শিক্ষকতা পেশায় যারা নিয়োজিত, সম্মানের দিক দিয়ে তারা সমাজের সবচেয়ে উঁচুস্তরের মানুষ। কিন্তু সম্মানজনক সম্মানী প্রাপ্তির দিক দিয়ে তারা আজও পাতালেই রয়ে গেছেন। সরকার আসে, সরকার যায়; কিন্তু শিক্ষকদের ভাগ্যের পরিবর্তন হয় না। শিক্ষানীতি, শিক্ষা আইন, মন্ত্রীদের বক্তৃতা-বিবৃতি, নেতাদের শ্লোগানে শিক্ষকদের সম্মান ও সম্মানীর বিষয়টি যুগ যুগান্তরে উচ্চারিত হয়েছে। কিন্তু কোনো সরকারই শিক্ষকদের সম্মানের বিষয়টি বিবেচনা করে সম্মানজনক বেতন কাঠামো প্রণয়ন করেনি।
প্রাক-প্রাথমিক বিদ্যালয় থেকে বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ের প্রতিটি স্তরে শিক্ষকতা পেশায় নিয়োজিতরা তাই জীবনের অধিকাংশ সময় মানবেতর জীবন যাপন করেন। শিক্ষকরা ক্লাসে ছাত্রদের যে প্রবাদ প্রবচন পড়ান সেই ‘হ্যান্ড টু মাউথ’ অথবা ‘নুন আনতে পানতা ফুরায়’ -প্রবাদটিই তাদের নিত্যসঙ্গী। শিক্ষকের ছাত্ররাই ওই প্রবাদ বাক্য শিখে সিএসপি অফিসার হন। বিসিএস, জেসিএস পাশ করে ম্যাজিস্ট্রেট, ডিসি, এসপি, জর্জ-ব্যারিস্টার ও অফিসের বড় কর্তার পদ অলঙ্কৃত করেন।
শিক্ষকের ¯েœহের শিক্ষার্থীরাই প্রধানমন্ত্রী, মন্ত্রী, শিক্ষামন্ত্রী, ডিজির মহাপরিচালক পদে আসীন হন। কিন্তু দুর্ভাগ্য শিক্ষকদের পিছু ছাড়ে না। ওই সম্মানটুকু নিয়েই তাদের সন্তুষ্ট থাকতে হয়। প্রধানমন্ত্রী, মন্ত্রী, এমপি, বিচারকরা নিজ শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে গেলে অথবা শিক্ষককে কাছে পেলে পুরাতন স্মৃতি রোমন্থন করে আনন্দে বিগলিত হন। কিন্তু শিক্ষকদের সম্মানীর বিষয়টি নিয়ে মুখে রা’টি পর্যন্ত করেন না। পাছে যদি গাঁটের পয়সা খরচ হয়!
মহামান্য বিচারকরা কত শত বিষয়ে স্বপ্রণোদিত রায় প্রদান করেন অথবা আইনজীবীরা প্রায়শই এটা-ওটা নিয়ে হাইকোর্ট-সুপ্রিম কোর্টে রিট করেন অথবা আদালতের নজরে আনেন; কিন্তু দুর্ভাগ্য শিক্ষকদের তারা এখনও পর্যন্ত এমন কোনো ছাত্র তৈরি করতে পারেনি; যিনি শিক্ষকদের মানবেতর জীবন যাপনের বিষয়টি আদালতের নজরে আনবেন। সরকারি ও বিরোধী দলের সব নেতাই তো শিক্ষকদের ছাত্র, তারা কেন সংসদে বিল উত্থাপন করেন না এই বিষয়ে? এই রকম হাজারো প্রশ্ন আমার মাথার ভিতর প্রায় ঘুরপাক খায়। এমন ভাবনা ভুল না শুদ্ধ জানি না; তবে এমন ভাবি, হয়তো নিজেই শিক্ষকতা পেশায় নিয়োজিত আছি তাই!!!
দুই
‘যে দেশে গুনীর কদর নেই, সে দেশে গুনি জন্মে না’। বাংলাদেশের জন্য এই উক্তিটি বেমানান। কারণ এদেশে গুনির কদর করা না হলেও আল্লাহর রহমতে গবরে পদ্ম ফুল প্রতি যুগে কয়েক ডজন ফোঁটে। তারা সারা বিশ্বে এদেশের মাথা উঁচু করেন। এমনই একজন খ্যাতিমান অধ্যাপককে কয়েক বছর আগে একজন সংসদ সদস্য সংসদে বলেছিলেন: তিনি একজন শিক্ষক। তার এত টাকা কোথা থেকে আসে? গাড়ি বাড়ি কোথায় পান?… ইত্যাদি। এই ধারণাটি শুধু ওই সম্মানিত সংসদ সদস্যের নয়; প্রায় পুরো সমাজ বা রাষ্ট্রযন্ত্র এমনটি বিশ্বাস করে বলে ৮ম পে স্কেল নিয়ে যে নাটক হচ্ছে তা দেখে মনে হয়। আর এমন ধারণা হওয়ার কারণ আবহমান কালের চিরাচরিত ঐতিহ্য: ‘প্রকৃত প-িত মশায় মানে ধবধবে সাদা পুরাতন পাঞ্জাবি গাঁয়ে, ভাঙ্গা ছাতা হাতে, মরচে ধরা হাতল ওয়ালা সাইকেলে অথবা কখনও পায়ে হেঁটে মাইলে পর মাইল যেয়ে ছাত্র পড়ানো ব্যক্তির ছবি’ আমাদের মানসপটে ফুঁটে ওঠে। আমরা ধরেই নেই যে, যিনি অধিক বিদ্বান, তিনি হবেন অতি ভদ্র, বিদ্যার ভারে তার মাথা সব সময় ন্যূয়ে থাকবে।
আর্য, মৌযর্, গুপ্ত, হুন, পাল, সেন, সুলতানী, পাঠান, মুঘল, ইংরেজ কিংবা স্বাধীন বাংলাদেশ সর্বদাই ওই একই চিত্র। বাংলার বাইরে উমাইয়া-আব্বাসীয় খিলাফত, অটোমান সালতানও এর ব্যতিক্রম ছিল না। তাই শিক্ষা ব্যবস্থার নানা দিক নিয়ে ইতিহাসগ্রন্থগুলোয় আলোচনা থাকলেও ওই সব যুগে শিক্ষকদের বেতন কাঠামো কেমন ছিল সে সম্পর্কে আলোকপাত একেবারেই নেই বলেলেই চলে। দয়া করে দুই একজন ঐতিহাসিক এই বিষয়ে যা আলোকপাত করেছেন তা থেকে জানা যায় যে, বৈদিক যুগে শিক্ষকরা কোনো গুরু দক্ষিণা গ্রহণ করতেন না। ভিক্ষা দ্বারা জীবন-নির্বাহ করতেন। পাল যুগে বিহারগুলোতেই প-িতদের থাকা খাওয়ার সুবন্দোবস্ত ছিল। রাজা বিহারের জন্য যে কর মুক্ত জমি দান করতেন সেখান থেকেই শিক্ষার্থীদের পাশাপাশি শিক্ষকদের ব্যয় নির্বাহ হতো। মুঘল দরবার থেকে ঢাকার শিক্ষা বিস্তারে নিযুক্ত শেষ শিক্ষক মৌলভী আসাদ উল্লাহর বেতন ছিল মাসিক ৬০ টাকা।
বঙ্গদেশে আধুনিক ধাঁচের সর্বপ্রথম উচ্চ আরবি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে (১৭৬৫ সালে বর্ধমানের বুহারে জমিদার মুনশির সদরুদ্দীন প্রতিষ্ঠা করেন) শিক্ষক মোল্লা নিযামুদ্দীনের পুত্র আবদুল আলীম বাহারুল মাসিক ৪০০ টাকা বেতন পেতেন। ব্রিটিশ ভারতে সরকার ইংরেজি শিক্ষা প্রসারের জন্য যে দু’জন সহকারী পরিদর্শক নিয়োগ করতেন; তাদের মাসিক ২০০-৩০০ টাকা প্রদান করা হতো। এই রকম কম-বেশি দু’চারটি উদাহরণ দেয়া যাবে। কিন্তু সামগ্রিকভাবে একথা সত্য যে, সব যুগেই শিক্ষকদের বেতনের বিষয়টি উপেক্ষিত থেকেছে। আর এই উপেক্ষার ধারবাহিকতাই ফরাস উদ্দিন পে কমিশন রক্ষা করেছে! তাই তাদেরকে খুব দোষ দেয়া যায় না!!!
তবে বেতন কম হলেও সর্ব যুগ সর্বকালে শিক্ষকতা পেশাকে সম্মানজনক পেশা হিসেবেই বিবেচনা করা হয়েছে। খলিফা হারুন-আল রশীদ (৭৮৬-৮০৯ খ্রি.) তার পুত্র আল-আমীনের শিক্ষককে রাজপুত্রকে প্রহারের অনুমতিও দিয়েছিলেন। তিনি তার পুত্রের শিক্ষককে যে নির্দেশনা দিয়েছিলেন তা থেকেই জানা যায়: ‘এত কড়া হবেন না যাতে তার বুদ্ধিবৃত্তিক বিকাশ রুদ্ধ হয় অথবা এমন নরম হবেন না যাতে সে আলস্য উপভোগ করতে পারে এবং কুঁড়েমিটাই তার অভ্যাসে পরিণত হয়। ¯েœহ ও দয়ার স্পর্শে তাকে সহজ-সরল করে গড়ে তুলুন; কিন্তু তাতে যদি সে সাড়া না দেয়, তাহলে কঠোর হাতে ও প্রয়োজনে মারধর করতেও দ্বিধা করবেন না।’ মুঘল বাদশা আওরঙ্গজেব আলমগীরের (১৬৫৮-১৭০৭ খ্রি.) শিক্ষককে সম্মান প্রদর্শনের বিষয়টি ইতিহাস খ্যাত। কবি কাজী কাদের নেওয়াজের ভাষায়:
“… বাদশাহ কহেন, ‘সেদিন প্রভাতে
দেখিলাম আমি দাঁড়ায়ে তফাতে
নিজ হাতে যবে চরণ আপনি করেন প্রক্ষালন,
পুত্র আমার জল ঢালি শুধু ভিজাইছে ও চরণ।
নিজ হাত খানি আপনার পায়ে বুলাইয়া সযতনে
ধুয়ে দিল না কেন সে চরণ, স্মরি ব্যথা পাই মনে।
উচ্ছ্বাস ভরে শিক্ষক তবে দাঁড়ায়ে সগৌরবে,
কুর্ণিশ করি বাদশাহর তরে কহেন উচ্চরবে-
‘আজ হতে চির উন্নত হল শিক্ষা গুরুর শির
সত্যই তুমি মহান উদার বাদশাহ আলমগীর।” (শিক্ষা গুরুর মর্যাদা)
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানও শিক্ষকদের মর্যাদার বিষয়ে সচেষ্ট ছিলেন। তার জীবনী পাঠ থেকে জানা যায় যে, ‘এক বার তার গৃহশিক্ষকের গুটি বসন্ত হয়েছিল। ফলে ওই শিক্ষকের ঘরে কেউ যেতে চাইতো না। বঙ্গবন্ধু শিক্ষকের সেবায় নিজেকে নিয়োজিত করলেন। তিনি গরম পানি করে শিক্ষককে ¯œান করান, বিছানার চাদর বদলে দেন।’ কিন্তু আজ সেই সম্মানটুকুও যেতে বসেছে! সরকারের কর্তা ব্যক্তি থেকে সমাজের সমাজের নিচু তলার মানুষ কেউই আর শিক্ষকদের আগের মতো সম্মান দিতে চান না। কারণ এখন সম্মানের মাপকাঠি বিদ্যা নয়, টাকা। তাই তো ডিসি সাহেবরা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য মহোদয়কে চেয়ার থেকে তুলে দিয়ে সেই চেয়ারে বসে নিজেদের ক্ষমতার দাপট দেখান!
চার
শিক্ষক হিসেবে আমি ব্যক্তিগতভাবে সম্মান ও সম্মানী দু’টিই চাই। প্রাক-প্রাথমিক বিদ্যালয় থেকে বিশ্ববিদ্যালয় স্তরের শিক্ষকদের বেতন অন্য যে কোনো চাকরির বেতনের চেয়ে বেশি হওয়া উচিত বলে আমি মনে করি। যদি শিক্ষকদের বেতন তাদের সম্মানের সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে প্রদান করা হয়; তবেই কেবল মেধাবীরা এই পেশাকে গ্রহণ করবে। আমাদের দেশে প্রাথমিক বিদ্যালয়ের একজন প্রধান শিক্ষক তৃতীয় শ্রেণীর মর্যাদা পায়। ওই বিষয়টি আমাকে পীড়িত করে। কারণ প্রাথমিকেই একজন শিক্ষার্থীর ফাউন্ডেশন বা ভিত্তি তৈরি হয়। আর ওই দুর্বল ফাউন্ডেশন বা ভিত্তির ওপর অনেক তলা নির্মিত হলে ভবিষ্যৎ-এ যে তা রানা প্লাজার মত ধসে পড়বে, তা আর বলার অপেক্ষা রাখে না।
আমাদের অফিস-আদালতে তৃতীয় শ্রেণীর কমকর্তা-কর্মচারী কারা, আমরা কি একবার ভেবেছি? ওই তৃতীয় শ্রেণীদের হাতে আমাদের জাতির ভবিষ্যৎ কা-ারিরা বেড়ে উঠছে ভাবা যায়! (আমি তৃতীয় শ্রেণীর কর্মকর্তা-কর্মচারী বা প্রাথমিকের শিক্ষকদের ছোট করতে চাইছি না। আমি বাস্তব অবস্থা বুঝাতে চাইছি।) তৃতীয় শ্রেণীর হাতে বেড়ে ওঠা একটা শিশু চিন্তা-চেতনায় তৃতীয় শ্রেণীর হবে, এটাই কি স্বাভাবিক নয়? আর কোনো শিক্ষকের অর্থনৈতিক অবস্থা যদি দুর্বল হয় এবং সারাদিন যদি তাকে চিন্তা করতে হয় যে, মাসের বাকি ১৫ দিন আমি কিভাবে সংসার চলাবো? -সেই বিষয়ে; তবে তাকে দিয়ে অন্তত সুশিক্ষিত জাতি গড়ে তোলা সম্ভব নয়।
শিক্ষা আইন, শিক্ষানীতি এই রকম গ-ায় গ-ায় হাজারে হাজারে নিয়ম কানুন তৈরি করলেও শিক্ষকদের উপযুক্ত বেতন প্রদান ছাড়া শিক্ষার মানের উন্নয়ন অসম্ভব। সুশিক্ষিত ও দক্ষ জনশক্তি গড়ে তুলতে হলে প্রথমে শিক্ষকদের সম্মানের সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে সম্মানী প্রদান করতে হবে।
আর যদি শিক্ষকদের উপযুক্ত বেতন কাঠামো প্রণয়ন করা যায়; তবে শিক্ষকরা নিজ থেকেই টিউশনি পরিহার করবে, বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে পাঠদানে বিরত হবে, ক্লাস ও পরীক্ষা গ্রহণের নিয়মিত সময় দেবে। অন্যথায় যত আইনই করা হোক না কেন, সামগ্রিক অবস্থার খুব বেশি পরিবর্তন হবে বলে মনে হয় নয়।
শিক্ষকরা আইনের ফাঁক ফোঁকর বের করে, রাজনৈতিক প্রভাব খাটিয়ে পূর্বের নিয়মেই চলবে। কিন্তু আমরা সব সরকারকেই দেখেছি শিক্ষককের উচ্চতর বেতনের বিষয়টির প্রতি নজর না দিয়ে অন্য সব কম গুরুত্বপূর্ণ বিষয় নিয়ে মেতে থাকতে। যার ফলে দেখা যাচ্ছে শিক্ষা ব্যবস্থা ভারসাম্য হারাচ্ছে। তবে একথা সত্য যে, সব সরকারই শিক্ষকদের বেতন বৃদ্ধি ও স্বতন্ত্র বেতন স্কেল প্রবর্তন, বেতন কমিশনের প্রয়োজনীয়তার কথা স্বীকার করেছেন। বছরের পর বছর ওইগুলো বাস্তবায়ন করা হবে বলে আশ্বাসও প্রদান করছেন। অনেকটা মুলা ঝুলিয়ে রাখা আর কী? এখন অপেক্ষা করার পালা এই মুলা ঝুলিয়ে রাখার অবসান কবে হয়।
অপেক্ষার কথা শুনে সেদিন আমার এক তরুণ সহকর্মী আমার উপর বেজায় ক্ষেপেছিলেন! তিনি অনেকটা উত্তেজিত হয়ে বলছিলেন, অপেক্ষা নয়, আমাদের উচিত পে স্কেলে যাতে আমাদের সম্মান ও সম্মানীর বিষয়টি ঠিক থাকে সে জন্য এখনই আন্দোলন করা। আন্দোলন ছাড়া বাস্তবায়িত হবে না শিক্ষকদের স্বতন্ত্র পে স্কেল। শিক্ষকরা পাবে না তাদের প্রকৃত মর্যাদা। সদ্য বিশ্ববিদ্যালয় যোগ দেয়া এই তরুণ সহকর্মীর কথা শুনে মুচকি হাসলাম। আমার হাসির অর্থ হয়তো সে বোঝেনি! কিন্তু সেদিন হয়তো তাকে বলিনি, দলবাজ শিক্ষক নেতাদের আধিপত্যের এই যুগে কার ঘাড়ে কয়টা মাথা আছে, সরকারের বিরুদ্ধে আন্দোলন করবে!!!
আজ আমার এই কথা শুনে সদ্য বিশ্ববিদ্যালয়ে যোগ দেয়া ওই সহকর্মীর মতো অনেকেই হয়তো রাগ করবেন, কিন্তু আমাদের মতো অনেক দিন বিশ্ববিদ্যালয়ে চাকরি করার পর আশা করি উপলব্ধি করতে পারবেন। শিক্ষকদের সম্মান ও সম্মানীর জন্য সরকার বা পে কমিশন যতটা না দায়ী তার চেয়ে বেশি দায় ওই সব দলকানাদের!। অধ্যক্ষ আসাদুল হক