ইউক্রেনে রুশ অভিযানের ১০০তম দিন আজ

হাওর বার্তা ডেস্কঃ ইউক্রেনে রুশ অভিযানের ১০০ তম দিন আজ। গত ২৪ ফেব্রুয়ারি রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিনের নির্দেশে প্রতিবেশী ইউক্রেনে কথিত ‘বিশেষ সামরিক অভিযান’ শুরু করে রুশ বাহিনী। এক পর্যায়ে কিয়েভ থেকে পিছু হটলেও মস্কোর নজর এখন দেশটির পূর্বাঞ্চলীয় এলাকায়। বর্তমানে ডনবাসের শিল্প শহর সেভেরোডোনেস্ক ও লিসিচানস্ক দখলের পথে রয়েছে রুশ বাহিনী। কৌশলগত গুরুত্বপূর্ণ শহর দুইটিতে মস্কোর নিয়ন্ত্রণ এলাকা সম্প্রসারণে মরিয়া তৎপরতা চালাচ্ছে তারা। জোরালো প্রতিরোধ গড়ে তোলার চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে ইউক্রেনীয় যোদ্ধারাও।

জাতিসংঘ বলছে, যুদ্ধের প্রথম ১০০টি দিন শিশুদের জন্য একটি বিধ্বংসী পরিণতির দিকে নিয়ে গেছে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর এমন দৃশ্য আর দেখা যায়নি।
ইউক্রেনের প্রধান প্রসিকিউটরের অফিস বুধবার জানিয়েছে, রাশিয়ার হামলায় কমপক্ষে ২৪৩ শিশু মারা গেছে। রুশ বাহিনীর হাতে আরও ৪৪৬ শিশু আহত হয়েছে।

জাতিসংঘের ধারণা, যুদ্ধ শুরুর পর থেকে ইউক্রেনে কমপক্ষে চার হাজার ১৪৯ জন বেসামরিক নাগরিক নিহত হয়েছে। এছাড়া আহত হয়েছে আরও চার হাজার ৯৪৫ জন।
আন্তর্জাতিক অভিবাসন সংস্থা বলেছে, যুদ্ধের কারণে ইউক্রেনে প্রতি ছয় জনের মধ্যে একজন অভ্যন্তরীণভাবে বাস্তুচ্যুত হয়েছে। এ ধরনের বাস্তুচ্যুত মানুষের মোট সংখ্যা ৭৭ লাখ।
জাতিসংঘের শরণার্থী বিষয়ক হাইকমিশনার (ইউএনএইচসিআর) জানিয়েছে, ৬৮ লাখেরও বেশি মানুষ ভিনদেশে পালিয়ে গেছে।
ইউক্রেনের দাবি, যুদ্ধের শুরু থেকে এ পর্যন্ত দেশটিতে অন্তত ২৪ হাজার ২০০ রুশ সেনা নিহত হয়েছে। রাশিয়ান এবং ইউক্রেনীয় প্রতিনিধিরা যুদ্ধবিরতি নিশ্চিত করতে মোট চার দফায় মুখোমুখি আলোচনায় বসেছে। এর মধ্যে তিন দফায় বেলারুশে এবং এক দফা তুরস্কে আলোচনা অনুষ্ঠিত হয়েছে। বেলারুশে অনুষ্ঠিত বৈঠকে উভয় পক্ষই বিরোধপূর্ণ অঞ্চল থেকে বেসামরিক নাগরিকদের সরিয়ে নেওয়ার জন্য মানবিক করিডোর বাস্তবায়নের বিষয়ে সম্মত হয়।
পরে তুরস্কের প্রেসিডেন্ট রজব তাইয়্যেব এরদোয়ানের মধ্যস্থতায় ২৯ মার্চ ইস্তাম্বুলে অনুষ্ঠিত আলোচনায় রাশিয়ান পক্ষের কাছে একটি খসড়া চুক্তির ব্যাপারে তাদের নীতিগত অবস্থান স্পষ্ট করে।

‘বিশেষ সামরিক অভিযান’
রুশ প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিনের নির্দেশে ২০২২ সালের ২৪ ফেব্রুয়ারি শুরু হওয়া এই যুদ্ধকে ‘বিশেষ সামরিক অভিযান’ হিসেবে আখ্যায়িত করে থাকে রাশিয়া। অন্যদিকে কিয়েভের পাশে দাঁড়ায় যুক্তরাষ্ট্র ও তার পশ্চিমা মিত্ররা। ন্যাটো মহাসচিব জেনস স্টলটেনবার্গ বলেছেন, রাশিয়া ইউক্রেনে সরকার বদলে দিতে চায়।
গত ২৭ ফেব্রুয়ারি ইউক্রেনে আগ্রাসনের জেরে শাস্তিমূলক পদক্ষেপ হিসেবে রাশিয়ার একাধিক ব্যাংককে বিশ্বের প্রধান আর্থিক লেনদেনকারী পরিষেবা সুইফট থেকে বাদ দিতে সম্মত হয় যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, কানাডা ও ইউরোপীয় ইউনিয়ন। আন্তর্জাতিক আর্থিক প্রবাহ থেকে রাশিয়াকে বিচ্ছিন্ন করে ফেলা তথা দেশটির অর্থনৈতিক খাতকে পঙ্গু করে দিতেই এমন পদক্ষেপ নেওয়া হয়।
এদিকে, রাশিয়ার বেসামরিক বিমানের জন্যও ইউরোপীয় ইউনিয়নের আকাশসীমা ব্যবহার নিষিদ্ধ করা হয়।
বিদ্যমান যুদ্ধাবস্থার মধ্যেই রুশ প্রেসিডেন্টের দফতর ক্রেমলিনের মুখপাত্র দিমিত্রি পেসকভ জানান, ইউক্রেনের সঙ্গে শান্তি আলোচনার জন্য রাশিয়ার একটি প্রতিনিধি দল বেলারুশে পৌঁছেছে। তার ওই ঘোষণার একদিনের মাথায় ইউরোপীয় ইউনিয়নে যোগদানের আবেদন করে ইউক্রেন।
ইউক্রেনের সামরিক বাহিনীর জন্য ৫৫৪ মিলিয়ন ডলারের সহায়তা প্যাকেজও অনুমোদন দিয়েছে ইউরোপীয় ইউনিয়ন। ইউরোপীয় কমিশনের প্রেসিডেন্ট উরসুলা ভন ডার লিয়েন বলেছেন, প্রথমবারের মতো আক্রমণের মুখে থাকা একটি দেশকে সামরিক সরঞ্জাম কেনার জন্য তহবিল দেবে তার জোট।

আক্রান্ত মারিউপোল, খারকিভ
ইউক্রেনের শক্তিশালী প্রতিরোধ সত্ত্বেও রাশিয়ান বাহিনী যুদ্ধের শুরু থেকেই কিয়েভের সামরিক স্থাপনাগুলোকে লক্ষ্যবস্তুতে পরিণত করে আসছে। যুদ্ধের শুরুতেই রুশ সেনারা খারকিভ ও মারিউপোল অবরোধ করে। খারকিভে ইউক্রেনীয় ও রুশ বাহিনী এখনও লড়াই চালিয়ে যাচ্ছে। তবে ইউক্রেনীয় কর্তৃপক্ষ জানিয়েছে, তারা এরইমধ্যে খারকিভের কিছু এলাকার নিয়ন্ত্রণ পুনরুদ্ধার করতে সমর্থ হয়েছে।
হামলার প্রথম মাসেই রাশিয়ান সেনারা আজভ সাগর উপকূলের কৌশলগত শহরগুলো দখলের টার্গেট নেয়। বন্দর শহর বারদিয়ানস্কের নিয়ন্ত্রণ নিতে সমর্থ হয় তারা। যুদ্ধের তৃতীয় মাসে আজভ সাগরে ইউক্রেনের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ বন্দর শহর মারিউপোলের নিয়ন্ত্রণ নেয় রুশ বাহিনী। কয়েক দিনের যুদ্ধে পুরো শহর যেন ধ্বংসস্তূপে পরিণত হয়।
৯ মার্চ রুশ বোমা হামলায় একটি শিশু হাসপাতাল লণ্ডভণ্ড হয়ে যাওয়ার কথা জানায় মারিউপোলের সিটি কাউন্সিল। পরদিন রুশ বাহিনী বেসামরিকদের সরিয়ে নেওয়ার একটি মানবিক করিডোরে বোমাবর্ষণ করে।
রুশ বাহিনীর নিয়ন্ত্রণে আসা ইউক্রেনের আরেক শহর খেরসন। সেখানকার একটি অঞ্চলে ইতোমধ্যেই রাশিয়ান মুদ্রা রুবলের ব্যবহার শুরু হয়েছে। এ বছরের শেষ নাগাদ পুরো খেরসন শহরে রুশ মুদ্রা চালু করতে চায় মস্কো।

বুচা ট্র্যাজেডি
ইউক্রেনের প্রেসিডেন্ট ভলোদিমির জেলেনস্কির একজন উপদেষ্টা মিখাইল পোডোলিয়াক। এপ্রিলের গোড়ার দিকে তিনি জানান, দেশটির বুচা শহর থেকে রুশ বাহিনী চলে যাওয়ার পর সেখান হাত বাঁধা অবস্থায় বেসামরিক ব্যক্তিদের মরদেহ পড়ে থাকতে দেখা গেছে। মস্কোর তরফে বিষয়টি অস্বীকার করা হলেও এ নিয়ে বিশ্বব্যাপী নিন্দার ঝড় উঠে।
ইউক্রেনের প্রসিকিউটর জেনারেল বলেছেন, বুচা এবং বৃহত্তর কিয়েভ অঞ্চলে কমপক্ষে ৪১০ জন বেসামরিক নাগরিকের মরদেহ উদ্ধার করা হয়েছে। ন্যাটো মহাসচিব বলেছেন, বুচায় বেসামরিক হত্যাকাণ্ড একটি ‘অসহনীয় বর্বরতা’। গত কয়েক দশকে এমন বর্বরতা দেখেনি ইউরোপ। এই নৃশংসতা যারা চালিয়েছে তাদের অবশ্যই বিচারের আওতায় আনা হবে।

কূটনৈতিক ও সামরিক তৎপরতা
যুদ্ধের মধ্যেই তুরস্কে আলোচনার টেবিলে বসেছেন রাশিয়া ও ইউক্রেনের পররাষ্ট্রমন্ত্রীরা। তবে এমন কূটনৈতিক তৎপরতার পাশাপাশি সামরিক তৎপরতাও থেমে নেই। পশ্চিমা মিত্রদের কাছ থেকে বিপুল পরিমাণ সামরিক সরঞ্জাম সংগ্রহ করেছে কিয়েভ। সম্প্রতি ইউক্রেনে অস্ত্র সরবরাহ অব্যাহত রাখা এবং এটি আরও জোরদারের প্রতিশ্রুতি দিয়েছে ফ্রান্স।
যুক্তরাষ্ট্র বুধবার ঘোষণা দিয়েছে, তারা ইউক্রেনে চারটি অত্যাধুনিক, মধ্য পাল্লার রকেট ব্যবস্থা ও গোলাবারুদ পাঠাবে। যা ডনবাস অঞ্চলে রাশিয়ার অগ্রগতি ঠেকাতে ইউক্রেনকে সহযোগিতা করবে। নতুন এই রকেট ব্যবস্থা যুক্তরাষ্ট্রের ৭০০ মিলিয়ন ডলারের নিরাপত্তা সহযোগিতার অংশ। এতে আরও থাকবে হেলিকপ্টার, ট্যাংক-বিধ্বংসী জ্যাভেলিন অস্ত্র ব্যবস্থা, রাডার, ট্যাক্টিক্যাল যানসহ বেশ কিছু সামরিক সরঞ্জাম।
রাশিয়ার পররাষ্ট্রমন্ত্রী সের্গেই ল্যাভরভ বলেছেন, ইউক্রেনে যুক্তরাষ্ট্রের অত্যাধুনিক রকেট ব্যবস্থা পাঠানোর ফলে তৃতীয় দেশের যুদ্ধে জড়িয়ে পড়ার ঝুঁকি বেড়েছে। পশ্চিমাদের ইউক্রেনে অস্ত্র সরবরাহ না করার আহ্বান জানিয়েছেন তিনি।
ল্যাভরভের ডেপুটি সের্গেই রিয়াবকভ বলেছেন, ইউক্রেনে যুক্তরাষ্ট্রের সামরিক সহযোগিতা চরম নেতিবাচক হিসেবে দেখে মস্কো। ক্রেমলিন মুখপাত্র দিমিত্রি পেসকভ বলেছেন, আমরা মনে করি যুক্তরাষ্ট্র ইচ্ছাকৃতভাবে আগুনে ঘি ঢালছে। মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী অ্যান্টনি ব্লিনকেন অবশ্য বলেছেন, ইউক্রেন নিশ্চয়তা দিয়েছে তারা দূরপাল্লার অস্ত্র ব্যবস্থা রাশিয়ার ভূখণ্ডে হামলার জন্য ব্যবহার করবে না।

রুশ যুদ্ধাপরাধ
মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন রাশিয়ার বিরুদ্ধে ইউক্রেনে বড় ধরনের যুদ্ধাপরাধ সংঘটনের অভিযোগ করেছেন। এজন্য মস্কোকে মূল্য দিতে হবে বলেও অঙ্গীকার করেছেন তিনি। গত ১৩ এপ্রিল পুতিনকে একনায়ক হিসেবে আখ্যায়িত করে রাশিয়ার বিরুদ্ধে ইউক্রেনে ‘গণহত্যা’ সংঘটনের অভিযোগ করেন বাইডেন।

ন্যাটো মহাসচিব জেন্স স্টোলটেনবার্গ বলেছেন, ইউক্রেনের জরুরিভিত্তিতে সামরিক সহায়তা প্রয়োজন। কিয়েভকে সহায়তায় পশ্চিমা মিত্রদের আরও সংহতির তাগিদ দেন তিনি। ইউক্রেনের প্রতি সংহতি জানাতে দেশটি সফরে যান পোল্যান্ড, লাটভিয়া, এস্তোনিয়া ও লিথুয়ানিয়ার নেতারা। পুতিনের সঙ্গে ফোনালাপে যুদ্ধ অবসানে মধ্যস্থতার উদ্যোগ নেওয়ার ব্যাপারে নিজ দেশের প্রস্তুতির কথা জানিয়েছেন তুর্কি প্রেসিডেন্ট রজব তাইয়্যেব এরদোয়ান। এর মধ্যেই ২৫ মে ইউক্রেনের খেরসন ও জাপোরিঝিয়া অঞ্চলের বাসিন্দাদের জন্য রাশিয়ান নাগরিকত্বের নিয়ম সহজ করার একটি ডিক্রিতে স্বাক্ষর করেন রুশ প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন। তবে ইউক্রেনকে কব্জায় নিয়ে একদিকে পুতিনের মরিয়া চেষ্টা, অন্যদিকে পশ্চিমাদের সহায়তা নিয়ে কিয়েভের পাল্টা প্রতিরোধের পরিণতি শেষ পর্যন্ত কী হয় সেটা সময়ই বলে দেবে। সূত্র: আনাদোলু এজেন্সি, রয়টার্স।

Print Friendly, PDF & Email

     এ ক্যাটাগরীর আরো খবর