ঢাকা ০৯:২২ অপরাহ্ন, শনিবার, ০৪ জানুয়ারী ২০২৫, ২১ পৌষ ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

ফেরাউনকে দেওয়া মুসা (আ.) এর চার প্রস্তাব

  • Reporter Name
  • আপডেট টাইম : ১২:৩২:৩৬ অপরাহ্ন, শনিবার, ২৯ ডিসেম্বর ২০১৮
  • ৩৯৪ বার

হাওর বার্তা ডেস্কঃ মিশর অধিপতি ফেরাউনের দোর্দ-প্রতাপে প্রজারা তাকে খোদার আসনে পূজা দিতে বাধ্য ছিল। ফেরাউন পরিষ্কার ভাষায় ঘোষণা করেছিল ‘আমিই তোমাদের সর্বোচ্চ রব (প্রতিপালক; আমিই সত্য, আমার উপরে কেউ নেই)।’ (সূরা নাজিয়াত : ২৪)।

আল্লাহর নবী হজরত মুসা (আ.) ফেরাউনকে ক্ষমতার দম্ভ ছেড়ে আল্লাহর পথে আসার উপদেশ দিতেন। এক পর্যায়ে তিনি প্রস্তাব দেন, হীন যেমন বেপযীর য়্যক চীজ ও বেয়া’র পস যেমন বেস্তা’ন এওয়ায আ’ন রা’ চাহা’র শোনো তুমি মেনে নাও আমার একটি বিষয় একবার তার বদলায় পাবে প্রতিদান চারটি নগদ পুরস্কার। ফেরাউন বলল, প্রস্তাব ভালোই তো। একটির বদলে চারটি। আগে বল, প্রথম প্রস্তাবটি কী? মুসা বললেন, গোফত আ’ন য়্যক কে বগুয়ী আ’শেকা’র কে খোদায়ী নীস্ত গাইরে কেরদেগা’র বললেন, তা হলো তুমি বলবে প্রকাশ্যে পরিষ্কার ‘আল্লাহ ছাড়া নাই ভিন্ন কোনো উপাস্য আমার।’

তিনিই আসমান ও জমিনের স্রষ্টা। আকাশের তারকারাজি, জমিনের তরুলতা-গাছগাছালি, মানুষ, জিন-পরী, পশুপক্ষী সবকিছুর একমাত্র স্রষ্টা ও রিজিকদাতা তিনি। বিশাল সাগর, বিস্তীর্ণ প্রান্তর, সুউচ্চ পর্বতমালা, সৃষ্টিজগতে আরও যা কিছু আছে সবই তার অনুগত। এক আল্লাহ ছাড়া অন্য কোনো প্রভু নেই। চিন্তিত ফেরাউন বলল, তোমার প্রস্তাব তো বুঝলাম। যে চার উপকারের কথা বলেছ, কী কী বল তো শুনি। ওসব উপকারের কথা শুনে তোমার এমন কঠিন প্রস্তাবের ধকল সামলানোর মনোবল হয়তো পাব। আমার মনে তোমার খোদাকে অস্বীকার করার যে সিন্ধুকটি আছে, অন্য রকম ধনরতের আশ্বাসে হয়তো তার তালা খুলে যাবে।

গোফত মুসা কাওয়ালীনে আ’ন চাহা’র সেহহাতী বা’শদ তানাত রা পা’য়দার মুসা বললেন, সেই চার পুরস্কারের প্রথমটি লাভ করবে দেহের সুস্থতা ও সুস্বাস্থ্য স্থায়ী। আল্লাহর ওপর ঈমানের বিনিময়ে যে চার মহাসম্পদ লাভ করবে তার প্রথমটি হলো, শারীরিক সুস্থতা ও সুস্বাস্থ্য এবং তা হবে স্থায়ী। চিকিৎসাশাস্ত্রে যেসব রোগ-শোকের কথা বলা হয়েছে তা তোমার শরীর থেকে দূরে বহু দূরে থাকবে। সানিয়ান বা’শদ তোরা উমরে দেরা’য কে আজল দা’রদ যে উমরত এহতেরা’জ দ্বিতীয়ত তুমি লাভ করবে দীর্ঘ সুন্দর জীবন মৃত্যু স্পর্শ করবে না তোমার জীবন-যৌবন।
তবে এর অর্থ এই নয় যে, প্রকৃতিগতভাবে যে জীবন তুমি যাপন করছ তা একটানা সুখে ও সুস্থতায় কাটিয়ে দেবে। তাহলে তো এ জগৎ থেকে কোনো সঞ্চয় নিয়ে যেতে পারবে না।

দুনিয়ার জীবন থেকে আখেরাতের পাথেয় সংগ্রহ করতে হলে এখানে দুঃখ-কষ্টের সম্মুখীন হতে হবে। মওলানা রুমি বলেন, অনন্ত জীবন লাভের মূলধন প্রত্যেকের অন্তরভূমিতে গচ্ছিত ও লুকায়িত আছে। তবে সন্ধানী ও পরিশ্রমী ছাড়া কেউ এ গুপ্তধন লাভ করতে পারে না। মওলানা বুঝিয়ে বলেন, আমাকে একটি প্রশ্নের উত্তর দাও। কেউ যদি শ্রম না দেয় সে কি মজুরির দাবি করতে পারে? তার দাবি কি টিকবে? নিশ্চয়ই না। চোন নকর্দ আন কা’র মুযদাশ হাস্ত? লা লাইসা লিল ইনসা’নে ইল্লা মা সাআ কাজ না করে কি কেউ মজুরি চাইতে পারে? না। মানুষ যার জন্য চেষ্টা করে তা ছাড়া কিছু পায় না।

মওলানা এখানে কোরআন মজিদের এ জীবন্ত শিক্ষাটি তুলে ধরেছেন। (ইবরাহিম ও মুসার কিতাবে যেসব শিক্ষা তন্মধ্যে রয়েছে) ‘মানুষ তাই পায় যা সে করে আর তার কর্মই অচিরে দেখান হবে।’ (সূরা নজম : ৩৯, ৪০)।
তখন হেলায় খেলায় সময় কাটিয়ে দেওয়ার কারণে তুমি আফসোস করবে, হায়! আমার মাথার ওপর যে মেঘমালা ছায়া বিস্তার করেছিল তার মাঝেই তো লুকায়িত ছিল আলোকিত চাঁদনি। আমি টেরই পেলাম না। হায়াতটা অবহেলার মধ্যে কাটিয়ে দিলাম। আল্লাহ পাক বলেন, ‘যারা আল্লাহর সম্মুখীন হওয়াকে মিথ্যা বলেছে তারা অবশ্যই ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। এমনকি তাদের কাছে যখন অকস্মাৎ কেয়ামত উপস্থিত হবে তখন তারা বলবে, হায়! এর ব্যাপারে আমরা যে অবহেলা করেছি তার জন্য আক্ষেপ। তারা তাদের পিঠে নিজেদের পাপ বহন করবে; দেখ, তারা যা বহন করবে তা অতি নিকৃষ্ট।’ (সূরা আনআম : ৩১)।

মুসা (আ.) এর কথা শোনার পর ফেরাউনের অপেক্ষার তর সয় না। তত্ত্বকথার চেয়ে সে নগদে জানতে চায়, আরও কী কী আছে। বল তোমার তৃতীয় পুরস্কার। মুসা (আ.) বললেন, তৃতীয় মহাসম্পদ, যা তোমাকে দেওয়া হবে সেটি হলো, দুই জাহানের বাদশাহী। ইহজগতের রাজত্ব তুমি পাবে। পরকালের রাজত্বও তোমার হাতের মুঠোয় দেওয়া হবে। এ রাজত্বের সুবিধা হলো, তাতে তোমার কোনো শত্রু থাকবে না, প্রতিদ্বন্দ্বীও থাকবে না। দেখবে, সর্বত্র শুধু শান্তি ও সুখই বিরাজিত। তুমি ভেবে দেখ, তুমি আল্লাহর কত নাফরমানি কর, এরপরও তোমাকে অগাধ ধনরত ও নেয়ামত দিয়েছেন। এখন যদি তার ফরমাবরদারি কর, অনুগত হও তাহলে কত অবারিত নেয়ামত তোমাকে দেবেন? ফেরাউন দেখল, তাই তো। আচ্ছা, মুসা বল তোমার চতুর্থ পুরস্কারের প্রস্তাবটি। আমার মন তো এক রকম অস্থির হয়ে উঠছে।

গোফত চারুম অ’নকে মানী তো জওয়ান মূয় হাম চোন কীর ও রোখ চোন আরগওয়ান চতুর্থ হলো, লাভ করবে তুমি চিরতারুণ্য যৌবন চুল হবে কৃঞ্চ আলকাতরা, চেহারা রক্তবরণ। যেগুলো বললাম, সব রং-রূপের বর্ণনা। আমার কাছে এগুলোর কোনো মূল্য একবারেই নেই। তবু তোমার চিন্তা যেহেতু নিচ প্রকৃতির, তাই তোমার চিন্তা অনুসারে কথা বললাম। শরিয়তের নির্দেশ হলো, মানুষের সঙ্গে কথা বলো তাদের জ্ঞানবুদ্ধির অনুপাতে। শিশুর সঙ্গে কথা বললে তাদের ভাষায় বলতে হবে। মুসার কথা শুনে ফেরাউন চিন্তা করল, মুসা তার খোদার পক্ষে কথা বলেছে। কাজেই প্রস্তাবগুলো ভিত্তিহীন নয়।

মুসাকে বলল, তোমার প্রস্তাব সম্পর্কে মতামত জানানোর জন্য আমাকে দু-একটা দিন সময় দাও। মুসা (আ.) এর প্রস্তাবটি প্রিয় সহধর্মিণী আসিয়াকে গিয়ে বলল। আসিয়া পরামর্শ দিল, কালবিলম্ব না করে তুমি মুসার খোদার ওপর বিশ্বাস স্থাপন করো। আসিয়া আরও বলল, এমন সুন্দর প্রস্তাব সেই মজলিসেই তো গ্রহণ করা উচিত ছিল। এ তো একটি বীজ রোপণ করে হাজার হাজার শস্য ও ফসল ঘরে তোলার মতো; কিংবা এক রত্তি সোনা মাটিতে পোঁতার বিনিময়ে বিরাট স্বর্ণখনি হস্তগত করার মতো লোভনীয় ব্যবসা। এ তো একান্ত আল্লাহর হয়ে যাওয়ার প্রস্তাব। তুমি আল্লাহর হয়ে গেলে আল্লাহও তোমার হয়ে যাবেন। ফেরাউনের বিদুষী স্ত্রী আসিয়া স্বামীর অজান্তে এক আল্লাহয় বিশ্বাসী ছিলেন। এ অপরাধে পরবর্তী সময়ে ফেরাউন অবর্ণনীয় নির্যাতন করে তাকে শহীদ করে। কোরআন মজিদের দুটি স্থানে বিবি আসিয়ার প্রসঙ্গ উল্লেখ আছে। (সূরা কাসাস : আয়াত-৯; সূরা তাহরিম : আয়াত-১১)।

আসিয়ার এমন বলিষ্ঠ বক্তব্য ফেরাউনের মনে আত্মবিশ্বাস জাগাতে পারল না। বলল, বিষয়টি আমি প্রধানমন্ত্রী হামানের সঙ্গেও পরামর্শ করে দেখি। আসিয়া নিষেধ করলেন, খবরদার! হামানকে যদি বল, সে বিভ্রান্ত করবে। হামান ফেরাউনকে বলল, জাহাঁপনা! মুসার কথায় আপনি ফাঁদে পা দেবেন না। মুসা আপনাকে যত ওয়াদা দিয়েছে এর সব পাল্লায় ওজন করলে জনগণ যেভাবে আপনাকে পূজা-অর্চনা দেয় সেরূপ একদিনের সমানও হবে না। শেষ পর্যন্ত হামান ফেরাউনকে রাজকীয় দাম্ভিকতার অন্ধগহ্বরে টেনে নিয়ে গেল।

স্ত্রী আসিয়ার সুন্দর পরামর্শের পরও ফেরাউন কেন হামানের সঙ্গে পরামর্শ করতে গেল মওলানা রুমি তার সহজাত আকর্ষণ দর্শন দিয়ে এর রহস্য বিশ্লেষণ করেছেন। মসনবিতে মওলানার অন্যতম জীবনদর্শন হলো, সৃষ্টিজগৎ বা সত্তাগতভাবে যেসব বস্তু বা ব্যক্তির উৎপত্তি একই উৎস থেকে তা পরস্পরকে আকর্ষণ করে। সৃষ্টিজগতের সর্বত্র ভালো ভালোকে এবং মন্দ মন্দকে আকর্ষণ করে। কাকের বন্ধুত্ব কাকের সঙ্গে আর বাজপাখির আত্মীয়তা বাজপাখির সঙ্গে। এখানেও ফেরাউনের সৃষ্টিস্বভাব যেহেতু মন্দ ছিল তাই সে সৃষ্টিস্বভাবে মন্দ হামানের শরণাপন্ন হলো।

হাদিস শরিফে বর্ণিত, মোমিন যেমন দোজখ থেকে বাঁচার জন্য আল্লাহর কাছে পানাহ চান, দোজখও মোমিনের পদচারণা থেকে বাঁচার জন্য আল্লাহর কাছে পানাহ চায়। অনুরূপ মোমিন যেমন বেহেশতের জন্য আকাক্সক্ষা করে বেহেশতও মোমিনের জন্য প্রতীক্ষার প্রহর গোনে। মওলানা আমাকে-আপনাকে আত্ম আবিষ্কারের পরামর্শ দিয়ে বলেন, চিন্তা করে দেখ, ফেরাউন তোমার মধ্যেও বিরাজ করে। তুমি শুধু অন্যের ঘাড়ে দোষ চাপাও, অন্যদের তোমার দুশমন বলে ভাব। আসলে দুশমনে তো জুয তো নবুয়াদ আই লায়ীন বী গুনা’হা’ন রা’ মগো দুশমন বে কীন
তোমার দুশমন তুমি ছাড়া অন্য কেউ নয়, হে অভিশপ্ত! নিরাপরাধদের বল না অযথা তোমার দুশমন বিদ্বেষবশত।

তোমার দুশমন তোমার ভেতরকার নফসে আম্মারা। মুসারূপ রূহের উপদেশ পেয়ে তোমার ফেরাউনরূপী অন্তর প্রথমে পরামর্শ করে স্ত্রী আসিয়ার সঙ্গে। আসিয়া তোমার বিবেক। কিন্তু কলুষিত অন্তর স্বভাবের টানে হামানরূপী নফসের কাছে যায়। তার কুমন্ত্রণার শিকার ও বিভ্রান্ত হয়। হে সাধক, ওহে মোমিন! এখন তুমি নিজেই নিজের পরীক্ষা নিতে পার। তোমার শেষ পরিণতি বেহেশত নাকি দোজখ, এখই বুঝে নিতে পার। পরীক্ষা নিয়ে দেখ, তোমার অন্তর তোমাকে কোনদিকে টানে। তুমি কি সৎ, সত্য, সুন্দর, ভালো ও ন্যায়ের পথে চলতে ভালোবাস? নাকি, অসুন্দর, অন্যের ক্ষতিসাধন, দাম্ভিকতার পথে চলতে চাও? তুমি কি জান্নাতের অভিসারী, নাকি দোযখের অন্ধকার গলিতে চলতে বিকৃত আনন্দ পাও? গর বে হামান মায়েলী হামানী য়ী গর বে মুসা মায়েলী সুবহানী য়ী তোমার ঝোঁক যদি হয় হামানের দিকে তুমি নাফরমান তোমার মনের টান যদি মুসার দিকে হয়, তবে মুসলমান।

Tag :

Write Your Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Save Your Email and Others Information

About Author Information

ফেরাউনকে দেওয়া মুসা (আ.) এর চার প্রস্তাব

আপডেট টাইম : ১২:৩২:৩৬ অপরাহ্ন, শনিবার, ২৯ ডিসেম্বর ২০১৮

হাওর বার্তা ডেস্কঃ মিশর অধিপতি ফেরাউনের দোর্দ-প্রতাপে প্রজারা তাকে খোদার আসনে পূজা দিতে বাধ্য ছিল। ফেরাউন পরিষ্কার ভাষায় ঘোষণা করেছিল ‘আমিই তোমাদের সর্বোচ্চ রব (প্রতিপালক; আমিই সত্য, আমার উপরে কেউ নেই)।’ (সূরা নাজিয়াত : ২৪)।

আল্লাহর নবী হজরত মুসা (আ.) ফেরাউনকে ক্ষমতার দম্ভ ছেড়ে আল্লাহর পথে আসার উপদেশ দিতেন। এক পর্যায়ে তিনি প্রস্তাব দেন, হীন যেমন বেপযীর য়্যক চীজ ও বেয়া’র পস যেমন বেস্তা’ন এওয়ায আ’ন রা’ চাহা’র শোনো তুমি মেনে নাও আমার একটি বিষয় একবার তার বদলায় পাবে প্রতিদান চারটি নগদ পুরস্কার। ফেরাউন বলল, প্রস্তাব ভালোই তো। একটির বদলে চারটি। আগে বল, প্রথম প্রস্তাবটি কী? মুসা বললেন, গোফত আ’ন য়্যক কে বগুয়ী আ’শেকা’র কে খোদায়ী নীস্ত গাইরে কেরদেগা’র বললেন, তা হলো তুমি বলবে প্রকাশ্যে পরিষ্কার ‘আল্লাহ ছাড়া নাই ভিন্ন কোনো উপাস্য আমার।’

তিনিই আসমান ও জমিনের স্রষ্টা। আকাশের তারকারাজি, জমিনের তরুলতা-গাছগাছালি, মানুষ, জিন-পরী, পশুপক্ষী সবকিছুর একমাত্র স্রষ্টা ও রিজিকদাতা তিনি। বিশাল সাগর, বিস্তীর্ণ প্রান্তর, সুউচ্চ পর্বতমালা, সৃষ্টিজগতে আরও যা কিছু আছে সবই তার অনুগত। এক আল্লাহ ছাড়া অন্য কোনো প্রভু নেই। চিন্তিত ফেরাউন বলল, তোমার প্রস্তাব তো বুঝলাম। যে চার উপকারের কথা বলেছ, কী কী বল তো শুনি। ওসব উপকারের কথা শুনে তোমার এমন কঠিন প্রস্তাবের ধকল সামলানোর মনোবল হয়তো পাব। আমার মনে তোমার খোদাকে অস্বীকার করার যে সিন্ধুকটি আছে, অন্য রকম ধনরতের আশ্বাসে হয়তো তার তালা খুলে যাবে।

গোফত মুসা কাওয়ালীনে আ’ন চাহা’র সেহহাতী বা’শদ তানাত রা পা’য়দার মুসা বললেন, সেই চার পুরস্কারের প্রথমটি লাভ করবে দেহের সুস্থতা ও সুস্বাস্থ্য স্থায়ী। আল্লাহর ওপর ঈমানের বিনিময়ে যে চার মহাসম্পদ লাভ করবে তার প্রথমটি হলো, শারীরিক সুস্থতা ও সুস্বাস্থ্য এবং তা হবে স্থায়ী। চিকিৎসাশাস্ত্রে যেসব রোগ-শোকের কথা বলা হয়েছে তা তোমার শরীর থেকে দূরে বহু দূরে থাকবে। সানিয়ান বা’শদ তোরা উমরে দেরা’য কে আজল দা’রদ যে উমরত এহতেরা’জ দ্বিতীয়ত তুমি লাভ করবে দীর্ঘ সুন্দর জীবন মৃত্যু স্পর্শ করবে না তোমার জীবন-যৌবন।
তবে এর অর্থ এই নয় যে, প্রকৃতিগতভাবে যে জীবন তুমি যাপন করছ তা একটানা সুখে ও সুস্থতায় কাটিয়ে দেবে। তাহলে তো এ জগৎ থেকে কোনো সঞ্চয় নিয়ে যেতে পারবে না।

দুনিয়ার জীবন থেকে আখেরাতের পাথেয় সংগ্রহ করতে হলে এখানে দুঃখ-কষ্টের সম্মুখীন হতে হবে। মওলানা রুমি বলেন, অনন্ত জীবন লাভের মূলধন প্রত্যেকের অন্তরভূমিতে গচ্ছিত ও লুকায়িত আছে। তবে সন্ধানী ও পরিশ্রমী ছাড়া কেউ এ গুপ্তধন লাভ করতে পারে না। মওলানা বুঝিয়ে বলেন, আমাকে একটি প্রশ্নের উত্তর দাও। কেউ যদি শ্রম না দেয় সে কি মজুরির দাবি করতে পারে? তার দাবি কি টিকবে? নিশ্চয়ই না। চোন নকর্দ আন কা’র মুযদাশ হাস্ত? লা লাইসা লিল ইনসা’নে ইল্লা মা সাআ কাজ না করে কি কেউ মজুরি চাইতে পারে? না। মানুষ যার জন্য চেষ্টা করে তা ছাড়া কিছু পায় না।

মওলানা এখানে কোরআন মজিদের এ জীবন্ত শিক্ষাটি তুলে ধরেছেন। (ইবরাহিম ও মুসার কিতাবে যেসব শিক্ষা তন্মধ্যে রয়েছে) ‘মানুষ তাই পায় যা সে করে আর তার কর্মই অচিরে দেখান হবে।’ (সূরা নজম : ৩৯, ৪০)।
তখন হেলায় খেলায় সময় কাটিয়ে দেওয়ার কারণে তুমি আফসোস করবে, হায়! আমার মাথার ওপর যে মেঘমালা ছায়া বিস্তার করেছিল তার মাঝেই তো লুকায়িত ছিল আলোকিত চাঁদনি। আমি টেরই পেলাম না। হায়াতটা অবহেলার মধ্যে কাটিয়ে দিলাম। আল্লাহ পাক বলেন, ‘যারা আল্লাহর সম্মুখীন হওয়াকে মিথ্যা বলেছে তারা অবশ্যই ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। এমনকি তাদের কাছে যখন অকস্মাৎ কেয়ামত উপস্থিত হবে তখন তারা বলবে, হায়! এর ব্যাপারে আমরা যে অবহেলা করেছি তার জন্য আক্ষেপ। তারা তাদের পিঠে নিজেদের পাপ বহন করবে; দেখ, তারা যা বহন করবে তা অতি নিকৃষ্ট।’ (সূরা আনআম : ৩১)।

মুসা (আ.) এর কথা শোনার পর ফেরাউনের অপেক্ষার তর সয় না। তত্ত্বকথার চেয়ে সে নগদে জানতে চায়, আরও কী কী আছে। বল তোমার তৃতীয় পুরস্কার। মুসা (আ.) বললেন, তৃতীয় মহাসম্পদ, যা তোমাকে দেওয়া হবে সেটি হলো, দুই জাহানের বাদশাহী। ইহজগতের রাজত্ব তুমি পাবে। পরকালের রাজত্বও তোমার হাতের মুঠোয় দেওয়া হবে। এ রাজত্বের সুবিধা হলো, তাতে তোমার কোনো শত্রু থাকবে না, প্রতিদ্বন্দ্বীও থাকবে না। দেখবে, সর্বত্র শুধু শান্তি ও সুখই বিরাজিত। তুমি ভেবে দেখ, তুমি আল্লাহর কত নাফরমানি কর, এরপরও তোমাকে অগাধ ধনরত ও নেয়ামত দিয়েছেন। এখন যদি তার ফরমাবরদারি কর, অনুগত হও তাহলে কত অবারিত নেয়ামত তোমাকে দেবেন? ফেরাউন দেখল, তাই তো। আচ্ছা, মুসা বল তোমার চতুর্থ পুরস্কারের প্রস্তাবটি। আমার মন তো এক রকম অস্থির হয়ে উঠছে।

গোফত চারুম অ’নকে মানী তো জওয়ান মূয় হাম চোন কীর ও রোখ চোন আরগওয়ান চতুর্থ হলো, লাভ করবে তুমি চিরতারুণ্য যৌবন চুল হবে কৃঞ্চ আলকাতরা, চেহারা রক্তবরণ। যেগুলো বললাম, সব রং-রূপের বর্ণনা। আমার কাছে এগুলোর কোনো মূল্য একবারেই নেই। তবু তোমার চিন্তা যেহেতু নিচ প্রকৃতির, তাই তোমার চিন্তা অনুসারে কথা বললাম। শরিয়তের নির্দেশ হলো, মানুষের সঙ্গে কথা বলো তাদের জ্ঞানবুদ্ধির অনুপাতে। শিশুর সঙ্গে কথা বললে তাদের ভাষায় বলতে হবে। মুসার কথা শুনে ফেরাউন চিন্তা করল, মুসা তার খোদার পক্ষে কথা বলেছে। কাজেই প্রস্তাবগুলো ভিত্তিহীন নয়।

মুসাকে বলল, তোমার প্রস্তাব সম্পর্কে মতামত জানানোর জন্য আমাকে দু-একটা দিন সময় দাও। মুসা (আ.) এর প্রস্তাবটি প্রিয় সহধর্মিণী আসিয়াকে গিয়ে বলল। আসিয়া পরামর্শ দিল, কালবিলম্ব না করে তুমি মুসার খোদার ওপর বিশ্বাস স্থাপন করো। আসিয়া আরও বলল, এমন সুন্দর প্রস্তাব সেই মজলিসেই তো গ্রহণ করা উচিত ছিল। এ তো একটি বীজ রোপণ করে হাজার হাজার শস্য ও ফসল ঘরে তোলার মতো; কিংবা এক রত্তি সোনা মাটিতে পোঁতার বিনিময়ে বিরাট স্বর্ণখনি হস্তগত করার মতো লোভনীয় ব্যবসা। এ তো একান্ত আল্লাহর হয়ে যাওয়ার প্রস্তাব। তুমি আল্লাহর হয়ে গেলে আল্লাহও তোমার হয়ে যাবেন। ফেরাউনের বিদুষী স্ত্রী আসিয়া স্বামীর অজান্তে এক আল্লাহয় বিশ্বাসী ছিলেন। এ অপরাধে পরবর্তী সময়ে ফেরাউন অবর্ণনীয় নির্যাতন করে তাকে শহীদ করে। কোরআন মজিদের দুটি স্থানে বিবি আসিয়ার প্রসঙ্গ উল্লেখ আছে। (সূরা কাসাস : আয়াত-৯; সূরা তাহরিম : আয়াত-১১)।

আসিয়ার এমন বলিষ্ঠ বক্তব্য ফেরাউনের মনে আত্মবিশ্বাস জাগাতে পারল না। বলল, বিষয়টি আমি প্রধানমন্ত্রী হামানের সঙ্গেও পরামর্শ করে দেখি। আসিয়া নিষেধ করলেন, খবরদার! হামানকে যদি বল, সে বিভ্রান্ত করবে। হামান ফেরাউনকে বলল, জাহাঁপনা! মুসার কথায় আপনি ফাঁদে পা দেবেন না। মুসা আপনাকে যত ওয়াদা দিয়েছে এর সব পাল্লায় ওজন করলে জনগণ যেভাবে আপনাকে পূজা-অর্চনা দেয় সেরূপ একদিনের সমানও হবে না। শেষ পর্যন্ত হামান ফেরাউনকে রাজকীয় দাম্ভিকতার অন্ধগহ্বরে টেনে নিয়ে গেল।

স্ত্রী আসিয়ার সুন্দর পরামর্শের পরও ফেরাউন কেন হামানের সঙ্গে পরামর্শ করতে গেল মওলানা রুমি তার সহজাত আকর্ষণ দর্শন দিয়ে এর রহস্য বিশ্লেষণ করেছেন। মসনবিতে মওলানার অন্যতম জীবনদর্শন হলো, সৃষ্টিজগৎ বা সত্তাগতভাবে যেসব বস্তু বা ব্যক্তির উৎপত্তি একই উৎস থেকে তা পরস্পরকে আকর্ষণ করে। সৃষ্টিজগতের সর্বত্র ভালো ভালোকে এবং মন্দ মন্দকে আকর্ষণ করে। কাকের বন্ধুত্ব কাকের সঙ্গে আর বাজপাখির আত্মীয়তা বাজপাখির সঙ্গে। এখানেও ফেরাউনের সৃষ্টিস্বভাব যেহেতু মন্দ ছিল তাই সে সৃষ্টিস্বভাবে মন্দ হামানের শরণাপন্ন হলো।

হাদিস শরিফে বর্ণিত, মোমিন যেমন দোজখ থেকে বাঁচার জন্য আল্লাহর কাছে পানাহ চান, দোজখও মোমিনের পদচারণা থেকে বাঁচার জন্য আল্লাহর কাছে পানাহ চায়। অনুরূপ মোমিন যেমন বেহেশতের জন্য আকাক্সক্ষা করে বেহেশতও মোমিনের জন্য প্রতীক্ষার প্রহর গোনে। মওলানা আমাকে-আপনাকে আত্ম আবিষ্কারের পরামর্শ দিয়ে বলেন, চিন্তা করে দেখ, ফেরাউন তোমার মধ্যেও বিরাজ করে। তুমি শুধু অন্যের ঘাড়ে দোষ চাপাও, অন্যদের তোমার দুশমন বলে ভাব। আসলে দুশমনে তো জুয তো নবুয়াদ আই লায়ীন বী গুনা’হা’ন রা’ মগো দুশমন বে কীন
তোমার দুশমন তুমি ছাড়া অন্য কেউ নয়, হে অভিশপ্ত! নিরাপরাধদের বল না অযথা তোমার দুশমন বিদ্বেষবশত।

তোমার দুশমন তোমার ভেতরকার নফসে আম্মারা। মুসারূপ রূহের উপদেশ পেয়ে তোমার ফেরাউনরূপী অন্তর প্রথমে পরামর্শ করে স্ত্রী আসিয়ার সঙ্গে। আসিয়া তোমার বিবেক। কিন্তু কলুষিত অন্তর স্বভাবের টানে হামানরূপী নফসের কাছে যায়। তার কুমন্ত্রণার শিকার ও বিভ্রান্ত হয়। হে সাধক, ওহে মোমিন! এখন তুমি নিজেই নিজের পরীক্ষা নিতে পার। তোমার শেষ পরিণতি বেহেশত নাকি দোজখ, এখই বুঝে নিতে পার। পরীক্ষা নিয়ে দেখ, তোমার অন্তর তোমাকে কোনদিকে টানে। তুমি কি সৎ, সত্য, সুন্দর, ভালো ও ন্যায়ের পথে চলতে ভালোবাস? নাকি, অসুন্দর, অন্যের ক্ষতিসাধন, দাম্ভিকতার পথে চলতে চাও? তুমি কি জান্নাতের অভিসারী, নাকি দোযখের অন্ধকার গলিতে চলতে বিকৃত আনন্দ পাও? গর বে হামান মায়েলী হামানী য়ী গর বে মুসা মায়েলী সুবহানী য়ী তোমার ঝোঁক যদি হয় হামানের দিকে তুমি নাফরমান তোমার মনের টান যদি মুসার দিকে হয়, তবে মুসলমান।