বিএডিসির বিপুল পরিমাণ বীজ অবিক্রিত থাকায় দেশের কৃষি উৎপাদন কমার শঙ্কা

বাংলাদেশ কৃষি উন্নয়ন করপোরেশনের (বিএডিসি) বিপুল পরিমাণ বীজ অবিক্রিত অবস্থায় রয়েছে। চলতি রবি মৌসুমে বিএডিসির ৩৭ হাজার টনের বেশি বীজ অবিক্রিত থাকায় প্রায় ১ হাজার ৫০ কোটি টাকার লোকসানের শঙ্কা দেখা দিয়েছে। পাশাপাশি বিপুল পরিমাণ বীজ অবিক্রিত থাকায় দেশের খাদ্য উৎপাদনও কিছুটা কম হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। উচ্চফলনশীল ধানের বীজ কাজে না লাগায় প্রায় ৪ দশমিক ২ লাখ টন খাদ্য উৎপাদন কম হতে পারে বলে কৃষি বিশেষজ্ঞদের ধারণা। যা দেশের কৃষির জন্য বড় ধাক্কা হবে। কৃষি অর্থনীতিবিদ এবং কৃষি মন্ত্রণালয় সংশ্লিষ্ট সূত্রে এসব তথ্য জানা যায়। সংশ্লিষ্ট সূত্র মতে, ২০২৩-২৪ অর্থবছরের বিএডিসির মজুত বীজের পরিমাণ ছিল ১ লাখ ৭২ হাজার ৯৫০ টন। আউশ, আমন, বোরো ধানের বীজ রয়েছে ৬৬ হাজার ২৪৭ টন। এর মধ্যে বোরো ধানের বীজ অবিক্রীত রয়েছে ২৮ হাজার ৫ টন। এ ছাড়া উচ্চফলনশীল গম, ভুট্টা, ডাল বীজ, তৈল বীজ, সবজি বীজ, মসলা ও পাট বীজও অবিক্রীত রয়েছে ৫ হাজার ৬১৩ টন। গম বীজ ৫ হাজার ১৯৩ টন, ভুট্টা বীজ ৩০ টন, ডাল ও তৈল বীজ  ৩৩০ টন, সবজি বীজ ১৩ টন, মসলা  ৪৪ টন। উচ্চফলনশীল বোরো বীজ বিএডিসির সারাদেশের ২৭টি অঞ্চলে ৮ হাজার ৫৩৬ ডিলার এবং ১০০টি বীজ বিক্রয়কেন্দ্রের মাধ্যমে কৃষকদের মধ্যে বিক্রি করা হয়। তবে এ বছর রবি মৌসুমে সব মিলিয়ে অবিক্রীত বীজ রয়েছে ৩৭ হাজার টন। এত বিপুল পরিমাণ বীজ অবিক্রীত থাকায় এ মৌসুমে ফসলের উৎপাদন কমে যাবে ৪ দশমিক ২ লাখ টনের বেশি। আর এতে আর্থিক ক্ষতির পরিমাণ দাঁড়াবে ১ হাজার ৫০ কোটি টাকারও বেশি। সূত্র জানায়, কম দামে কৃষকের হাতে উন্নত মানের বীজ তুলে দেয়াই হচ্ছে বিএডিসির দায়িত্ব। তবে বীজ বিতরণ নিয়ে প্রতিষ্ঠানটির বিরুদ্ধে অভিযোগের শেষ নেই। বীজ সংকট, ভেজাল, নিম্নমান, দামে নয়ছয়, বরাদ্দে ঘাপলাসহ নানা অনিয়মের পাশাপাশি এবার বিপুল পরিমাণ বীজ অবিক্রিত রয়েছে। মূলত বেসরকারি কোম্পানিকে বীজ বিক্রির সুযোগ করে দিতে গিয়েই বিএডিসি এমন পরিস্থিতি পড়েছে বলে অভিযোগ উঠেছে। বিএডিসির একটি চক্রের আঁতাতে কৃষকের কাছে সঠিক সময়ে বিএডিসির বীজ পৌঁছেনি। বরং বেসরকারি সংস্থাগুলোর বীজ বিক্রি হয়ে যাওয়ার পর বিএডিসি বীজ বাজারে দেয়। ফলে সংস্থাটির বীজ অবিক্রিত থেকে যায়। আর কৃষক সরকারের কম দামের বীজ থেকে বঞ্চিত হয়েছে। বোরো মৌসুমের শুরুতে সঠিকভাবে তদারকি করা হলে এত বীজ অবিক্রীত থাকতো না। মূলত অক্টোবর থেকে জানুয়ারির প্রথম সপ্তাহের মধ্যে বোরো বীজ রোপণ শুরু হয়। এরপর আর বীজ রোপণের সময় থাকে না। ফলে এসব বীজ এই মৌসুমে কোনো কাজে আসে না। বিএডিসির বীজ অবিক্রিত থাকলেও বেসরকারি কোম্পানির বীজ কখনো অবিক্রিত থাকে না। প্রতি বছর দেশে আমদানি করা উচ্চমূল্যের ১২ হাজার টন ভুট্টা বীজ বিক্রি হয়। অথচ সরকার ভালো মানের ভুট্টা বীজ উচ্চ দরে সংগ্রহ করেও বিক্রি করতে পারে না। সূত্র আরো জানায়, চুক্তিবদ্ধ চাষির মাধ্যমে বিএডিসির বীজ উৎপাদন করা হয়। উৎপাদিত বীজ প্রক্রিয়াজাত ও সংরক্ষণ করে পরবর্তী মৌসুমে তা কৃষক পর্যায়ে সরবরাহ করা হয়। বেসরকারি এবং বিভিন্ন সংস্থার উৎপাদিত বীজের চেয়ে বিএডিসির বীজে ১৫ থেকে ২০ শতাংশ পর্যন্ত বেশি ফলন হয়ে থাকে। এবার ১০ কেজি প্যাকেটে বিভিন্ন জাতের ভিত্তি বীজ ডিলার পর্যায়ে প্রতি কেজি ৫৪ টাকা, কৃষক পর্যায়ে ৬২ টাকা। প্রত্যায়িত/মান ঘোষিত বীজ ডিলার পর্যায়ে প্রতি কেজি ৫০ টাকা, কৃষক পর্যায়ে ৫৭ টাকা নির্ধারণ করা হয়েছিল। বিএডিসির বীজ ভালো হওয়ায় প্রত্যন্ত অঞ্চলের কৃষকের কাছে এ বীজের জনপ্রিয়তা রয়েছে। কিন্তু কৃত্রিম সংকট তৈরির কারণে কৃষকরা এ বীজের নাগাল পাঁচ্ছে না। ডিলারদের দেরিতে বীজ বরাদ্দ দেয়া হয়। ফলে একদিকে ভরা মৌসুমে সংকট তৈরি করা হয়, অন্যদিকে মৌসুম শেষে নানা অজুহাতে অবিক্রিত দেখানো হয়। আর কৃষকদের বাধ্য হয়ে অপেক্ষাকৃত বেশি দরে বেসরকারি আমদানিকারকদের কাছ থেকে বীজ সংগ্রহ করতে হয়। বিভিন্ন বেসরকারি কোম্পানির বীজ বেশি বিক্রির সুযোগ তৈরি করে দিতে চলে নানা কারসাজি। কখনও কৃত্রিম সংকট, আবার কখন প্রণোদনার বীজে ভেজালের কারণে সরকারি বীজের প্রতি কৃষকের আস্থাহীনতা তৈরি করতে একটি চক্র কাজ করে। এতে অসাধু বেসরকারি কোম্পানি নিম্নমানের বীজ বাজারে ছেড়ে দেয়, আর তাতে কৃষকরা প্রতারিত হন। এদিকে বীজ অবিক্রিত থাকার বিষয়ে কৃষি মন্ত্রণালয়ের বীজ অনু বিভাগের মহাপরিচালক (বীজ) মো. আবু জুবাইর হোসেন বাবলু জানান, বিএডিসির বীজ অবিক্রীত থাকার বিষয় আমার জানা নেই। কেন এত বীজ বিক্রি হয়নি তার জবাব বিএডিসিই দিতে পারবে। অন্যদিকে বিএডিসির সদস্য পরিচালক (বীজ ও উদ্যান) মো. মোস্তাফিজুর রহমান জানান, কৃষকরা এখনও পুরোনো বীজ ব্রি আটাশ ও ঊনত্রিশের ওপর নির্ভরশীল। কয়েক বছর ধরে ধানের এই দুটি জাতে রোগ ছড়িয়ে পড়েছে। ফলে এবার বিএডিসি উচ্চফলনশীল নতুন জাতের বীজ সংগ্রহ করেছে। কিন্তু কৃষকরা এখনও নতুন জাতের প্রতি আগ্রহী হয়ে ওঠেননি। ফলে বীজ অবিক্রিত থেকে গেছে। কৃষকের কথা চিন্তা করেই বাজারে বিএডিসির বেশি বীজের সরবরাহ রাখতে হয়, যাতে বীজের কোনো সংকট না থাকে। আর সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের অনুমতি নিয়েই বীজ মজুত করা হয়। আগামী মার্চ পর্যন্ত বোরো বীজতলা করা যাবে। এর মধ্যে মজুত থাকা বীজ বিক্রি হয়ে যাবে।

Print Friendly, PDF & Email

     এ ক্যাটাগরীর আরো খবর