উদ্দেশ করে লেখা, সেই সুচেতা চক্রবর্তীর টুকরো করে কাটা মৃতদেহ পাওয়া গিয়েছে গত শনিবার। যাঁর ব্যাগে পাওয়া গিয়েছে, সেই সমরেশ সরকারই লিখেছেন চিঠি। ডায়েরিটিও তাঁরই। আপাতত তিনি শ্রীরামপুর থানার লক আপে দিব্যি আছেন। খাওয়া-ঘুম কিছুতেই কোনও হেরফের নেই। বুধবার ধর্মঘট নিয়ে পুলিশ যখন ব্যস্ত, সারাটা দিন কার্যত গড়িয়েই কাটিয়েছেন সমরেশ। দুপুরে শালপাতা বিছানো স্টিলের থালায় খেয়েছেন ভাত, ডাল, করলা ভাজা, চচ্চড়ি, কাতলা মাছের ঝোল, পাঁপড়। হাবভাব এতটাই স্বাভাবিক যে পুলিশ হিসেব মেলাতে পারছে না।
একটি রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাঙ্কের ম্যানেজার সমরেশ দুর্গাপুরের মামড়াবাজারে যে আবাসন থাকতেন, সেখান থেকে সুচেতার বিধাননগরের ফ্ল্যাটের দূরত্ব দুই কিলোমিটারেরও কম। সুচেতার স্বামী থাকেন বসিরহাটে। সুচেতার সঙ্গে তাঁর চার বছরের মেয়ে দীপাঞ্জনা (টুকরো করে কাটা হয়েছে তাকেও) থাকত শুধু। ফলে সেখানে যাতায়াতে কোনও বাধা ছিল না সমরেশের। মোবাইল তো ছিলই।
তার পরেও কেন এই চিঠি, যা পরে আর পাঠানো হল না? কেন তাতে বারবার লেখা হল দু’জনের প্রেম ও সম্পর্ক নিয়ে নানা কথা? ওই সব কথা কি ফোনে বা মুখোমুখি বলতে পারছিলেন না সমরেশ? লিখে কি তাঁর মনে হয়েছিল, পাঠানো ঠিক হবে না? না কি, পুরোটাই সাজানো? নিজের প্রেম জাহির করে পুলিশকে বিভ্রান্ত করার ছক?
শনিবার সকালে ব্যারাকপুর থেকে শেওড়াফুলি যাওয়ার ভুটভুটি থেকে চারটে ব্যাগে ভরা মা-মেয়ের কাটা দেহ গঙ্গায় ফেলতে গিয়ে ধরা পড়ে যান সমরেশ। গত পাঁচ দিনে তিনি নানা রকম গল্প ফেঁদে পুলিশকে বিপথে চালিত করার চেষ্টা করেছেন। প্রথমে দাবি করেছিলেন, মেয়েকে খুন করে মা আত্মহত্যা করেছেন। পরে সুচেতাকে খুনের কথা মেনে নিলেও শিশুটিকে মারার কথা মানতে চাননি। শেষে মঙ্গলবার তিনি দু’জনকেই খুন করার কথা কবুল করেছেন বলে পুলিশ সূত্রের দাবি।
ওই দিনই দুপুরে হুগলি পুলিশের একটি দল সমরেশকে দুর্গাপুরে তাঁর ব্যাঙ্কের আবাসনে নিয়ে গিয়েছিল। সুচেতা ও অন্য এক তরুণীর ব্যাঙ্কের আমানত ও সঞ্চয়ের কাগজপত্র তাঁর কাছে ছিল বলে সমরেশ জেরায় জানায়েছিলেন। সেগুলি বাজেয়াপ্ত করার পর পুলিশের চোখে পড়ে ডায়েরির পাতায় লেখা চারটি চিঠি। পুলিশের ধারণা, সেগুলি মাস কয়েকের মধ্যে লেখা। তাদের সংশয়, তবে কি কিছু দিন যাবত তাঁদের সম্পর্ক নিয়ে টানাপড়েনে ভুগছিলেন সমরেশ?
ব্যাঙ্কের সহকর্মীরা পুলিশকে জানিয়েছেন, মায়ের ঘনিষ্ঠ হওয়ার সুবাদে চার বছরের দীপাঞ্জনারও কাছের মানুষ হয়ে উঠেছিলেন সমরেশ। খুন হওয়ার দিন চারেক আগে মেয়েকে নিয়ে ব্যাঙ্কে আসেন সুচেতা। সে দিন শিশুটিকে চকোলেট দিয়ে আদর করতে দেখা গিয়েছিল সমরেশকে। তেমন দু’জনকে পৃথিবী থেকে সরিয়ে ফেলার পরিকল্পনা তবে কবে করলেন তিনি?
পুলিশের মতে, সমরেশ এখনও অনেক কিছুই চেপে রেখেছেন। তাঁর হাবভাব দেখেও অফিসারেরা যথেষ্ট অবাক। পুলিশ লকআপের যে পরিবেশ তাতে সাধারণ মানুষের খাপ খাইয়ে নিতে যথেষ্ট অসুবিধা হয়। কিন্তু ব্যাঙ্কের পদস্থ অফিসার হয়েও সমরেশ নির্বিকার। জেলা পুলিশের এক কর্তা বলেন, ‘‘টানা জেরার সময়েও উনি ভাবলেশহীন ভাবেই জবাব দিচ্ছেন। বিভ্রান্ত করার চেষ্টাও করে যাচ্ছেন।’’ তাঁর দাবি, ‘‘সমরেশই যে হত্যাকারী, তা পরিষ্কার। ঘটনাস্থল পরীক্ষা করে পোক্ত প্রমাণ মিলেছে। তবে আরও কিছু তথ্যের জন্য জেরা আপাতত চালিয়ে যাওয়া হবে।’’
এবং তদন্তের জট খোলার কাজেই চিঠিগুলো সূত্র দেখাতে পারে বলে পুলিশের আশা। যদিও বিভ্রান্ত করার জন্যও চিঠিগুলো লেখা হয়ে থাকতে পারে। পুলিশের একাংশের মতে, খুন করার পরে কোনও ভাবে ধরা পড়ে গেলে হয়তো ওই সব চিঠি দেখাবেন বলে ভেবে রেখেছিলেন সমরেশ। যাতে দাবি করা যায়, সুচেতার প্রতি তাঁর এতই ভালবাসা, যে তাঁর পক্ষে এমন কাজ করা কোনও ভাবেই সম্ভব নয়। ঠিক কখন এবং কী মানসিক পরিস্থিতিতে সমরেশ ওই চিঠিগুলি লিখেছিলেন, ডায়েরি খুঁটিয়ে পড়ে এবং আরও কিছু পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে সেই জট ছাড়ানোর চেষ্টা চলছে।