চাকরি চাও টাকা দাও স্কুলের দফতরি, পুলিশের সিপাহি থেকে শুরু করে সব নিয়োগেই চলছে বাণিজ্য। অভিযোগের তীর এমপি, দলের নেতা ও সরকারি কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে

ঘুষ বাণিজ্য ছাড়া সরকারি দফতর-অধিদফতরে চাকরি পাওয়ার কোনো উপায় নেই। স্বাস্থ্য সেক্টর, পুলিশ, শিক্ষাখাতসহ সব সেক্টরের সব নিয়োগেই টাকা লেনদেন এখন ওপেন সিক্রেট হয়ে দাঁড়িয়েছে। এমনকি স্কুলের দফতরি, গুদামঘরের নাইটগার্ডে নিয়োগ পেতেও পূরণ করতে হয় চাহিদা। স্থানীয় পর্যায়ে এমপির নেতৃত্বে রাজনৈতিক দলের নেতা-কর্মীরা ঘুষবাণিজ্য সরাসরি হাতিয়ে নেওয়ার পরই নিয়োগপত্র নিশ্চিত করা হচ্ছে। আবার কোথাও নিয়োগ বাণিজ্যের টাকা ভাগাভাগি করে নিচ্ছে এমপি ও সরকারি কর্মকর্তারা। ভাগাভাগি হচ্ছে সর্বত্রই। রীতিমতো কোটা হারে ভাগ করে দেওয়া হচ্ছে চাকরি, সেই হারেই বণ্টন হচ্ছে টাকা। নিয়োগ ক্ষেত্রে টাকা আদায় ও বণ্টনে দলীয় লোকজন বা এমপি ভাগ না পেলেই বাধছে ঝামেলা। অভিযোগ-পাল্টা অভিযোগ তুলে বন্ধ করা হচ্ছে নিয়োগ প্রক্রিয়া। বিধি মোতাবেক আবেদন-নিবেদন, লিখিত পরীক্ষা, মৌখিক পরীক্ষা, যাচাই-বাছাই ও মেধার কোনো পাত্তা দেওয়া হচ্ছে না। কে আগে টাকা পরিশোধ করছে তার ভিত্তিতেই তৈরি হচ্ছে নিয়োগের তালিকা।

এক্ষেত্রে এক জেলার প্রার্থী অন্য জেলার নিছক ইউপি চেয়ারম্যানের সার্টিফিকেট দাখিল করেই চাকরি প্রার্থী হচ্ছেন, টাকার জোরে পেয়ে যাচ্ছেন চাকরি। দফতরসমূহে চাকরির ইন্টারভিউ বা লিখিত পরীক্ষার দিন প্রকাশ্যে টাকা লেনদেনের হাট বসে যায়। পত্র অনুযায়ী অলিখিতভাবে ঘুষের রেটও বেঁধে দেওয়া আছে। সারাদেশেই প্রায় একই রেটে টাকা লেনদেন হয়। এক্ষেত্রে বাকি রাখার কোনো বিধান নেই, ব্যাংকের চেকও গ্রহণ করা হয় না। ক্যাশ টাকা হাতে এনে যথাসময়ে জমা দেওয়ার মধ্য দিয়েই নিয়োগ প্রার্থীর যোগ্যতা (!) অর্জন করতে হয়। আওয়ামী লীগ সরকারের প্রথম দফার শাসনামলেও চাকরি প্রার্থীদের যোগ্যতা হিসেবে ছাত্রলীগ কি না তা নিশ্চিত করার চেষ্টা চলত। এখন জামায়াত-শিবির, ছাত্রদল বা ছাত্রলীগ যেই হোক সমস্যা নেই- নির্দিষ্ট পরিমাণ টাকা পরিশোধ করতেই হবে। সেখানে এক ও অভিন্ন স্লোগান- চাকরি চাও তো টাকা দাও। হাটবাজারের গুদামঘরে নাইটগার্ড নিয়োগ পেতে হলেও ৭০ হাজার থেকে এক লাখ টাকা পর্যন্ত পরিশোধ করতে হচ্ছে। মাস্টাররোলে সরকারি স্কুলের দফতরি পদে নিয়োগ পেতে দরকষাকষি চলে এক লাখ থেকে তিন লাখ টাকা পর্যন্ত। পুলিশের সিপাই পদে চাকরি পেতে হলে তিন লাখ থেকে পাঁচ লাখ টাকা দিতে হচ্ছে, এসআই প্রার্থীদের পরিশোধ করতে হয় পাঁচ লাখ থেকে আট লাখ টাকা। একইভাবে প্রাইমারি স্কুলের শিক্ষক-শিক্ষিকা পদের জন্য পাঁচ লাখ থেকে ছয় লাখ টাকা, ডাক্তার নিয়োগে ৭-৮ লাখ টাকা, মাঠ পর্যায়ের স্বাস্থ্যকর্মীর ক্ষেত্রেও তিন লাখ টাকা পর্যন্ত ঘুষ দেওয়ার রেওয়াজ চালু করা হয়েছে। স্থানীয় পর্যায়ে বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই সংসদ সদস্যরা চাকরির বাজার নিয়ন্ত্রণ করে চলছেন। সেসব স্থানে সরকারি দলের নেতা-কর্মী ও সংশ্লিষ্ট দফতরের কর্মকর্তাদের নিয়ে এমপি ‘কোটা পদ্ধতির বণ্টন’ ধার্য করে দেন। সেই মোতাবেক নির্ধারিত ব্যক্তি নিয়োগ প্রার্থীদের কাছ থেকে সব টাকা সংগ্রহ করে কোটা মোতাবেক ভাগ-বণ্টন করা হয়। তবে পুলিশ নিয়োগের ক্ষেত্রে কিছুটা ব্যতিক্রম ছিল। সেখানে জেলা পর্যায়ে দায়িত্বশীল এসপিরা ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষ ও মন্ত্রী-প্রতিমন্ত্রীদের নাম ভাঙিয়ে স্থানীয় এমপিদের নিয়ে ভাগ-বণ্টনে রাজি হননি। সেক্ষেত্রে নিয়োগ প্রার্থীদের থেকে টাকা তুলে এসপিসহ পুলিশের ঊর্ধ্বতন কিছু কর্মকর্তা তা ভাগাভাগি করে নেয় বলে অভিযোগ রয়েছে। অবশ্য প্রভাবশালী সংসদ সদস্য অনেকে পুলিশ নিয়োগের কার্যক্রম থেকেও নিজের ভাগ আদায় করতে সমর্থ হন। যারা এ বণ্টনে শরিক হতে পারেননি তারাই নানারকম অভিযোগ তুলে নিয়োগ প্রক্রিয়া বাধাগ্রস্ত করছে। স্বাস্থ্যখাতে অস্থায়ী ভিত্তিতে (অ্যাডহক) চিকিৎসক ও কর্মকর্তা নিয়োগের ক্ষেত্রেও বিপুল পরিমাণ টাকা ঘুষ বাণিজ্য চলার ব্যাপারে সরাসরি অভিযোগ তুলেছেন ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশ (টিআইবি)। অনুসন্ধান শেষে টিআইবি বলছে, অ্যাডহক ভিত্তিতে নিয়োগ পেতে চিকিৎসকদের তিন থেকে পাঁচ লাখ টাকা করে দিতে হয়েছে। টানা দ্বিতীয়বারের মতো ক্ষমতায় আসা আওয়ামী লীগ সরকারের গত আমলে সাড়ে চার হাজারেরও বেশি চিকিৎসককে অ্যাডহক ভিত্তিতে নিয়োগ দেওয়া হয়।

আওয়ামী লীগ সমর্থিত চিকিৎসকদের সংগঠন স্বাধীনতা চিকিৎসক পরিষদের (স্বাচিপ) সদস্যরা,  স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের মাঠ পর্যায়ের কর্মকর্তা, অফিস সহকারী এবং প্রশাসনিক কর্মকর্তারা এই নিয়োগের জন্য টাকা নিয়েছেন বলে টিআইবির প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়। স্বাস্থ্য খাতের শুধু ডাক্তার নিয়োগের ক্ষেত্রেই নয়, সাম্প্রতিক সময়ের সব নিয়োগেই ব্যাপক আকারে ঘুষ বাণিজ্য চলছে। পরিবার পরিকল্পনা অধিদফতরের আওতায় সারা দেশে কয়েক হাজার নিয়োগের ক্ষেত্রেও রীতিমতো প্রকাশ্যে চলেছে ঘুষের লেনদেন। একেক পদে একেক রেটে আলাদা আলাদা ব্যক্তি নিয়োগের দায়িত্ব পালন করেন। অনেক স্থানে নিুপদের চাকরির ক্ষেত্রে এমপির নির্দেশে জেলা ও থানা পর্যায়ের আওয়ামী লীগ নেতার সঙ্গে সংশ্লিষ্ট সরকারি কর্মকর্তা যৌথ টিম গঠন করেছেন। সেই টিমের আওতায় ঘুষ হাতিয়ে নিয়ে ভাগ-বণ্টন করে নেওয়া হয়েছে। এদিকে আনসার-ভিডিপি সদস্যদের নিয়োগ দেওয়ার ক্ষেত্রে সারা বছর ধরেই চলে ঘুষের বেশুমার বাণিজ্য। একশ্রেণীর আনসার অ্যাডজুটেন্ট এসব টাকা হাতিয়ে নেন বলে অভিযোগ রয়েছে।

Print Friendly, PDF & Email

     এ ক্যাটাগরীর আরো খবর