পুলিশের নানা উদ্যোগের পরও ঢাকার আইনশৃঙ্খলা ও অপরাধ পরিস্থিতি এখনও স্বস্তির জায়গায় ফেরেনি। রাজধানীর বিভিন্ন এলাকায় ছিনতাই, চাঁদাবাজি, ডাকাতির ঘটনা লেগেই আছে। এসব ঘটনার পেছনে পুরনো পেশাদার অপরাধীদের পাশাপাশি কারামুক্ত শীর্ষ সন্ত্রাসী এবং নতুন মুখের অপরাধীরা সক্রিয় রয়েছে। সর্বশেষ গত শুক্রবার রাতে রাজধানীর এলিফ্যান্ট রোডে বিপণিবিতান মাল্টিপ্ল্যান সেন্টারের সামনে এক ব্যবসায়ীকে কুপিয়ে জখম করে ৫ আগস্টের পর কারামুক্ত শীর্ষ সন্ত্রাসী সানজিদুল ইসলাম ইমনের ক্যাডাররা।
কারামুক্ত অন্যান্য শীর্ষ সন্ত্রাসীরাও চাঁদাবাজিসহ নানা অপরাধ করে রাজধানীর আইনশৃঙ্খলা এবং অপরাধ পরিস্থিতিকে বেশামাল করে তুলছে। এমন প্রেক্ষাপটে ঢাকা মহানগর পুলিশ অপরাধে যুক্ত শীর্ষ সন্ত্রাসীদের ধরতে বিশেষ অভিযান শুরু করেছে। এমনকী তাদের ধরতে পুরস্কার ঘোষণার পরিকল্পনা করা হয়েছে। এদিকে সাম্প্রতিক সময়ে সবচেয়ে আলোচিত শীর্ষ সন্ত্রাসী ইমন পুলিশি তৎপরতার মুখে মালয়েশিয়া পালিয়েছে বলে ঢাকার আন্ডারওয়ার্ল্ড সূত্রে জানা গেছে।
সূত্র জানায়, চাঁদার দাবিতে এলিফেন্ট রোডে ব্যবসায়ী এহতেশামুল হকের ওপর হামলার তিন দিন আগেই সানজিদুল ইসলাম মালয়েশিয়া পাড়ি জমিয়েছে। সে ভুয়া নাম-ঠিকানায় পাসপোর্ট করে দেশ ছেড়েছে বলে সূত্র জানিয়েছে। সেখানে এখন ইমন সেকেন্ড হোম করার পরিকল্পনা নিয়েছে। মালয়েশিয়ায় থাকেন তার স্ত্রী খন্দকার শাহনাজ পারভীন লিনা। যে ঢাকার আরেক শীর্ষ সন্ত্রাসী টিটনের বোন। মালয়েশিয়া থেকেই বাহিনী নিয়ন্ত্রণ করছে ইমন।
গতকাল মঙ্গলবার ঢাকার পুলিশ কমিশনার শেখ মো. সাজ্জাত আলীও বলেন, ইমন যে মালয়েশিয়া পালিয়ে গেছে, এ তথ্য তার কাছেও এসেছে। তথ্য তিনি যাচাই-বাছাই করে দেখছেন। পুলিশ কমিশনার আরও বলেন, কারামুক্তির পর অপরাধে যুক্ত শীর্ষ সন্ত্রাসীদের ধরতে পুরস্কার ঘোষণা করতে তার কাছে একটি প্রস্তাব এসেছে। কোন প্রক্রিয়ায় এই পুরস্কার ঘোষণা করা হবে, কত টাকার পুরস্কার ঘোষণা করা হবে- তা নিয়ে ভাবছেন বলেও এ প্রতিবেদককে জানান পুলিশ কমিশনার।
ছাত্র-জনতার গণ-আন্দোলনের মুখে গত বছরের ৫ আগস্ট শেখ হাসিনা সরকারের পতনের পর একে একে কারাগার থেকে বেরিয়ে যায় ঢাকার শীর্ষ সন্ত্রাসীরা। এই তালিকায় রয়েছে- শীর্ষ সন্ত্রাসী ইমন, ইমামুল হাসান হেলাল ওরফে পিচ্চি হেলাল, আব্বাস আলী ওরফে কিলার আব্বাস, সুইডেন আসলাম, খন্দকার নাঈম আহমেদ ওরফে টিটন, খোরশেদ আলম ওরফে রাসু ওরফে ফ্রিডম রাসু, ফ্রিডম সোহেল, আরমান, হাবিবুর রহমান তাজ। কারাগার থেকে বেরিয়েই এদের বেশিরভাগই পুরান ক্যাডারদের পাশাপাশি নতুন মুখ দিয়ে বাহিনী ঢেলে সাজায়। এর পরই সন্ত্রাস, চাঁদাবাজিতে নতুন করে হাত পাকানো শুরু করে। শেখ হাসিনা সরকারের পতনের পর পুলিশি নিষ্ক্রিয়তার সুযোগে বিদেশে পলাতক শীর্ষ সন্ত্রাসীদেরও কেউ কেউ দেশে ফিরে আসছে। এই তালিকায় রয়েছে পুরস্কারঘোষিত শীর্ষ সন্ত্রাসী ত্রিমতি সুব্রত বাইন ও টোকাই সাগর। আবার কারামুক্তির পর বিদেশে চলে গেছে কিলার আব্বাস ও আরমান।
সূত্র আরও বলেছে, ঢাকায় একের পর খুনের ঘটনার পর ১৯৯৮ সালে সুইডেন আসলাম, যোশেফ, বিকাশ ও প্রকাশকে ধরতে ৫০ হাজার টাকা করে প্রথম পুরস্কার ঘোষণা করে সরকার। এরপর ২০০১ সালের ১ অক্টোবর বিএনপি নেতৃত্বাধীন চারদলীয় জোট সরকার ক্ষমতাসীন হওয়ার পর খুনোখুনি ও সন্ত্রাস-চাঁদাবাজি বেড়ে গেলে ঢাকার ২৩ শীর্ষ সন্ত্রাসীকে ধরিয়ে দিতে পুরস্কার ঘোষণা করে। কিন্তু কখনও শীর্ষ সন্ত্রাসী ইমনকে ধরতে পুরস্কার ঘোষণা করা হয়নি। ২০০৮ সালে তাকেসহ ঢাকার আট সন্ত্রাসীকে ভারত থেকে ফেরত আনে পুলিশ। সেই থেকেই কারাগারে ছিল ইমন। কারাগারে বসেই সে খুনোখুনি ও চাঁদাবাজি নিয়ন্ত্রণ করে আসছিল। তার বিরুদ্ধে একাধিক খুনসহ ৩৩টি মামলা রয়েছে।
পুলিশ, গোয়েন্দা ও আন্ডারওয়ার্ল্ড সূত্রে জানা গেছে, ৫ আগস্টের পর কারাগার থেকে বেরিয়ে ইমন, পিচ্চি হেলাল, সুইডেন আসলামসহ অন্য শীর্ষ সন্ত্রাসীরা নতুন মুখ দিয়ে ক্যাডার বাহিনী ঢেলে সাজিয়েছে, যাতে প্রশাসনের লোকজন তাদের চিনতে না পারে। শীর্ষ সন্ত্রাসী সুইডেন আসলাম এরই মধ্যে ফার্মগেট, কাওরানবাজার এবং আশপাশ এলাকায় দখল চাঁদাবাজি শুরু করেছে। ইমন ধানমন্ডি, নিউমার্কেট, জিগাতলা, গুলশান-বনানী, এলিফেন্ট রোডসহ আশপাশের এলাকায় ব্যাপক চাঁদাবাজি শুরু করেছে। দখল-বেদখলেও তার বাহিনী টাকার বিনিময়ে কাজ করছে। গত এক মাসে ইমন ধানমন্ডি ও জিগাতলা এলাকায় অন্তত ২০টি পয়েন্ট থেকে বিপুল অঙ্কের চাঁদাবাজি করেছে। আর পিচ্চি হেলাল মোহাম্মদপুর, আগারগাঁওসহ আশপাশের এলাকায় দখল চাঁদাবাজি করছে বলে পুলিশ ও আন্ডারওয়ার্ল্ড সূত্র জানিয়েছে। টোকাই সাগর বিদেশ থেকে দেশে ফিরে এয়ারপোর্টের নিয়ন্ত্রণ নিতে নানা চেষ্টা চালাচ্ছে।
সূত্র জানিয়েছে, ছাত্র-জনতার আন্দোলনের সময় ঢাকার থানা, ফাঁড়ি থেকে যেসব অস্ত্র গোলাবারুদ লুট হয়েছে, তার একটি অংশ হাতবদল হয়ে ঢাকার শীর্ষ সন্ত্রাসীদের কাছে এসেছে। সেই অস্ত্র ব্যবহৃত হচ্ছে সন্ত্রাস, চাঁদাবাজি, অপহরণ ও খুনোখুনিতে। পেশিশক্তি বাড়াতে শীর্ষ সন্ত্রাসীরা নতুন মুখের তরুণ সন্ত্রাসীদের হাতে এসব অস্ত্র তুলে দিয়েছে। তাদের খুনোখুনি, চাঁদাবাজি, সন্ত্রাসের কারণে ঢাকার আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়ে উদ্বেগ তৈরি হয়েছে জনমনে। পুলিশ-র্যাবকেও শীর্ষ সন্ত্রাসীদের অপতৎপরতার দিকটা ভাবিয়ে তুলেছে। তাদের ধরতে ঢাকার পুলিশ কমিশনার এরই মধ্যে একাধিক টিম মাঠে নামিয়েছেন। বিভিন্ন সোর্সের মাধ্যমে খোঁজখবর নিচ্ছেন শীর্ষ সন্ত্রাসীদের বিষয়ে।
পুলিশের যতটুকু ব্যর্থতা, অপরাধীদের ততটুকুই দৌরাত্ম্য : ড. তৌহিদুল হক
সমাজ ও অপরাধ বিশেষজ্ঞ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের (ঢাবি) সহযোগী অধ্যাপক তৌহিদুল হক বলেন, পুলিশ এখনও পরিপূর্ণভাবে আইন প্রয়োগ করতে পারছে না। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর যতটুকু ব্যর্থতা, অপরাধীদের ততটুকুই দৌরাত্ম্য বাড়বে। আবার কোথায়ও কোথায়ও আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরা নিজেরাই হেনস্তার শিকার হচ্ছেন। এসব ঘটনা যখন চলতে থাকে, তখন অপরাধীরা আরও সক্রিয় হয়ে ওঠে। তিনি আরও বলেন, ৫ আগস্টের পর জামিনে বের হওয়া সন্ত্রাসীরা নানা ধরনের অপরাধ করছে। পুরান দলগুলোকে সক্রিয় করছে। অপরাধ প্রতিরোধে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর পাশাপাশি সামাজিক ও রাজনৈতিক প্রতিরোধ গড়ে তুলতে হবে।
ইমন-পিচ্চি হেলালকে গ্রেপ্তারের চেষ্টা চলছে : ডিএমপির ডিবি প্রধান
হত্যাসহ একাধিক মামলা হওয়ায় সন্ত্রাসী কর্মকা-ে সম্পৃক্ত ‘পিচ্চি হেলাল’ ও ইমনকে গ্রেপ্তারের চেষ্টা চলছে বলে জানিয়েছেন ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের (ডিবি) প্রধান রেজাউল করিম মল্লিক। গতকাল মঙ্গলবার রাজধানীর মিন্টো রোডের ডিএমপি মিডিয়া সেন্টারে আয়োজিত সংবাদ সম্মেলনে এ কথা জানান তিনি।
মল্লিক বলেন, চাঁদাবাজ, ছিনতাইকারী, মাদক ব্যবসায়ী অথবা অবৈধ কোনো কাজ করলে তাকে অবশ্যই আইনের আওতায় নেওয়া হবে। অতিরিক্ত পুলিশ কমিশনার বলেন, বর্তমান পরিস্থিতির সুযোগ নিয়ে চিহ্নিত সন্ত্রাসী, চাঁদাবাজ ও ছিনতাইকারীরা মাথাচাড়া দিয়ে উঠছে। অবৈধ মজুদদার, সন্ত্রাসী, চাঁদাবাজ, ছিনতাইকারী ও মাদক ব্যবসায়ীদের বিরুদ্ধে গোয়েন্দা পুলিশের কঠোর অবস্থান অব্যাহত রয়েছে। সাম্প্রতিক সময়ে দেশব্যাপী পুলিশের গোয়েন্দা বিভাগের কর্মকা- জোরদার করা হয়েছে। এরই ফলশ্রুতিতে সর্বশেষ ২৪ ঘণ্টায় ঢাকা মহানগরের বিভিন্ন জায়গায় অভিযান পরিচালনা করে ২৭ অপরাধীকে গ্রেপ্তার করেছে ডিবি।