ঐতিহ্য আনন্দ উৎসবে আবার দ্বারপ্রান্তে পহেলা বৈশাখ। নতুন বছরকে বরণ করে নিতে এদিন
বাঁধনহারা আনন্দে-উৎসবে মেতে
ওঠে বাঙালি। ঐতিহ্যবাহী লোকজ আনুষ্ঠানিকতা, বাঙালিয়ানা খাবার আর সাজপোশাকে ঘটে এ আনন্দের বহির্প্রকাশ। লিখেছেনÑ
বর্ষবরণের সূচনা হয়েছিল মূলত সম্রাট আকবরের সময়। কৃষকদের খাজনা পরিশোধ করার সুবিধার্থে মোগল সম্রাট আকবর ১৫৮৪ খ্রিস্টাব্দে বাংলা সন প্রবর্তন করেন। সে সময় কৃষকরা চৈত্র মাসের শেষ দিন পর্যন্ত জমিদার, ভূস্বামীদের খাজনা পরিশোধ করতেন। পরদিন নববর্ষে ভূস্বামীরা তাদের মিষ্টিমুখ করাতেন। ষাটের দশকের
গোড়ায় ছায়ানট রমনায় বর্ষবরণ উৎসবের সূচনা করে, যা কালক্রমে আজ বাঙালির সর্বজনীন উৎসবে পরিণত হয়েছে। বর্ষবরণের ঐতিহ্য সম্পর্কে সম্মিলিত সাংস্কৃতির জোটের সভাপতি নাসির উদ্দীন ইউসুফ বলেন, ‘ষাটের দশকের শুরুতে বর্ষবরণকে উৎসব হিসেবে পালন করা শুরু হলেও মূলত স্বাধীনতাপরবর্তী সময়েই বৈশাখী উৎসব ধীরে ধীরে সর্বজনীন উৎসবে রূপ নিতে থাকে। এ উৎসবের ঐতিহ্য আরও ব্যাপক পরিসরে ছড়িয়ে দিতে তরুণ সমাজকেই এগিয়ে আসতে হবে।’
নববর্ষের প্রথম প্রহর মানেই আনন্দ আর উৎসবের আমেজ। নতুন বছরকে বরণ করে নিতে সূর্যোদয়ের সঙ্গে সঙ্গে ছায়ানটের শিল্পীরা রমনা বটমূলে একসঙ্গে গেয়ে ওঠে, ‘এসো হে বৈশাখ, এসো এসো’। এদিন বৈশাখী রঙ লাল-সাদায় সেজে ওঠে ছোট-বড় সবাই। বৈশাখে বাঙালিয়ানা সাজপোশাকে একতারা, ডুগডুগি হাতে তরুণ-তরুণীরা বাঙালির ঐতিহ্যবাহী লোকজ সংস্কৃতিকে হৃদয়ে ধারণ করে ফেরে যেন শিকড়ে। ফাস্টফুডে অভ্যস্ত তরুণ-তরুণীরাও এদিন মহাতৃপ্তিতে খেয়ে ওঠে পান্তা-ইলিশ।
বাংলা বর্ষবরণের মূল আচার অনুষ্ঠান শুরু হয়ে যায়
চৈত্রসংক্রান্তির মধ্য দিয়ে। চৈত্র মাসের শেষ বিকাল থেকে শুরু হয়ে মধ্যরাত পর্যন্ত ঢাকার তাঁতীবাজার, শাখারীবাজার, সূত্রাপুরসহ দেশের বিভিন্ন জেলায় চলে চৈত্রসংক্রান্তির উৎসব। বৈশাখের প্রথম প্রহরে আয়োজন করা হয় মঙ্গল শোভাযাত্রার। মঙ্গল শোভাযাত্রায় ছোট-বড় সবাই ঢোল, ডুগডুগি আর বাঁশির সুরে মেতে ওঠে উৎসবের আমেজে। নববর্ষকে বরণ করে নেওয়ার জন্য দেশের বিভিন্ন স্থানে আয়োজন করা হয় বৈশাখী মেলা, লোকজ গান আর যাত্রাপালার। এ আয়োজনে ক্লান্তিহীন আনন্দে মেতে ওঠে গ্রামবাসীর মতো নগরবাসীও। পিঠা, মুড়ি-মুড়কি, বাতাসা আর পান্তা-ইলিশের আয়োজন চলে ঘরে ঘরে। হালখাতা আর ক্রেতাদের মিষ্টিমুখ করিয়ে
এদিন ব্যবসায়ীরা শুরু করেন নতুন বছরের হিসাব-নিকাশ।
পহেলা বৈশাখে নতুন পোশাক পরে ঘুরে বেড়ানো এ যেন এখন বৈশাখী উৎসবের এক অবিচ্ছেদ্য অংশ। তবে একসময় বর্ষবরণে নতুন পোশাক পরার চল তেমন ছিল না বললেই চলে এমনটাই জানান টাঙ্গাইল শাড়ি কুটিরের স্বত্বাধিকারী মুনিরা ইমদাদ। তিনি বলেন, ‘শুরুর দিকে বর্ষবরণে নতুন পোশাক পরার চল ছিল না। গরমকে মাথায় রেখে করা শাড়িগুলোই তখন বর্ষবরণে পরা হতো। ক্রমে বর্ষবরণে নতুন পোশাক পরার চল শুরু হয়। সে সময় বৈশাখী সাজে পরা হতো মূলত লাল পাড়ের সাদা জমিনের গরদের শাড়ি। পহেলা বৈশাখে সুতি শাড়ি পরার চলটা শুরু হয় আশির দশকে। টাঙ্গাইল শাড়ি কুটিরই প্রথম পহেলা বৈশাখ উপলক্ষে ঢাকায় লাল পাড়ের সাদা সুতি শাড়ি আনে। এটি এখন বাঙালির ঐতিহ্যে পরিণত হয়েছে।’
শাড়িতেই লুকিয়ে থাকে ষোলো আনা বাঙালিয়ানা। বৈশাখের এবার তাঁতে বোনা সুতি জামদানি ও সুতি শাড়ির ওপর সুতার কাজ এবং ব্লক শাড়ির চাহিদা বেশি। মসলিন, সিল্ক শাড়ির কদরও রয়েছে। সন্দেশের ছাঁচ, সাপলুডু, রেশমি চুড়ি, বাংলা চলচ্চিত্র, কবিতা, পটচিত্র, মুখোশ, ঢোল-তবলাসহ বিভিন্ন রকম বাঙালিয়ানা ঐতিহ্যে অ্যাপ্লিক, হাতের কাজ, ব্লক, হ্যান্ডপেইন্ট, ব্রাশপেইন্টের মাধ্যমে ফুটিয়ে তোলা হয়েছে শাড়ি, পাঞ্জাবি, সালোয়ার-কামিজ, টপস, কুর্তি, ফতুয়ার নকশা। ডিজাইনার শাহীন আহম্মেদ জানালেন, ‘প্যাটার্ন কাট কুর্তা এখন বেশ ট্রেন্ডি। পেছনে লম্বা এবং সামনে খাটো, কোরা দুটি ভি-আকৃতি, দুই স্তরের নকশা। ঢিলেঢালা হাতা, ফুলেল প্রিন্ট নকশার বৈচিত্র্যময় কাটছাঁটের টপস, কুর্তি এবার তরুণীদের বৈশাখী ট্রেন্ডি।
শিশুদের সালোয়ার-কামিজ, শাড়ি, ফ্রক, ফতুয়া, পাঞ্জাবি, টি-শার্টে কটবেসডের পাশাপাশি এমব্র্রয়ডারি, হাতের কাজ, সিকোয়েন্স, প্রিন্ট গুরুত্ব পেয়েছে এবার। শিশুদের পোশাকের ক্যাপশন হিসেবে ফোক আর্ট, পাখা, কলস, পাখিসহ নানা রকম লোকজ মোটিফ ব্যবহার হয়েছে। বৈশাখের মূল রঙ লাল-সাদা হলেও এখন নীল, হলুদ, বেগুনি, সবুজসহ বিভিন্ন রঙে রঙিন হয়ে উঠছে বৈশাখী পোশাক।
সময়ের সঙ্গে বৈশাখী সাজেও এসেছে ব্যাপক পরিবর্তন। লাল টিপ, টানা কাজল, আইলাইনারের সঙ্গে রেশমি চুড়ি, পরিপাটি খোঁপা বেণি ছাড়াও এলোবেণি, টুইস্ট বেণি, রিং বেণিসহ বিভিন্ন ধরনের খোঁপা, বেণিতে পূর্ণতা আনতে পারেন বৈশাখী সাজে। তবে দিনময় উৎসবের আনন্দে মাতোয়ারা থাকতে ঘুরেফিরে সুস্থ ও সতেজ থাকাটাও জরুরি। সারা দিনের জন্য বেরোনোর পরিকল্পনা থাকলে আরামদায়ক পোশাক ও জুতা বেছে নিন। সঙ্গে শিশু থাকলে তাদের নিরাপত্তা ও আরাম দুটিতেই বাড়তি নজর রাখতে হবে। ঘুরতে বের হওয়ার সময় সঙ্গে অবশ্যই পানির বোতল, ছাতা ও সানগ্লাস সঙ্গে রাখতে ভুলবেন না।