হাওর বার্তা ডেস্কঃ কিছুদিন আগেও মুখে মুখে ছিল চলচ্চিত্রের মন্দা আর খরার আলাপচারিতা। দেশীয় চলচ্চিত্রের ভবিষ্যৎ নিয়ে সংশয় প্রকাশ হচ্ছিল নানা মহল থেকে। কিন্তু হঠাৎ একপশলা বৃষ্টির মতোই কিছু নতুন চলচ্চিত্রের মুক্তি এবং অভাবনীয় সাফল্য পালটে দিয়েছে সব হিসাবনিকাশ। দেশের চলচ্চিত্র নিয়ে আবার নতুনভাবে আশার সঞ্চার হয়েছে। কারণ এ চলচ্চিত্রগুলো ঘিরে লাখো দর্শক এখন হলমুখী। ‘শান’, ‘গলুই’, ‘দিন দ্য ডে’, ‘পরাণ’, ‘হাওয়া’ চলচ্চিত্রগুলোর দর্শক-সাফল্য আমাদের সিনেমায় নতুন দিনের ইঙ্গিত দিচ্ছে।
দেশের রুচিশীল সিনেমা প্রদর্শনকারী প্রতিষ্ঠানের মধ্যে বর্তমানে যমুনা ফিউচার পার্কে অবস্থিত ব্লকবাস্টার সিনেমাস অন্যতম। এখানে এখন রায়হান রাফী পরিচালিত ‘পরাণ’ চলচ্চিত্রের ৩টি শো, মোর্তেজা অতাশজমজম পরিচালিত বাংলাদেশ-ইরান যৌথ প্রযোজনার চলচ্চিত্র ‘দিন দ্য ডে’র ৩টি শো এবং মেজবাউর রহমান সুমন পরিচালিত ‘হাওয়া’ চলচ্চিত্রের ১১টি শো প্রতিদিন প্রদর্শিত হচ্ছে। ব্লকবাস্টার সিনেমাসের অপারেশন ইনচার্জ এএইচ রাজু যুগান্তরকে বলেন, শুধু সকালের কিছু শো ছাড়া বাকি সব শো দর্শকদের আগমনে কানায় কানায় পূর্ণ থাকছে। এটি আমাদের খুবই অনুপ্রাণিত করছে। ‘শান’ ও ‘গলুই’ চলচ্চিত্রের মধ্য দিয়ে দর্শকের এই ব্যাপক হলমুখী মনোভাবের সৃষ্টি হয়। গত কুরবানির ঈদে ‘দিন দ্য ডে’ মুক্তি পাওয়ার পর প্রথম দুই সপ্তাহ হাউজফুল ছিল। ‘পরাণ’ চলচ্চিত্রটি দর্শক ধীরে ধীরে টানতে থাকে। আর ‘হাওয়া’ চলচ্চিত্রটির শুরুতে প্রতিদিন ১৩টি শো চালিয়েছি আমরা। সবই হাউজফুল ছিল। সেই ধারাবাহিকতা বজায় আছে এখনো।
তিনি বলেন, ভালো সিনেমা না পাওয়ার কারণে এবং অশ্লীলতা ঢুকে যাওয়ায় দর্শক অনেকটা হলবিমুখ ছিলেন। কিন্তু বর্তমান সময়ে এই চলচ্চিত্রগুলো নতুন দিনের সূচনা করেছে। ঈদ ও উৎসবের অন্যতম অনুষঙ্গ হলে বসে চলচ্চিত্র দেখা, সেটি আবার ফিরে এসেছে। সিনেমার পরিচালকরা নতুন করে ভাবতে শুরু করেছেন। দর্শকের রুচি অনুযায়ী গল্প, পরিচ্ছন্ন নির্মাণ, সঠিক প্রচার পেলে দর্শক হলে আসতে বাধ্য।
বাংলা চলচ্চিত্রের দর্শকদের নতুন সিনেমাকে ঘিরে এই উল্লাস সরেজমিনে ঢাকার বিভিন্ন হলে গিয়েও দেখা গেছে।
এদিকে ‘শান’, ‘গলুই’, ‘দিন দ্য ডে’, ‘পরাণ’, ‘হাওয়া’ চলচ্চিত্রের সাফল্যে খুবই উদ্দীপ্ত চলচ্চিত্রের প্রদর্শক হল-মালিকরা। সারা দেশে সব মিলিয়ে এখন প্রেক্ষাগৃহ আছে শতাধিক। এই প্রেক্ষাগৃহগুলোয় নতুন চলচ্চিত্রগুলো বিভিন্ন সময়ে প্রদর্শিত হয়েছে এবং কিছুটা হলেও ব্যবসার মুখ দেখেছে। এ বিষয়ে চলচ্চিত্র প্রদর্শক সমিতির সভাপতি শোয়েব রশিদ যুগান্তরকে বলেন, আমরা খুবই আশাবাদী। সত্যি বলতে, একটা সময় গল্পের চেয়ে অশ্লীলতা বেশি প্রাধান্য পেয়েছিল সিনেমায়। পরিবার নিয়ে দেখার মতো চলচ্চিত্র ছিল না সেগুলো। আমরা সেগুলো না বুঝেই চালিয়েছি। এতে দর্শক নষ্ট হয়েছে। কিন্তু বর্তমান সময়ের এই চলচ্চিত্রগুলো হলে পরিবার-পরিজন নিয়ে দেখা যায় এবং দেখছেন সবাই। ঢাকার বাইরের দর্শকরাও এই চলচ্চিত্রগুলো উপভোগ করছেন।
তিনি বলেন, শুধু ঈদকে ঘিরে নয়, আমরা চাই সারা বছর এমন চলচ্চিত্র নির্মাণ হোক। এতে আমাদের চলচ্চিত্রের সুদিন সত্যিকার অর্থেই ফিরে আসবে বলে বিশ্বাস।
বাংলাদেশ চলচ্চিত্র পরিচালক সমিতির সভাপতি সোহানুর রহমান সোহান যুগান্তরকে বলেন, প্রথমেই নতুন এই চলচ্চিত্রগুলোর পরিচালক ও প্রযোজকদের আমি সাধুবাদ জানাই। পাশাপাশি তারা আগামী দিনে আরও ভালো ভালো চলচ্চিত্র আমাদের উপহার দেবেন বলে আশা করি। তারা প্রমাণ করেছেন, সিনেমাই দেশের মানুষের কাছে এখনো বিনোদনের সবচেয়ে বড় মাধ্যম।
তিনি বলেন, দর্শকদের এই হলমুখী মনোভাব চলচ্চিত্র অঙ্গনের সবাইকে উজ্জীবিত করেছে। ঢাকার অনেক দর্শক পাওয়া গেলেও মফস্বলের দর্শকরা এখনো সেভাবে অংশ নেননি। আর এজন্যই সেখানে আরও বেশি করে সিনেপ্লেক্স নির্মাণ করতে হবে। কারণ, মফস্বলের যারা আছেন, তারাও ঝকঝকে পরিচ্ছন্ন ছবি, সুন্দর সাউন্ডে চলচ্চিত্র উপভোগ করতে চান।
প্রসঙ্গত, রাজধানীসহ সারা দেশের জেলা, উপজেলা পর্যায় পর্যন্ত একসময় ১২০০ প্রেক্ষাগৃহ ছিল। সেখানে নিয়মিতভাবে চলচ্চিত্রের প্রদর্শন হতো। কিন্তু কালের পরিক্রমায় সিনেমার ব্যবসায় ধস নামে। যার কারণ হিসাবে মূলত মানসম্মত চলচ্চিত্র নির্মাণের ব্যর্থতা, চলচ্চিত্রে আশ্লীলতার প্রবেশ, মধ্যবিত্ত পরিবারগুলোর সিনেমাবিমুখ হওয়াসহ নানা কারণকে দায়ী করা হয়ে থাকে। সেদিক থেকে বর্তমান সময়ের মানসম্পন্ন গল্প ও রুচিসম্মত চলচ্চিত্রগুলোকে নতুন আলো হিসাবে বিবেচনা করা হচ্ছে। অন্যদিকে চলচ্চিত্রের সুদিন ফিরিয়ে আনতে নেওয়া হয়েছে কিছু সরকারি উদ্যোগ। এর মধ্যে নতুন প্রেক্ষাগৃহ নির্মাণ, পুরোনোগুলো সংস্কার এবং বন্ধগুলো চালু করতে প্রধানমন্ত্রীর অনুমতিক্রমে তথ্য ও সম্প্রচার মন্ত্রণালয় থেকে এক হাজার কোটি টাকার ঋণ তহবিল গঠন করা হয়েছে। রাষ্ট্রায়ত্ত যে কোনো ব্যাংক থেকে এই ঋণ নেওয়ার সুবিধা রাখা হয়েছে।