হাওরবার্তা প্রধান সম্পাদক… দেশের পাবলিক তথা সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে বেতন আর মর্যাদার দাবিতে যখন শিক্ষকরা শ্রেণিকক্ষ ছেড়ে বাইরে আন্দোলন করছেন, তখন উচ্চশিক্ষা খাতে খবর এলো নতুন করে আরও ছয়টি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের অনুমোদন দিয়েছে সরকার। এ নিয়ে দেশে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের সংখ্যা দাঁড়ালো ৯১টিতে।
বেশিরভাগ বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের বিরুদ্ধে নানা অনিয়ম ও বিশ্ববিদ্যালয় পরিচালনার শর্ত ভঙ্গের অভিযোগ থাকার পরও নতুন বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপনের অনুমোদন দেওয়া হলো। উদ্যোক্তা যারা আছেন, তারা হয়তো আর সব ব্যবসার চেয়ে এখানেই লাভটা বেশি দেখছেন। কিন্তু ব্যবসা বলে সমালোচনা যারা করেন তারা নিশ্চয়ই মাথায় রাখবেন যে, দেশে উচ্চ শিক্ষা নিচ্ছেন এমন ৬৩ শতাংশ শিক্ষার্থীই পড়ছেন বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোয়। ঢাকাসহ সারাদেশে ৮৫টি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে সাড়ে চার লাখের বেশি শিক্ষার্থী রয়েছে।
গত বছর বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরী কমিশনের যে প্রতিবেদন পাওয়া গিয়েছিল, তাতে দেখা যায় এসব বিশ্ববিদ্যালয়ের মাত্র ১০টির মান `ভালো`। বাকিগুলোর মান `মোটামুটি`, অনেকগুলোর মান `খুব খারাপ`। অনেক অর্থ দিয়ে এখানে পড়তে হয়, কারণ সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে স্থান সংকুলান হয় না। কিন্তু মান নিয়ে যে শংকা সর্বত্র উচ্চারিত তারপর প্রশ্ন থাকে, তাহলে এসব চলছে কেমন করে? কর্তৃপক্ষই বা কি করছে? পড়ালেখার পরিবর্তে এসব বিশ্ববিদ্যালয়ের অনেকগুলোই হয়ে উঠছে উদ্যোক্তাদের জন্য অর্থ উৎপাদনকারী কারখানা। শিক্ষার্থীদের জন্য সুবিধা, শিক্ষকের মান, অবকাঠামো এবং বিশ্ববিদ্যালয়ের চরিত্র সবদিক থেকে একটি আরেকটি থেকে আলাদা। বেশ কয়েকটি বিশ্ববিদ্যালয়ের বিরুদ্ধে সার্টিফিকেট বাণিজ্য করার অভিযোগ আছে। অনেক বিশ্ববিদ্যালয় ঢাকায় এবং দেশের বিভিন্ন জায়গায় অলি-গলিতে ভাড়া করা ভবনে কার্যক্রম চালাচ্ছে। এগুলোর মান খুব খারাপ। সাধারণ পরিবেশটুকুও নেই কোনো কোনোটিতে।
এমন যখন বাস্তবতা সরকার তখন আরো ৬টি নতুন বিশ্ববিদ্যালয়ের কেন আনুমোদন দিল তার কোনো ব্যাখ্যা নেই। অবশ্য বাংলাদেশে কোন সরকারইবা কোন কাজের ব্যাখ্যা কখন দিয়েছে? তবে একথা স্বীকার করতেই হবে যে, বাংলাদেশে উচ্চশিক্ষাঙ্গনের ক্ষেত্রে দ্রুত বিকাশমান উপখাত বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়। এবং বিপুল পরিমাণ শিক্ষার্থীর উচ্চশিক্ষার চাহিদা পূরণে এরা এখন গুরুত্বপূর্ণ অবস্থানে। দেশে বেসরকারি প্রতিষ্ঠান হয়েছে, তাই উচ্চশিক্ষার্থে এদেশের সন্তানদের বিদেশে যাওয়ার হার কমেছে, বৈদেশিক মুদ্রার সাশ্রয় হচ্ছে। শুধু তাই নয়, বিভিন্ন ক্ষেত্রে এসব প্রতিষ্ঠান থেকে উত্তীর্ণ শিক্ষার্থীরা অবদান রেখে চলেছেন। বিসিএস পরীক্ষায় বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পাশ করা অনেক শিক্ষার্থী ভাল ফলাফল করছেন, ব্যক্তিখাতে ভূমিকা রাখছেন এমনকি উচ্চ শিক্ষার আরো বড় জগতেও তাদের বিচরণ বাড়ছে। আমাদের মনে আরো ভরসার সঞ্চার করে যখন দেখি, এদেশের বেশ ক’টি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে নেপাল, ভুটান, মালদ্বীপ, ভারত, তুরস্ক থেকেও ছেলেমেয়েরা এসে লেখাপড়া করছে।
স্থান সংকুলান না হওয়ায় সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলো উচ্চশিক্ষার বর্ধিত চাহিদা মেটাতে পারছিলনা এটা যেমন সত্য, তার চেয়ে বড় সত্য সরকারের পক্ষেও এই খাতে নতুন বিনিয়োগ করা সম্ভব হচ্ছিল না। আর সে জন্যই সরকার বেসরকারি ‘বিশ্ববিদ্যালয় আইন, ১৯৯২’ করে এই পথ উন্মুক্ত করে। এই আইন পরবর্তীতে ১৯৯৮ সালে আবারো সংশোধিত হয়। বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় না থাকলে অন্তত ৫০টি বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপন করতে হতো এবং শিক্ষক সংখ্যা বর্তমানের চেয়ে দিগুণ নিয়োগ দিতে হতো। আর সরকার এদিকে নজর দিলে প্রাথমিক শিক্ষা জাতীয়করণ করতে পারতো না, কিংবা মাধ্যমিক বা উচ্চ মাধ্যমিকে এমপিও সুবিধা সৃষ্টি সম্ভব হতো না। এটিই বাস্তবতা।
মান নিয়ে শংকা আছে, এবং কোনো কোনো অবস্থায় তা বাস্তব। কিন্তু অনেকগুলো বেশ মানসম্পন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ও প্রতিষ্ঠিত হয়েছে যার পেছেনে রয়েছে সেসব বিশ্ববিদ্যালয়ের উদ্যোক্তাদের ধারাবাহিক আন্তরিক প্রচেষ্টা। পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার মান ভাল। আবার এসব পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের অধিকতর দক্ষ ও যোগ্য শিক্ষকরাই আবার বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর সাথে জড়িত। বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে ক্লাস লেকচার উপস্থাপন পদ্ধতি আধুনিক। জাতীয় ও আন্তর্জাতিক বিভিন্ন প্রতিযোগিতায়ও বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা কৃতিত্বের সাক্ষর রাখছেন।
এখানে শিক্ষক রাজনীতি নেই, ছাত্ররাজনীতি নেই, তাই সেশন জট নেই। নির্ধারিত সময়ে উচ্চশিক্ষা সম্পন্ন করতে পারছে সবাই। বেতন কম থাকলেও ছাত্র ও শিক্ষক রাজনীতির কারণে উল্লেখযোগ্যসংখ্যক সরকারি বিশ্ববিদ্যালয় সেশনজটে পড়ে বিধায় শিক্ষার্থীদের সামগ্রিক খরচও একটা সময় গিয়ে অনেক বেড়ে যায়। একাডেমিক ক্যালেন্ডারের মধ্যে লেখাপড়া শেষ হওয়ায় চাকুরির বাজারে এরা আগে প্রবেশ করে সরকারি উচ্চ শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থীদের চেয়ে। চাকুরির বাজারে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় আরেকটি কারণে সুবিধাজনক অবস্থানে আছে, কারণ অধিকাংশ বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় চাকরির বাজারে চাহিদা আছে এমন সব বিষয়ই পড়িয়ে থাকে। কিন্তু এরপরও কথা থেকে যায়। মানসম্পন্ন মাত্র ১০টি প্রতিষ্ঠান কেন? কেন বাড়ছেনা সংখ্যাটি? কেন সনদ বিক্রির অভিযোগ এত তীব্র?
মান নিয়ে যখন আমরা কথা বলি, তখন এসব প্রতিষ্ঠান সরকারের কাছে থেকে কতটা সহযোগিতা পায় তাও জানতে হয়। বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় দেশের অন্যতম প্রধান বেসরকারি খাত হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। সাধারণ মানুষ যেমন বলছে, সরকারও স্বীকার করছে যে, এতে বিপুলসংখ্যক শিক্ষার্থীর উচ্চশিক্ষার সুযোগ যেমন সৃষ্টি হয়েছে, তেমনি বিপুল পরিমাণ বৈদেশিক মুদ্রার অপচয় রোধ সম্ভব হচ্ছে। কিন্তু এ খাতে সরকারি কোনো আর্থিক পৃষ্ঠপোষকতা নেই।
যখন মান নিয়ে অসন্তোষের কথা প্রকাশ করে, তখন অভিভাবক হিসেবে বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরী কমিশনের দায়িত্বের কথাও উচ্চারিত হয়। বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার মান উন্নয়নের জন্য সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের তদারকি আরো জোরদার করা দরকার। কমিশনের চেয়ারম্যান ও সদস্যরা আসছেন সরকারি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে, রাজনৈতিক বিবেচনায়। তাই তাদের জববাবদিহিতার বিষয়ও আছে এখানে। নজরদারি বাড়াতে অনেকদিন থেকেই অ্যাক্রেডিটেশন কাউন্সিল গঠনের প্রস্তাব আলোচিত হচ্ছে, কিন্তু তা আলোর মুখ দেখছে না।
যেখানে জ্ঞানের সৃষ্টি হয়, জ্ঞান ধারণের ব্যবস্থা থাকে এবং জ্ঞান বিতরণ হয়, সেটাকেই আমরা বিশ্ববিদ্যালয় বলব। এ হিসেবে আমাদের বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলো কোন অবস্থায় আছে তা আমাদের ভাবতে হবে। যদি অল্পসংখ্যককেও মান সম্মত বলা হয়, তাহলে মঞ্জুরি কমিশনের উচিত হবে সেগুলোতে ডক্টরাল প্রগাম চালু করার উদ্যোগ নেয়া।
বিশ্ববিদ্যালয়ে এমন একটা আবহ দরকার যেখানে শিক্ষার্থীরা জ্ঞানের নেশায় ছুটতে পারে। আর শিক্ষকরাও নতুন জ্ঞানের ভাণ্ডার তৈরির জন্য শিক্ষার্থীদের প্রণোদনা জোগাতে পারেন। তাই এ ধরনের প্রতিষ্ঠানে দলীয় চিন্তাভাবনা, কার্যক্রম বড় বাধা। রাজনৈতিক আনুগত্যও পরিবেশ বিনষ্ট করে। পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে সহিংস ছাত্ররাজনীতি ছাড়াও শিক্ষক রাজনীতি যেভাবে দানা বেঁধেছে তাতে আগামীতে বিশ্বমানের বিশ্ববিদ্যালয়ের চাহিদা বেসরকারি খাত থেকে পূরণ হলে অবাক হওয়ার কিছু থাকবে না।
উচ্চশিক্ষার ক্রমবর্ধমান জাতীয় চাহিদা বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোকে বাদ দিয়ে বাস্তবায়ন সম্ভব নয়। কিন্তু মানের দিকে নজরদারি না বাড়িয়ে শুধু সংখ্যায় বাড়লে এসব বিশ্ববিদ্যালয়ের অনেকগুলো শুধু সনদই বিক্রি করতে থাকবে, যা তারা এখন করছে।