দেশের কৃষিক্ষেত্রে ডিজিটালাইজেশনের সুবিধা পাচ্ছেন কৃষকরা

হাওর বার্তা ডেস্কঃ বিভিন্ন ধরনের অ্যাপসের প্রচলন এবং বিভিন্ন এলাকায় কম্পিউটার ভিত্তিক তথ্য কেন্দ্রের কার্যক্রমের মাধ্যমে দেশের কৃষিক্ষেত্রে ডিজিটালাইজেশনের সেবার প্রসার ঘটছে।

কৃষি তথ্য সার্ভিস (এআইএস) সূত্রে জানা যায়, কৃষকদের আরো উন্নত সেবা প্রদানের লক্ষ্যে কৃষি বিভাগ আরো বেশি সংখ্যাক মোবাইলভিত্তিক অ্যাপস প্রচলন ও উন্নয়নের জন্য কাজ করে যাচ্ছে।

কৃষি তথ্য সার্ভিসের কর্মকর্তাদের মতে, গত কয়েক বছরে চালু হওয়া বেশ কয়েকটি অ্যাপস কৃষকদের জন্য ফলদায়ক হিসেবে প্রমাণিত হয়েছে। বিশেষত, কৃষকদের যথাসময়ে কৃষিবিষয়ক তথ্য প্রদান এবং পণ্যের ন্যায্য মূল্য প্রাপ্তি নিশ্চিত করার ক্ষেত্রে এগুলো কার্যকর।

এ রকমই একটি গুরুত্বপূর্ণ ‘অ্যাপ’ হচ্ছে ‘ডিজিটাল ই-পূর্জি’। কয়েকবছর আগে দেশের চিনিকলগুলোতে আখ চাষিদের কাছে দ্রুত ‘ডেলিভারি অর্ডার’ পৌঁছানোর জন্য এর প্রচলন করা হয়। ‘ই-পূর্জি’ ব্যবস্থার মাধ্যমে চাষীরা তাৎক্ষণিকভাবে তাদের মোবাইল ফোনে ‘এসএমএস’-এর মাধ্যমে চিনিকল কর্তৃপক্ষের আখ বিক্রয় আদেশ পেয়ে থাকে।

ডিজিটাল বাংলাদেশ গড়ার লক্ষ্যে আধুনিক কৃষি প্রযুক্তি ও তথ্যাদি কৃষকের দোড় গোড়ায় পৌঁছাতে দেশের দশটি কৃষি অঞ্চলে গ্রাম পর্যায়ে ৪৯৯টি কৃষি তথ্য ও যোগাযোগ কেন্দ্র (এআইসিসি) স্থাপন করেছে সরকারের কৃষি তথ্য সার্ভিস। এ রকম আরো ১৫০টি এআইসিসি স্থাপনের বিষয় প্রক্রিয়াধীন।

পাশাপাশি, কমিউনিটি রুরাল রেডিও (কৃষি রেডিও), কৃষি কলসেন্টার, মেবাইল অ্যাপস, ওয়েবসাইট, ই-বুক, আইসিটি ল্যাব, কৃষি ইনফরমেশন বুথ (কিয়স্ক) প্রভৃতির মাধ্যমে কৃষি ক্ষেত্রে ডিজিটালাইজেশন ঘটছে। এই কার্যক্রমে সহায়ক হিসেবে কাজ করছে প্রিন্ট মিডিয়া, বেতার, টেলিভিশন।

কৃষি তথ্য সার্ভিসের পরিচালক কৃষিবিদ ড. মো. জাহাঙ্গীর আলম রাজধানীর খামারবাড়িতে তার কার্যালয়ে বাসসকে এসব কথা বলেন। তিনি বলেন, ‘কৃষি মন্ত্রণালয়ের অধীনস্থ এই সংস্থাটি গ্রাম পর্যায়ে ৪৯৯টি কৃষি তথ্য ও যোগাযোগ কেন্দ্র (এআইসিসি) স্থাপন করেছে। এর মাধ্যমে গ্রামের তৃণমূল পর্যায়ে কৃষি তথ্য প্রযুক্তিকে কৃষক ব্যবহার উপযোগী আকারে কৃষকের দ্বারপ্রান্তে পৌঁছে দেয়ার ব্যবস্থা করছে। কৃষি তথ্য সার্ভিসের সার্বিক তত্ত্বাবধানে কৃষি তথ্য ও যোগাযোগ কেন্দ্র সম্পূর্ণ কৃষক দ্বারা পরিচালিত হচ্ছে। এসব কেন্দ্রের লক্ষ্য হলো কৃষকের চাহিদামাফিক আধুনিক কৃষি প্রযুক্তি বা তথ্য সময়মতো কৃষক বা সংশ্লিষ্টদের কাছে সহজলভ্য করা’।

তিনি জানান, অনলাইনে ভিডিও কনফারেন্সিং এর মাধ্যমে বিশেষজ্ঞ পরামর্শ কৃষি তথ্য সার্ভিস থেকে প্রদান করা হচ্ছে। এসব কেন্দ্রে প্রশিক্ষণসহ সকল আইসিটি উপকরণ (কম্পিউটার, ল্যাপটপ, প্রিন্টার, মডেম, ক্যামেরা ইত্যাদি) সরবরাহ করা হয়েছে। গ্রাম পর্যায়ে স্থাপিত এসব এআইসিসিতে কৃষকদের মাঝে তথ্য সেবা প্রদান করা হচ্ছে। আরো ১৫০টি এআইসিসি স্থাপনের বিষয় প্রক্রিয়াধীন রয়েছে বলে তিনি উল্লেখ করেন।

প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত কৃষক এসব তথ্য ইন্টারনেটের মাধ্যমে সংগ্রহ করে কৃষি তথ্য ও যোগাযোগ কেন্দ্র বা এআইসিসির সদস্য ও প্রতিবেশী কৃষকের মাঝে পৌঁছে দেন। কোন কৃষক কৃষিবিষয়ক কোনো সমস্যার সম্মুখীন হলে সরবরাহকৃত মোবাইলের সাহায্যে এআইএসের কর্মকর্তাদের সঙ্গে যোগাযোগ করে সমাধান নেন।
কৃষিবিষয়ক সমস্যা মুখে সঠিকভাবে উপস্থাপন করা না গেলে বা ই-মেইলে সঠিক বিবরণ তুলে ধরা সম্ভব না হলে ওয়েব ক্যামেরা সাহায্যে ছবি তুলে রোগাক্রান্ত বা পোকায় আক্রান্ত ফসলের ছবি, পুষ্টির অভাবজনিত লক্ষণ ছবিসহসহ ই-মেইল করতে পারেন বা ওয়েব ক্যামের সামনে সমস্যা-বস্তুটি নিয়ে এসে সরাসরি ছবি দেখিয়ে ও আলোচনার মাধ্যমে সমস্যার সমাধান পেতে পারে।

কৃষি তথ্য সার্ভিসের কর্মকর্তারা জানান, মোবাইল ফোনের কৃষক, জেলা ও উপজেলা পর্যায়ের সম্প্রসারকর্মীদের কাছে কৃষি তথ্য প্রযুক্তি পৌঁছাতে কৃষি তথ্য সার্ভিস, প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের ‘এটুআই’ এবং বাংলালিংকের মধ্যে ত্রিপক্ষীয় চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়েছে। বর্তমানে মোবাইল এসএমএস এর মাধ্যমে লক্ষ্যাভীষ্ঠদের নিকট তথ্য সেবা বিতরণ করা হচ্ছে এবং আগামীতে আইভিআর, ফোন-ইন-কলসহ আরো কিছু সেবা কার্যক্রম শুরু করা হবে।

কৃষিবিদ ড. জাহাঙ্গীর আলম জানান, সরাসরি কৃষি বিশেষজ্ঞদের সঙ্গে কথা বলে তাৎক্ষণিকভাবে কৃষিবিষয়ক বিভিন্ন সমস্যার সমাধান দিতে নিরলসভাবে কাজ করছে কৃষি তথ্য সার্ভিস ও প্র্যাকটিক্যাল অ্যাকশনের যৌথ উদ্যোগে প্রতিষ্ঠিত কৃষি কল সেন্টার। যে সেন্টারটিতে যে কেউ বাংলাদেশের যে কোনো প্রান্ত থেকে যে কোনো মোবাইল থেকে কল করতে পারেন ১৬১২৩ নম্বরে। পেতে পারেন কৃষি, মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ, বন, পরিবেশ, পুষ্টি বিষয়ক যে কোনো সহজ সরল সময়োপযোগী পরামর্শ। এ সেন্টারটি শুক্রবার ও সরকারি ছুটি ব্যতীত সকাল ৯টা থেকে বিকাল ৫টা পর্যন্ত খোলা থাকে কৃষক ও কৃষির সেবায়।

কৃষি তথ্য সার্ভিস সূত্রে জানা যায়, দেশের কয়েকটি জায়গায় বর্তমান কমিউনিটি রুরাল রেডিও (কৃষি রেডিও) স্থাপন করা হয়েছে। এর মধ্যে ‘আমার রেডিও আমার কথা বলে’ শীর্ষক স্লোগান নিয়ে বরগুনা জেলার আমতলীতে অবস্থিত কমিউনিটি রেডিওর মাধ্যমে কৃষি রেডিও এফএম ৯৮.৮ নামে বরগুনা ও পটুয়াখালী জেলার ১২টি উপজেলায় গ্রামীণ কল্যাণ ও চাহিদাভিত্তিক কৃষিসহ অন্যান্য অনুষ্ঠান সম্প্রচার করা হয়ে থাকে। কৃষি রেডিও স্বেচ্ছাশ্রমে পরিচালিত এই রেডিও প্রতিদিন ৮ ঘণ্টা করে সম্প্রচার (সকাল ৯টা থেকে ১১টা এবং বিকাল ৩টা থেকে রাত ৯টা পর্যন্ত) করে।

কৃষিবিষয়ক আধুনিক তথ্য ও প্রযুক্তি সহজলভ্য করতে দুইটি মোবাইল আ্যাপস তৈরি করা হয়েছে। এর একটি কৃষিকথা পত্রিকার। অন্যটি ই-কৃষিভিত্তিক। আ্যাপস দুইটি গুগল প্লে স্টোর থেকে ‘কৃষিকথা’ এবং ‘এগ্রিকালচার ইনফরমেশন সার্ভিস’ নামে সার্চ দিয়ে সম্পূর্ণ বিনামূল্যে ডাউনলোড করার সুবিধা রয়েছে।

কৃষিতে ডিজিটালাইজেশনের অংশ হিসাবে চালু করা হয়েছে কৃষি তথ্য সার্ভিসের নিয়মিত হালনাগাদ করা টেক্সট, অডিও, ভিডিও, নিউজভিত্তিক একটি ওয়েবসাইট। হালনাগাদ কৃষিবিষয়ক তথ্যসমৃদ্ধ http://www.ais.gov.bd/ ওয়েবসাইট কৃষি’র চলমান চাহিদা পূরণ করছে।

কৃষির উন্নয়নের লক্ষ্যে ঢাকা, রাজশাহী, রংপুর, সিলেট, চট্টগ্রাম, রাঙ্গামাটি, খুলনা, বরিশাল, কুমিল্লা ও ময়মনসিংহ জেলায় একটি করে দশটি আইসিটি ল্যাব রয়েছে। এসব আইসিটি ল্যাবের মাধ্যমে বছরব্যাপী কৃষক, সম্প্রসারণ কর্মী, কর্মকর্তাসহ সংশ্লিষ্টদের ই-কৃষি বিষয়ক প্রশিক্ষণ দেয়া হচ্ছে।

এরই মধ্যে চালু করা হয়েছে কৃষি ইনফরমেশন বুথ (কিয়স্ক)। টাচ স্ক্রিনের মাধ্যমে সহজেই এ বুথ (কিয়স্ক) থেকে কৃষি বিষয়ক অনলাইন-অফলাইন কৃষি তথ্য পাচ্ছেন। প্রয়োজন হলে প্রিন্ট করে নেয়ার সুযোগ রয়েছে। বর্তমানে ১১টি কিয়স্ক তৈরি হয়েছে। এছাড়াও রয়েছে কৃষি ডাইরি। এর মধ্যে ফোন ই-মেইল, সাধারণ ডাইরি এবং কৃষির আধুনিক ও হালনাগাদ তথ্যপ্রযুক্তি সন্নিবেশিত থাকে। তথ্যপ্রযুক্তি বিস্তারে অন্যতম মাধ্যম ফোন, ই-মেইল, ওয়েবসাইট ও কৃষি সংশ্লিষ্টদের যোগাযোগের ঠিকানাও এ ডাইরিতে সংযুক্ত হয়েছে। উল্লেখ্য, কৃষি তথ্য সম্প্রচারের নিমিত্তে বাংলাদেশ বেতার ও টেলিভিশনের সাথে ৫০ বছর মেয়াদী চুক্তি করেছে কৃষি তথ্য সার্ভিস।

কৃষিবিদ ড. মো. জাহাঙ্গীর আলম বলেন, ‘ডিজিটাল বাংলাদেশ’ গঠনে অন্যান্য খাতের সাথে তাল মিলিয়ে কৃষিখাতেও তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তির ব্যবহার হচ্ছে। বর্তমান কৃষিবান্ধব সরকার কৃষি ও কৃষকের বিভিন্ন সমস্যা সমাধানে তথ্যপ্রযুক্তি ব্যবহারের উপর গুরুত্ব দিচ্ছে উল্লেখ করে তিনি বলেন, ‘তথ্যপ্রযুক্তির ব্যবহারের ফলে কৃষি উৎপাদন বাড়ছে’।

সরকারি উদ্যোগের পাশাপাশি কয়েকটি আন্তর্জাতিক ও স্থানীয় সংগঠন কৃষকদের ডিজিটাল সেবা প্রদানের লক্ষ্যে কাজ করছে। কৃষকদের জন্য ‘ইন্টেলিজেন্ট ডিসিশন সাপোর্ট সিস্টেম’ (আইডিএসএস) নামের একটি ডিজিটাল কৃষি যন্ত্র ২০১৮ সালে প্রচলনের পরিকল্পনা রয়েছে। যন্ত্রটির ব্যবহার শেখানো এবং এর সুফল পাওয়ার উপায় সম্পর্কে কৃষকদের অবহিত করার লক্ষ্যে কৃষি সম্প্রসারন অধিদপ্তর, এসিআই লিমিটেড, এসএনভি নেদারল্যান্ডস ডেভেলপমেন্ট অর্গানাইজেশন এবং নেদারল্যান্ডস স্পেস অফিস একসাথে কাজ করছে।

কৃষকদের ফসলভিত্তিক তথ্য ও পরামর্শ প্রদানের লক্ষ্যে ‘আইডিএসএস’ প্রণয়ন করা হয়েছে। এর মাধ্যমে কৃষকরা সার, কীটনাশকসহ বিভিন্ন কৃষি উপকরণ কার্যকরভাবে ব্যবহার করতে পারবে। এই পদ্ধতিতে কৃষকরা বৃষ্টিপাত, খরা অথবা বন্যার পূর্বাভাস পাবেন।

কৃষকরা স্মার্ট ফোন ব্যবহারের মাধ্যমে আইডিএসএস-এর সাথে সংযুক্ত হতে পারবে। প্রাথমিক পর্যায়ে ১২ জেলার কৃষকরা কৃষিকাজের জন্য গুরুত্বপূর্ণ পাঁচ তথ্য এর মাধ্যমে পাবেন। গ্লোবাল কমপ্যাক্ট মালয়েশিয়ার সহযোগিতায় জাতিসংঘ উন্নয়ন কর্মসূচি (ইউএনডিপি) ২০১৭ সালের সেপ্টেম্বরে অধিকতর সুবিধাজনক বাজার সুবিধা নিশ্চিত করার লক্ষে ১০ হাজার ক্ষুদ্র কৃষককে ডিজিটাল সহায়তা দেওয়ার জন্য একটি প্রচারণা শুরু করে।

প্রচার শেষে স্থানীয় বাজার ও ভ্যালু চেইনগুলোতে সংযুক্ত হওয়া এবং অর্থ সংগ্রহের লক্ষ্যে কৃষকরা মোবাইল ডিভাইসগুলোতে ও প্রযুক্তিগত প্রবেশাধিকার পাবেন। এই উদ্ভাবনের ফলে ক্ষুদ্র কৃষকরা উদ্যোক্তায় পরিণত হবেন। কয়েক বছর আগে বগুড়া জেলায় কৃষকরা ধান চাষের জন্য ‘টেগরা’ নামে এ ধরনেরই আরেকটি প্রযুক্তির সঙ্গে পরিচিত হয়েছিলেন।

Print Friendly, PDF & Email

     এ ক্যাটাগরীর আরো খবর