ঢাকা ১০:৫২ অপরাহ্ন, বৃহস্পতিবার, ১৪ নভেম্বর ২০২৪, ৩০ কার্তিক ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

আক্রান্ত সুন্দরবন, নিশ্চুপ বাংলাদেশ

  • Reporter Name
  • আপডেট টাইম : ০৬:৪৬:৩৩ অপরাহ্ন, বৃহস্পতিবার, ১৪ মে ২০১৫
  • ৪৪২ বার
কতগুলো বাংলা শব্দ প্রশ্নহীনভাবে সুন্দরবনের ‘প্রতিশব্দ’ হয়ে উঠছে। ‘আবারও’ এবং ‘জাহাজডুবি’। ‘আবারও’ সারবোঝাই জাহাজ ডুবেছে সুন্দরবনে। আবারও মৃত্যুযন্ত্রণা পাড়ি দিচ্ছে একক আয়তনে দুনিয়ার বৃহত্তম ম্যানগ্রোভ অরণ্য সুন্দরবন। ৫ এপ্রিল ২০১৫ পূর্ব সুন্দরবন বিভাগের শরণখোলা রেঞ্জের ভোলা নদীর বিমলের চরের কাছে ৫০০ টন পটাশ সার (মিউরেট অব পটাশ) নিয়ে ডুবে যায় জাহাজ ‘জাবালে নূর’। ঘটনার পর জাহাজটি তোলার ব্যাপারে রাষ্ট্র একেবারেই বরাবরের মতো নিশ্চুপ দিন-রাত পার করছে। সুন্দরবনে লাগাতার কখনও সিমেন্ট, কখনও তেল, কখনও সারবোঝাই জাহাজ ডুবছে। আর প্রতিটি অন্যায় ‘দুর্ঘটনা’ নামের একটি আপাত বিচারহীন প্রত্যয়ের মোড়কে ঢাকা পড়ে যাচ্ছে। সাম্প্রতিক সার বিপর্যয়ের পর বিপর্যয়ের কারণ অনুসন্ধানে সুন্দরবন পূর্ব বন বিভাগের বন কর্মকর্তা আমীর হোসাইন চৌধুরীকে প্রধান করে চার সদস্যবিশিষ্ট তদন্ত কমিটি গঠিত হয়েছে। পরিবেশ ও বনবিষয়ক সংসদীয় স্থায়ী কমিটি এ ঘটনায় উদ্বেগ প্রকাশ করেছে। সবচেয়ে আশার বাণী দিয়েছেন নৌপরিবহনমন্ত্রী। সুন্দরবনে সার বিপর্যয়ের পর ১২ মে সচিবালয়ে অনুষ্ঠিত এক সংবাদ সম্মেলনে মংলা-ঘষিয়াখালী চ্যানেলে ২০১৫ সালের জুন থেকে নৌযান চলাচল বন্ধের ঘোষণা দেন নৌপরিবহনমন্ত্রী। আমরা দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করি, এবার হয়তো সুন্দরবনে কিছুটা হলেও নৌযান ‘দুর্ঘটনা’ কমে আসবে। কিন্তু আবারও সেই একই প্রশ্ন জাগে, প্রধানমন্ত্রীও কিন্তু সুন্দরবনের ভেতর দিয়ে নৌপথ বন্ধের নির্দেশ দিয়েছিলেন। বিস্ময়করভাবে কেন জানি কেউ তা মানেনি। ২০১১ সালের ২৪ নভেম্বর প্রধানমন্ত্রী সুন্দরবনের ভেতর দিয়ে নৌরুট বন্ধ করার নির্দেশ দেন। ২০১২ সালের ২১ আগস্ট পরিবেশ ও বন মন্ত্রণালয় নৌপরিবহন মন্ত্রণালয়কে চিঠি দিয়ে নৌরুটটি বন্ধের আহ্বান জানায়। কিন্তু কেউ কারও কথা রাখেনি। বনের ভেতর দিয়ে লাগাতার চলছে জলযান, পরিবহন করছে তেলসহ বনের জন্য বিপজ্জনক পণ্য। হঠাৎ ডুবছে আর ছড়িয়ে দিচ্ছে দুঃসহ দূষণ। আশা করি রাষ্ট্র কি এজেন্সি সবাই এবার সদয় হবেন, সুন্দরবনের ভেতর দিয়ে বিপজ্জনক নৌপথটি পরিহার করবেন।
সুন্দরবনের বাংলাদেশ অংশের পূর্ব সুন্দরবন বিভাগেই মূলত ভারি জলযানের চলাচল বেশি। তাই এ পথেই জলযানডুবি ও তেলদূষণের ঘটনা বেশি। সাম্প্রতিক ঘটনার আগে এরকম বহুবার হলেও কেউ কোনো পাত্তা দেয়নি। মংলা বন্দরের কাছাকাছি ১৯৮৮ সালের ১ জুলাই তেল কার্গো ফুটো হয়ে সুন্দরবনে ডিজেল ছড়িয়ে পড়ে এবং একই সালের ১০ আগস্ট সুন্দরবনের মাজহার পয়েন্টে ট্যাঙ্কার সংঘর্ষে উচ্চমাত্রার সালফারযুক্ত তেল ছড়িয়ে পড়ে সুন্দরবনে। ১৯৯৪ সালের আগস্টে মংলা বন্দরগামী একটি বিদেশি জাহাজ সুন্দরবনের পাশে বানীশান্তায় ডুবে যায় এবং ভাটিতে ২০ কিলোমিটার এলাকায় তেল ছড়িয়ে পড়ে। (সূত্র : পরিবেশ ও বন মন্ত্রণালয়ের প্রতিবেদন, ২০০২)। সুন্দরবনের প্রবীণ জেলেদের সঙ্গে আলাপকালে জানা যায়, সে সময় প্রতিটি ঘটনার পরপরই আশপাশের নদীতে পোনা ও ছোট কাঁকড়া মরে যায় এবং নদী ও খালপাড়ে চারা গাছ কিছুটা কম জন্মে। ২০১৪ সালের ৩০ সেপ্টেম্বর ৬০০ টন সিমেন্টের কাঁচামাল নিয়ে এমভি নয়ন শ্রী-৩ পশুর চ্যানেলে ডুবে যায়। একই সালের ১২ সেপ্টেম্বর পশুর চ্যানেলে প্রায় ৬৩০ টন সিমেন্টের কাঁচামাল নিয়ে এমভি হাজেরা-২ ডুবে যায়। একই সালের ২৪ নভেম্বর যাত্রীবাহী তিনতলা লঞ্চ ‘এম ভি শাহীদূত’ সুন্দরবনের হরিণটানা এলাকায় ডুবে যায়। ওই ঘটনায় বন বিভাগ ৫০ কোটি টাকার একটি ক্ষতিপূরণ মামলা করে। (মামলা নং-২ হরিণ/২০১৪-২০১৫/১৪৯/চাপা)। বন বিভাগের ভাষ্য, ওই লঞ্চডুবির ফলে বনের অনেক জায়গা দুমড়েমুচড়ে গেছে, নাব্যতা সঙ্কট তৈরি হয়েছে এবং অনেক পোনা মরেছে। নৌযান ডুবে সুন্দরবনের সবচেয়ে বড় সর্বনাশটি ঘটে ২০১৪ সালের ডিসেম্বরে। ৯ ডিসেম্বর ২০১৪ ‘এমটি সাউদার্ন স্টার-৭’ নামের একটি কার্গো বোট ডুবে ৩ লাখ ৫৭ হাজার ৬৬৪ লিটার ফার্নেস তেল ছড়িয়ে পড়ে শ্যালা নদীসহ চাঁদপাই রেঞ্জের প্রায় ২০টি খাল, দুটি ভাড়ানি ও বনস্তরে। নিদারুণভাবে ‘এমটি সাউদার্ন স্টার-৭’ নামের কার্গো বোটটি ২০১০ সাল থেকেই সমুদ্র পরিবহন অধিদফতরের লাইসেন্স ছাড়াই শুধু পেট্রোবাংলার অনুমোদন নিয়ে এ পথে চলাচল করছিল। তেল পরিবহনের আগে এটি একটি বালু বহনকারী কার্গো ছিল। আমরা এখনও জানি না পটাশ সার নিয়ে ডুবে যাওয়া এবারের ‘জাবালে নূর’ জাহাজটি আগে কী ছিল বা কীভাবে সংরক্ষিত বনের ভেতর দিয়ে চলাচলের ক্ষমতা সে রপ্ত করেছে।
২০১৪ সালের ডিসেম্বরে সুন্দরবনে তেল বিপর্যয়ের পর সুন্দরবন অঞ্চলের জনগণ থেকে শুরু করে শুধু বাংলাদেশ নয়, গোটা দুনিয়া ভেবেছিল রাষ্ট্র হিসেবে বাংলাদেশ সুন্দরবনের প্রতি আরও মনোযোগী হবে। আরও সংবেদনশীল ও দায়িত্বশীল হবে। কিন্তু কোনোভাবেই তা ঘটেনি। রাষ্ট্র সুন্দরবনের ওপর লাগাতার আঘাতকে অন্যায়ভাবে বৈধতা দিয়ে চলেছে। এখনও সুন্দরবনে একটি নৌযান ডুবি ও দূষণের দৃষ্টান্তমূলক বিচার হয়নি। সুরক্ষিত হয়নি সুন্দরবনের প্রাণিসম্পদের সার্বভৌমত্ব। তা হলে আর দুনিয়ার বৃহত্তম ম্যানগ্রোভ অরণ্য নিয়ে এত বৈশ্বিক দরবার করার কী আছে! কারণ সুন্দরবনের ওপর মৃত্যু আঘাত চাপিয়ে দিয়ে বৈশ্বিক জলবায়ু দেনদরবারে সুন্দরবনকে এক গুরুত্বপূর্ণ কার্বন শোষণাগার বলার সাহস কি বাংলাদেশ এখনও করছে?
সুন্দরবনকে অনেকে ইউনেস্কো ঘোষিত ৫২২নং বিশ্ব ঐতিহ্য এবং ৫৬০তম রামসার অঞ্চল হিসেবে বর্ণনা করতে পছন্দ করেন। পাশাপাশি এ বন বিশ্বের একক বৃহত্তম ম্যানগ্রোভ অরণ্য, ইরাবতী ডলফিনের সর্ববৃহৎ বিচরণস্থল। ১৯৯৯ সালে সুন্দরবনের চার পাশের ১০ কিলোমিটার এলাকাকে প্রতিবেশগত সঙ্কটাপন্ন এলাকা ঘোষণা করা হয়েছে। সবচেয়ে বড় কথা সুন্দরবন বাংলাদেশের সংরক্ষিত বনভূমি। বাংলাদেশ পরিবেশ সংরক্ষণ (সংশোধন) আইন ২০১০ এর ৩নং বিধি অনুযায়ী প্রতিবেশগত সঙ্কটাপন্ন এলাকার জলাভূমির বৈশিষ্ট্য পরিবর্তন বা নষ্ট করা আইনত দ-নীয় অপরাধ। পাশাপাশি বন্যপ্রাণী সংরক্ষণ ও নিরাপত্তা আইন ২০১২ অনুযায়ী সংরক্ষিত বনে নৌপথসহ সব ধরনের কর্মকা-ই আইনত নিষিদ্ধ। বিস্ময়করভাবে ২০১১ সালে সুন্দরবনে ঘোষিত হয়েছে তিনটি ডলফিন অভয়াশ্রম। অথচ আইন উপেক্ষা করে সুন্দরবনে চলছে ভারি জলযান, ঘটছে বিপর্যয়। প্রতিটি ঘটনার পর রাষ্ট্র একে বলে দিচ্ছে ‘দুর্ঘটনা’। ভারত-বাংলাদেশ নৌপ্রটোকল রুট ও দক্ষিণাঞ্চলের সঙ্গে দেশের নৌবাণিজ্য যোগাযোগ পথ হিসেবে ব্যবহৃত ঘষিয়াখালী চ্যানেল মংলা নালা ও রামপালের কুমার নদ ভরাট হয়ে প্রায় তিন বছর ধরে বন্ধ রয়েছে। তখন থেকেই সুন্দরবনের ভেতর দিয়ে শ্যালা নদীকে নৌপথ হিসেবে ব্যবহার করছে অভ্যন্তরীণ নৌ কর্তৃপক্ষ। প্রতিটি নৌযানডুবির পর সুন্দরবনের জটিল বাস্তুসংস্থান কখনও সিমেন্ট, কখনও রাসায়নিক সার, কখনও তেলের নির্দয় আক্রমণে রক্তাক্ত হয়েছে। তারপরও সুন্দরবনের বাস্তুসংস্থান টিকে থাকার জানপ্রাণ লড়াই করে যাচ্ছে, এ যে প্রজাতির মৌলিক বিজ্ঞান। তার মানে এই নয় যে, একতরফা বাণিজ্যের মুনাফা কি রাজনৈতিক বাহাদুরি দিয়ে প্রাণ ও প্রকৃতির বিজ্ঞানের ওপর বারবার মৃত্যু আঘাত ছুড়ে দেবে রাষ্ট্র বা রাষ্ট্রের প্রশ্রয় পাওয়া কোনো করপোরেট এজেন্সি। সাম্প্রতিক পটাশ সার বিপর্যয়ের ফলে সুন্দরবন বাস্তুসংস্থান একইভাবে আগের বিপর্যয়গুলোর মতোই ক্ষতবিক্ষত হয়েছে। খাদ্যশৃঙ্খল থেকে শুরু করে বাস্তুসংস্থানের জটিল গণিত চুরমার হয়েছে। জানি তারপরও সুন্দরবন টিকে থাকার সংগ্রাম করে যাবে, বাংলাদেশ কি বিশ্ববাসীর স্বার্থেই। সাম্প্রতিক সারবোঝাই জাহাজডুবির সুষ্ঠু তদন্ত ও ন্যায়বিচার আবারও প্রার্থনা করছি রাষ্ট্রের কাছে। আশা করছি, নৌপরিবহনমন্ত্রীর সাম্প্রতিক ঘোষণা সত্যি হবে। সুন্দরবনের ভেতর দিয়ে সব ধরনের নৌপথ বন্ধ হবে। সুন্দরবনের সুরক্ষায় রাষ্ট্র, জনগণ এবং অরণ্যজীবনের ভেতর বিকশিত হোক ন্যায্যতার বিজ্ঞান।
Tag :

Write Your Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Save Your Email and Others Information

About Author Information

Haor Barta24

জনপ্রিয় সংবাদ

আক্রান্ত সুন্দরবন, নিশ্চুপ বাংলাদেশ

আপডেট টাইম : ০৬:৪৬:৩৩ অপরাহ্ন, বৃহস্পতিবার, ১৪ মে ২০১৫
কতগুলো বাংলা শব্দ প্রশ্নহীনভাবে সুন্দরবনের ‘প্রতিশব্দ’ হয়ে উঠছে। ‘আবারও’ এবং ‘জাহাজডুবি’। ‘আবারও’ সারবোঝাই জাহাজ ডুবেছে সুন্দরবনে। আবারও মৃত্যুযন্ত্রণা পাড়ি দিচ্ছে একক আয়তনে দুনিয়ার বৃহত্তম ম্যানগ্রোভ অরণ্য সুন্দরবন। ৫ এপ্রিল ২০১৫ পূর্ব সুন্দরবন বিভাগের শরণখোলা রেঞ্জের ভোলা নদীর বিমলের চরের কাছে ৫০০ টন পটাশ সার (মিউরেট অব পটাশ) নিয়ে ডুবে যায় জাহাজ ‘জাবালে নূর’। ঘটনার পর জাহাজটি তোলার ব্যাপারে রাষ্ট্র একেবারেই বরাবরের মতো নিশ্চুপ দিন-রাত পার করছে। সুন্দরবনে লাগাতার কখনও সিমেন্ট, কখনও তেল, কখনও সারবোঝাই জাহাজ ডুবছে। আর প্রতিটি অন্যায় ‘দুর্ঘটনা’ নামের একটি আপাত বিচারহীন প্রত্যয়ের মোড়কে ঢাকা পড়ে যাচ্ছে। সাম্প্রতিক সার বিপর্যয়ের পর বিপর্যয়ের কারণ অনুসন্ধানে সুন্দরবন পূর্ব বন বিভাগের বন কর্মকর্তা আমীর হোসাইন চৌধুরীকে প্রধান করে চার সদস্যবিশিষ্ট তদন্ত কমিটি গঠিত হয়েছে। পরিবেশ ও বনবিষয়ক সংসদীয় স্থায়ী কমিটি এ ঘটনায় উদ্বেগ প্রকাশ করেছে। সবচেয়ে আশার বাণী দিয়েছেন নৌপরিবহনমন্ত্রী। সুন্দরবনে সার বিপর্যয়ের পর ১২ মে সচিবালয়ে অনুষ্ঠিত এক সংবাদ সম্মেলনে মংলা-ঘষিয়াখালী চ্যানেলে ২০১৫ সালের জুন থেকে নৌযান চলাচল বন্ধের ঘোষণা দেন নৌপরিবহনমন্ত্রী। আমরা দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করি, এবার হয়তো সুন্দরবনে কিছুটা হলেও নৌযান ‘দুর্ঘটনা’ কমে আসবে। কিন্তু আবারও সেই একই প্রশ্ন জাগে, প্রধানমন্ত্রীও কিন্তু সুন্দরবনের ভেতর দিয়ে নৌপথ বন্ধের নির্দেশ দিয়েছিলেন। বিস্ময়করভাবে কেন জানি কেউ তা মানেনি। ২০১১ সালের ২৪ নভেম্বর প্রধানমন্ত্রী সুন্দরবনের ভেতর দিয়ে নৌরুট বন্ধ করার নির্দেশ দেন। ২০১২ সালের ২১ আগস্ট পরিবেশ ও বন মন্ত্রণালয় নৌপরিবহন মন্ত্রণালয়কে চিঠি দিয়ে নৌরুটটি বন্ধের আহ্বান জানায়। কিন্তু কেউ কারও কথা রাখেনি। বনের ভেতর দিয়ে লাগাতার চলছে জলযান, পরিবহন করছে তেলসহ বনের জন্য বিপজ্জনক পণ্য। হঠাৎ ডুবছে আর ছড়িয়ে দিচ্ছে দুঃসহ দূষণ। আশা করি রাষ্ট্র কি এজেন্সি সবাই এবার সদয় হবেন, সুন্দরবনের ভেতর দিয়ে বিপজ্জনক নৌপথটি পরিহার করবেন।
সুন্দরবনের বাংলাদেশ অংশের পূর্ব সুন্দরবন বিভাগেই মূলত ভারি জলযানের চলাচল বেশি। তাই এ পথেই জলযানডুবি ও তেলদূষণের ঘটনা বেশি। সাম্প্রতিক ঘটনার আগে এরকম বহুবার হলেও কেউ কোনো পাত্তা দেয়নি। মংলা বন্দরের কাছাকাছি ১৯৮৮ সালের ১ জুলাই তেল কার্গো ফুটো হয়ে সুন্দরবনে ডিজেল ছড়িয়ে পড়ে এবং একই সালের ১০ আগস্ট সুন্দরবনের মাজহার পয়েন্টে ট্যাঙ্কার সংঘর্ষে উচ্চমাত্রার সালফারযুক্ত তেল ছড়িয়ে পড়ে সুন্দরবনে। ১৯৯৪ সালের আগস্টে মংলা বন্দরগামী একটি বিদেশি জাহাজ সুন্দরবনের পাশে বানীশান্তায় ডুবে যায় এবং ভাটিতে ২০ কিলোমিটার এলাকায় তেল ছড়িয়ে পড়ে। (সূত্র : পরিবেশ ও বন মন্ত্রণালয়ের প্রতিবেদন, ২০০২)। সুন্দরবনের প্রবীণ জেলেদের সঙ্গে আলাপকালে জানা যায়, সে সময় প্রতিটি ঘটনার পরপরই আশপাশের নদীতে পোনা ও ছোট কাঁকড়া মরে যায় এবং নদী ও খালপাড়ে চারা গাছ কিছুটা কম জন্মে। ২০১৪ সালের ৩০ সেপ্টেম্বর ৬০০ টন সিমেন্টের কাঁচামাল নিয়ে এমভি নয়ন শ্রী-৩ পশুর চ্যানেলে ডুবে যায়। একই সালের ১২ সেপ্টেম্বর পশুর চ্যানেলে প্রায় ৬৩০ টন সিমেন্টের কাঁচামাল নিয়ে এমভি হাজেরা-২ ডুবে যায়। একই সালের ২৪ নভেম্বর যাত্রীবাহী তিনতলা লঞ্চ ‘এম ভি শাহীদূত’ সুন্দরবনের হরিণটানা এলাকায় ডুবে যায়। ওই ঘটনায় বন বিভাগ ৫০ কোটি টাকার একটি ক্ষতিপূরণ মামলা করে। (মামলা নং-২ হরিণ/২০১৪-২০১৫/১৪৯/চাপা)। বন বিভাগের ভাষ্য, ওই লঞ্চডুবির ফলে বনের অনেক জায়গা দুমড়েমুচড়ে গেছে, নাব্যতা সঙ্কট তৈরি হয়েছে এবং অনেক পোনা মরেছে। নৌযান ডুবে সুন্দরবনের সবচেয়ে বড় সর্বনাশটি ঘটে ২০১৪ সালের ডিসেম্বরে। ৯ ডিসেম্বর ২০১৪ ‘এমটি সাউদার্ন স্টার-৭’ নামের একটি কার্গো বোট ডুবে ৩ লাখ ৫৭ হাজার ৬৬৪ লিটার ফার্নেস তেল ছড়িয়ে পড়ে শ্যালা নদীসহ চাঁদপাই রেঞ্জের প্রায় ২০টি খাল, দুটি ভাড়ানি ও বনস্তরে। নিদারুণভাবে ‘এমটি সাউদার্ন স্টার-৭’ নামের কার্গো বোটটি ২০১০ সাল থেকেই সমুদ্র পরিবহন অধিদফতরের লাইসেন্স ছাড়াই শুধু পেট্রোবাংলার অনুমোদন নিয়ে এ পথে চলাচল করছিল। তেল পরিবহনের আগে এটি একটি বালু বহনকারী কার্গো ছিল। আমরা এখনও জানি না পটাশ সার নিয়ে ডুবে যাওয়া এবারের ‘জাবালে নূর’ জাহাজটি আগে কী ছিল বা কীভাবে সংরক্ষিত বনের ভেতর দিয়ে চলাচলের ক্ষমতা সে রপ্ত করেছে।
২০১৪ সালের ডিসেম্বরে সুন্দরবনে তেল বিপর্যয়ের পর সুন্দরবন অঞ্চলের জনগণ থেকে শুরু করে শুধু বাংলাদেশ নয়, গোটা দুনিয়া ভেবেছিল রাষ্ট্র হিসেবে বাংলাদেশ সুন্দরবনের প্রতি আরও মনোযোগী হবে। আরও সংবেদনশীল ও দায়িত্বশীল হবে। কিন্তু কোনোভাবেই তা ঘটেনি। রাষ্ট্র সুন্দরবনের ওপর লাগাতার আঘাতকে অন্যায়ভাবে বৈধতা দিয়ে চলেছে। এখনও সুন্দরবনে একটি নৌযান ডুবি ও দূষণের দৃষ্টান্তমূলক বিচার হয়নি। সুরক্ষিত হয়নি সুন্দরবনের প্রাণিসম্পদের সার্বভৌমত্ব। তা হলে আর দুনিয়ার বৃহত্তম ম্যানগ্রোভ অরণ্য নিয়ে এত বৈশ্বিক দরবার করার কী আছে! কারণ সুন্দরবনের ওপর মৃত্যু আঘাত চাপিয়ে দিয়ে বৈশ্বিক জলবায়ু দেনদরবারে সুন্দরবনকে এক গুরুত্বপূর্ণ কার্বন শোষণাগার বলার সাহস কি বাংলাদেশ এখনও করছে?
সুন্দরবনকে অনেকে ইউনেস্কো ঘোষিত ৫২২নং বিশ্ব ঐতিহ্য এবং ৫৬০তম রামসার অঞ্চল হিসেবে বর্ণনা করতে পছন্দ করেন। পাশাপাশি এ বন বিশ্বের একক বৃহত্তম ম্যানগ্রোভ অরণ্য, ইরাবতী ডলফিনের সর্ববৃহৎ বিচরণস্থল। ১৯৯৯ সালে সুন্দরবনের চার পাশের ১০ কিলোমিটার এলাকাকে প্রতিবেশগত সঙ্কটাপন্ন এলাকা ঘোষণা করা হয়েছে। সবচেয়ে বড় কথা সুন্দরবন বাংলাদেশের সংরক্ষিত বনভূমি। বাংলাদেশ পরিবেশ সংরক্ষণ (সংশোধন) আইন ২০১০ এর ৩নং বিধি অনুযায়ী প্রতিবেশগত সঙ্কটাপন্ন এলাকার জলাভূমির বৈশিষ্ট্য পরিবর্তন বা নষ্ট করা আইনত দ-নীয় অপরাধ। পাশাপাশি বন্যপ্রাণী সংরক্ষণ ও নিরাপত্তা আইন ২০১২ অনুযায়ী সংরক্ষিত বনে নৌপথসহ সব ধরনের কর্মকা-ই আইনত নিষিদ্ধ। বিস্ময়করভাবে ২০১১ সালে সুন্দরবনে ঘোষিত হয়েছে তিনটি ডলফিন অভয়াশ্রম। অথচ আইন উপেক্ষা করে সুন্দরবনে চলছে ভারি জলযান, ঘটছে বিপর্যয়। প্রতিটি ঘটনার পর রাষ্ট্র একে বলে দিচ্ছে ‘দুর্ঘটনা’। ভারত-বাংলাদেশ নৌপ্রটোকল রুট ও দক্ষিণাঞ্চলের সঙ্গে দেশের নৌবাণিজ্য যোগাযোগ পথ হিসেবে ব্যবহৃত ঘষিয়াখালী চ্যানেল মংলা নালা ও রামপালের কুমার নদ ভরাট হয়ে প্রায় তিন বছর ধরে বন্ধ রয়েছে। তখন থেকেই সুন্দরবনের ভেতর দিয়ে শ্যালা নদীকে নৌপথ হিসেবে ব্যবহার করছে অভ্যন্তরীণ নৌ কর্তৃপক্ষ। প্রতিটি নৌযানডুবির পর সুন্দরবনের জটিল বাস্তুসংস্থান কখনও সিমেন্ট, কখনও রাসায়নিক সার, কখনও তেলের নির্দয় আক্রমণে রক্তাক্ত হয়েছে। তারপরও সুন্দরবনের বাস্তুসংস্থান টিকে থাকার জানপ্রাণ লড়াই করে যাচ্ছে, এ যে প্রজাতির মৌলিক বিজ্ঞান। তার মানে এই নয় যে, একতরফা বাণিজ্যের মুনাফা কি রাজনৈতিক বাহাদুরি দিয়ে প্রাণ ও প্রকৃতির বিজ্ঞানের ওপর বারবার মৃত্যু আঘাত ছুড়ে দেবে রাষ্ট্র বা রাষ্ট্রের প্রশ্রয় পাওয়া কোনো করপোরেট এজেন্সি। সাম্প্রতিক পটাশ সার বিপর্যয়ের ফলে সুন্দরবন বাস্তুসংস্থান একইভাবে আগের বিপর্যয়গুলোর মতোই ক্ষতবিক্ষত হয়েছে। খাদ্যশৃঙ্খল থেকে শুরু করে বাস্তুসংস্থানের জটিল গণিত চুরমার হয়েছে। জানি তারপরও সুন্দরবন টিকে থাকার সংগ্রাম করে যাবে, বাংলাদেশ কি বিশ্ববাসীর স্বার্থেই। সাম্প্রতিক সারবোঝাই জাহাজডুবির সুষ্ঠু তদন্ত ও ন্যায়বিচার আবারও প্রার্থনা করছি রাষ্ট্রের কাছে। আশা করছি, নৌপরিবহনমন্ত্রীর সাম্প্রতিক ঘোষণা সত্যি হবে। সুন্দরবনের ভেতর দিয়ে সব ধরনের নৌপথ বন্ধ হবে। সুন্দরবনের সুরক্ষায় রাষ্ট্র, জনগণ এবং অরণ্যজীবনের ভেতর বিকশিত হোক ন্যায্যতার বিজ্ঞান।