জেলহত্যার ঘাতকরা কে কোথায়

কেন্দ্রীয় কারাগারে জাতীয় চার নেতা হত্যা মামলার বিচারিক কার্যক্রম শেষ হওয়ার সাড়ে তিন বছর পার হলেও এখনও পলাতক ১১ খুনিকে খুঁজে বের করা সম্ভব হয়নি। দণ্ডিত পলাতকদের আদৌ দেশে ফিরিয়ে আনা সম্ভব কিনা তা নিয়ে সংশয় দেখা দিয়েছে। সরকারের পক্ষ থেকে বলা হচ্ছে, পলাতকদের দেশে ফিরিয়ে এনে দণ্ড কার্যকর করা হবে। পলাতক খুনিদের মধ্যে একজন জার্মানিতে, অন্যরা কানাডা, যুক্তরাষ্ট্র, সেনেগাল ও জিম্বাবুয়েতে রয়েছেন বলে জানা গেছে।

বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে সপরিবারে নির্মমভাবে হত্যার পর ১৯৭৫ সালের ৩ নভেম্বর কেন্দ্রীয় কারাগারে বন্দি অবস্থায় হত্যা করা হয় জাতীয় চার নেতা সৈয়দ নজরুল ইসলাম, তাজউদ্দীন আহমদ, এম মনসুর আলী এবং এএইচএম কামরুজ্জামানকে। পরদিন তৎকালীন উপ-কারামহাপরিদর্শক (ডিআইজি প্রিজন) কাজী আবদুল আউয়াল লালবাগ থানায় একটি হত্যা মামলা করেন।

জেলহত্যা মামলার পলাতক আসামি দফাদার মারফত আলী শাহ ও আবুল হাশেম মৃধার বিরুদ্ধে দেওয়া নিম্ন আদালতের মৃত্যুদণ্ডের রায় বহাল রেখে ২০১৩ সালের ৩০ এপ্রিল রায় ঘোষণা করেন সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগ। একইসঙ্গে তাদেরকে বেকসুর খালাস দিয়ে হাইকোর্টের দেওয়া রায় বাতিল ঘোষণা করা হয়। তৎকালীন প্রধান বিচারপতি মো. মোজাম্মেল হোসেনের নেতৃত্বে আপিল বিভাগের ছয় বিচারপতির বেঞ্চ এ রায় ঘোষণা করেন। এর আগে একই বছরের ১৭ এপ্রিল মামলার আপিলের শুনানি শেষ হলে ৩০ এপ্রিল রায় ঘোষণার দিন ধার্য করেন আদালত।

জেলহত্যার ঘাতকরা কে কোথায়?

২০০৪ সালের ২০ অক্টোবর ঢাকা মহানগর দায়রা জজ মো. মতিউর রহমান মামলার রায় দেন। এতে রিসালদার মোসলেম উদ্দিন (পলাতক), দফাদার মারফত আলী শাহ (পলাতক) ও এল ডি দফাদার আবুল হাসেম মৃধাকে (পলাতক) মৃত্যুদণ্ড দেওয়া হয়। রায়ের বিরুদ্ধে আসামিপক্ষ আপিল করলে ২০০৮ সালে হাইকোর্ট মোসলেম উদ্দিনের মৃত্যুদণ্ড বহাল রেখে মারফত আলী ও হাশেম মৃধাকে খালাস দেয়। আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় যাওয়ার পর ২০০৯ সালের ১৪ সেপ্টেম্বর হাইকোর্টের ওই রায়ের বিরুদ্ধে আপিলের আবেদন (লিভ টু আপিল) করা হয়। হাইকোর্ট ফাঁসির তিন আসামির মধ্যে শুধু দুজনকে খালাস দেওয়ায় রায়ের ওই অংশটির বিরুদ্ধে আপিল করেছিল রাষ্ট্রপক্ষ। পলাতক আসামিদের পক্ষে আপিলের কোনো আবেদন হয়নি।

এই মামলায় বিচারিক আদালত যাবজ্জীবন কারাদণ্ড দেয় সেনা কর্মকর্তা খন্দকার আবদুর রশিদ, শরিফুল হক ডালিম, বজলুল হুদা, এমএইচএম বি নূর চৌধুরী, একেএম মহিউদ্দিন আহমেদ, এএম রাশেদ চৌধুরী, আহমদ শরিফুল হোসেন, আবদুল মাজেদ, মো. কিসমত হোসেন, নাজমুল হোসেন আনসার, সৈয়দ ফারুক রহমান, সুলতান শাহরিয়ার রশিদ খানকে। এদের মধ্যে ফারুক, শাহরিয়ার রশিদ, বজলুল হুদা ও একেএম মহিউদ্দিনকেও খালাস দিয়েছিল হাইকোর্ট। তবে বঙ্গবন্ধু হত্যা মামলায় এই চারজনের মৃত্যুদণ্ড কার্যকর হয়েছে। অন্যরা পলাতক। এদের মধ্যে মেজর আহমদ শরিফুল হোসেন, ক্যাপ্টেন মো. কিসমত হাশেম ও ক্যাপ্টেন নাজমুল হোসেন আনসার ছাড়া বাকিরা বঙ্গবন্ধু হত্যা মামলায় মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত। তারা এখনও পলাতক রয়েছেন। নিম্ন আদালতের রায়ে খালাস পান বিএনপি নেতা প্রয়াত কে এম ওবায়দুর রহমান, শাহ মোয়াজ্জেম হোসেন, নুরুল ইসলাম মঞ্জুর, তাহেরউদ্দিন ঠাকুর, সেনা কর্মকর্তা মো. খায়রুজ্জামান ও আজিজ পাশা।

জেলহত্যা মামলায় দণ্ডিত পলাতক এগারো জন হলেন, মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত রিসালদার মোসলেম উদ্দিন, দফাদার মারফত আলী শাহ ও এল ডি দফাদার আবুল হাসেম মৃধা। যাবজ্জীবন দণ্ডপ্রাপ্ত সেনা কর্মকর্তা খন্দকার আবদুর রশিদ, শরিফুল হক ডালিম, এমএইচএম বি নূর চৌধুরী, এএম রাশেদ চৌধুরী, আহমদ শরফুল হোসেন, আবদুল মাজেদ, ক্যাপ্টেন মো. কিসমত হাশেম ও নাজমুল হোসেন আনসার। পলাতক খুনিদের মধ্যে একজন জার্মানিতে, অন্যরা কানাডা, যুক্তরাষ্ট্র, সেনেগাল ও জিম্বাবুয়েতে রয়েছেন বলে জানা গেছে।

বঙ্গবন্ধু ও জেলহত্যার নায়ক খুনি সাবেক রিসালদার মোসলেউদ্দিন খান জার্মানিতে পালিয়ে আছেন বলে সম্প্রতি সরকারি গণমাধ্যম বাসসকে জানিয়েছেন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খাঁন কামাল।

তিনি বলেন, ‘আমরা জানতে পেরেছি- জাতির পিতা শেখ মুজিবুর রহমান ও জেলহত্যা মামলার পলাতক খুনি মোসলেউদ্দিন জার্মানিতে বসবাস করছেন। তবে জার্মানির কোথায় মোসলেউদ্দিন বসবাস করছেন, এ ব্যাপারে আমরা এখনো নিশ্চিত হতে পারিনি। খুনিদের দেশে ফিরিয়ে আনতে কূটনৈতিক ও আইনি প্রচেষ্টা চালানো হচ্ছে বলেও জানান তিনি।

এছাড়া পলাতক আসামিদের মধ্যে তিনজন যথাক্রমে সাবেক লে. কর্নেল এসএইচএমবি নূর চৌধুরী কানাডায়, লে. কর্নেল রাশেদ চৌধুরী যুক্তরাষ্ট্রে বসবাস করছেন বলেও জানা গেছে। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী বলেন, তাদের কানাডা ও যুক্তরাষ্ট্র থেকে দেশে ফিরিয়ে আনতে ইতোমধ্যেই কূটনৈতিক ও আইনি উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। এ বিষয়ে আইনজীবী নিয়োগ দেওয়া হয়েছে।

জানা গেছে, বঙ্গবন্ধুর আত্মস্বীকৃত খুনি এবং জেলহত্যা মামলার অন্যতম আসামি অবসরপ্রাপ্ত কর্নেল এসএইচএমবি নূর চৌধুরী রয়েছেন কানাডায়। কানাডার ফেডারেল কোর্ট তাকে বহিষ্কারের নির্দেশ দেওয়ার পর তাকে দেশে আনার প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে। এ মামলায় দণ্ডিত আবদুর রশিদ, শরিফুল হক ডালিম, মোসলেমউদ্দিন, রাশেদ চৌধুরী ও আবদুল মাজেদ বিদেশে পালিয়ে রয়েছেন।

১৯৯৬ সালের জুনে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনা প্রধানমন্ত্রী হিসেবে শপথ নেওয়ার মুহূর্তেই খুনি নূর চৌধুরী সপরিবারে কানাডায় পালিয়ে যান। কানাডায় গিয়ে ফেড়ারেল কোর্টে রাজনৈতিক আশ্রয় চেয়ে একটি আবেদন করেন। ওই আবেদনে নূর চৌধুরী নিজেকে চাকরিচ্যুত সেনা কর্মকর্তা ও অরাজনৈতিক ব্যক্তি হিসেবে উল্লেখ করেন। আবেদনে বঙ্গবন্ধু সরকারের কুৎসা আর জিয়াউর রহমানের প্রতি নিজের সমর্থন ও যোগসাজশের কথা উল্লেখ করেছেন। মৃত্যুদণ্ডবিরোধী কানাডা সরকারও তখন তাকে শর্তসাপেক্ষে রাজনৈতিক আশ্রয় দেয়।

সম্প্রতি কানাডা সফরে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গে সে দেশের প্রধানমন্ত্রী জাস্টিন ট্রুডোর দ্বিপাক্ষিক বৈঠকে দু’দেশ নূর চৌধুরীর বিষয়ে ঐকমত্যে পৌঁছায়। এই আলোচনায় নূর চৌধুরীকে ফিরিয়ে এনে বিচারের মুখোমুখি করা এবং বঙ্গবন্ধু ও জেলহত্যা মামলার রায় কার্যকর করা হবে বলে জানা গেছে।

জেলহত্যা মামলায় পলাতক আসামিদের ফিরিয়ে আনতে আর কত সময় লাগবে জানতে চাইলে আইনমন্ত্রী অ্যাডভোকেট আনিসুল হক বলেন, সরকার পলাতক আসামিদের খুঁজে বের করে দেশে ফিরিয়ে আনার ব্যাপারে কাজ করছে। আশাকরি এই মামলায় সাজাপ্রাপ্ত পলাতক আসামিদের খুঁজে বের করতে সক্ষম হবো এবং দ্রুত সাজা কার্যকর করা হবে।

অপরদিকে অ্যাটর্নি জেনারেল মাহবুবে আলম বলেন, বঙ্গবন্ধু হত্যা মামলার আসামিরাও এই মামলায় দণ্ডিতদের মধ্যে রয়েছে। সুতরাং তাদেরকে ফিরিয়ে আনলেও এই মামলার আসামিরা চলে আসবে। অন্যদের ক্ষেত্রেও সরকারের পক্ষ থেকে চেষ্টা চালিয়ে যাওয়া হচ্ছে।

Print Friendly, PDF & Email

     এ ক্যাটাগরীর আরো খবর