ঢাকা ১০:২০ অপরাহ্ন, রবিবার, ০১ ডিসেম্বর ২০২৪, ১৭ অগ্রহায়ণ ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

তিন বছরেই ২৪ কোটি টাকা দুর্নীতি, দেনার ঘানি টানছে বিআরটিসি

  • Reporter Name
  • আপডেট টাইম : ১১:১১:৪১ পূর্বাহ্ন, শনিবার, ৩০ নভেম্বর ২০২৪
  • ২ বার

রাষ্ট্রীয় সংস্থা বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন করপোরেশন (বিআরটিসি) ২০১৩ সালে ৫০টি ‘আর্টিকুলেটেড’ বাস কিনেছিল। বলা হয়েছিল, ভারতীয় ঋণের আওতায় কেনা এ বাসগুলো ঢাকার গণপরিবহনে নতুন মাত্রা যোগ করবে। কিন্তু মাত্র সাত বছরের মধ্যেই ৪৩টি বাস অকেজো হয়ে পড়ে, যা অনেককে মনে করিয়ে দিতে পারে আড়াই দশক আগে সুইডেন থেকে কেনা বিশ্বখ্যাত ভলভো বাসের অভিজ্ঞতার কথা।

রাষ্ট্রীয় সম্পদের প্রতি অযত্ন-অবহেলা সরকারি এ প্রতিষ্ঠানে জেঁকে থাকা গাফিলতি, অনিয়ম ও দুর্নীতির একটি দিক মাত্র। গত কয়েক বছর আগের অনিয়ম-দুর্নীতির জের বিআরটিসি এখনো টেনে চলেছে। এতে ব্যাহত হচ্ছে তার মূল লক্ষ্য—যাত্রীসেবা।

আর্টিকুলেটেডে ভলভোর ছায়া

প্রচলিত বাসের প্রায় দ্বিগুণ দৈর্ঘ্যের ‘আর্টিকুলেটেড’ বাসের কাঠামোর জন্য বিদেশে জনসাধারণের কাছে বেন্ডি, স্ট্রেচ, স্লিংকি ইত্যাদি নামে পরিচিত।

বৈধ দৈর্ঘ্যের মধ্যে থেকে এই বাসে তুলনামূলকভাবে বেশি যাত্রী পরিবহন করা সম্ভব হওয়ায় এটি জনপ্রিয়তা পেয়েছে। তুলনামূলক সরু রাস্তায় চালানো কিছুটা সমস্যা হওয়ায় অবশ্য বিশ্বের অনেক শহর থেকে দুটি অংশ জুড়ে তৈরি করা এ বাস তুলে দেওয়া হয়েছে।

২০১৩ সালে কেনা ৫০টি আর্টিকুলেটেড বাসের মধ্যে বিআরটিসি ২০২২ সালে ২৭টি আবার চালু করে। বাকি বাসগুলো এখনো ডিপোতে পড়ে রয়েছে। এসব নিয়ে গত ১৫ বছরে সংস্থাটির বহরে যুক্ত হয়েছে মোট ১ হাজার ৫৫৮টি বাস। এর মধ্যে কাগজে-কলমেই চালু আছে ১ হাজার ২৪৪টি। আর চারটি প্রকল্পে এসব বাস কেনায় খরচ হয়েছে প্রায় ১৩০০ কোটি টাকা। এ সময়ে অনেক বাস নষ্ট হয়ে গেছে। দীর্ঘদিন পড়ে থাকায় কিছু ‘ভাঙারি’ হিসেবে কেজি দরে বিক্রি করা হয়েছে। যথাযথ রক্ষণাবেক্ষণের অভাবে বা সময়মতো মেরামত না করায় গাড়ি অচল পড়ে থাকায় যাত্রীসেবা ব্যাহত হওয়ার পাশাপাশি বিআরটিসির আয়ে প্রভাব পড়েছে। দায়দেনা শোধে অসুবিধা ও কর্মীদের বেতন অনিয়মিত হয়ে পড়াসহ বিভিন্ন সমস্যায় জর্জরিত সংস্থাটি।

বিআরটিসিসংশ্লিষ্ট সূত্র বলছে, এখন আরও ৮টি আর্টিকুলেটেড বাস সচল করার উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। এসব বাসের দুটি অংশের মাঝখানে থাকা রাবারের সংযোগটি জার্মানিতে তৈরি।

চাহিদা নিতান্ত সীমিত বলে এগুলো স্থানীয় বাজারে সাধারণত পাওয়া যায় না। প্রতিটি বাসের নতুন সংযোগের মূল্য ৩৩ লাখ টাকার বেশি। তবে দেশি প্রযুক্তিতে মাত্র ৪০ হাজার টাকায় পুরোনোগুলো মেরামত করা হচ্ছে।

বিআরটিসি অনেক ঘটা করে ২০০১-০২ সালে সুইডেনের বিশ্বখ্যাত ভলভো কোম্পানির ৫০টি আধুনিক দোতলা বাস ঢাকার রাস্তায় নামিয়েছিল। অত্যাধুনিক বাসগুলোয় যাত্রা বেশ আরামদায়ক হওয়ায় তা প্রশংসিত হয়েছিল। তবে ইজারা ব্যবস্থাপনার ত্রুটি এবং রক্ষণাবেক্ষণের অভাবে মাত্র পাঁচ বছরের মধ্যেই বাসগুলো একে একে অকেজো হয়ে পড়ে।

দামি বা বিশেষ কোম্পানির গাড়ি ছাড়াও সাধারণভাবেই রাষ্ট্রীয় এ কোম্পানির গাড়ি রক্ষণাবেক্ষণ ও সংস্কারে অবহেলার অভিযোগ পুরোনো। সংস্থার সূত্রে জানা গেছে, সাম্প্রতিক কয়েক বছরে চট্টগ্রাম, নারায়ণগঞ্জ, মতিঝিল, কল্যাণপুর, মিরপুর, জোয়ারসাহারা, গাজীপুরসহ বিভিন্ন ডিপোতে ১৩৯টি বাস অকেজো হয়ে বিভিন্ন মেয়াদে পড়ে ছিল। এ বাসগুলোর অনেক যন্ত্রাংশ মেরামতযোগ্য হলেও পড়ে থেকে বাইরের অংশ নষ্ট হয়ে যায়। ফলে সরকারি সম্পদের অপচয় হয়েছে।

তিন অর্থবছরের অনিয়ম ভোগাচ্ছে

পরিবহন নিরীক্ষা অধিদপ্তরের প্রতিবেদন অনুযায়ী, রাজধানীর তেজগাঁওসহ বিআরটিসির বিভিন্ন বাস ডিপোর ব্যবস্থাপক ও কর্মকর্তারা ২০১৭-১৮ থেকে ২০১৯-২০ সাল পর্যন্ত তিন অর্থবছরে ৪ কোটি ৮৭ লাখ টাকা আত্মসাৎ করেছেন। চালক, কন্ডাক্টর ও লিজগ্রহণকারী বাইরের ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠান থেকে প্রাপ্ত রাজস্ব যথাযথভাবে ব্যাংকে জমা না করায় এই আর্থিক ক্ষতি হয়েছে। নিরীক্ষা প্রতিবেদন বলছে, কেবল ওই তিন অর্থবছরে বিআরটিসির মোট দুর্নীতির অঙ্ক ২৪ কোটি ৬২ লাখ টাকার বেশি। মামলা-মোকদ্দমার কারণে প্রাপ্য আদায়েও বিআরটিসি সমস্যায় পড়ছে।

প্রতিবেদনে দেখা যায়, ‍কল্যাণপুর বাস ডিপোর ৩৭টি দোকানের বরাদ্দে অনিয়মের অভিযোগ রয়েছে। ব্যবসার ধরন পরিবর্তনের ফি না জমা হয়নি। ফুলবাড়িয়া সিবিএস-২ মার্কেটের বকেয়া ভাড়া আদায়ে জটিলতা রয়েছে। এসব ব্যর্থতার পেছনে বিআরটিসির প্রধান কার্যালয়ের এস্টেট বিভাগের কর্মকর্তাদের ভূমিকা নিয়ে অভিযোগ উঠেছে। মতিঝিল, কল্যাণপুর, জোয়ারসাহারা, বরিশাল, খুলনা, বগুড়া বাস ডিপো ও প্রধান কার্যালয় ইজারা বাবদ ৬ কোটি টাকার বেশি রাজস্ব আদায় করতে ব্যর্থ হয়েছে বিআরটিসি। আন্তর্জাতিক রুটে শ্যামলী পরিবহন, রয়েল কোচ ও এন আর ট্রাভেলস তিন বছরে ২৪ লাখ ৬১ হাজার টাকার রয়্যালটি ফি বকেয়া রেখেছে, যা করোনার কারণ দেখিয়ে পরিশোধ করা হয়নি।

সংস্থাটির সূত্র বলছে, সাবেক চেয়ারম্যান ফরিদ আহমেদ ভুঁইয়া ও মো. এহসান এলাহীর সময়ের এসব দুর্নীতির দায় এখনো টানতে হচ্ছে বিআরটিসিকে। বর্তমান চেয়ারম্যানের ঠিক আগে পর্যায়ক্রমে দায়িত্ব পালন করা এই দুজনের সময়ে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের কাছে বিআরটিসির দেনা দাঁড়িয়েছিল ১০১ কোটি টাকা। গত চার বছরে তা থেকে ৯২ কোটি টাকা পরিশোধ করা হয়েছে।

দেনা মেটাতে বাসভাড়া

রাজধানীর অনেক সাধারণ বাসযাত্রীর অভিযোগ, ঢাকার পথে এই সরকারি সংস্থার গাড়ি খুব বেশি রুটে দেখা যায় না। আবার হুটহাট রুট পরিবর্তনেরও নজির আছে। বিআরটিসির সূত্র বলছে, দেনা শোধের চাপের কারণে যাত্রীসেবায় কিছুটা কম গুরুত্ব দিয়ে বিভিন্ন সরকারি প্রতিষ্ঠানে বাসভাড়া দেওয়া হচ্ছে। রাজধানীর পথে এখন তাদের ৫৫০টি গাড়ি যাত্রী পরিবহন করে। তবে এসব গাড়ি থেকে বেশি আয় হয় না। ১৭২টি গাড়ি সরকারি বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে ভাড়া দেওয়া হয়েছে।

বিআরটিসির চেয়ারম্যান মো. তাজুল ইসলাম গত সোমবার আজকের পত্রিকার সঙ্গে আলাপকালে ১৭২টি বাসভাড়া দেওয়ার বিষয়টি সত্যি বলে নিশ্চিত করেন। কারণ হিসেবে তিনি বলেন, বিগত কয়েক বছরে যে পরিমাণ দেনা হয়েছে, তা শোধ করতে অর্থ দরকার। সরকারি প্রতিষ্ঠানে বাসভাড়া দিয়ে ভালো আয় হচ্ছে। গত মাসে ১২ কোটি টাকা বেতন দেওয়া হয়েছে। প্রায় আড়াই কোটি টাকা লাভ হয়েছে।

তাজুল ইসলাম আরও বলেন, সাবেক কর্মকর্তাদের অনিয়মে বিআরটিসিতে বড় অঙ্কের বকেয়া ছিল। ২০২১ সাল থেকে তা এখন পর্যন্ত ৯ কোটিতে নামানো হয়েছে। বিভাগীয় মামলা ও চাপ প্রয়োগে পুরোনো বকেয়া আদায়ের চেষ্টা চলছে, তবে পুরোটা আদায় কঠিন। এস্টেট ডিপার্টমেন্টের জটিলতা ও অনিয়ম চরমে পৌঁছেছে মন্তব্য করে তিনি বলেন, এটি ঠিক করার চেষ্টা চলছে।

লিজ আর দেওয়া হবে না

সরকারি প্রতিষ্ঠানের কাছে ভাড়ার বাইরে বর্তমানে বেসরকারি কোম্পানির হাতেও ১৯টি বিআরটিসির বাস লিজ দেওয়া হয়েছে। চেয়ারম্যান তাজুল ইসলাম বলেন, ২০২১ সালে দায়িত্ব নেওয়ার পর তিনি দেখেন, নিয়ম ভেঙে বিআরটিসির বাস বেসরকারি কোম্পানির হাতে তুলে দেওয়া হয়েছে। এ লিজ প্রক্রিয়া ধীরে ধীরে বন্ধ করা হবে। মেয়াদ শেষ হলে আর নবায়ন করা হবে না। এসব লিজ মালিক বছরের পর বছর রাজস্ব না দিয়ে বিআরটিসিকে ক্ষতিগ্রস্ত করেছে। ২০১৮-১৯ অর্থবছরে যুক্ত বাসগুলোও অবহেলায় ভাঙারিতে পরিণত হয়েছে।

বিশেষজ্ঞের পরামর্শ

বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) পুরকৌশল বিভাগের অধ্যাপক যোগাযোগ ও পরিবহন বিশেষজ্ঞ ড. হাদিউজ্জামান আজকের পত্রিকাকে বলেন, গত তিন অর্থবছরে বিআরটিসির পরিচালনা কমিটি সংকট নিরসনে বড় ভূমিকা রেখেছে। তবে বিআরটিসি যতই লাভজনক প্রতিষ্ঠান হোক না কেন, তাদের প্রধান কাজ জনগণকে সেবা দেওয়া। সেখানে তাদের গুরুত্ব দেওয়া উচিত। ইজারা দিয়ে লাভ করা মুখ্য লক্ষ্য হওয়া উচিত নয়।

অধ্যাপক হাদিউজ্জামান আরও বলেন, বিআরটিসির যে কাঠামোগত সক্ষমতা আছে, তা দেশের অন্য কোনো বাস কোম্পানির নেই। সেটা কাজে লাগাতে হবে। বিআরটিসির একটা প্রবণতা আছে, রুট সংখ্যা বাড়ানো। কিন্তু অনেক রুটে দরকার মতো বাস থাকে না। এদিকে নজর দিতে হবে।

Tag :

Write Your Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Save Your Email and Others Information

About Author Information

Haor Barta24

জনপ্রিয় সংবাদ

তিন বছরেই ২৪ কোটি টাকা দুর্নীতি, দেনার ঘানি টানছে বিআরটিসি

আপডেট টাইম : ১১:১১:৪১ পূর্বাহ্ন, শনিবার, ৩০ নভেম্বর ২০২৪

রাষ্ট্রীয় সংস্থা বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন করপোরেশন (বিআরটিসি) ২০১৩ সালে ৫০টি ‘আর্টিকুলেটেড’ বাস কিনেছিল। বলা হয়েছিল, ভারতীয় ঋণের আওতায় কেনা এ বাসগুলো ঢাকার গণপরিবহনে নতুন মাত্রা যোগ করবে। কিন্তু মাত্র সাত বছরের মধ্যেই ৪৩টি বাস অকেজো হয়ে পড়ে, যা অনেককে মনে করিয়ে দিতে পারে আড়াই দশক আগে সুইডেন থেকে কেনা বিশ্বখ্যাত ভলভো বাসের অভিজ্ঞতার কথা।

রাষ্ট্রীয় সম্পদের প্রতি অযত্ন-অবহেলা সরকারি এ প্রতিষ্ঠানে জেঁকে থাকা গাফিলতি, অনিয়ম ও দুর্নীতির একটি দিক মাত্র। গত কয়েক বছর আগের অনিয়ম-দুর্নীতির জের বিআরটিসি এখনো টেনে চলেছে। এতে ব্যাহত হচ্ছে তার মূল লক্ষ্য—যাত্রীসেবা।

আর্টিকুলেটেডে ভলভোর ছায়া

প্রচলিত বাসের প্রায় দ্বিগুণ দৈর্ঘ্যের ‘আর্টিকুলেটেড’ বাসের কাঠামোর জন্য বিদেশে জনসাধারণের কাছে বেন্ডি, স্ট্রেচ, স্লিংকি ইত্যাদি নামে পরিচিত।

বৈধ দৈর্ঘ্যের মধ্যে থেকে এই বাসে তুলনামূলকভাবে বেশি যাত্রী পরিবহন করা সম্ভব হওয়ায় এটি জনপ্রিয়তা পেয়েছে। তুলনামূলক সরু রাস্তায় চালানো কিছুটা সমস্যা হওয়ায় অবশ্য বিশ্বের অনেক শহর থেকে দুটি অংশ জুড়ে তৈরি করা এ বাস তুলে দেওয়া হয়েছে।

২০১৩ সালে কেনা ৫০টি আর্টিকুলেটেড বাসের মধ্যে বিআরটিসি ২০২২ সালে ২৭টি আবার চালু করে। বাকি বাসগুলো এখনো ডিপোতে পড়ে রয়েছে। এসব নিয়ে গত ১৫ বছরে সংস্থাটির বহরে যুক্ত হয়েছে মোট ১ হাজার ৫৫৮টি বাস। এর মধ্যে কাগজে-কলমেই চালু আছে ১ হাজার ২৪৪টি। আর চারটি প্রকল্পে এসব বাস কেনায় খরচ হয়েছে প্রায় ১৩০০ কোটি টাকা। এ সময়ে অনেক বাস নষ্ট হয়ে গেছে। দীর্ঘদিন পড়ে থাকায় কিছু ‘ভাঙারি’ হিসেবে কেজি দরে বিক্রি করা হয়েছে। যথাযথ রক্ষণাবেক্ষণের অভাবে বা সময়মতো মেরামত না করায় গাড়ি অচল পড়ে থাকায় যাত্রীসেবা ব্যাহত হওয়ার পাশাপাশি বিআরটিসির আয়ে প্রভাব পড়েছে। দায়দেনা শোধে অসুবিধা ও কর্মীদের বেতন অনিয়মিত হয়ে পড়াসহ বিভিন্ন সমস্যায় জর্জরিত সংস্থাটি।

বিআরটিসিসংশ্লিষ্ট সূত্র বলছে, এখন আরও ৮টি আর্টিকুলেটেড বাস সচল করার উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। এসব বাসের দুটি অংশের মাঝখানে থাকা রাবারের সংযোগটি জার্মানিতে তৈরি।

চাহিদা নিতান্ত সীমিত বলে এগুলো স্থানীয় বাজারে সাধারণত পাওয়া যায় না। প্রতিটি বাসের নতুন সংযোগের মূল্য ৩৩ লাখ টাকার বেশি। তবে দেশি প্রযুক্তিতে মাত্র ৪০ হাজার টাকায় পুরোনোগুলো মেরামত করা হচ্ছে।

বিআরটিসি অনেক ঘটা করে ২০০১-০২ সালে সুইডেনের বিশ্বখ্যাত ভলভো কোম্পানির ৫০টি আধুনিক দোতলা বাস ঢাকার রাস্তায় নামিয়েছিল। অত্যাধুনিক বাসগুলোয় যাত্রা বেশ আরামদায়ক হওয়ায় তা প্রশংসিত হয়েছিল। তবে ইজারা ব্যবস্থাপনার ত্রুটি এবং রক্ষণাবেক্ষণের অভাবে মাত্র পাঁচ বছরের মধ্যেই বাসগুলো একে একে অকেজো হয়ে পড়ে।

দামি বা বিশেষ কোম্পানির গাড়ি ছাড়াও সাধারণভাবেই রাষ্ট্রীয় এ কোম্পানির গাড়ি রক্ষণাবেক্ষণ ও সংস্কারে অবহেলার অভিযোগ পুরোনো। সংস্থার সূত্রে জানা গেছে, সাম্প্রতিক কয়েক বছরে চট্টগ্রাম, নারায়ণগঞ্জ, মতিঝিল, কল্যাণপুর, মিরপুর, জোয়ারসাহারা, গাজীপুরসহ বিভিন্ন ডিপোতে ১৩৯টি বাস অকেজো হয়ে বিভিন্ন মেয়াদে পড়ে ছিল। এ বাসগুলোর অনেক যন্ত্রাংশ মেরামতযোগ্য হলেও পড়ে থেকে বাইরের অংশ নষ্ট হয়ে যায়। ফলে সরকারি সম্পদের অপচয় হয়েছে।

তিন অর্থবছরের অনিয়ম ভোগাচ্ছে

পরিবহন নিরীক্ষা অধিদপ্তরের প্রতিবেদন অনুযায়ী, রাজধানীর তেজগাঁওসহ বিআরটিসির বিভিন্ন বাস ডিপোর ব্যবস্থাপক ও কর্মকর্তারা ২০১৭-১৮ থেকে ২০১৯-২০ সাল পর্যন্ত তিন অর্থবছরে ৪ কোটি ৮৭ লাখ টাকা আত্মসাৎ করেছেন। চালক, কন্ডাক্টর ও লিজগ্রহণকারী বাইরের ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠান থেকে প্রাপ্ত রাজস্ব যথাযথভাবে ব্যাংকে জমা না করায় এই আর্থিক ক্ষতি হয়েছে। নিরীক্ষা প্রতিবেদন বলছে, কেবল ওই তিন অর্থবছরে বিআরটিসির মোট দুর্নীতির অঙ্ক ২৪ কোটি ৬২ লাখ টাকার বেশি। মামলা-মোকদ্দমার কারণে প্রাপ্য আদায়েও বিআরটিসি সমস্যায় পড়ছে।

প্রতিবেদনে দেখা যায়, ‍কল্যাণপুর বাস ডিপোর ৩৭টি দোকানের বরাদ্দে অনিয়মের অভিযোগ রয়েছে। ব্যবসার ধরন পরিবর্তনের ফি না জমা হয়নি। ফুলবাড়িয়া সিবিএস-২ মার্কেটের বকেয়া ভাড়া আদায়ে জটিলতা রয়েছে। এসব ব্যর্থতার পেছনে বিআরটিসির প্রধান কার্যালয়ের এস্টেট বিভাগের কর্মকর্তাদের ভূমিকা নিয়ে অভিযোগ উঠেছে। মতিঝিল, কল্যাণপুর, জোয়ারসাহারা, বরিশাল, খুলনা, বগুড়া বাস ডিপো ও প্রধান কার্যালয় ইজারা বাবদ ৬ কোটি টাকার বেশি রাজস্ব আদায় করতে ব্যর্থ হয়েছে বিআরটিসি। আন্তর্জাতিক রুটে শ্যামলী পরিবহন, রয়েল কোচ ও এন আর ট্রাভেলস তিন বছরে ২৪ লাখ ৬১ হাজার টাকার রয়্যালটি ফি বকেয়া রেখেছে, যা করোনার কারণ দেখিয়ে পরিশোধ করা হয়নি।

সংস্থাটির সূত্র বলছে, সাবেক চেয়ারম্যান ফরিদ আহমেদ ভুঁইয়া ও মো. এহসান এলাহীর সময়ের এসব দুর্নীতির দায় এখনো টানতে হচ্ছে বিআরটিসিকে। বর্তমান চেয়ারম্যানের ঠিক আগে পর্যায়ক্রমে দায়িত্ব পালন করা এই দুজনের সময়ে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের কাছে বিআরটিসির দেনা দাঁড়িয়েছিল ১০১ কোটি টাকা। গত চার বছরে তা থেকে ৯২ কোটি টাকা পরিশোধ করা হয়েছে।

দেনা মেটাতে বাসভাড়া

রাজধানীর অনেক সাধারণ বাসযাত্রীর অভিযোগ, ঢাকার পথে এই সরকারি সংস্থার গাড়ি খুব বেশি রুটে দেখা যায় না। আবার হুটহাট রুট পরিবর্তনেরও নজির আছে। বিআরটিসির সূত্র বলছে, দেনা শোধের চাপের কারণে যাত্রীসেবায় কিছুটা কম গুরুত্ব দিয়ে বিভিন্ন সরকারি প্রতিষ্ঠানে বাসভাড়া দেওয়া হচ্ছে। রাজধানীর পথে এখন তাদের ৫৫০টি গাড়ি যাত্রী পরিবহন করে। তবে এসব গাড়ি থেকে বেশি আয় হয় না। ১৭২টি গাড়ি সরকারি বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে ভাড়া দেওয়া হয়েছে।

বিআরটিসির চেয়ারম্যান মো. তাজুল ইসলাম গত সোমবার আজকের পত্রিকার সঙ্গে আলাপকালে ১৭২টি বাসভাড়া দেওয়ার বিষয়টি সত্যি বলে নিশ্চিত করেন। কারণ হিসেবে তিনি বলেন, বিগত কয়েক বছরে যে পরিমাণ দেনা হয়েছে, তা শোধ করতে অর্থ দরকার। সরকারি প্রতিষ্ঠানে বাসভাড়া দিয়ে ভালো আয় হচ্ছে। গত মাসে ১২ কোটি টাকা বেতন দেওয়া হয়েছে। প্রায় আড়াই কোটি টাকা লাভ হয়েছে।

তাজুল ইসলাম আরও বলেন, সাবেক কর্মকর্তাদের অনিয়মে বিআরটিসিতে বড় অঙ্কের বকেয়া ছিল। ২০২১ সাল থেকে তা এখন পর্যন্ত ৯ কোটিতে নামানো হয়েছে। বিভাগীয় মামলা ও চাপ প্রয়োগে পুরোনো বকেয়া আদায়ের চেষ্টা চলছে, তবে পুরোটা আদায় কঠিন। এস্টেট ডিপার্টমেন্টের জটিলতা ও অনিয়ম চরমে পৌঁছেছে মন্তব্য করে তিনি বলেন, এটি ঠিক করার চেষ্টা চলছে।

লিজ আর দেওয়া হবে না

সরকারি প্রতিষ্ঠানের কাছে ভাড়ার বাইরে বর্তমানে বেসরকারি কোম্পানির হাতেও ১৯টি বিআরটিসির বাস লিজ দেওয়া হয়েছে। চেয়ারম্যান তাজুল ইসলাম বলেন, ২০২১ সালে দায়িত্ব নেওয়ার পর তিনি দেখেন, নিয়ম ভেঙে বিআরটিসির বাস বেসরকারি কোম্পানির হাতে তুলে দেওয়া হয়েছে। এ লিজ প্রক্রিয়া ধীরে ধীরে বন্ধ করা হবে। মেয়াদ শেষ হলে আর নবায়ন করা হবে না। এসব লিজ মালিক বছরের পর বছর রাজস্ব না দিয়ে বিআরটিসিকে ক্ষতিগ্রস্ত করেছে। ২০১৮-১৯ অর্থবছরে যুক্ত বাসগুলোও অবহেলায় ভাঙারিতে পরিণত হয়েছে।

বিশেষজ্ঞের পরামর্শ

বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) পুরকৌশল বিভাগের অধ্যাপক যোগাযোগ ও পরিবহন বিশেষজ্ঞ ড. হাদিউজ্জামান আজকের পত্রিকাকে বলেন, গত তিন অর্থবছরে বিআরটিসির পরিচালনা কমিটি সংকট নিরসনে বড় ভূমিকা রেখেছে। তবে বিআরটিসি যতই লাভজনক প্রতিষ্ঠান হোক না কেন, তাদের প্রধান কাজ জনগণকে সেবা দেওয়া। সেখানে তাদের গুরুত্ব দেওয়া উচিত। ইজারা দিয়ে লাভ করা মুখ্য লক্ষ্য হওয়া উচিত নয়।

অধ্যাপক হাদিউজ্জামান আরও বলেন, বিআরটিসির যে কাঠামোগত সক্ষমতা আছে, তা দেশের অন্য কোনো বাস কোম্পানির নেই। সেটা কাজে লাগাতে হবে। বিআরটিসির একটা প্রবণতা আছে, রুট সংখ্যা বাড়ানো। কিন্তু অনেক রুটে দরকার মতো বাস থাকে না। এদিকে নজর দিতে হবে।