ঢাকা আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র উৎসবে আজ প্রদর্শিত হবে তৌফিক ইলাহি পরিচালিত চলচ্চিত্র ‘নীলপদ্ম’। এ সিনেমায় অভিনয় করেছেন রুনা খান। সিনেমায় অভিনয় ও অন্যান্য প্রসঙ্গে কথা হয় জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কারপ্রাপ্ত এ অভিনেত্রীর সঙ্গে। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন- তারেক আনন্দ
ঢাকা আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র উৎসবে প্রদর্শিত হচ্ছে আজ আপনার অভিনীত চলচ্চিত্র ‘নীলপদ্ম’। নিশ্চয়ই আপনি উচ্ছ্বসিত?
জাতীয় জাদুঘরে আজ সন্ধ্যা ৭টায় প্রদর্শন করা হবে ‘নীলপদ্ম’। পরিচালক তৌফিক ইলাহির সঙ্গে আমার প্রথম কাজ। এটি তার প্রথম পূর্ণদৈর্ঘ্য ছবি। ঢাকা চলচ্চিত্র উৎসবে প্রথম প্রিমিয়ার হচ্ছে। এর আগে সুচিত্রা সেন আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র উৎসবে প্রদর্শন করা হয়। ঢাকা চলচ্চিত্র উৎসবে ১৯ তারিখ নর্থসাউথ অডিটরিয়ামে বিকাল তিনটায় আরেকটি শো প্রদর্শন করা হবে। ঢাকা চলচ্চিত্র উৎসবে আমাদের দেশের বেশ কয়েকটি সিনেমা প্রদর্শন করা হচ্ছে। আমার খুবই ভালো লাগছে। সিনেমায় আমার চরিত্রের নাম নীলা। যৌনকর্মীর জীবনের মধ্য দিয়ে ওই সম্প্রদায়ের জীবন-যাপন, সংগ্রাম, সামাজিক অবস্থানÑ সবকিছু বলার চেষ্টা করা হয়েছে। নীলপদ্ম হচ্ছে নীলার জীবনের গল্প। নীলার জীবনের মধ্য দিয়েই একটি সম্প্রদায়ের গল্প বলা হয়েছে।
এ সিনেমায় আপনি একজন যৌনকর্মীর ভূমিকায় অভিনয় করেছেন। শুটিংকালের অভিজ্ঞতা কেমন ছিল?
একটু বলতে চাইÑ পরিচালক তৌফিক ইলাহির সঙ্গে আমার পরিচয় ছিল না। এই সিনেমার মাধ্যমেই প্রথম পরিচয়। মূলত এই চরিত্রে আমাকে কাস্ট করেছেন অভিনেতা আবদুন নূর সজল ভাই। তৌফিক ভাই এবং সজল ভাই দুজনই জাহাঙ্গীরনগর বিশ^বিদ্যালয়ে পড়াশোনা করেছেন। তারা পূর্বপরিচিত। গল্পটা এমন যে, তৌফিক ভাই কাস্টিংয়ের ব্যাপারে কথা বলছিলেন। তখন সজল ভাই তাকে বলেন, এই চরিত্রটা রুনা হতে পারে। আপনি রুনার সঙ্গে কথা বলে দেখতে পারেন। সজল ভাই আমাকে ফোনে জানান, আমার বিশ^াবিদ্যালয়ের বড় ভাই সিনেমা বানাবেন। আমার কাছে মনে হয়েছে তুই এই চরিত্র ভালো করতে পারবি, একটু কথা বলে দেখ। তার পর তৌফিক ভাই আমাকে ফোন দিলেন। স্ক্রিপ্ট পাঠালেন। আমার গল্প, চরিত্র পছন্দ হলো। আমি নীলা চরিত্রে রাজি হলাম। আমার একজন সহকর্মী, তার গল্প শুনে মনে হয়েছে, আমি কাজ করতে পারি। সজল ভাই এখানে অভিনয় করেননি। তিনি এই সিনেমার সঙ্গে যুক্তও নন। একটি গুরুত্বপূর্ণ চরিত্রে আমাকে ভাবার জন্য আন্তরিক ধন্যবাদ, কৃতজ্ঞতা সজল ভাইয়ের প্রতি। এখানে একটু বলবার আছে- পরিচালক দীর্ঘ সময় এই শ্রেণির মানুষের জীবন নিয়ে গবেষণা করেছেন। তিনি নিজে একজন বিশ^বিদ্যালয়ের শিক্ষক। শুটিংয়ে তার গবেষণা, তিনি যে ধারণাগুলো পেয়েছেন; সেগুলো তিনি আমাকে গাইডলাইন হিসেবে তুলে ধরেছেন। এটা একটা দিক গেল পরিচালকের পক্ষ থেকে। তিনি আমাকে তার গবেষণার অনেক কিছু শেয়ার করেছেন। আমরা শুটিং করেছি মূলত দৌলতদিয়ার যৌনপল্লীতে। এই কাজের সুবাধেই আমার ওখানে যাওয়া হয়েছে। আমরা যে কদিন শুটিং করেছি, ওখানকার যারা বাসিন্দা, ওখানে যারা বসবাস করেন তারা প্রত্যক্ষভাবে আমাকে এবং আমার টিমকে পুরোপুরি সহযোগিতা করেছেন। যেমন একটি উদাহরণ দিই- একটা সিকোয়েন্স ছিল বিচার-শালিসের। আমরা যখন শুটিং করছিলাম তখন ওরা এসে বলল, এমন বিচার-শালিসে আমরা তো সবাই থাকি। আপনাদের এখানে কম লোক হয়ে যাচ্ছে। ওখানে যাওয়ার পর দৌলতদিয়ার কর্মীরা আমাদের টিমকে দারুণ সহযোগিতা করেছে। প্রত্যেকটা শটের ব্যাপারে, সাজের ক্ষেত্রেও। কস্টিউমের ক্ষেত্রে আমি যা নিয়ে গিয়েছিলাম, যাওয়ার পর দেখা গেখা গেলো খুব সাদামাটা হচ্ছে। তখন তাদেরই একজন একটা শাড়ি পরতে দিলেন। আপু তুমি এই শাড়িটা পরো। সারাদিন ওরা আমাদের কাছে আসছে, গল্প করছে। আশপাশে ছোট যে টংদোকান থাকে সেখান থেকে আচার কিনে নিয়ে আসছে। আচার খাবা কিনা? মুড়িমাখা নিয়ে আসছে। আপু এটা খেয়ে দেখো। ওরা এত সহযোগিতাপরায়ণ ছিল। জরি, চুমকি দেওয়া সব রকমের কাপড় তারা পরে। চরিত্রটা পর্দায় আমি নিজেই আজকে প্রথম দেখব। ১৫ ও ১৯ তারিখ দুদিনই আমি থাকব। দেখার পর উপলব্ধিটা বলতে পারবÑ দেখি কী হলো, কেমন হলো। সবার সহযোগিতা পেয়েছি। পরিচালক, সহশিল্পীদের; বিশেষ করে সিনেমাটোগ্রাফার ছিলেন নাহিয়ান বেলাল। তিনি খুবই সহযোগিতা করেছেন। নীলপদ্মের নীলা চরিত্র পর্দায় দেখে যদি বিশ^াসযোগ্য মনে হয়, তা হলেই আমি স্বার্থক, এ কৃতিত্ব সবার।
নীলা চরিত্রে অভিনয়ের পর রুনা খান নিজে কতটা সন্তুষ্ট হলেন?
আমি যদি সত্যি কথা বলি- প্রথমত আমি দেখিনি ছবিটা। এর পর একটা বিষয় আমি জানি, দেখার পর যেটা হবে, শুধু খুঁতগুলো, ভুলগুলো দেখতে পাব। আমার কাজ আমাকে কখনও সন্তুষ্ট করতে পারে না। অভিনয় দেখার পর মনে হয়, এই জিনিসটা করতে পারলে ভালো হতো। আরও বিশ^াসযোগ্য করা যেত। এবারও তা-ই মনে হচ্ছে, এখানে বেশি করেছি, এমন করা যেত। এটা না করে, ওই ডেলিভারিটা দিলে ঠিক হতো। তবে সহশিল্পীরা- রাশেদ মামুন অপু, একে আজাদ সেতু, সুজাত শিমুল, রোকেয়া প্রাচী আপা, শাহেদ আলী ভাই দৌলতদিয়ার অনেকে সহশিল্পী হিসেবে কাজ করেছেন; তাদের প্রতি কৃতজ্ঞ।
এবার একটু পেছনে ফিরে যাই- দীর্ঘদিনের চেনা রুনা খানকে বদলে নতুনভাবে নিজেকে হাজির করলেন। এটা যেমন আপনার জন্য চ্যালেঞ্জ ছিল, ঠিক দর্শকরা নতুন রুনা খানকে কীভাবে নিচ্ছে?
২০০৫ সালে পেশাগতভাবে সিসিমপুরের মধ্য দিয়ে কাজটা শুরু করি। ওই সময় আমি সিদ্ধান্ত নিয়েছি, আমি অভিনেতা এবং মডেল হিসেবে কাজ করব। সে হিসেবে আজ পর্যন্ত আমার কাছে যত রকম কাজের প্রস্তাব এসেছে মডেল বা অভিনেতা হিসেবে; আমার যেটা মনে হয়েছে, আমি এগুলোর সঙ্গে যুক্ত হতে চাই এবং সেভাবেই যুক্ত হয়েছি। আমার কাজ করার প্রসেসটা একদম নতুন মেয়েটা, যখন কাজ শুরু করেছিলাম সেই থেকে আজ পর্যন্ত একই প্রসেসে কাজ করেছি। আমি নাগরিকের হয়ে মঞ্চ নাটক করেছি বা বিজ্ঞাপনের প্রস্তাব পেয়েছি, টেলিভিশন নাটকের অফার পেয়েছি, ওটিটিতে কাজ করছি। একইভাবে কাজ করছি। ২০০৫ সালে সাপ্তাহিক ২০০০, আনন্দধারা নামে দুটি ম্যাগাজিন ছিল। শাহাদাত চৌধুরী ছিলেন সম্পাদক। এই গল্পটা এখন এজন্য বলছি, তখন আমরা ম্যাগাজিন দুটোর ফটোশুট করেছি। আমাদের সঙ্গে যোগাযোগ করতেন শাহাদাত চৌধুরীর মেয়ে শাশা চৌধুরী। রোজার ঈদ, কোরবানির ঈদÑ দুই ঈদের সব ফ্যাশন হাউসের পাঠানো পোশাকে আমরা মডেল হয়ে কাজ করতাম। স্টিল ফটোশুট করতাম। আমার স্পষ্টভাবে মনে আছে তিন্নি, আমি, ফারাহ রুমা, স্বাগতা, তানজিকা, অপুর্ব, নিশোসহ আরও অনেকে একসঙ্গে কাজ করেছি। এই শুট কিন্তু আমরা ২০০৫ থেকে ২০০৮ সাল পর্যন্ত করেছি। রোজার ঈদ, কোরবানির ঈদের সংখ্যাগুলো আমাদের ছবি দিয়ে ভরা থাকত ম্যাগাজিনে। এর পর ২০০৯ সালে আমার বিয়ে হলো। সন্তান জন্মের পর আমি একটা লম্বা বিরতিতে যাই। তার পর ব্যাক করি। সে সময় সিদ্ধান্ত নিয়েছি, যেহেতু আমার কাজের পাশাপাশি সন্তান, পরিবারকে বড় একটা সময় দিতে হয়, তাই আমি কাজের সংখ্যা কমিয়ে দিলাম। তারই ধারাবাহিকতায় ২০১৩ থেকে ১৯ পর্যন্ত বেছে বেছে কাজ করেছি। শুধু তিন বছর মাত্র একটা ধারাবাহিক নাটক ফ্যামিলি ক্রাইসিসে। কোভিডের সময় আমার ব্যক্তিগত জার্নি ছিল ওয়েটলস। অসংখ্যবার বলেছি যে, এর সঙ্গে আমার পেশাগত কোনো সম্পর্ক নেই। গত দশ বছর আমার শরীরে অতিরিক্ত ওজন থাকার কারণে নানা সমস্যায় পড়তে হয়েছে। সেগুলো থেকে ওভারকাম করতে আমি ওজন কমানোর চেষ্টা করি। এর আগে চেষ্টা করেছি পারিনি, ফাইনালি আমি পেরেছি। ওজন কমানোর পর আমার সঙ্গে যোগাযোগ করেন আমাদের রেডের বিউটিশিয়ান আফারোজা পারভীন আপু। তিনি আমার সঙ্গে কথা বলেন, বিদ্যা সিনহা মিমের বিয়ের দিন। একদম খাবার টেবিলে। রুনা তোকে নিয়ে আমি একটা শুট করতে চাই। তখন সেই শুটের কস্টিউম ডিজাইনার হিসেবে যুক্ত হন শাহরুখ আমিন। ওটা ছিল আমার ওজন কমনোর পর প্রথম শুট। মেকাপে আফরোজা আপু। তার পর থেকে যতগুলো শুট করেছি, প্রতিটি শুটই দেশের পেশাদার ডিজাইনারদের পোশাকের মডেল হয়ে। আমি আগের গল্পটা এজন্য বললাম, ওই শাশা আপুদের সময়ে যে কাজগুলো করতাম এখনও সেই একই কাজ করছি। যে বিখ্যাত ডিজাইনারদের হয়ে গত দুবছর ধরে কাজ করছি তাদের প্রত্যেকের সঙ্গে জয়া আপা, মেহজাবীন, মিম, তাসনিয়া ফারিনরা কাজ করছে। এগুলোর প্রথম কথা হচ্ছে- পেশাগত কাজ, যেহেতু আমি মডেল।
আপনি যেটা বলেছেন সেটা আমি বুঝেছি বা আমাকেও ফেস করতে হয়। সিনেমা এবং নাটকে এত বেশি পাশের বাড়ির মেয়ে বা নিজেদের ঘরের মেয়ে চরিত্রে কাজ করেছি। যেমনÑ সিসিমপুরের সুমনা নিজেদের ঘরের মেয়ে, বিটিভির প্রথম কাজ আমার। একটা প্রজন্ম বড় হয়েছে সিসিমপুর দেখে। এর পর গ্রামীণফোনের বিজ্ঞাপনচিত্র, স্টেশনের ওয়েটিং রুম। মধ্যবিত্ত পাশের বাড়ির একটা মেয়ের চরিত্র ছিল। চলচ্চিত্র হালদা, ছিটকিনি বা সর্বশেষে জনপ্রিয় ধারাবাহিক ফ্যামিলি ক্রাইসিসের কথা যদি বলেন। এগুলো সব চরিত্র ছিল দর্শকের আপন। আমি প্রান্তিক মানুষ থেকে শুরু করে উচ্চবিত্তের চরিত্রে অভিনয় করতে চাই। একই ধরনের চরিত্রে সারাজীবন ধরে কাজ করতে চাই না। সেই জায়গা থেকে একটা চ্যালেঞ্জ আছে। কারণ আমার যে কাজগুলো জনপ্রিয় হয়েছে, দর্শক বেশি মনে রেখেছেনÑ মিষ্টি, ঘরোয়া মেয়ে রুনাকে। এখন তারা এত গ্ল্যামারাস রূপে দেখতে চায় না, এটা দর্শকদের মনে হতেই পারে। মিশ্র প্রতিক্রিয়া আছে, প্রতিক্রিয়াটা থাকা স্বাভাবিক। আমি ভীষণরকম ভালোবাসা, প্রশংসা যেমন পেয়েছি, আবার অনেকে সমালোচনাও করেছে। দুটোকেই আমি স্বাগত জানাই। যেটা বলতে চাই, আমি পেশাদার অভিনেতা, মডেল। আমি সব ধরনের, সব চরিত্রে কাজ করতে চাই।
এখন ধারাবাহিক নাটকই কমে গেল। ধারাবাহিককে মিস করেন না?
আমার সন্তান জন্মের পর বিরতি শেষে যখন ২০১৩ সালে বেশকিছু ধারাবাহিকে কাজ করেছিলাম। ২০১৪ সালে সিদ্ধান্ত নিয়েছি, সংখ্যায় অনেক বেশি কাজের সঙ্গে যুক্ত থাকলে পরিবারকে সময় দেওয়া কঠিন হয়ে যায়। তখন আমার কাছে মনে হয়েছে মাসে পাঁচ দিন কাজ করব। আমি বড় ধারাবাহিক করেছি মাত্র দুটি। একটি মাহফুজ আহমেদের পরিচালনায় ‘আমাদের ছোট নদী চলে বাঁকে বাঁকে’Ñ এটি দুই বছর শুটিং করেছি। এর পর ২০১৯ থেকে ’২২ সাল পর্যন্ত মুহাম্মদ মোস্তফা কামাল রাজের ‘ফ্যামিলি ক্রাইসিসে’ কাজ করেছি। এই দুটি ছাড়া বলার মতো কোনো ধারাবাহিকে অভিনয় করিনি। এর মাঝে মাঝে একক নাটক, টেলিছবি বা সিনেমা করেছি। আমার কাজের সংখ্যা বিয়ের পর ২০টিও হবে না। যেমন এক বছরে একটা সিনেমা করেছি ‘ছিটকিনি’, পরের এক বছরে ‘হালদা’। ওটিটিতে যুক্ত হলাম তখন আশফাক নিপুণের ‘কষ্টনীড়’, চরকিতে ‘আত্মনগর’, গত বছর মুক্তি পেল কাজল আরেফিন অমির ‘অসময়’। এই সময়ের মধ্যে মঞ্চে আসাদুজ্জামান নূরের নির্দেশনায় ‘দেওয়ান গাজীর কিস্সা’তে অভিনয় করেছি। যেখানে সহশিল্পী ছিলেন আলী যাকের, আবুল হায়াৎ, সারা যাকের। তাদের মতো অভিনেতাদের সঙ্গে কাজ করার সুযোগ পেয়েছি। সব মিলিয়ে আমি বলতে চাই আমি শুধু অভিনয় করতে চাই। মাধ্যমকে আলাদা করতে চাই না।