ফের করোনার হানা

হাওর বার্তা ডেস্কঃ দেশে ফের করোনাভাইরাস হানা দিয়েছে। অদৃশ্য এই ভাইরাসে শনাক্তের হার প্রতিদিন লাফিয়ে লাফিয়ে বাড়ছে। নতুন বছরেই শনাক্তের হার ১.৩ শতাংশে নেমেছিল। অফিস-আদালত-শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান চলছিল পুরোদমে। চাঙা হয়েছে অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড। ওমিক্রনের প্রাদুর্ভাবে নতুন করে করোনার তৃতীয় ঢেউ আছড়ে পড়ছে। রাজধানী ঢাকা থেকে সে ঢেউ ছড়িয়ে পড়ছে সারা দেশে। গত কয়েকদিনে শনাক্তের হার বেড়ে ২৮.৪৯ শতাংশে দাঁড়িয়েছে। করোনা সংক্রমণ রোধে মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ ৫টি জরুরি নির্দেশনা দিয়ে প্রজ্ঞাপন জারি করেছে। এখন থেকে সরকারি-বেসরকারি অফিস, শিল্পকারখানায় কর্মকর্তা-কর্মচারীদের অবশ্যই ভ্যাকসিন সার্টিফিকেট গ্রহণ করতে হবে। রাষ্ট্রীয়, সামাজিক, রাজনৈতিক, ধর্মীয় সমাবেশ ও অনুষ্ঠানে ১০০ জনের বেশি সমাবেশ করা যাবে না। সবার ভ্যাকসিন সার্টিফিকেট বা ২৪ ঘণ্টার মধ্যে পিসিআর সার্টিফিকেট নিতে হবে। বাজার, মসজিদ, বাসস্ট্যান্ড, লঞ্চঘাট, মেলা, খেলা দেখা, রেলস্টেশনসহ সবধরনের জনসমাবেশে যাতায়াতে মাস্ক ব্যবহার করতে হবে। ডিসি সম্মেলনেও করোনাভাইরাসের সংক্রমণ নিয়ন্ত্রণে জেলা প্রশাসকদের কঠোর মনিটরিংয়ের নির্দেশনা দেয়া হয়েছে। এর আগে মন্ত্রী পরিষদ থেকে ১১ দফা বিধিনিষেধ দেয়া হয় এবং যানবাহনে অর্ধেক যাত্রী বহনের সিদ্ধান্ত দেয়। পরবর্তীতে গণপরিবহনে ‘যত আসন তত যাত্রী’ নির্দেশনা দেয়া হলেও তা মানা হচ্ছে না।

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, সরকারের দেয়া বিধিনিষেধ মানতে হবে। না হলে পরিস্থিতি আরো খারাপ হলে উৎপাদন, ব্যবসা-বাণিজ্য বন্ধ হয়ে যাবে। দেশের অর্থনীতির ওপর চাপ বাড়বে। অর্থনীতিকে চলমান রাখতেই সংক্রমণের লাগাম টেনে ধরবে হবে।
স্বাস্থ্যমন্ত্রী জাহিদ মালেক বলেছেন, করোনার সংক্রমণ রোধে অর্ধেক লোক দিয়ে অফিস আদালত চালানোর সিদ্ধান্ত হয়েছে। খুব শিগগিরই এ সিদ্ধান্ত প্রজ্ঞাপন আকারে চলে আসবে। আর করোনা নিয়ন্ত্রণে সরকারের বিধিনিষেধ মানার পাশাপাশি নাগরিকদের সচেতন হবে। প্রত্যেককে সংক্রমণ রোধে দায়িত্বশীল নাগরিকের ভূমিকা পালন করতে হবে।

মন্ত্রিপরিষদের প্রজ্ঞাপন : দেশে করোনাভাইরাস সংক্রমণ নিয়ন্ত্রণে পাঁচটি জরুরি নির্দেশনা জারি করেছে মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ। গতকাল শুক্রবার মন্ত্রিপরিষদ বিভাগের যুগ্মসচিব মো. সাবিরুল ইসলাম স্বাক্ষরিত এক প্রজ্ঞাপনে পাঁচটি নির্দেশনার বিষয়ে জানানো হয়েছে। নির্দেশনায় বলা হয়েছে, এক. ২১ জানুয়ারি থেকে ৬ ফেব্রুয়ারি সকল স্কুল, কলেজ বন্ধ থাকবে। বিশ্ববিদ্যালয়গুলো নিজ নিজ ক্ষেত্রে অনুরূপ ব্যবস্থাগ্রহণ করবে। দুই. রাষ্ট্রীয়, সামাজিক, রাজনৈতিক, ধর্মীয় সমাবেশ ও অনুষ্ঠানে ১০০ জনের বেশি সমাবেশ করা যাবে না। এসব ক্ষেত্রে যারা যোগদান করবেন তাদের অবশ্যই ভ্যাকসিন সার্টিফিকেট বা ২৪ ঘণ্টার মধ্যে পিসিআর সার্টিফিকেট আনতে হবে। তিন. সরকারি-বেসরকারি অফিস, শিল্পকারখানায় কর্মকর্তা-কর্মচারীদের অবশ্যই ভ্যাকসিন সার্টিফিকেট গ্রহণ করতে হবে। সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ এ বিষয়ে দায়িত্ব বহন করবে। চার. বাজার, মসজিদ, বাসস্ট্যান্ড, লঞ্চঘাট, রেলস্টেশনসহ সবধরনের জনসমাবেশে অবশ্যই মাস্ক ব্যবহার করতে হবে। প্রশাসন ও আইনশৃঙ্খলা বাহিনী বিষয়টি মনিটর করবে। পাঁচ. করোনা সংক্রমণ রোধে মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ এই ৫টি জরুরি নির্দেশনা জারি করেছে বলে উল্লেখ করা হয়েছে প্রজ্ঞাপন।

স্বাস্থ্য অধিদফতরের সংবাদ সম্মেলন : করোনাভাইরাসের সংক্রমণ বেড়ে যাওয়ার চিত্র তুলে ধরে গতকাল শুক্রবার স্বাস্থ্য অধিদফতরের সম্মেলন কক্ষে জরুরি সংবাদ সম্মেলন করেছেন স্বাস্থ্যমন্ত্রী জাহিদ মালেক। তিনি বলেছেন, প্রতিদিন আক্রান্তের হার বেড়ে যাচ্ছে। মন্ত্রিপরিষদ থেকে ১১ দফা বিধিনিষেধ দেওয়ার পরেও সাধারণ মানুষ তা মানছে না। বর্তমানে প্রতিদিন হাসপাতালে করোনা রোগী বাড়ছে। এভাবে আক্রান্তের হার বাড়তে থাকলে হাসপাতালের বেড খালি থাকবে না। করোনা কমে যাওয়ার পর স্বাস্থ্যবিধি না মানার কারণে এমনটা হয়েছে। এরই মধ্যে ঢাকার হাসপাতালগুলোর বেড এক-তৃতীয়াংশ পূরণ হয়ে গেছে। আর তাই প্রধানমন্ত্রীর অনুমোদনক্রমে আগামী ২ সপ্তাহ স্কুল, কলেজ বন্ধ রাখা হবে।

সংক্রমণের হার কমাতে গেলে সবাইকে নিজ জায়গা থেকে বিধিনিষেধ মানতে হবে জানিয়ে মন্ত্রী বলেন, সবার ভ্যাকসিন সনদ সঙ্গে থাকতে হবে। জেলা প্রশাসক ও পুলিশের প্রতি ১১ দফা বাস্তবায়নে কঠোর ভূমিকা পালন করবেন।

পরামর্শক কমিটির ৫ সুপারিশ : করোনা সংক্রমণ রোধে বিনামূল্যে মাস্ক বিতরণসহ ৫ দফা সুপারিশ করেছে কোভিড-১৯ সংক্রান্ত জাতীয় কারিগরি পরামর্শক কমিটি। কমিটির ৫৩তম সভার পর ১৯ জানুয়ারী কারিগরি কমিটির সভাপতি অধ্যাপক ডা. মো. সহিদুল্লার সই করা এক বিজ্ঞপ্তিতে এ তথ্য জানানো হয়েছে।
সুপারিশগুলো হচ্ছেÑ এক. কোভিড-১৯ পজিটিভ রোগীরা লক্ষণ প্রকাশের ১০ দিন পর্যন্ত আইসোলেশনে থাকবেন। কোভিড-১৯ রোগীর সংস্পর্শে এসেছেন এমন ব্যক্তিদের কোনো উপসর্গ না থাকলে তাদের কোয়ারেন্টিনের প্রয়োজন নেই। তবে তাদের টাইট মাস্ক পরার বিষয়টি নিশ্চিত করতে হবে। দুই. বিমানবন্দরসহ সব পোর্ট অফ এন্ট্রিতে সরকারি স্বাস্থ্য নির্দেশনা যথাযথভাবে পালনের লক্ষ্যে স্বাস্থ্য অধিদফতরের পক্ষ থেকে নজরদারি বৃদ্ধির জন্য কমিটি সুপারিশ করেছে। তিন. সব সরকারি হাসপাতালে সার্বক্ষণিক কোভিড-১৯ ও নন-কোভিড সব রোগীর জরুরি চিকিৎসা নিশ্চিত করার সুপারিশ করা হয়েছে। চার. মন্ত্রিপরিষদের প্রজ্ঞাপন বাস্তবায়নের লক্ষ্যে অংশীদের যেমনÑ পরিবহন মালিক সমিতি, দোকান মালিক সমিতি, রেস্তোরাঁ মালিক সমিতির নেতাসহ সবাইকে সম্পৃক্ত করে পদক্ষেপ নেওয়ার সুপারিশ করা হয়েছে। পাঁচ. জাতীয় পরামর্শক কমিটি জনগণের মাস্ক পরা নিশ্চিত করতে সরকারের পক্ষ থেকে বিনামূল্যে মাস্ক বিতরণের প্রস্তাব করেছে। এ ছাড়া, জনপ্রতিনিধি ও ধর্মীয় প্রতিনিধিদের মাধ্যমে জনগণকে সঠিকভাবে মাস্ক পরা এবং অন্যান্য স্বাস্থ্যবিধি মানার ব্যাপারে উদ্বুদ্ধকরণের সুপারিশ করা হয়েছে।

সঙ্গে রাখুন টিকা সনদ : যেখানেই যান সঙ্গে রাখুন টিকা সনদ। সামাজিক, রাজনৈতিক, ধর্মীয় ও রাষ্ট্রীয় অনুষ্ঠান, সরকারি-বেসরকারি অফিস, শিল্পকারখানা, হাটবাজার, শপিং মল, মসজিদ, বাসস্ট্যান্ড, লঞ্চঘাট, রেল স্টেশন, বইমেলা, বাণিজ্যমেলা, লঞ্চ, রেলওয়ে সবখানেই টিকা সনদ দেখাতে হতে পারে। টিকা সনদের বিষয়ে সরকারের দেওয়া নির্দেশনা মেনে চলার ব্যাপারে প্রশাসনের পদক্ষেপের কথা জানিয়ে স্বাস্থ্যমন্ত্রী বলেছেন, প্রশাসনকে আরো কঠিনভাবে বলছি, বলব, যেন করোনার টিকা সনদের বিষয়ে বেশি নজরদারি করে। তবে দায়িত্বটা নিজেদের। যারা বাইরে ঘুরি, খাই, বেড়াতে যাই, এ সময় এগুলো কম করলেই হয়। সরকার ঘোষিত বিধিনিষেধ জনগণকে মেনে চলার আহ্বান জানিয়ে মন্ত্রী বলেন, জনগণ নিয়ম মানলে সব সম্ভব। জনগণের ইচ্ছার ওপর নির্ভর করে আমরা কত দ্রুত এ পরিস্থিতি থেকে বেরিয়ে আসতে পারব। নিজের সুরক্ষার জন্য, পরিবারের জন্য বিধিনিষেধ পালন করা প্রয়োজন। অর্থনীতি চলমান রাখতে হলে সংক্রমণের লাগাম টেনে ধরতে হবে। এটা কখনোই সরকার একা পারবে না। সরকার নিয়ম-আইন করতে পারে, কিন্তু সেটা মানার দায়িত্ব জনগণের। মন্ত্রী জানান, দেশের অর্থাৎ সাড়ে ১২ কোটি মানুষকে (৭০ শতাংশ) টিকা দেওয়া হবে। এখন পর্যন্ত ১৫ কোটি ১০ লাখ ডোজ টিকা দেওয়া হয়েছে। এর মধ্যে প্রথম ডোজ দেওয়া হয়েছে ৯ কোটি ২৪ লাখ আর দ্বিতীয় ডোজ দেওয়া হয়েছে ৫ কোটি ৮০ লাখ। হাতে আরো প্রায় ৯ কোটি টিকা আছে। প্রত্যেকেই টিকা পাবেন।

সোয়া ৯ কোটি মানুষ টিকা নিয়েছে : দেশের ৯ কোটি ২৪ লাখের বেশি মানুষকে করোনাভাইরাসের টিকার প্রথম ডোজ দেওয়া হয়েছে। সরকারের লক্ষ্যমাত্রা ১২ কোটি মানুষকে টিকার আওতায় নিয়ে আসা। গতকাল শুক্রবার স্বাস্থ্য অধিদফতর এ তথ্য জানিয়েছে। বর্তমানে দেশের মোট জনসংখ্যা ১৭ কোটি ৩ লাখ ১৭ হাজারের বেশি। সরকার আগে শতকরা ৮০ জনকে করোনার টিকা দেয়ার সিদ্ধান্ত ঘোষণা করে। এখন বলা হচ্ছে, করোনা মোকাবিলায় জনসংখ্যার ৭০ শতাংশকে টিকার আওতায় আনার লক্ষ্য নেওয়া হয়েছে। সেই হিসাবে ১১ কোটি ৯২ লাখ ২১ হাজারের বেশি মানুষকে করোনাভাইরাসের টিকা দেওয়া হবে।

স্বাস্থ্য অধিদফতর জানায়, এখন পর্যন্ত করোনাভাইরাসের টিকার প্রথম ডোজ পেয়েছে ৯ কোটি ২৪ লাখ ২৬ হাজার ২৩৩ জন (৭৭ দশমিক ৫৩ শতাংশ)। আর দুই ডোজ পেয়েছেন, ৫ কোটি ৮০ লাখ ৫ হাজার ২৫৯ জন (৪৮ দশমিক ৬৫ শতাংশ)।
দেশে ১২ থেকে ১৭ বছর বয়সি ১ কোটি ২৮ লাখ ৯৭ হাজার ৯০৯ জন টিকা পেয়েছেন। ১ কোটি ২৯ লাখ কিশোর-কিশোরীকে টিকা দেওয়ার লক্ষ্যমাত্রা অচিরেই পূরণ হবে বলে আশাবাদী স্বাস্থ্য অধিদফতর। এছাড়া বর্তমানে ষাটোর্ধ্ব, সম্মুখ সারির কর্মী এবং স্বাস্থ্যঝুঁকিতে থাকা জনগোষ্ঠীকে দেওয়া হচ্ছে- কোভিড টিকার তৃতীয় বা বুস্টার ডোজ।

২০২০ সালের ৮ মার্চ দেশে প্রথম ৩ জনের দেহে করোনাভাইরাস শনাক্ত হয়। এর ১০ দিন পর ওই বছরের ১৮ মার্চ দেশে এ ভাইরাসে আক্রান্ত হয়ে প্রথম একজনের মৃত্যু হয়। গত বছরের ৫ ও ১০ আগস্ট দুদিন সর্বাধিক ২৬৪ জন করে মারা যান। করোনাভাইরাসের সংক্রমণ ২০২১ সালে কমে এলেও ২০২২ সালের শুরুতেই তা বাড়তে থাকে।

করোনা সংক্রমণ বেড়ে যাওয়া প্রসঙ্গে দেশের প্রখ্যাত মেডিসিন বিশেষজ্ঞ প্রধানমন্ত্রীর ব্যক্তিগত চিকিৎসক ডা. এবিএম আবদুল্লাহ বলেন, দিনদিন পরিস্থিতির অবনতি হচ্ছে, চারপাশের চিত্র বদলে যাচ্ছে। আমরা এক মাস আগেও যে অবস্থানে ছিলাম বর্তমানে সেখানে নেই। আক্রান্তের হার একটু একটু করে বাড়ছে। এ থেকে রক্ষা পেতে সকলকে স্বাস্থ্যবিধি মানতে হবে। সরকার যেসব বিধিনিষেধ দিয়েছে সেগুলো মানলে সংক্রমণ রোধ করা সম্ভব। টিকা গ্রহণ করতে হবে এবং নমুনা পরীক্ষা করতে হবে।

Print Friendly, PDF & Email

     এ ক্যাটাগরীর আরো খবর