ঢাকা ০৪:০০ পূর্বাহ্ন, শুক্রবার, ১১ জুলাই ২০২৫, ২৬ আষাঢ় ১৪৩২ বঙ্গাব্দ

‘মব’ ফাঁদে বাড়ছে অস্থিরতা কেউ আইন নিজের হাতে তুলে নিলে সে যেই হউক তাকে ছাড় দেয়া হবে না: আইজিপি

  • Reporter Name
  • আপডেট টাইম : ১১:৪০:১৩ অপরাহ্ন, শনিবার, ৫ জুলাই ২০২৫
  • ৮ বার

দেশে নতুন এক আপদ ও আতঙ্কের নাম “মব সন্ত্রাস”। গণপিটুনি, চাঁদাবাজি, দখল, রাজনৈতিকভাবে প্রতিপক্ষকে ঘায়েল করা ও ব্যক্তিস্বার্থ উদ্ধারে টার্গেট করে পরিকল্পিতভাবে ‘মব সন্ত্রাস’ তৈরি করা হচ্ছে। লুটপাট ও হত্যায় ব্যবহার করা হচ্ছে বিক্ষুব্ধ জনতার ‘মব’ ফাঁদ। মব সন্ত্রাসের ফাঁদে ফেলে এক শ্রেনীর সুবিধাভোগিরা ভয়াবহভাবে আইন নিজের হাতে তুলে নিচ্ছে। সম্প্রতি কুমিল্লার মুরাদনগরে চুরির অভিযোগে মা, ছেলে ও মেয়েকে প্রকাশ্যে পিটিয়ে হত্যা করা হয়। গাজীপুরে হৃদয় নামের এক যুবক, ঢাকায় আল আমিন এবং সিরাজগঞ্জে এক মানসিক প্রতিবন্ধীসহ গত ছয় দিনে ৬ জন এই সহিংসতায় প্রাণ হারিয়েছেন। সারাদেশেই মব ফাঁদে বাড়ছে অস্থিরতা।

সামাজিক ও অপরাধ বিশেষজ্ঞরা বলছেন, বর্তমানে চলা মব সন্ত্রাসের অধিকাংশই পরিকল্পিত। হত্যাকারীরা জনতাকে উস্কে দেয়, যাতে হত্যার দায় স্পষ্টভাবে কারও ওপর না পড়ে। এতে একদিকে প্রতিপক্ষকে শায়েস্তা করা যায়, অন্যদিকে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে বিভ্রান্ত করে মূল হোতারা দায় এড়িয়ে যায়। শুধু রাজনৈতিক প্রতিপক্ষই নয়, ব্যক্তিগত বিরোধে আপন ভাইকে মব তৈরি করে ফাঁসানোর ঘটনাও ঘটছে।

বিশেষজ্ঞরা আরও বলছেন, মব সন্ত্রাসের মাধ্যমে হত্যাকান্ডের মামলায় শাস্তির নজির নেই বললেই চলে। ফলে অপরাধীদের বিরুদ্ধে মানুষের ক্ষোভকে কাজে লাগাচ্ছে আরেক অপরাধী চক্র; গণপিটুনির ফাঁদে ফেলে মারধর ও হত্যার মতো ঘটনা ঘটাচ্ছে। নিরপরাধ মানুষও ফাঁদে পড়ে মারধর ও হত্যার শিকার হচ্ছেন। এ ধরনের অপরাধে জড়িতদের কঠোর আইনগত ব্যবস্থার মুখোমুখি করতে হবে। সেই সঙ্গে রাজনৈতিক দলের নেতাকর্মীরা এসব কাজে জড়িত থাকলে দল থেকে বহিষ্কারসহ নির্মোহ কঠোর পদক্ষেপই গণপিটুনির মতো ঘটনা কমিয়ে আনতে পারে বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা।

আইজিপি বাহারুল আলম ইনকিলাবকে বলেন, মব সৃষ্টি করে নানা ধরনের অপরাধ করা হচ্ছে। এর সাথে জড়িতদের কঠোর হস্তে দমন করতে সারাদেশের মাঠ পর্যায়ের পুলিশ কর্মকর্তাদের নির্দেশ দেয়া হয়েছে। কেউ আইন নিজের হাতে তুলে নিলে সে যেই হউক তাকে ছাড় দেয়া হবে না।

সামরিক ও অপরাধ বিশেষজ্ঞ ব্রিগেডিয়ার জেনারেল (অব:) মোস্তফা কামাল ইনকিলাবকে বলেন, বর্তমানে দেশে মব ভায়োলেন্স একটা উদ্বেগজনক ও ভয়ংকর সামাজিক সমস্যা হয়ে দেখা দিয়েছে। এ প্রবনতা আইনের শাসনের প্রতি অনাস্থা ও নৈতিক অবক্ষয়ের প্রতিফলন। এ থেকে উত্তরনের জন্য অতি দ্রুত সরকার ও সমাজের সকলকে এগিয়ে আসতে হবে। মবের সাথে জড়িতদের কঠোর হস্তে দমন করতে হবে সরকারকে। আইনের শাসন প্রতিষ্ঠা ও মানবিক মুল্যবোধ জাগ্রত করতে পারলেই মব কমিয়ে আনা সম্বব হবে।

মানবাধিকার সংগঠক নূর খান লিটন ইনকিলাবকে বলেন, দেশে একটি অস্থিরতা তৈরির জন্য একটি গ্রুপ সক্রিয় হয়ে উঠেছে। তাদের পরিকল্পিত মব সন্ত্রাসের শিকার হচ্ছে মানুষ। দীর্ঘদিন ধরে এসব ঘটনা চলমান থাকার দায় সরকার এড়াতে পারে না। আইন-আদালতকে পাশ কাটিয়ে মব সন্ত্রাস বা আইন নিজের হাতে তুলে দেওয়ার সুযোগ নেই। মব সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে গণতন্ত্রমনা মানুষকে রুখে দাঁড়াতে হবে, কারণ এ অসভ্যতা চলতে পারে না।

মব তৈরি করে আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতি প্রসঙ্গে জানতে চাইলে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অপরাধ বিজ্ঞান বিভাগের সহকারী অধ্যাপক এ. বি. এম নাজমুস সাকিব ইনকিলাবকে বলেন, আইন নিজের হাতে তুলে নেয়ার অধিকার বাংলাদেশের বিচারব্যবস্থায় কাউকে দেয়া হয়নি। ৫ আগস্টের হঠাৎ পরিবর্তন বাংলাদেশের সমাজে নতুন করে এক ধরনের সামাজিক বিশৃঙ্খলার উদ্ভব ঘটিয়েছে যা ‘মব জাস্টিস’ হিসেবে পরিচিতি লাভ করেছে। বর্তমানে বাংলাদেশ একটি অন্তর্বতীকালীন সরকার রয়েছে এবং আইনের শাসন কায়েম করা তাদের উপর বর্তায়। কিন্তু আমরা লক্ষ্য করছি কিছু গোষ্ঠী তাদের নিজস্ব ধ্যান-ধারণা এবং বিশ্বাসের উপর ভিত্তি করে নিজেরাই আইন প্রয়োগ করার কাজে লিপ্ত হচ্ছে। কোন কোন গোষ্ঠী এই সুযোগে নিজেদের স্বার্থ হাসিল করার পাঁয়তারা করছে। তিনি আরও বলেন, একদিকে যেমন বাংলাদেশের বিচার ব্যবস্থার দীর্ঘসূত্রিতা মবকারীদের মধ্যে আস্থাহীনতা তৈরি করেছে এবং অন্যদিকে নতুন পরিবর্তন এর ফলে ভিন্নমতকে অগ্রাহ্য করার এক ধরনের তাড়না তাদের মধ্যে লক্ষণীয়। তবে এভাবে ভিন্নমতকে পেশীর জোরে নিষ্পেষিত করার প্রচেষ্টা চলমান থাকলে সেটা সমাজে যেমন কোন ভালো ফলাফল বয়ে আনবে না, তেমনি আদিম সমাজের ‘রিভেঞ্জ থিওরি’তে ফিরে যাওয়ার অবস্থা তৈরি হতে পারে। ভবিষ্যত বাংলাদেশের জন্যে যেটা খুবই আশঙ্কার এবং দুশ্চিন্তার। সরকারের উচিত এই বিষয়ে জনগণকে স্পষ্ট বার্তা প্রদান করা এবং কঠোরভাবে নিয়ন্ত্রণ করা।

সূত্র জানায়, রাজধানীসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে যেভাবে ‘মব সন্ত্রাস’ চলছে তাতে দেশের সাধারণ মানুষ অতিষ্ঠ। বেশির ভাগ ক্ষেত্রে অপরাধীদের গ্রেপ্তার করা হচ্ছে না। মানবাধিকার সংগঠনগুলোর তথ্য অনুযায়ী, ২০২৪ সালের সেপ্টেম্বর থেকে গত জুন পর্যন্ত ১০ মাসে ২৫৩টি মব সন্ত্রাস ঘটে। এতে ১৬৩ জন নিহত এবং ৩১২ জন আহত হয়। বেসরকারি প্রতিষ্ঠান মানবাধিকার সাংস্কৃতিক ফাউন্ডেশনের (এমএসএফ) পরিসংখ্যান অনুযায়ী, গত জুনে দেশে অন্তত ৪১ টি গণপিটুনির ঘটনায় ১০ জন নিহত হয়। গুরুতর আহত হয় ৪৭ জন। গণপিটুনির শিকার ৩০ জনকে আহত অবস্থায় পুলিশে সোপর্দ করা হয়। আইন ও সালিশ কেন্দ্রের (আসক) প্রতিবেদন বলছে, চলতি বছরের প্রথম পাঁচ মাসে (জানুয়ারি-মে) গণপিটুনিতে ৭৮ জন নিহত হয়েছে। গত বছরের সেপ্টেম্বর থেকে ডিসেম্বর পর্যন্ত চার মাসে গণপিটুনির ঘটনায় ৭৫ জন নিহত হয়। হিউম্যান রাইটস সাপোর্ট সোসাইটির (এইচআরএসএস) হিসাবে, ২০২৪ সালের সেপ্টেম্বর থেকে গত মে পর্যন্ত ৯ মাসে মব সন্ত্রাস ঘটেছে ২০২টি। এসব ঘটনায় ১৩১ জন নিহত হয়েছে। এ সময়ে আহত হয় ১৬৫ জন। সরকারের উপদেষ্টারা কয়েক মাস ধরে মব সন্ত্রাস নিয়ন্ত্রণের হুঁশিয়ারি দিয়েছেন। মাঝেমধ্যে উদ্যোগ দেখা গেলেও মব সন্ত্রাস বন্ধ হয়নি।

গত ২২ জুন রাজধানীর উত্তরায় সাবেক সিইসি কে এম নুরুল হুদাকে উচ্ছৃঙ্খল জনতা মারধর ও চরমভাবে নাজেহাল করে পুলিশে সোপর্দ করা হয়। এর আগে ৬ মে গুলশানে হেনস্তা করা হয় ভাস্কর রাসাকে। গত ১৩ মে রাতে সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষা ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের শিক্ষার্থী শাহরিয়ার আলম সাম্যকে ছুরি মেরে হত্যা করা হয়। গত ২০ মে রাতে ধানম-ির ৪ নম্বর সড়কে মব তৈরি করে হাক্কানী পাবলিশার্সের মালিক গোলাম মোস্তফার বাড়িতে ঢোকার চেষ্টা করা হয়। ডিএমপি সদর দপ্তরে এক অনুষ্ঠানে ডিএমপি কমিশনার শেখ মো. সাজ্জাত আলী বলেন, মব সন্ত্রাস ঠেকাতে ব্যর্থ হলে সংশ্লিষ্ট পুলিশ সদস্যদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।

বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য ইকবাল হাসান মাহমুদ টুকু বলেন, মব সন্ত্রাস কোনো সভ্য সমাজে গ্রহণযোগ্য নয়। অপরাধের বিচার হবে আদালতে, রাস্তায় নয়। জনগণের নিরাপত্তা নিশ্চিত করাই রাষ্ট্র ও সমাজের দায়িত্ব। বিএনপি এই অপশক্তির বিরুদ্ধে শক্ত অবস্থান নিয়েছে। স্বাধীনতার পরও মব সন্ত্রাস হয়েছিল। তখনো এর প্রতিকার করেনি তখনকার সরকার। ফলে দেশে অরাজকতা তৈরি হয়েছিল। বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকারও মব সন্ত্রাস দমনে কার্যকর পদক্ষেপ নিতে পারছে না। অপরাধ বিশ্লেষকরা মনে করছেন, সামাজিক অস্থিরতা, আইনের শাসন না মানা, রাজনৈতিক বিরোধ, আধিপত্য বিস্তার, অর্থনৈতিক দুরবস্থাসহ নানা কারণে একে অন্যকে পরিকল্পিতভাবে ফাঁসানোর প্রবণতা, আইন নিজের হাতে তুলে নিয়ে আইন না মানার প্রবণতায় গণপিটুনির ঘটনা বাড়ছে। কিছু ক্ষেত্রে পেশাদার অপরাধী ও রাজনৈতিক দলের নেতাকর্মীরাও মব তৈরি করছেন। এর প্রতিরোধে সরকারের পাশাপাশি সমাজের সকলকে এগিয়ে আসতে হবে।

Tag :

Write Your Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Save Your Email and Others Information

About Author Information

Haor Barta24

‘মব’ ফাঁদে বাড়ছে অস্থিরতা কেউ আইন নিজের হাতে তুলে নিলে সে যেই হউক তাকে ছাড় দেয়া হবে না: আইজিপি

আপডেট টাইম : ১১:৪০:১৩ অপরাহ্ন, শনিবার, ৫ জুলাই ২০২৫

দেশে নতুন এক আপদ ও আতঙ্কের নাম “মব সন্ত্রাস”। গণপিটুনি, চাঁদাবাজি, দখল, রাজনৈতিকভাবে প্রতিপক্ষকে ঘায়েল করা ও ব্যক্তিস্বার্থ উদ্ধারে টার্গেট করে পরিকল্পিতভাবে ‘মব সন্ত্রাস’ তৈরি করা হচ্ছে। লুটপাট ও হত্যায় ব্যবহার করা হচ্ছে বিক্ষুব্ধ জনতার ‘মব’ ফাঁদ। মব সন্ত্রাসের ফাঁদে ফেলে এক শ্রেনীর সুবিধাভোগিরা ভয়াবহভাবে আইন নিজের হাতে তুলে নিচ্ছে। সম্প্রতি কুমিল্লার মুরাদনগরে চুরির অভিযোগে মা, ছেলে ও মেয়েকে প্রকাশ্যে পিটিয়ে হত্যা করা হয়। গাজীপুরে হৃদয় নামের এক যুবক, ঢাকায় আল আমিন এবং সিরাজগঞ্জে এক মানসিক প্রতিবন্ধীসহ গত ছয় দিনে ৬ জন এই সহিংসতায় প্রাণ হারিয়েছেন। সারাদেশেই মব ফাঁদে বাড়ছে অস্থিরতা।

সামাজিক ও অপরাধ বিশেষজ্ঞরা বলছেন, বর্তমানে চলা মব সন্ত্রাসের অধিকাংশই পরিকল্পিত। হত্যাকারীরা জনতাকে উস্কে দেয়, যাতে হত্যার দায় স্পষ্টভাবে কারও ওপর না পড়ে। এতে একদিকে প্রতিপক্ষকে শায়েস্তা করা যায়, অন্যদিকে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে বিভ্রান্ত করে মূল হোতারা দায় এড়িয়ে যায়। শুধু রাজনৈতিক প্রতিপক্ষই নয়, ব্যক্তিগত বিরোধে আপন ভাইকে মব তৈরি করে ফাঁসানোর ঘটনাও ঘটছে।

বিশেষজ্ঞরা আরও বলছেন, মব সন্ত্রাসের মাধ্যমে হত্যাকান্ডের মামলায় শাস্তির নজির নেই বললেই চলে। ফলে অপরাধীদের বিরুদ্ধে মানুষের ক্ষোভকে কাজে লাগাচ্ছে আরেক অপরাধী চক্র; গণপিটুনির ফাঁদে ফেলে মারধর ও হত্যার মতো ঘটনা ঘটাচ্ছে। নিরপরাধ মানুষও ফাঁদে পড়ে মারধর ও হত্যার শিকার হচ্ছেন। এ ধরনের অপরাধে জড়িতদের কঠোর আইনগত ব্যবস্থার মুখোমুখি করতে হবে। সেই সঙ্গে রাজনৈতিক দলের নেতাকর্মীরা এসব কাজে জড়িত থাকলে দল থেকে বহিষ্কারসহ নির্মোহ কঠোর পদক্ষেপই গণপিটুনির মতো ঘটনা কমিয়ে আনতে পারে বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা।

আইজিপি বাহারুল আলম ইনকিলাবকে বলেন, মব সৃষ্টি করে নানা ধরনের অপরাধ করা হচ্ছে। এর সাথে জড়িতদের কঠোর হস্তে দমন করতে সারাদেশের মাঠ পর্যায়ের পুলিশ কর্মকর্তাদের নির্দেশ দেয়া হয়েছে। কেউ আইন নিজের হাতে তুলে নিলে সে যেই হউক তাকে ছাড় দেয়া হবে না।

সামরিক ও অপরাধ বিশেষজ্ঞ ব্রিগেডিয়ার জেনারেল (অব:) মোস্তফা কামাল ইনকিলাবকে বলেন, বর্তমানে দেশে মব ভায়োলেন্স একটা উদ্বেগজনক ও ভয়ংকর সামাজিক সমস্যা হয়ে দেখা দিয়েছে। এ প্রবনতা আইনের শাসনের প্রতি অনাস্থা ও নৈতিক অবক্ষয়ের প্রতিফলন। এ থেকে উত্তরনের জন্য অতি দ্রুত সরকার ও সমাজের সকলকে এগিয়ে আসতে হবে। মবের সাথে জড়িতদের কঠোর হস্তে দমন করতে হবে সরকারকে। আইনের শাসন প্রতিষ্ঠা ও মানবিক মুল্যবোধ জাগ্রত করতে পারলেই মব কমিয়ে আনা সম্বব হবে।

মানবাধিকার সংগঠক নূর খান লিটন ইনকিলাবকে বলেন, দেশে একটি অস্থিরতা তৈরির জন্য একটি গ্রুপ সক্রিয় হয়ে উঠেছে। তাদের পরিকল্পিত মব সন্ত্রাসের শিকার হচ্ছে মানুষ। দীর্ঘদিন ধরে এসব ঘটনা চলমান থাকার দায় সরকার এড়াতে পারে না। আইন-আদালতকে পাশ কাটিয়ে মব সন্ত্রাস বা আইন নিজের হাতে তুলে দেওয়ার সুযোগ নেই। মব সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে গণতন্ত্রমনা মানুষকে রুখে দাঁড়াতে হবে, কারণ এ অসভ্যতা চলতে পারে না।

মব তৈরি করে আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতি প্রসঙ্গে জানতে চাইলে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অপরাধ বিজ্ঞান বিভাগের সহকারী অধ্যাপক এ. বি. এম নাজমুস সাকিব ইনকিলাবকে বলেন, আইন নিজের হাতে তুলে নেয়ার অধিকার বাংলাদেশের বিচারব্যবস্থায় কাউকে দেয়া হয়নি। ৫ আগস্টের হঠাৎ পরিবর্তন বাংলাদেশের সমাজে নতুন করে এক ধরনের সামাজিক বিশৃঙ্খলার উদ্ভব ঘটিয়েছে যা ‘মব জাস্টিস’ হিসেবে পরিচিতি লাভ করেছে। বর্তমানে বাংলাদেশ একটি অন্তর্বতীকালীন সরকার রয়েছে এবং আইনের শাসন কায়েম করা তাদের উপর বর্তায়। কিন্তু আমরা লক্ষ্য করছি কিছু গোষ্ঠী তাদের নিজস্ব ধ্যান-ধারণা এবং বিশ্বাসের উপর ভিত্তি করে নিজেরাই আইন প্রয়োগ করার কাজে লিপ্ত হচ্ছে। কোন কোন গোষ্ঠী এই সুযোগে নিজেদের স্বার্থ হাসিল করার পাঁয়তারা করছে। তিনি আরও বলেন, একদিকে যেমন বাংলাদেশের বিচার ব্যবস্থার দীর্ঘসূত্রিতা মবকারীদের মধ্যে আস্থাহীনতা তৈরি করেছে এবং অন্যদিকে নতুন পরিবর্তন এর ফলে ভিন্নমতকে অগ্রাহ্য করার এক ধরনের তাড়না তাদের মধ্যে লক্ষণীয়। তবে এভাবে ভিন্নমতকে পেশীর জোরে নিষ্পেষিত করার প্রচেষ্টা চলমান থাকলে সেটা সমাজে যেমন কোন ভালো ফলাফল বয়ে আনবে না, তেমনি আদিম সমাজের ‘রিভেঞ্জ থিওরি’তে ফিরে যাওয়ার অবস্থা তৈরি হতে পারে। ভবিষ্যত বাংলাদেশের জন্যে যেটা খুবই আশঙ্কার এবং দুশ্চিন্তার। সরকারের উচিত এই বিষয়ে জনগণকে স্পষ্ট বার্তা প্রদান করা এবং কঠোরভাবে নিয়ন্ত্রণ করা।

সূত্র জানায়, রাজধানীসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে যেভাবে ‘মব সন্ত্রাস’ চলছে তাতে দেশের সাধারণ মানুষ অতিষ্ঠ। বেশির ভাগ ক্ষেত্রে অপরাধীদের গ্রেপ্তার করা হচ্ছে না। মানবাধিকার সংগঠনগুলোর তথ্য অনুযায়ী, ২০২৪ সালের সেপ্টেম্বর থেকে গত জুন পর্যন্ত ১০ মাসে ২৫৩টি মব সন্ত্রাস ঘটে। এতে ১৬৩ জন নিহত এবং ৩১২ জন আহত হয়। বেসরকারি প্রতিষ্ঠান মানবাধিকার সাংস্কৃতিক ফাউন্ডেশনের (এমএসএফ) পরিসংখ্যান অনুযায়ী, গত জুনে দেশে অন্তত ৪১ টি গণপিটুনির ঘটনায় ১০ জন নিহত হয়। গুরুতর আহত হয় ৪৭ জন। গণপিটুনির শিকার ৩০ জনকে আহত অবস্থায় পুলিশে সোপর্দ করা হয়। আইন ও সালিশ কেন্দ্রের (আসক) প্রতিবেদন বলছে, চলতি বছরের প্রথম পাঁচ মাসে (জানুয়ারি-মে) গণপিটুনিতে ৭৮ জন নিহত হয়েছে। গত বছরের সেপ্টেম্বর থেকে ডিসেম্বর পর্যন্ত চার মাসে গণপিটুনির ঘটনায় ৭৫ জন নিহত হয়। হিউম্যান রাইটস সাপোর্ট সোসাইটির (এইচআরএসএস) হিসাবে, ২০২৪ সালের সেপ্টেম্বর থেকে গত মে পর্যন্ত ৯ মাসে মব সন্ত্রাস ঘটেছে ২০২টি। এসব ঘটনায় ১৩১ জন নিহত হয়েছে। এ সময়ে আহত হয় ১৬৫ জন। সরকারের উপদেষ্টারা কয়েক মাস ধরে মব সন্ত্রাস নিয়ন্ত্রণের হুঁশিয়ারি দিয়েছেন। মাঝেমধ্যে উদ্যোগ দেখা গেলেও মব সন্ত্রাস বন্ধ হয়নি।

গত ২২ জুন রাজধানীর উত্তরায় সাবেক সিইসি কে এম নুরুল হুদাকে উচ্ছৃঙ্খল জনতা মারধর ও চরমভাবে নাজেহাল করে পুলিশে সোপর্দ করা হয়। এর আগে ৬ মে গুলশানে হেনস্তা করা হয় ভাস্কর রাসাকে। গত ১৩ মে রাতে সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষা ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের শিক্ষার্থী শাহরিয়ার আলম সাম্যকে ছুরি মেরে হত্যা করা হয়। গত ২০ মে রাতে ধানম-ির ৪ নম্বর সড়কে মব তৈরি করে হাক্কানী পাবলিশার্সের মালিক গোলাম মোস্তফার বাড়িতে ঢোকার চেষ্টা করা হয়। ডিএমপি সদর দপ্তরে এক অনুষ্ঠানে ডিএমপি কমিশনার শেখ মো. সাজ্জাত আলী বলেন, মব সন্ত্রাস ঠেকাতে ব্যর্থ হলে সংশ্লিষ্ট পুলিশ সদস্যদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।

বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য ইকবাল হাসান মাহমুদ টুকু বলেন, মব সন্ত্রাস কোনো সভ্য সমাজে গ্রহণযোগ্য নয়। অপরাধের বিচার হবে আদালতে, রাস্তায় নয়। জনগণের নিরাপত্তা নিশ্চিত করাই রাষ্ট্র ও সমাজের দায়িত্ব। বিএনপি এই অপশক্তির বিরুদ্ধে শক্ত অবস্থান নিয়েছে। স্বাধীনতার পরও মব সন্ত্রাস হয়েছিল। তখনো এর প্রতিকার করেনি তখনকার সরকার। ফলে দেশে অরাজকতা তৈরি হয়েছিল। বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকারও মব সন্ত্রাস দমনে কার্যকর পদক্ষেপ নিতে পারছে না। অপরাধ বিশ্লেষকরা মনে করছেন, সামাজিক অস্থিরতা, আইনের শাসন না মানা, রাজনৈতিক বিরোধ, আধিপত্য বিস্তার, অর্থনৈতিক দুরবস্থাসহ নানা কারণে একে অন্যকে পরিকল্পিতভাবে ফাঁসানোর প্রবণতা, আইন নিজের হাতে তুলে নিয়ে আইন না মানার প্রবণতায় গণপিটুনির ঘটনা বাড়ছে। কিছু ক্ষেত্রে পেশাদার অপরাধী ও রাজনৈতিক দলের নেতাকর্মীরাও মব তৈরি করছেন। এর প্রতিরোধে সরকারের পাশাপাশি সমাজের সকলকে এগিয়ে আসতে হবে।