পর্ব (২)
ড্রয়িংরুমের সামনে যেতেই তিলের হাত পা কাপতে লাগলো। আল্লাহ এতগুলো ছেলে কোথা থেকে আসলো? এর মধ্যে রিদ ভাইয়া কোনটা? ছোটবেলা আর বড়বেলার চেহারা কি এক হবে?? আমি কি চিনতে পারবো?? ইশ! রিমা আমাকে কতবার উনার ছবি দেখাতে চাইলো আর আমি ফালতু রাগ দেখিয়ে মুখের উপর বলে দিয়েছিলাম,তোর ভাই কি ঘোড়ায়চড়া রাজকুমার যে আমি দেখতে যাবো? তোর ভাই গাদা চড়ার গরুকুমার। আর আমি গরুকুমারদের দেখিনা!
তিল ওড়নার নিচ দিয়ে সবাইকে দেখার চেষ্টা করতে লাগলো। কোনটা তার রিদ ভাইয়া! এদিকে পায়ের সাথে হাতটাও তাল মিলিয়ে কাপছে সাথে চায়ের কাপ টকটক করে শব্দ শুরু করে দিয়েছে। মনে হচ্ছে আজ কাপেরা মিলে যুদ্ধ বেধে যাচ্ছে কে আগে ফেটে গিয়ে চা নিচে গড়িয়ে ফেলতে পারে।
তীল কাপদের ঝাকানি নিয়ে এক সাইড থেকে চা বাড়িয়ে দিচ্ছে সবাইকে। হঠাৎই,,
“” এভাবে সঙ সেজে সামনে দিয়ে ঘুরঘুর করছিস কেন? তোর কি মনে হয় আমি ইউকে থেকে এসেছি তোর মতো কুৎসিত সঙের সার্কাস দেখার জন্য?? আর আড়াইহাত লম্বা ঘোমটা দিয়ে কি প্রমান করতে চাচ্ছিস,তুই খুব পর্দা করিস? ছেলেদের সামনে আসতে লজ্জা পাস? নাকি নিজেকে খুব রুপবতী ভাবিস যে আমরা দেখলে তোর রুপ খসে খসে নিচে পড়বে???””
রিদের এমন রিদয়ঘাত কথা শুনে তীলের হাত থেকে চায়ের ট্রেটা টুপ করে মেঝেতে পড়ে গেলো। চায়ের কাপগুলো এবার যেন যুদ্ধে জয়ী হয়ে নিজেদেরকে বিসর্জন দিলো। তিলের বুঝতে বাকি রইলোনা এমন ঝাঝালো কথা তাকে কে বলতে পারে। তিলের চোখ নোনা পানিতে তৈ তৈ করছে। কাপা কাপা পা নিয়ে ড্রয়িংরুম থেকে বেরিয়ে আসে। মাথাটা উচু করে তার রিদ ভাইয়াকে দেখার সাহস হলোনা। চুপচাপ নিজের রুমে চলে আসলো।
বুকের ভেতরটা কেমন হুহু করছে। যার অনুপস্থিতে বুকের ভেতরে এতো ব্যথা অনুভব হতো তার উপস্থিতে তা যেন দ্বিগুন হারে বেড়ে গেলো। তিলের ইচ্ছে হলো ব্যথার হারটাকে হিসেব করে বের করতে। কি পরিমান ব্যথা হচ্ছে জানতে পারলে তো মন্দ হয়না। কিন্তু হারটা কি স্বাভাবিকভাবেই ধরবো নাকি চক্রবৃদ্ধীতে???? আর রিদ ভাইয়াকে প্রেজেন্ট ভেল্যু ধরবো নাকি ফিউচার ভেল্যু??
~~
“” তোর এতো দেমাক কিসের, তিল? তুই সামান্য শাড়ীর কাছে আমাকে হারিয়ে দিলি?””
তিল নিজের কাপড় গুছানো রেখে রিমার দিকে তাকালো। পুরো শরীরে হলুদের মাঝামাখি। কি অপরুপ লাগছে রিমাকে। কই আগে তো কখনো এতো সুন্দর লাগেনি তাহলে কি বিয়ের ছোয়া রিমাকে এক ঝটকায় সুন্দরী বানিয়ে দিলো? আমার গায়ে হলুদেও বুঝি আমাকে এমনি সুন্দর লাগবে?
“” কি হলো কথা বলছিস না কেন? কাল তো তোদের ছেড়ে চলেই যাবো। তাই বুঝি আজকেই পর করে দিলি? তুই এতো পাষান তিল?? আমার গায়ে হলুদের ছোয়া লাগাতে এলিনা?””
“” তুই তো বলেছিলি শাড়ী না পড়লে তোর সামনে যাওয়া নিষেধ!””
“” আমি রাগ করে বললাম দেখে তুই যাবিনা? এই তুই আমার বেস্টফ্রেন্ড?? আর আমার জন্য একটু শাড়ী পড়লে কি এমন হতো শুনি?””
তিল কিছু বলতে যাবে তার আগেই রিমা শাড়ী গুটিয়ে বেড়িয়ে গেলো। বেশ অভিমান করেছে খুব বুঝতে পারছে তিল। কিন্তু তাতে তিলের কষ্ট লাগেনি বরংচ ঠোটে হাসি ফুটে উঠেছে। মনে মনে বিড়বিড় করে বললো,
“” বাব্বাহ,এতো রাগ?””
সে রাতে তিলের ঘুম হলোনা। সে তো তার ব্যথার হার বের করায় বিজি ছিলো। যার উত্তরের ডিজিটগুলো একক,দশক,শতকে মিলিয়ে পড়তে পড়তে রাত পেরিয়ে ভোর হয়ে গেলো। ভোরের আযান কানে আসতেই তিল ওযু করে নামাজটা পরে নিলো। নিজের রুম থেকে বেড়িয়ে সিড়ি বেয়ে উপরে উঠে গেলো। কেন জানি আজ খোলা আকাশের নিচে মনভরে নিশ্বাস নিতে ইচ্ছে করছে।
তিল দুহাত দুদিকে প্রসারিত করে শব্দ করে লম্বা নিশ্বাস নিতেই হালকা কেশে উঠলো। ধুর ছাই! নিশ্বাসটাও ঠিকমতো নিতে শিখলাম না। কিছুটা মুখটা ভেংচি কেটে নিচে নামতেই মনে হলো রিদ ভাইয়ার রুমে একটু উকি দিতে। আচ্ছা উনি কি এখনো ঘুমাচ্ছে? কোন রুমে শুয়েছেন উনি? আবার এমন নয় তো উনার গরুর পাকবাহিনীকে সাথে নিয়ে ঘুমিয়েছে?
তিল এতো ভাবনা ছেড়ে ছোটবেলা রিদ যে রুমে ঘুমাতো সে রুমের কাছাকাছি এসে থেমে গেলো। দরজায় হালকা বল প্রয়োগে নড়ে উঠলো। তারমানে দরজা খুলেই ঘুমিয়েছে। কিন্তু কেন? উনিও কি আমার মতো দরজা আটকিয়ে ঘুমাতে ভয় পান নাকি ইচ্ছে করেই খুলে রেখেছেন?
তিল দরজাটা যেইনা আরেকটু খুলতে যাবে অমনি ভেতর থেকে রিদ বলে উঠে,
“” আমার রুমে রুপ খসিয়ে পড়া মেয়েদের ঢুকা নিষেধ। আর নিষেধ অবজ্ঞা করার শাস্তি কি হতে পারে সেটা জানতে চাইলে ভেতরে আসতে পারে!””
রিদের মুখে শাস্তির কথা শুনেই তিল ভয়ে চোখ বন্ধ করে,সেই ছোটবেলাতে চলে গেলো,
“” এ্যাা,এ্যাা,এ্যাা,আমাল হাতে লাগছে লিদ ভাইয়া। আম্মু! বলো আব্বু,লিদ ভাইয়া আমাকে মালছে। আমাল কষ্ট লাগছেতো,লিদ ভাইয়া!
রিদ বাশের সবুজ,চিকন কুন্চিটা আরোশক্ত করে চেপে ধরে তীলের হাতে লাগাতার বাড়ি মেরে যাচ্ছে,
“” তোকে মানা করেছিলাম রবিনের সাথে খেলবিনা? তোর এতো বড় সাহস আমার নিষেধ অবজ্ঞা করলি? ওর পুতুলের সাথে তোর পুতুলের বিয়ে?? আজ মেরে তোর হাত দিয়ে রক্ত বের করে ফেলবো আর সেই রক্ত দিয়ে তোর পুতুলকে রাঙিয়ে বউ সাজাবো। দেখি কত বিয়ে দিতে পারিস।””
তিল সাথে সাথে চোখ খুলে ফেললো,রিদের রুমের দরজাটা ঝট করে টেনে দিয়ে নিজের হাতটা সরিয়ে ফেলে। চোখের সামনে ডানহাতটা মেলে ধরতেই মনে হলো হাত দিয়ে রক্ত পড়ছে! আজ এতো বছরও কি এই রক্ত পড়া বন্ধ হবেনা???
~~
“” রিমা,তুই নাকি আমাকে ডেকেছিস?””
রিমার চোখে মেকাপ আর্টিস্ট কাজল লাগিয়ে দিচ্ছে তাই তিলের দিকে তাকাতে পারলোনা। চোখদুটো বড়বড় করে একটু বাকিয়ে উপরের দিকে তাকিয়েই বললো,
“” তোর নাকি জামাই মরে গেছে?””
“” মানে??””
রিমা কাজল দেওয়া শেষ করে তিলের কাছে এগিয়ে এসে বললো,
“”আমাকে না জানিয়ে বিয়ে করে জামাইকে মেরে ফেললি?””
“” এসব কি উল্টাপাটা বলছিস রিমা?””
রিমা তিলকে টেনে নিজে যেখানে বসে বউ সাজছিলো সেখানে বসিয়ে দিলো। আয়নায় তিলের চোখে চোখ রেখে বললো,
“” তোকে দেখেতো সেরকমই লাগছে তিল! তোর বেস্টফ্রেন্ডের বিয়ে,কোথায় তুই সেজেগুজে বাড়ি মাতিয়ে রাখবি তা না বিধবা মেয়ের মতো ঘুরঘুর করছিস! আমি চলে গেলে আমার মায়ের মুখটাতে হাসি ধরে রাখার দায়িত্বটা তো তোরই। এমনভাবে মনমরা হয়ে আছিস,যেন সবার কষ্ট তুই একা ভোগ করার দায়িত্ব নিয়েছিস!””
রিমা মেকাপ আর্টিস্টদের চোখের ইশারা দিতেই সবাই এতে হুমড়ি খেয়ে পড়লো তিলের উপর। গলার ওড়নাটায় হাত দিতেই চিৎকার করে উঠে,
“” আরে কি করছেন আপনারা?””
রিমা সবাইকে হাতের ইশারায় থামিয়ে দিয়ে নিজে তিলের সামনে এসে ওড়নাটা খুলতে খুলতে বললো,
“”তোর এই গোলাপি ঠোট,মায়া চোখ,গোলাপী গাল গুলোকে ঢাকলে তোকে কেমন দেখা যায় সেটা দেখবো। মনে কর এটা আমার তোর কাছে চাওয়া আমার বিয়ের সেরা গিফট।””
রিমা কি বুঝাতে চাচ্ছে বুঝার জন্য ফেলফেল করে ওর মুখের দিকে তাকিয়ে রইলো তিল। যেন ওর মুখের দিকে এভাবে কিছুক্ষন তাকালেই সব বুঝতে পারবে!
“” যা,এই জামাটা ছেড়ে ব্লাউজ আর পেডিকোটটা পড়ে আয়।””
তিল কিছু বলতে যাবে তার আগেই রিমা বলে উঠে,
“” মুখ দিয়ে আর একটা শব্দ বের হলে আমার মুখ দিয়ে কবুল বের হবেনা। আর তুই জানিস আমি যা বলি তা করেই ছাড়ি!””
তিল অসহায়ের মতো মুখ করে রিমার হাত থেকে ব্লাউজ আর পেডিকোটটা নিয়ে ওয়াশরুমে ঢুকে গেলো।
“” এই মেয়ে তোমাকে আমার তিল মায়ের মতো লাগছে! নাম কি গো তোমার?””
তাসমিয়া বেগমের এমন আচরনে তিলের ইচ্ছে হলো আবার যদি মায়ের পেটে ঢুকা যেতো! কি লজ্জা,কি লজ্জা!! নিজের মা, নিজের মেয়েকে চিনতে পারছেনা,আমি কি এমনি অভাগী মেয়ে??? আচ্ছা এটা নিয়ে ফেসবুকে পোস্ট দিলে কেমন হবে? নিশ্চয় হাজার হাজার হা হা রিয়েক্ট আসবে। এমন ও তো হতে পারে এই একটা পোস্ট আমাকে ভাইরাল করে দিলো???
শাড়ী পড়ে বের হওয়ার পর থেকে তিলের মনে হচ্ছে কেউ তাকে খুব কাছ থেকে দেখছে। এমনভাবেই দেখছে মনে হচ্ছে তাকে খুটিয়ে খুটিয়ে দেখছে। তিল বার বার চারপাশে চোখ বুলিয়েও সেরকম চোখের দেখা পেলোনা। কিন্তু হঠাৎ এমন মনে হওয়ার কারন কী?? তিল পুরো বাড়ী ঘুরে চষে বেড়িয়েও রিদ ভাইয়ার দেখা পাচ্ছে না হঠাৎ এমন নাই হয়ে গেলো কিভাবে? গেলেন কোথায় উনি? রিদকে না পেয়ে চোখগুলো যেমন তাকে খোচাচ্ছে তার চেয়ে দ্বিগুন খোচাচ্ছে তার পড়নের শাড়ী। মাঝে মাঝেই কুচিতে পা লেগে পড়ে যাওয়ার উপক্রম হচ্ছে। এদিকে মনে হচ্ছে শাড়ীর নীচ দিয়ে ঠান্ডা বাতাস ঢুকছে। খুবই বাজে ফিল হচ্ছে। মাঝে মাঝে তো এমন লাগছে মনে হচ্ছে আমি কোনো জামাই পড়িনি। কি অদ্ভুত ফিলিং রে বাবা!
তীল এতোকিছুকে পা মাড়িয়ে রিদকেই খুজে যাচ্ছে। এতক্ষন পর্যন্ত তাকে যে দেখেছে সেই বলেছে তাকে খুবই সুন্দর লাগছে। আর এই সুন্দরটা তার রিদ ভাইয়া না দেখলেতো সব বৃথততততততা,
কিছু একটার সাথে পা লেগে ধপাস করে তিল পড়ে যেতে নিলে একটা ছেলে এসে ধরে ফেলে,
তিল চোখ,মুখ,কুচকিয়ে একদিকে হেলে আছে। ছেলেটার হাত বাধা হিসেবে কাজ করায় তিল মাঝ পথেই আটকে আছে এখনো মাটিতে পড়েনি।
“” ওয়াও,চোখ জুরিয়ে গেলো। হোয়াটস ইউর নেম প্রিটি গার্ল?””
তিল চোখ মেলে তাকাতেই ছেলেটি বলে উঠলো,
“” আমি সিজাত,ইউ কেন কল মি সিজ!””
তিল ছেলেটার দিকে ভালো করে তাকাতেই মনে হলো তার পেটের ডানপাশটাতে কিছু একটা চেপে বসে আছে। তিল নিজের হাত দিয়ে ওখানটাই হাত দিতেই বুঝতে পারলো ওটা অন্য কিছুনা এই বেটা সিজারের হাত। তিল আবার চোখ মুখ কুচকিয়ে গলা ফাটিয়ে চিৎকার দিয়ে বললো,
“” সিজার,হাত সরান!””
~~
রিমাকে বিদায় দিয়ে বড় আব্বু,বড় আম্মুকে সামলিয়ে ঘুম পাড়াতে পাড়াতে মাঝরাত হয়ে গেলো। তিল বড্ড ক্লান্ত হয়ে যাওয়া শরীরটা বিছানায় মেলে দিলো। রিমার জন্য মনটা বারবার কেদে উঠছে। ভাবতেই বুক ফেটে যাচ্ছে এখন থেকে তাকে একাই চলতে হবে,একা একাই সব কিছু করতে হবে। এই পুরো পরিবারটার খেয়ালও তাকে একাই রাখতে হবে। ভাবতেই বুকের ভেতর বড় পাথরের চাপ অনুভব হলো। এতোকিছুর ভেতরেও ক্লান্ত শরীরকে ঠান্ডা করতে চোখে ঘুম নেমে আসলো তিলের।
ঘুমের ঘোরেই তিলের মনে হলো কেউ তার উপর উঠে আসছে। তার পড়নের জামাটায় কেউ হাত দিয়ে পেটের দিক থেকে জামাটা সরাচ্ছে। তিল ঝট করে চোখ খুলতেই মাথাভর্তি ঝাঝড়া চুল দেখতে পেলো। মাথাটা আসতে আসতে নিচের দিকে যাচ্ছে। তিলকে অবাক করে দিয়ে তিলের পেটের ডানপাশটাতে কামড় বসিয়ে দিলো৷ তিল চিৎকার করতে নিলেই ওর মুখটা চেপে ধরে এক জোড়া চোখ তার দিকে চেয়ে রইলো,
“” আমি শাড়ী পরাতে গেলেই তোর কান্না পায়,ব্যথা লাগে,সুড়সুড়ি লাগে। আর এখন নিজে পেট বের করে শাড়ী পড়ে ছেলেদের পাগল করে বেড়াচ্ছিস? তাও আমাদের বাড়িতে আমারি ফ্রেন্ডের? এর শাস্তি তোকে পেতেই হবে তিল!””
ব্যথায় তিলের চোখ বেয়ে পানি গড়িয়ে কানে গিয়ে ঠেকছে। মুখ থেকে হাতটা সরে যেতেই তিল চাপা স্বরে বলে উঠে,
“” লিদ ভাইয়া??””
“” তুই এখনো ‘র’ বলা শিখিসনি??””