নওগাঁর মাঠে এখন শুধু পাকা ধানের সুবাস। নিচু জমিগুলোর ধান কাটা ও মাড়াই শুরু করেছেন কৃষকেরা। এরই মধ্যে সরকারি উদ্যোগে চলতি বোরো মৌসুমের ধান-চাল সংগ্রহ অভিযানও শুরু হয়েছে। তবে নানা ঝক্কি-ঝামেলা ও কম দামের কারণে এবারও সরকারি গুদামে ধান-চাল দিতে আগ্রহী নন কৃষক ও মিলাররা।
জানা গেছে, এবার কৃষক পর্যায়ে ধানের দাম নির্ধারণ করা হয়েছে প্রতি কেজি ৩৬ এবং মিলপর্যায়ে সেদ্ধ চালের দাম ৪৯ টাকা। এই দামে সন্তুষ্ট নন কৃষক ও মিলার—দুই পক্ষই।
সরেজমিনে দেখা গেছে, জেলার বিভিন্ন মাঠের নিচু জমির ধান কাটা ও মাড়াই শুরু হয়েছে। কেউ কেউ পরিবার-পরিজন নিয়ে খেতেই ধানমাড়াই করছেন। কোথাও কোথাও আবার কামলা (শ্রমিক) এনে দল বেঁধে ধান কাটা হচ্ছে। ঘরে ঘরে শুরু হচ্ছে ধান তোলার ব্যস্ততা। কৃষকেরা ধান তুলেই বাজারে বিক্রির প্রস্তুতি নিচ্ছেন।
নওগাঁ সদর উপজেলার কৃষক শহিদুল ইসলাম বলেন, ‘এ বছর বীজ, সার, কীটনাশক আর শ্রমিকের খরচ অনেক বেড়েছে। ৩৬ টাকা কেজি দিয়ে খরচ উঠবে না। তারপর আবার সরকারি গুদামে ধান দিতে হলে অনেক ঝামেলায় পড়তে হয়।’
আত্রাইয়ের কৃষক ফিরোজ আলী বলেন, ‘গুদামে ধান দিতে হলে রেজিস্ট্রেশন লাগে, মাপজোক হয়, পরে টাকা আসে। এত সময় কই? হাটে নিয়ে বিক্রি করলেই টাকা হাতে। তাই সবাই গুদামের চেয়ে হাটেই বেশি বিক্রি করে।’
অন্যদিকে মিলাররা সরকারের নির্ধারিত দাম নিয়ে অসন্তোষ প্রকাশ করেছেন। তাঁদের মতে, চালের দাম ধানের দামের দ্বিগুণের কাছাকাছি হওয়ার কথা। সেখানে মাত্র ৪৯ টাকা কেজি দরে চাল দিলে লাভ নয়; বরং লোকসান হবে কেজিতে ৫-৬ টাকা।
নওগাঁ জেলা চালকলমালিক গ্রুপের সাধারণ সম্পাদক ফরহাদ হোসেন চকদার বলেন, ‘৩৬ টাকায় ধান কিনে ৪৯ টাকায় চাল সরবরাহ করা খুবই কঠিন। বাস্তবতা অনুযায়ী চালের দাম কমপক্ষে ৫৫ টাকা হওয়া উচিত। এখানে বড় ধরনের বৈষম্য রয়েছে। সরকারকে অনুরোধ করছি, এ বৈষম্য দূর করার জন্য।’ তিনি আরও বলেন, ‘নওগাঁয় মোটা ধানের আবাদ হয় না। সরকারকে চাল দিতে হলে হাওর এলাকা থেকে মোটা ধান সংগ্রহ করতে হয়। এতে আমাদের অতিরিক্ত খরচ হয়। এ কারণে এই অঞ্চলের মিলাররা সরকারের বেঁধে দেওয়া দামে অসন্তোষ প্রকাশ করছেন।’
অটোমেটিক রাইস মিলমালিক সমিতির সভাপতি তৌফিকুল ইসলাম বাবু বলেন, ‘কয়েক বছর ধরেই লোকসানে সরকারকে চাল সরবরাহ করছি। দেড় মণ ধান থেকে এক মণ চাল হলেও, সব খরচ বাদ দিলে এবারও প্রতি কেজিতে ৫-৬ টাকা লোকসান হবে।’
তৌফিকুল ইসলাম আরও বলেন, সরকারের উচিত ধান-চালের টেস্ট মিলিং করে বাস্তব রেশিও অনুযায়ী দর নির্ধারণ করা। তা না হলে ধান-চাল সেক্টরে বড় ক্ষতি হতে পারে।
খাদ্য বিভাগ সূত্রে জানা গেছে, জেলার ১১টি উপজেলায় এবার ধান সংগ্রহের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে ১৩ হাজার ৭২৭ টন। আর সেদ্ধ চাল সংগ্রহ করা হবে ৫৪ হাজার ৭৭ টন। এ জন্য জেলার ৩৮৭টি মিলমালিককে চুক্তির আওতায় আনার পরিকল্পনা নিয়েছে খাদ্য বিভাগ।
জানতে চাইলে নওগাঁ সদর খাদ্যগুদামের ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা মাসুদ হোসেন বলেন, ‘সরকার যে দর নির্ধারণ করেছে তা সন্তোষজনক। আমাদের নির্ধারিত লক্ষ্যমাত্রা পূরণে মিলার ও কৃষকদের ইতিমধ্যে অবহিত করা হয়েছে। সবাই স্বতঃস্ফূর্তভাবে সাড়া দিচ্ছেন।’
এ বিষয়ে নওগাঁ জেলা খাদ্যনিয়ন্ত্রক খন্দকার ফরহাদ হোসেন বলেন, সরকারি সংগ্রহের মূল লক্ষ্য হলো কৃষকের উৎপাদিত ধানের ন্যায্য দর নিশ্চিত করা, বাজারদর নিয়ন্ত্রণে রাখা এবং সরকারি গুদামে পর্যাপ্ত মজুত গড়ে তোলা।’ তিনি জানান, সরকারি নির্দেশ অনুযায়ী ২৪ এপ্রিল থেকে সংগ্রহ শুরু হয়েছে। দুর্নীতি বা হয়রানি এড়াতে কঠোর নজরদারির ব্যবস্থাও নেওয়া হয়েছে।