চ্যাম্পিয়নরা এমনই

পি সারার প্রেসবক্সে তখন হাসির রোল। সাকিব আল হাসান যখন বললেন, এরপর থেকে কোচ হয়তো বলবেন, আমি আগের মতোই বল করছি। গল্পের শুরুটা বেশ কিছুদিন থেকেই। যদিও রেকর্ডবুক বলছে, সাকিব আল হাসান অসাধারণ ফর্মেই রয়েছেন। নিউজিল্যান্ডেই তো ডাবল সেঞ্চুরি হাঁকালেন। কিন্তু তার আউট হওয়ার ভঙ্গি যথেষ্টই বিতর্ক তৈরি করছিলো। ক্রিকেট বোর্ড প্রধান থেকে আমজনতা- অনেকেই অসন্তোষ প্রকাশ করছিলেন।
গল টেস্ট শেষে রীতিমতো বোমা ফাটালেন কোচ চন্দিকা হাথুরুসিংহে। সাকিবের বোলিং প্রসঙ্গে বলতে গিয়ে বলে দিলেন, সাকিব সেই আগের বোলার নেই। একটা কথা কবুল করতেই হবে বাংলাদেশ ক্রিকেটের আজকের সাফল্যের পেছনে চন্দিকার বিরাট অবদান। ধীরে ধীরে বাংলাদেশের ক্রিকেটে একটা শক্ত ভিত এনে দিয়েছেন তিনি। একইসঙ্গে অসীম ক্ষমতাও দেয়া হয়েছে হাথুরুসিংহকে। খুব সম্ভবত ক্রিকেট দুনিয়ার সবচেয়ে ক্ষমতাবান কোচ তিনি। জাতীয় দলের অন্যতম নির্বাচকও তিনি বটে। কেউ কেউ মজা করে বলেন, ক্রিকেটের ফুটবল কোচ। ফুটবলে কোচই যেমন শেষকথা, ক্রিকেটে কখনও তা নয়। বরং ক্রিকেটে অধিনায়করাই সবসময় প্রধান চরিত্র থেকেছেন। বাংলাদেশের ক্রিকেটে হাথুরুসিংহের অসীম ক্ষমতার সমালোচনাও করে থাকেন অনেকে। তাদের ধারণা অসীম ক্ষমতা তাকে ক্রমশ একনায়কে পরিণত করছে। রাগ-বিরাগের ঊর্ধ্বে নিজেকে নিতে পারেননি তিনি। তার অবদান স্বীকার করেও কেউ কেউ বলে থাকেন, বাংলাদেশ ক্রিকেটে বর্তমান সাফল্যের প্রধান নায়ক কোচ নন। এক্ষেত্রে প্রধান ভূমিকা রেখেছে প্রায় এক দশক ধরে একদল ক্রিকেটারের একসঙ্গে খেলে যাওয়া। পারফরমেন্সের মাধ্যমে তাদের কেউ কেউ নিজেদের নিয়ে গেছেন বিশ্ব পর্যায়ে। এক সেট খেলোয়াড়ের গুরুত্ব বুঝাতে গিয়ে তারা উদাহরণ হিসেবে টানেন ওয়েস্ট ইন্ডিজ ও পাকিস্তানকে। এক গ্রুপ অসাধারণ খেলোয়াড় পাওয়াতেই তারা দীর্ঘ একটা সময় ধরে ছিল দুনিয়ার অন্যতম সেরা দল। এখন সেই পারফরমারও নেই। সেই দলও নেই।
কোচের অসীম ক্ষমতার বিপদ শততম টেস্টের আগেই কিছুটা টের পাওয়া গিয়েছিলো। মাহমুদুল্লাহর টেস্ট পারফরমেন্স অনেকদিন থেকেই ভালো নয়। টেস্ট দল থেকে তার বাদ পড়া নিয়েও কোনো বিতর্ক নেই। কিন্তু যখন তাকে বিমানে তুলে দেয়ার কথা উঠলো তখন রীতিমতো ঝড় তৈরি হলো। চাউর হয়ে যায় হাথুরুসিংহের কথা অনুযায়ী, ওয়ানডে আর টি-টোয়েন্টি দল থেকেও তাকে বাদ দেয়া হয়েছিল। পরে মাশরাফি বিন মর্তুজার অনড় অবস্থানের কারণেই দলে তার ঠাঁই হয়। বোর্ড প্রধান নাজমুল হাসান পাপন অবশ্য আরো কড়া। কলম্বো এসে ঘোষণা দেন, মাহমুদুল্লাহকে তিনিই বাদ দিয়েছেন। লিটনের ইনজুরি না হলে আরো বড় নাম বাদ পড়তো বলেও জানান তিনি। কে জানে মুশফিক না সাকিব- কাকে বাদ দেয়ার কথা বলেছেন তিনি।
হাথরুসিংহ গল টেস্টের পর যখন ঘোষণা করলেন, আগের সাকিব নেই, তখন সাকিব আল হাসান মুখে কিছু বলেননি। এবং চ্যাম্পিয়নরা আসলে মুখে কিছু বলেনও না। পারফরমেন্সই তাদের একমাত্র জবাব। পারফর্ম করেই সমালোচকদের মুখ ভোঁতা করে দেন তারা। সাকিবের কখনো কখনো সমালোচনা হয়। সমালোচনার মতো কাজ তিনি করেনও। তবে তিনি যে, বাংলাদেশের ক্রিকেট ইতিহাসের সেরা পারফর্মার তা কেইবা অস্বীকার করতে পারবেন। পি সারায় পারফর্ম করেই সমালোচকদের জবাব দিলেন সাকিব। ১৩১ রান আর ৬ উইকেট। সেই আত্মপ্রত্যয়ী, গর্বিত সাকিব আল হাসান। সাকিবের ঘনিষ্ঠ বন্ধু তামিম ইকবাল। ক্রিকেট নিয়ে তাদের ধ্যান-ধারণায় মিল পাওয়া যায় বহু। এবং সত্যিকার অর্থে বাংলাদেশের ক্রিকেটের দিন বদলের অন্যতম নায়ক তারা দুইজনই। কখনো কখনো আচরণের কারণে তাদের দুই জনকেই সমালোচনার মুখোমুখি হতে হয়েছে। কিন্তু মাঠে দুইজনই বরাবর অনন্য। এবারো যেমন দ্বিতীয় ইনিংসে ৮২ রানের মহামূল্যবান এক ইনিংস খেলে ম্যাচ সেরা হলেন তামিম।
এই টেস্ট শুরুর আগেই কিছুটা চাপে ছিলেন মুশফিকুর রহিম। না, ব্যাটিংয়ে অসাধারণ ফর্মেই ছিলেন তিনি। আগের টেস্টে কিপিং- এর সুযোগ পাননি। কিন্তু লিটনের ইনজুরিতে আবারো গ্ল্যাভস ওঠে তার হাতে। যদিও মাহমুদুল্লাহর জন্য খারাপ লাগায় চাপে পড়েন তিনি। কী অসাধারণ দক্ষতাতেই না সে চাপ উতরে গেলেন মুশফিক। ব্যাট আর গ্ল্যাভস- দুই ভূমিকাতেই অসাধারণ। দলকে জিতিয়েই মাঠ ছাড়লেন। মুশফিকুর রহিমই এক সাক্ষাৎকারে মোস্তাফিজের প্রতিভার ধরন বুঝাতে গিয়ে বলেছিলেন, মোস্তাফিজকে তার জীবদ্দশায় কখনো তিনি খারাপ ফর্মে দেখবেন না। ইনজুরি থেকে ফেরার পর সেই মোস্তাফিজকে যেন খুঁজে পাওয়া যাচ্ছিলো না। কিন্তু দলের সবচেয়ে প্রয়োজনীয় সময়ে ঠিকই জ্বলে উঠলেন। তিন উইকেট নেয়া অসাধারণ এক স্পেলে ঘুরিয়ে দিলেন ম্যাচের মোড়। আরো একবার বুঝালেন, কেন তিনি বিশ্বের অন্যতম সেরা।
চ্যাম্পিয়নরা আসলে এমনই। সময়মতো তারা জবাব দেন। এবং সেটা মাঠেই।

Print Friendly, PDF & Email

     এ ক্যাটাগরীর আরো খবর