দ্বিতীয় স্ত্রী নৃত্যশিল্পী জিনাত কবির তিথির দায়ের করা যৌতুকের মামলা থেকে খালাস পেয়েছেন জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কারপ্রাপ্ত সংগীত পরিচালক শওকত আলী ইমন। সাক্ষী না আসায় এই মামলা থেকে খালাস পেয়েছেন তিনি। প্রায় ৯ বছর আগে তিথি যৌতুকের মামলাটি করেন ইমনের বিরুদ্ধে। অভিযোগ গঠনের পর থেকে প্রায় সাড়ে আট বছরের বেশি সময় চলমান ছিল মামলাটি।
এই সাড়ে আট বছরে সাক্ষ্যগ্রহণের জন্য ১৫টি তারিখ নির্ধারণ করেন ট্রাইব্যুনাল। বাদী হিসেবে সাক্ষ্য দিতে না আসায় তিথির বিরুদ্ধে জামিন-অযোগ্য গ্রেফতারি পরোয়ানাও জারি করেন আদালত। এরপরও তিনি সাক্ষ্য দিতে আদালতে উপস্থিত হননি। এছাড়া মামলাটি রাষ্ট্রপক্ষও চালাতে আগ্রহী না থাকায় ফৌজদারি কার্যবিধির ২৬৫ (এইচ) ধারায় ইমনকে সম্প্রতি খালাস দেন ঢাকার ৭ নং নারী ও শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইব্যুনালের বিচারক কামরুন্নাহার।
২০১৩ সালের ২৯ মার্চ দায়ের করা এ মামলায় বাদী তিথির পাশাপাশি সাক্ষী ছিলেন নকিব আহসান নুর, সোহেল, রেজাউল বাশার, স্যার সলিমুল্লাহ মেডিকেল কলেজ (মিটফোর্ড) হাসপাতালের চিকিৎসক মাসুদ পারভেজ, কলাবাগান থানার উপ-পরিদর্শক (এসআই) ও মামলার রেকর্ডিং অফিসার ফজলে রহমান, শারিফুল ইসলাম ও মামলার তদন্তকারী কর্মকর্তা আকলিমা আক্তার। এর মধ্যে তিনজন পুলিশ সদস্য ও একজন চিকিৎসক। যৌতুকের মামলায় প্রথমে বাদীকে সাক্ষ্য দিতে হয়। বাদী সাক্ষ্য দিতে না আসায় অন্য সাক্ষীদেরও সাক্ষ্য দেওয়ার জন্য সমন জারি করা হয়নি।
ট্রাইব্যুনালের রাষ্ট্রপক্ষের কৌঁসুলি আফরোজা ফারহানা অরেঞ্জ জাগো নিউজকে বলেন, যৌতুকের মামলায় প্রথমে বাদীকে সাক্ষ্য দিতে হয়। মামলার বাদী সাক্ষ্য দেওয়ার পর অন্য সাক্ষীদের সাক্ষ্য গ্রহণ করা হয়। এ মামলার বাদীকে সাক্ষ্য দেওয়ার জন্য জামিন-অযোগ্য গ্রেফতারি জারি করেন আদালত। এরপরও তিনি সাক্ষ্য দিতে আদালতে উপস্থিত হননি।
তিনি আরও বলেন, মামলাটি অভিযোগ গঠনের পর থেকে প্রায় সাড়ে আট বছর চলমান ছিল। বাদীর বাসার ঠিকানা থেকে সমন বারবার ফেরত আসে। মামলার বাদী যে ঠিকানা দিয়ে মামলা করেছেন সে ঠিকানায় তাকে পাওয়া যায়নি। তাই আদালত আসামি ইমনকে ফৌজদারি কার্যবিধি আইনের ২৬৫ (এইচ) ধারা মোতাবেক মামলার দায় থেকে খালাস দেন।
যা ছিল মামলার অভিযোগে
মামলার অভিযোগ থেকে জানা যায়, জিনাত কবির তিথি কলাবাগান থানাধীন ভূতের গলিতে ২০০৮ সালে পরিবারের সঙ্গে বসবাস করতেন। সে সময় তিনি ঢাকা সিটি কলেজে উচ্চমাধ্যমিকে পড়ালেখা করতেন। ২০০৯ সালের জানুয়ারি মাসে তিনি উচ্চশিক্ষার জন্য ভারত চলে যান। তিনি সেখানে পয়লান স্কুল অ্যান্ড কলেজে গ্রাজুয়েশন করার জন্য মিডিয়া অ্যান্ড কমিউনিকেশন বিষয়ে ভর্তি হন। ২০১১ সালের জুলাই মাসে ফেসবুকের মাধ্যমে ইমনের সঙ্গে তার পরিচয় হয়। পরিচয়ের সূত্র ধরে মাঝে মাঝে ইমনের সঙ্গে কথোপকথন হতো। এর মধ্যে ইমন তাকে বাংলাদেশে আসার জন্য অনুরোধ করতেন এবং বিয়ের আশ্বাস দেন।
এভাবে আশ্বাস-অনুরোধে ২০১১ সালের ৩ ডিসেম্বর তিথি ঢাকায় এলে বিমানবন্দর থেকে তাকে রিসিভ করেন ইমন। সেখান থেকে তিথিকে মগবাজারে নিজের স্টুডিওতে নিয়ে যান ইমন। তিথিকে সেখানে তিনদিন আটক করে রাখেন। এরপর তিথি সেখান থেকে পালিয়ে আত্মীয়ের বাসায় চলে যান। একই বছরের ১১ ডিসেম্বর বিয়ের আশ্বাস দিয়ে তাকে নিয়ে ইস্কাটনের বাসায় ওঠেন ইমন। সেখানে তারা স্বামী-স্ত্রী পরিচয়ে বসবাস করতে থাকেন। সেখান থেকে তিথি পালিয়ে গিয়ে তার আত্মীয়ের বাসায় চলে যান। ২০১২ সালের ২৫ নভেম্বর তিথিকে ফোন করে তার বাসায় নিয়ে গিয়ে জোর করে ধর্ষণ ও অন্তরঙ্গ মুহূর্তের ছবি তুলে তাকে তাড়িয়ে দেন ইমন।
এ ঘটনায় ইমনের বিরুদ্ধে রমনা থানায় একটি মামলা করেন তিথি। পরে ওই মামলা আপস করে ২০১২ সালের ৬ ডিসেম্বর ইমন ১০ লাখ টাকা মোহরানায় তিথিকে বিয়ে করেন। পরের বছর তিথির কাছে ২০ লাখ টাকা যৌতুক দাবি করেন ইমন। যৌতুকের টাকা না দেওয়ায় তিথিকে মারধর করে বাসা থেকে তাড়িয়ে দেন তিনি। এ ঘটনায় ইমনের বিরুদ্ধে যৌতুকের দাবিতে নির্যাতনের অভিযোগ এনে আরেকটি মামলা করেন তিথি।
মামলা চালাতে আগ্রহী নয় রাষ্ট্রপক্ষ
যৌতুকের মামলা থেকে ইমনকে খালাস দেওয়ার আদেশে বিচারক বলেন, ২০১৩ সালের ২৯ মার্চ মামলার বাদীর নালিশের পরিপ্রেক্ষিতে মামলাটি করা হয়। ২০১৪ সালের ২০ মে নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইনের ১১ (গ) ধারায় আসামির বিরুদ্ধে অভিযোগ গঠন করা হয়। অভিযোগ গঠনের পর থেকে ১৫টি তারিখ সাক্ষ্যগ্রহণের জন্য ধার্য করা হলেও রাষ্ট্রপক্ষ কোনো সাক্ষী আদালতে উপস্থিত করতে পারেনি। মামলাটি অভিযোগ গঠনের পর থেকে সাড়ে আট বছরের অধিক সময় চলমান। কলাবাগান থানা থেকে ২০২১ সালের ১৪ সেপ্টেম্বর বিনা তামিলে সাক্ষীর সমন ফেরত এসেছে। মামলাটি চালাতে রাষ্ট্রপক্ষ আগ্রহী নয়। ওপরের সব আলোচনা থেকে অত্র ট্রাইব্যুনাল এ সিদ্ধান্তে উপনীত হয় যে, মামলার কার্যক্রম চলমান রাখার যুক্তিসঙ্গত কারণ না থাকায় মামলার কার্যক্রম সমাপ্ত করা হলো। একইসঙ্গে আসামি ইমনকে ফৌজদারি কার্যবিধি আইনের ২৬৫ (এইচ) ধারা মোতাবেক মামলার দায় থেকে খালাস প্রদান করা হলো।
আরেক মামলা বিচার শুরুর অপেক্ষায়
প্রথম স্ত্রী অভিনেত্রী বিজরী বরকতউল্লাহর সঙ্গে বিচ্ছেদের পর জিনাত কবির তিথিকে বিয়ে করেন ইমন। তিথির সঙ্গেও তার বিচ্ছেদ হলে ২০২০ সালের ২৭ ফেব্রুয়ারি একটি বেসরকারি টিভি চ্যানেলের সংবাদ পাঠিকা রিদিতা রেজাকে বিয়ে করেন ইমন।
ওই বছরের ২০ সেপ্টেম্বর রিদিতা রেজা বাদী হয়ে যৌতুকের জন্য মারধরের ঘটনায় রমনা থানায় স্বামী শওকত আলী ইমনের নামে একটি মামলা করেন।
মামলায় ওই বছরের ২৫ সেপ্টেম্বর ইমনকে ইস্কাটনের বাসা থেকে গ্রেফতার করে পুলিশ। পরদিন তাকে ঢাকা মহানগর হাকিম আদালতে হাজির করা হয়। এ সময় তদন্তকারী কর্মকর্তা মামলার তদন্ত শেষ না হওয়া পর্যন্ত তাকে কারাগারে আটক রাখার আবেদন করেন। আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে আদালত তাকে কারাগারে পাঠানোর আদেশ দেন।
পরে ওই বছরের ১ অক্টোবর ইমনের আইনজীবী ঢাকা মহানগর হাকিম আদালতে জামিনের আবেদন করেন। শুনানি শেষে ঢাকার অতিরিক্ত মহানগর হাকিম কায়সারুল ইসলাম দুই হাজার টাকা মুচলেকায় তার জামিন আবেদন মঞ্জুর করেন।
২৬ নভেম্বর স্ত্রী রিদিতা রেজার করা মামলায় ইমনকে অভিযুক্ত করে ঢাকা মহানগর হাকিম আদালতে চার্জশিট (অভিযোগপত্র) দাখিল করেন মামলার তদন্তকারী কর্মকর্তা রমনা থানার পুলিশের পরিদর্শক তাহমিনা রহমান। মামলাটি প্রমাণের জন্য চার্জশিটে নয়জনকে সাক্ষী করা হয়।
চার্জশিটে মামলার তদন্তকারী কর্মকর্তা বলেন, শওকত আলী ইমন একজন যৌতুকলোভী ও মারমুখী স্বভাবের লোক। ২০২০ সালের ২৭ ফেব্রুয়ারি ইসলামী শরিয়াহ মোতাবেক রিদিতাকে বিয়ে করেন তিনি। এরপর থেকে ইমন রিদিতার কাছে যৌতুক দাবি করে তাকে মারপিট ও মানসিক নির্যাতন করে আসছেন বলে প্রাথমিক তদন্তে প্রকাশ পায়। ২০২০ সালের ৩ জুলাই রাত সাড়ে ১১টার দিকে ইমন তার রমনা থানাধীন ইস্কাটন গার্ডেনের বাসায় পুনরায় রিদিতার কাছে যৌতুক হিসেবে ১০ লাখ টাকা দাবি করেন। তিনি যৌতুক দিতে অস্বীকৃতি জানালে ইমন তাকে মারপিট করে বাসা থেকে বের করে দেন।
এই মামলার অভিযোগ গঠন শুনানির জন্য আগামী ১৬ ফেব্রুয়ারি দিন ধার্য রয়েছে। ঢাকার ৬ নং নারী ও শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইব্যুনালে এ অভিযোগ গঠন শুনানি অনুষ্ঠিত হবে।