কৃষিজমি কমে যাওয়া রোধ করুন

কৃষিজমির পরিমাণ দিন দিন আশঙ্কাজনক হারে কমে যাচ্ছে। জনসংখ্যার ঘনত্বের কারণে রাজধানীসহ দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে কৃষিজমি ব্যবহার হচ্ছে নগরায়নে। শিল্পকারখানা ও বিভিন্ন ধরনের স্থাপনায় গত এক-দেড় দশকে এ চিত্র ব্যাপকভাবে পরিলক্ষিত হচ্ছে। অর্থনীতিবিদেরা কৃষিজমিতে গড়ে ওঠা নগরায়ন ও শিল্পকারখানা গড়ে ওঠাকে জাতীয় অর্থনীতির জন্য হুমকি বলে মনে করছেন। কৃষিবিদেরাও একই অভিমত ব্যক্ত করে এর সাথে শঙ্কার দিকটি তুলে ধরেছেন।
গত এক দশকে প্রতি বছর গড়ে ৬৮ হাজার ৭০০ হেক্টর ফসলি জমি কমেছে। জাতিসঙ্ঘ খাদ্য ও কৃষি সংস্থা, ইউরোপীয় ইউনিয়ন ও ইউএসএইডের অর্থায়নে পরিচালিত এক গবেষণা প্রতিবেদনের তথ্য মতে, ১৯৭৬ সালে কৃষিজমির পরিমাণ ছিল ৯৭ লাখ ৬১ হাজার ৪৫০ হেক্টর। ২০০০ সাল পর্যন্ত তিন লাখ ২১ হাজার ৯০৯ হেক্টর কমে দাঁড়ায় ৯৪ লাখ ৩৯ হাজার ৫৪১ হেক্টরে। কিন্তু পরবর্তী ১০ বছরে ২০১০ সাল নাগাদ ছয় লাখ ৮৭ হাজার ৬০৪ হেক্টর কমে মোট কৃষিজমির পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ৮৭ লাখ ৫১ হাজার ৯৩৭ হেক্টর। ১৯৭৬ থেকে ২০০০ সাল পর্যন্ত ২৫ বছরে যে পরিমাণ কৃষিজমি কমেছে, পরের ১০ বছরে কমার পরিমাণ পাঁচ গুণ বেশি।
এ দেশের ৮৫ শতাংশ লোক কৃষিজীবী। কৃষি খাত আমাদের মোট কর্মসংস্থানের ৭০ শতাংশ জোগান দেয়। এ ছাড়াও কৃষি আমাদের খাদ্য নিরাপত্তার প্রধান উৎস। তদুপরি আমাদের এই ভূখণ্ড বিশ্বের ঘনবসতিপূর্ণ অঞ্চলগুলোর অন্যতম। মাথাপিছু আমাদের জমির পরিমাণ এক একরের এক-তৃতীয়াংশ থেকেও কম। আবার ভূমিহীনতার দৃষ্টিকোণ থেকে বিচার করলে দেখা যায়, আমাদের জনসংখ্যার প্রায় ৬০ শতাংশ ভূমিহীন ও প্রায় ভূমিহীন। নদীভাঙন, শহর সম্প্রসারণ, শিল্পকারখানা প্রতিষ্ঠাসহ প্রাকৃতিক ও মানবসৃষ্ট বিভিন্ন কারণে আমাদের আবাদি জমির পরিমাণ দিন দিন কমছে। ফলে চার দশক আগে আমাদের কৃষিজমির পরিমাণ যেখানে প্রায় দুই কোটি ৬০ লাখ একর ছিল, বর্তমানে তা এসে দুই কোটি ১৭ লাখ একরে দাঁড়িয়েছে। এর পরিমাণও নিম্নমুখী। পক্ষান্তরে গত চার দশকে আমাদের জনসংখ্যা প্রায় দ্বিগুণ এবং তার সাথে বেড়েছে খাদ্যের চাহিদা। এ অবস্থায় ক্রমবর্ধমান জনসংখ্যা ভবিষ্যৎ খাদ্য চাহিদা মেটানোর জন্য কৃষিজমি রক্ষা করা ছাড়া আমাদের সামনে দ্বিতীয় কোনো পথ নেই।
জাতিসঙ্ঘের সহায়তায় মৃত্তিকাসম্পদ উন্নয়ন প্রতিষ্ঠানের গবেষণায় বলা হয়েছে, বছরে কৃষিজমি কমছে ৬৮ হাজার হেক্টর। এক দশক ধরেই এ পরিমাণ জমি হারাতে হচ্ছে নগরায়ন, শিল্পকারখানা স্থাপন, আবাসন, সড়ক ও অন্যান্য অবকাঠামো নির্মাণের প্রয়োজন মেটাতে। অগ্রগতির ধারা চলতে থাকলে জমির ওপর চাপ আরো বাড়বে। একই সাথে বাড়বে চাল, আটা, সবজি, মাছ, ভোজ্যতেল, ফল প্রভৃতি পণ্যের চাহিদা। এগুলোর সাথে সরাসরি কৃষির যোগ। জমির পরিমাণ ক্রমাগত কমতে থাকলে এসব কৃষি কিংবা কৃষিজাত পণ্যের জোগান বাড়বে কিভাবে? খাদ্য নিরাপত্তাই-বা কিভাবে নিশ্চিত করা হবে?
বর্তমানে বাংলাদেশ খাদ্যশস্যে মোটামুটি স্বয়ংসম্পূর্ণ। কিন্তু জনসংখ্যা বেড়ে চলা এবং একই সাথে আর্থিকভাবে সচ্ছল পরিবারের সংখ্যা বাড়তে থাকায় খাদ্যের চাহিদা বাড়তেই থাকবে। একই সাথে বাড়তে থাকবে পুষ্টিকর বিভিন্ন ধরনের খাদ্যদ্রব্যের চাহিদা। এর জোগানের জন্যও ক্রমাগত চাপ পড়তে থাকবে জমির ওপর। কিন্তু শিল্প, অবকাঠামো ও সেবাসহ বিভিন্ন খাতের জন্যও নতুন নতুন জমি চাই। তার জোগান দেয়া সহজ কাজ নয়। এ প্রক্রিয়ায় সামাজিক সঙ্ঘাতের আশঙ্কাও থেকে যায়।
কৃষিজমি রক্ষা করতে আইনের বাস্তবায়ন অপরিহার্য। কৃষি খাত আমাদের বড় শক্তি। এ খাত কেবল মুখের গ্রাস জোগায় না, শিল্প ও রফতানি খাতের বিকাশেরও বড় উৎস। একই সাথে কৃষিতে উৎপাদনশীলতা বৃদ্ধির প্রতিও মনোযোগ বাড়াতে হবে। একই জমিতে চাই আরো বেশি ফলন এবং এ জন্য বিনিয়োগ যেমন বাড়াতে হবে, তেমনি বিজ্ঞান-প্রযুক্তির সুফল কাজে লাগানোর ওপরও সর্বোচ্চ জোর দিতে হবে। জন্মহার হ্রাসেও চাই আরো সচেতনতা সৃষ্টি, যাতে তৃণমূলেও এ উদ্যোগ যথাযথ সাফল্য খুঁজে পায়।
কৃষিজমি ক্রমেই হ্রাস পাওয়ায় দেশের খাদ্যনিরাপত্তা হুমকির সম্মুখীন হতে পারে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে। বাংলাদেশ এ মুহূর্তে মোটামুটিভাবে খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণ। কৃষিজমি হ্রাসের পরিণতিতে খাদ্য উৎপাদন হ্রাস পেলে এ ক্ষেত্রে সঙ্কট দেখা দেবে। দেশের জনসংখ্যা যেখানে বেড়েই চলেছে সেখানে কৃষিজমি হ্রাস পেলে খাদ্যচাহিদা পূরণে সঙ্কট হওয়ারই কথা। স্বাধীনতার পর গত চার দশকে কৃষিজমির পরিমাণ বিপুলভাবে হ্রাস পেলেও উন্নত চাষাবাদের কারণে এ সময়ে জনসংখ্যা দ্বিগুণেরও বেশি বেড়ে গেলে সঙ্কটের উদ্ভব হয়নি। তবে উন্নত প্রযুক্তির চাষাবাদ করেও একপর্যায়ে শেষ রক্ষার উপায় থাকবে না। কৃষিজমি আরো হ্রাস পেলে তা খাদ্যনিরাপত্তার জন্য অশনি সঙ্কেত হয়ে দেখা দেবে।

Print Friendly, PDF & Email

     এ ক্যাটাগরীর আরো খবর