব এস্টেটের বহু সম্পত্তি। হাইকোর্টের নিষেধাজ্ঞার তোয়াক্কা না করে ঢাকার প্রথম বাণিজ্যিক বিল্ডিং হিসেবে পরিচিত চকবাজারের ‘জাহাজবাড়ি’ ভবন গুঁড়িয়ে দেন হাজী সেলিম। রাজনৈতিক ক্ষমতা ও পেশিশক্তিকে কাজে লাগিয়ে নিজের সম্পদ বাড়িয়েছেন হাজারগুণ। রাজধানী ছাড়াও দেশের বিভিন্ন জেলায় নামে-বেনামে হাজী সেলিম ও তার পরিবারের সদস্যদের নামে বহু বাড়ি ও ফ্ল্যাট এবং বেনামি সম্পদ রয়েছে। এ ছাড়া পটুয়াখালীতে পায়রা বন্দর-সংলগ্ন এলাকায় প্রচুর সম্পত্তি কিনেছেন তিনি। সরকারি দলের দাপট দেখিয়ে লালবাগ এলাকায় যা খুশি তা-ই করেছেন হাজী সেলিম। নলগোলাতে প্রায় ১০ কাঠা খাস জমির ওপর বিহারিরা ঘরবাড়ি বানিয়ে বসবাস করত। হাজী সেলিম বিহারিদের উচ্ছেদ করে সেখানে বানিয়েছেন ‘হাজী সেলিম টাওয়ার’। ইমামগঞ্জে নিরীহ কয়েকজনের জমি দখল করে হাজী সেলিম ছেলের নামে তৈরি করছেন ‘ইরফান টাওয়ার’। জমির মালিকদের সঙ্গে মামলাজনিত কারণে এর আগে কয়েকবার আইনশৃঙ্খলা বাহিনী গিয়ে সেটার কাজ বন্ধ করে দেয়। কিছুদিন পর আবারো কাজ শুরু করেন। এভাবে সেখানে ১০ তলা পর্যন্ত অবকাঠামো তুলে ফেলেছেন। এভাবে চকবাজার এলাকায় কয়েকজন নিরীহ মানুষের প্রায় দেড় বিঘা জমি দখল করে বানিয়েছেন ‘আশিক টাওয়ার’। লালবাগের কামালবাগের চাঁদনীঘাট এলাকায় বধির স্কুল স্থাপনের জন্য প্রায় দুই বিঘা জায়গা বরাদ্দ দেয় সরকার। কিন্তু সেখানে আর বধির স্কুল তৈরি হয়নি। হাজী সেলিম সেই জায়গা দখল করে বানিয়েছেন ‘মদিনা ফিলিং স্টেশন’।
এসব অবৈধ সম্পদ করতে গিয়ে তার সহযোগী ছিলেন তার দুই ছেলে আওয়ামী লীগের সাবেক এমপি সোলায়মান সেলিম ও ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের (ডিএসসিসি) সাবেক কাউন্সিলর ইরফান সেলিম। নানা অপকর্মের কারণে একাধিকবার আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর হাতে আটকও হয়েছেন বাবা-ছেলে। তবে আইনের ফাঁকফোকর গলে আবার বেরিয়েও পড়েন। তবে এ পরিবারের রাজত্ব বহাল আছে লালবাগ এলাকায়। ভয়ে এলাকাবাসী এখনো সেলিম পরিবারের বিরুদ্ধে মুখ খুলতে সাহস পান না।
গত বুধবার গভীর রাতে রাজধানীর গুলশানের একটি বাসা থেকে সোলায়মান সেলিমকে গ্রেফতার করে পুলিশ। বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন চলাকালে চকবাজারের একটি প্লাস্টিক কারখানার শ্রমিক মো. রাকিব হাওলাদার হত্যা মামলায় তাকে গত বৃহস্পতিবার ঢাকার চিফ মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট (সিএমএম) আদালতে তোলার সময় গেটের সামনে জয়বাংলা স্লেøাগান দেন সোলায়মান। এ সময় তিনি বলেন, শেখ হাসিনা আবার আসবেন।
স্থানীয়রা জানান, হাজী সেলিমের পুত্ররা এখনো জেলখানা কিংবা পলাতক থাকলেও তাদের সহযোগী আওয়ামী দোসররা এখনো সক্রিয় রয়েছে। এদের গ্রেফতার করা না গেলে পুরান ঢাকার মানুষ হাজী সেলিমের পুত্রদের সিন্ডিকেড থেকে কখনোই মুক্ত পাবে না।