রাজধানী নামে খ্যাত চাঁপাইনবাবগঞ্জ ও রাজশাহীতে এবার বাগানে বাগানে ভরা আম। ছোট-বড় বাগান, সড়কের পাশের সব গাছের ডালে ডালে আম ঝুলে আছে।
অন্য বছরের তুলনায় এবার আমের ফলন বেশি হয়েছে। পরিমাণে বেশি। কিন্তু আবহাওয়ার নেতিবাচক প্রভাবে (অত্যাধিক তাপ) আকারে ছোট হয়ে গেছে।
আম বাগানমালিক ও ব্যবসায়ীরা বলছেন, বেশি ফলন হলেও অত্যধিক তাপে ক্ষতি হয়েছে। গুটি ও গোপালভোগ আম বাজারে পাওয়া গেলেও এখনো ভালো জাতের খিরসাপাত আম পাকেনি। তবে এ সপ্তাহে পাকতে পারে।
গত কয়েক দিন সরেজমিনে চাঁপাইনবাবগঞ্জ ও রাজশাহীর বিভিন্ন এলাকা ঘুরে সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে কথা বলে এমন চিত্রই পাওয়া গেছে।
কিন্তু ররিবার (২১ মে) রাজধানীর মতিঝিল, পল্টন, কারওয়ান বাজারে গেলে দেখা যায়, খুচরা আম ব্যবসায়ীরা ডাকছেন, ‘লন লন, হিমসাগর আম ভালো আম। চাঁপাই ও রাজশাহীর আম। কেজি ১২০ টাকা।’ যা আকৃতি বেশ বড়। কেজিতে ৪ থেকে ৫টা হবে। ব্যবসায়ীরা ডালিতে, ক্যারেটে থরে থরে সাজিয়ে আম বিক্রি করছেন।
বাস্তবে এসব আম চাঁপাইনবাবগঞ্জ ও রাজশাহী এলাকার নয়, এগুলো সাতক্ষীরার আম যা খিরসাপাতের ভিন্ন জাত। আমবাগান ও ব্যবসায়ীরা জানান, ভৌগলিকগত কারণে চাঁপাইনবাবগঞ্জ ও রাজশাহীতে মে মাসের দ্বিতীয় সপ্তাহে কিছু গুটি আম পাকে। এরপর গোপালভোগ উঠে। কিন্তু ভালো আম খিরসাপাত গাছ থেকে পাড়া শুরু হয় মে মাসের শেষ সপ্তাহ থেকে। যা জুনের দ্বিতীয় সপ্তাহ পর্যন্ত পাওয়া যাবে।
এরকম আমের ব্যাপারে জানতে চাইলে কারওয়ান বাজারের ফল ব্যবসায়ী আমির হোসেন ঢাকাপ্রকাশ-কে বলেন, ‘হিমসাগর আম, ১০০ থেকে ১২০ টাকা কেজি। মিরপুর আড়ত থেকে কিনে বিক্রি করা হচ্ছে।’
মতিঝিলের ফল ব্যবসায়ী সোবহান বলেন, ‘লন লন ভালো আম। ১২০ টাকা কেজি। আবহাওয়া আর মাটির গুণে দেশের অন্যান্য জেলার তুলনায় সাতক্ষীরার আম আগেভাগেই পাকে।’
আমের ব্যাপারে জানতে চাইলে চাঁপাইনবাবগঞ্জের রামচন্দ্রপুর হাটের মোক্তার, ফটিকসহ অনেকে ঢাকাপ্রকাশ-কে বলেন, এবছর আমের ফলন ভালো হয়েছে। গুটি ও গোপালভোগ আম বাজারে কিছু উঠেছে। ৫০ থেকে ৬০ টাকা কেজি। কিন্তু এখনো খিরসাপাত আম উঠেনি। সবচেয়ে ভালো আম কোনটি এমন প্রশ্নের জবাবে তারা বলেন, ‘জিআই সনদপ্রাপ্ত খিরসাপাত আম খুবই ভালো। সবার পছন্দ এটি। এরপর ল্যাংড়া, ফজলি বিভিন্ন জাতের আম পাওয়া যাবে। হাইব্রিড আম্রপলিসহ বিভিন্ন আমও রয়েছে। মে মাসের শেষ সপ্তাহ বা জুনের প্রথম সপ্তাহে খিরসাপাত আম পাওয়া যাবে। তারপর ল্যাংড়া, ফজলি আসবে বাজারে।
শুধু এই আম ব্যবসায়ী নয়, নাটোরের সোহেলও জানান, দেখেন ধান ক্ষেতেও ভালো আম হয়েছে। সড়কের পাশের গাছে আম ঝুলছে। অনেক বেশি আম ধরেছে। কিন্তু তাপের কারণে বড় হয়নি। অন্যন্য আম বাগানমালিকরাও বলছেন, খিরসাপাত আম পেতে আরও কয়েক দিন অপেক্ষা করতে হবে। তারা বলছেন, এবার প্রচন্ড তাপের কারণে আম বড় হয়নি। তবে যারা পানি দিয়েছে তাদের আম হয়ত একটু বড় হবে।
আমনুরার মতিউর রহমান বলেন, এবারে আম্রপালি আমও ভালো হয়েছে। সব সময় লেগে থেকেছি বাগানে। ১০ বিঘায় (৩৩ শতকে এক বিঘা) চার লাখ টাকা আশা করছি। তবে অন্য বছরের তুলনায় সাইজে ছোট হয়েছে। এ জন্য কেজিতে বেশি লাগবে। আগে ৭ থেকে ৮টা লাগলেও এবারে কেজিতে ১০টা লাগবে। তাই ফলন বেশি হলেও ওজনে বেশি হবে না।
এদিকে, রাজশাহীর আম বাগানমালিক ও ব্যবসায়ীরাও বলছেন, প্রশাসনের তরফ থেকে বাগান থেকে আম নামানোর ঘোষণা দিয়েছে। তবে আমের মোকাম বানেশ্বর বাজারসহ বিভিন্ন বাজারে বেচাকেনা তেমন জমেনি। বিমানবন্দর থানার বায়া বাজারের মিজানুর রহমান মিজান তার গাছের আম দেখিয়ে বলেন, সরকারের ঘোষণা অনুযায়ী গুটি আম বাগান থেকে পাড়া শুরু হয়েছে। এগুলো তেমন ভালো স্বাদের না। গোপালভোগও পাড়তে শুরু করেছে। তবে ভালো মানের খিরসাপাত আম পেতে হলে আরও কয়েক দিন অপেক্ষা করতে হবে।
আম বাগানে বেশি পরিশ্রম করতে হয় না। এ জন্য বরেন্দ্র অঞ্চলেও আম বাগানের পরিধি বাড়ছে। চাঁপাইনবাবগঞ্জের গোমস্তাপুরের সীমানা ছাড়িয়ে নওগা জেলার সাপাহারে ব্যাপকভাবে আমের বাগান করা হচ্ছে।
জানতে চাইলে সাপাহারের মইনুলসহ অনেকে বলেন, বাণিজ্যিকভাবেই এই এলাকায় আম্রপলিসহ বিভিন্ন জাতের আম বাগান করা হচ্ছে। কম পরিশ্রমে (খাটনি) ধানের চেয়ে আমে দামও ভালো পাওয়া যাচ্ছে। এ জন্য নওগাঁর বিভিন্ন থানাতেও আম বাগান বাড়ছে। তারা আরও জানান, ঢাকার বিভিন্ন আড়তে আম পাঠানো হচ্ছে।
ফলন বেশি হলেও এবার আম সাইজে ছোট কেন? এমন প্রশ্নের জবাবে চাঁপাইনবাবগঞ্জ আম গবেষণা কেন্দ্রের মূখ্য বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা ড. মো. মোখলেসুর রজমান ঢাকাপ্রকাশ-কে বলেন, এবারে আমের ভালো ফলন হয়েছে। প্রায় গাছে আম ধরেছে। কিন্তু বৃষ্টি হয়নি। অত্যধিক তাপের কারণে আম সাইজে ছোট হয়ে গেছে। আবহাওয়ার প্রভাবে এই খারাপ অবস্থা হয়েছে। তবে যারা একটু সেচ দিতে পেরেছে তাদের আম একটু বড় হয়েছে।
এক প্রশ্নের উত্তরে এই আম গবেষক বলেন, ভালোমানের অর্থাৎ খিরসাপাত আম পাওয়া যাবে কয়েক দিন পর। বর্তমানে ঢাকাতে যে আম দেখা যাচ্ছে তা এই এলাকার না। সাতক্ষীরার যে হিমসাগর বলা হয় তা খিরসাপতের মতো জাত।
অপর এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘প্রকৃত আম বাগানের মালিক বা ব্যবসায়ীরা আমে কেমিক্যাল দিতে পারে না। তারা সময় মতো বাজারে ছাড়েন যাতে পুষ্টিগুণের স্বাদ পায়। এবার জেলা প্রশাসন থেকে আম পাড়ার সময় নির্ধারণ করে দেয়নি। তা না করলেও স্বাভবিক সময়ে বাগানের আম পাকলে তা পাড়া হবে।
মূখ্য বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা আরও বলেন, শুধু আম নয়, অন্যান্য ফলও ছোট হয়ে গেছে। এ নিয়ে ভাবতে হবে। কিভাবে পরিস্থিতি মোকাবেলা করা যায়, বিভিন্ন ফলের স্বাভাবিক ফলন হয় সে ব্যাপারে কাজ করতে হবে।
উল্লেখ্য, চাঁপাইনবাবগঞ্জের আঞ্চলিক উদ্যানতত্ত্ব গবেষণা কেন্দ্র বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউট এর অন্তর্গত উদ্যানতত্ত্ব গবেষণা কেন্দ্র। বিএআরআইর অধীনে একটি আঞ্চলিক প্রতিষ্ঠান যা মূলত উদ্যানতাত্ত্বিক ফসল যেমন- আম, কুল, বেল, ডালিমের রোগ বালাই দমন ও উৎপাদন বৃদ্ধি করার জন্য প্রযুক্তি উদ্ভাবন করে থাকে। ফলন বৃদ্ধি ও গুণগত মান বৃদ্ধির জন্য বহুমাত্রিক গবেষণা করে থাকে।