ঢাকা ১২:০৫ অপরাহ্ন, রবিবার, ২২ ডিসেম্বর ২০২৪, ৮ পৌষ ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

শিশুর খাওয়া-দাওয়া ও মায়ের ভাবনা

  • Reporter Name
  • আপডেট টাইম : ০৩:০১:০৩ অপরাহ্ন, সোমবার, ৩০ সেপ্টেম্বর ২০১৯
  • ৩২৬ বার

হাওর বার্তা ডেস্কঃ আঠারো মাসের সিদরাত। খাওয়ার প্রতি খুবই অনীহা। মা লাভলী আক্তার সারাক্ষণ সন্তানকে খাওয়াতে না পারার টেনশনে ভোগেন। বিভিন্ন কৌশলে কিছু খাওয়াতে পারলেও তা যথেষ্ট মনে করেন না সিদরাতের মা। তাই বাজারের বিভিন্ন মজাদার খাবার খাওয়াতে চেষ্টা করেন। সিদরাতের বাবা জিএম এরশাদ সন্তানের পছন্দমতো খাবার আনতে ভুল করেন না।
ইদানীং প্রায় সব মাকেই বলতে শোনা যায়, আমার শিশু খেতে চায় না। খেলছে, পড়ছে, দুষ্টুমি করছে কিন্তু খেতে চাইছে না। খাবার গ্রহণে শিশুর এই অনীহা কেন? কেন শিশু খেতে চায় না? অনেক মা অনুযোগের সুরে বলেন, আমার বাচ্চা খাবার মুখে নিয়ে বসে থাকে গিলে না, আবার কেউ বা বলেন, আমার বাচ্চা শুধু চকোলেট, মিষ্টি জাতীয় খাবার, চিপস ও কোক খেতে চায়। কেউ বলেন, আমার বাচ্চা ফাস্টফুড পাগল, বিজ্ঞাপন, কার্টুন বা গান না দেখালে বাচ্চা খায় না।
অনেক মা বাচ্চাদের কার্টুন, কোক, চিপস, চকোলেট, ফাস্টফুড দেখিয়ে খাওয়ার অভ্যাস করেন। আসলে অনেক মায়েরা তাদের বাচ্চাদের খাবার নিয়ে একটু বেশি চিন্তিত থাকেন বলে খাবারের ক্ষেত্রে কোনো রুটিন মেনে চলেন না। আর এই অনিয়মিত খাদ্যাভ্যাসের দরুন ধীরে ধীরে খাবারের প্রতি শিশুর অনীহা তৈরি হয়। আমাদের মনে রাখা প্রয়োজন, শিশুর শরীর ছোট, তার চাহিদা কম ও তার হজম শক্তিও কম। অতএব শিশুর চাহিদা অনুযায়ী তাকে খেতে দিতে হবে। তার ক্ষিদে লাগলে সে নিজেই চেয়ে খাবে।
শিশু বিশেষজ্ঞ ডাক্তারদের মতে, খাওয়ার ব্যাপারে শিশুকে চাপ প্রয়োগ ঠিক নয়। ক্ষুধা লাগলে শিশু খাবে এটাই স্বাভাবিক, আর খাবার হজম হলেই শিশুর খিদে লাগবে। যদি খাওয়ার সুনির্দিষ্ট সময় ছাড়া অন্য সময়ে শিশুকে কিছু খাওয়ানো হয়, তবে তা ঠিকমতো হজম হবে না। হজম না হলে খিদে পাবে না। খিদে না পেলে শিশু খেতে চাইবে না। শিশুর খেতে না চাওয়া নিয়ে মায়েদের দুশ্চিন্তার কিছু নেই। আসলে শিশুর এই খেতে না চাওয়াটা খুব সাধারণ একটি সমস্যা।
প্রতিটা শিশুই আলাদা, আর তাদের খাবারের চাহিদাও ভিন্ন। এমনকি এ কথাও বলা হয়ে থাকে, দিনভেদে একই শিশুর খাবারের প্রতি চাহিদা বা আগ্রহের রকমফের ঘটে। মাঝেমধ্যে শিশু কোনো রকম ঝামেলা ছাড়াই তার জন্য বরাদ্দ খাবার খেয়ে ফেলে। আবার অন্যদিন হয়তো একদমই খেতে চায় না। এতে মা-বাবা চিন্তিত হয়ে পড়েন। ধারণা করে থাকেন যে, এটা বুঝি শিশুর বৃদ্ধি ও বিকাশকে বাধাগ্রস্ত করছে। আসলে ব্যাপারটি তা নয়। বাচ্চা যদি স্বাভাবিক চলাফেরা ও খেলাধুলায় ক্লান্ত না হয়ে পড়ে, তবে চিন্তার কোনো কারণ নেই। সাধারণত যেসব কারণে শিশু খেতে চায় না তার মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো জোরপূর্বক খাওয়ানো। জোর করে খাওয়ানোর ফলে শিশুর মধ্যে প্রচণ্ডভাবে খাদ্য অনীহা দেখা দেয়। অনেক সময় শক্ত খাবার, অপছন্দের খাবার এবং একই খাবারের পুনরাবৃত্তি করে খাওয়ালে খাবারের প্রতি শিশুর অনীহা তৈরি হয় এবং সে খাবার দেখলে শিশু ভয় পায় বা বমি করে ফেলে। ছোট শিশুদের ঘ্রাণেন্দ্রিয় বেশ স্পর্শকাতর। খাবারের গন্ধ এবং রঙ যদি ভালো না হয় বাচ্চারা সে খাবার খেতে চায় না, মুখ থেকে ফেলে দেয়। অনেক সময় শরীরের জিনঘটিত কারণে কিছু কিছু খাবারের গন্ধ বা স্বাদ বাচ্চারা সহ্য করতে পারে না। এর ফলে তারা সব ধরনের খাবার খেতে চায় না, বেছে বেছে খায়। হজম প্রক্রিয়ায় সমস্যা থাকায় অনেক বাচ্চার খিদে কম পায় এবং খাবার ইচ্ছা থাকে না। এ কারণেও অনেক বাচ্চা খাবার নিয়ে বায়না করতে পারে।
শিশুর খাবার না খেতে চাওয়ার পেছনে অনেক সময় সাইকোলজিক্যাল ব্যাপার কাজ করে। যেসব বাচ্চার মা অতিরিক্ত আদর বা শাসন করে, সে বাচ্চাদের মধ্যে খাবার নিয়ে ঝামেলা করার প্রবণতা বেশি দেখা যায়। অনেক মা শিশুকে নিয়মমাফিক খাওয়ানোর মাঝে কান্নামাত্রই মায়ের দুধ খাওয়ান বা অন্যের খাবার খাওয়ান। এই অনিয়মিত খাবারের দরুন শিশুর খাবারের রুচি ও খিদে নষ্ট হয়ে যায়। ফলে সে খাবার খেতে অনীহা প্রকাশ করে। কোনো কোনো বাড়িতে শিশু নিজের খাবার সময় ছাড়া অন্য সময়ও পরিবারের অন্যান্য সদস্য বা আত্মীয়স্বজন সবার সঙ্গে খায়। আবার অনেক মা তার শিশু ৭টার সময় পেটভরে খায়নি বলে ৮টার সময় তাকে আরেকবার খাবার দেন, ৯টার সময় আবার চেষ্টা করেন এবং এমনিভাবে সারাদিন ধরেই প্রচেষ্টা চলতে থাকে। এসব অভ্যাসই শিশুর খাবারের প্রতি অনীহা তৈরি করে।
শিশু বিশেষজ্ঞদের মতে, শিশুর মূল খাদ্যাভ্যাস তৈরি করতে হবে ছয় মাস বয়স থেকে, যখন সে মায়ের বুকের দুধের পাশাপাশি পরিপূরক খাবার খেতে শুরু করে। শিশুকে দৈনিক চার-পাঁচবার অল্প অল্প করে পরিপূরক খাবার খেতে দিতে হবে। শিশুর পরিপূরক খাবার অবশ্যই সুষম হতে হবে। এজন্য সবজি, ডাল, মাছ বা মাংস এবং খিচুড়ি রান্না করে দিলে ভালো হয়। তবে শিশুকে দুই বছর পর্যন্ত অন্য খাবারের পাশাপাশি বুকের দুধ খাওয়াতে হবে। শিশু যখন থেকে বাড়তি খাবার খেতে শিখে তখন থেকেই শিশুকে সব ধরনের খাবার খাওয়ার অভ্যাস করাতে হবে।
একটি শিশুর সঠিকভাবে বেড়ে ওঠার জন্য পুষ্টি সমৃদ্ধ খাবার খুবই গুরুত্বপূর্ণ। তাই তাকে ছোটবেলাতেই এসব মাছ, মাংস, ডিম, দুধ ও শাকসবজি খাবার দিতে হবে। এক বছর বয়স থেকে শিশুর খাবারের পরিমাণ ও সময় নির্দিষ্ট করতে হবে। কিছুদিন একই সময়ে খাওয়ালে শিশু এতে অভ্যস্ত হয়ে যাবে। দুই বছর পর্যন্ত শিশুর মস্তিষ্কের বৃদ্ধি ঘটে, তাই এ সময় শিশুকে পর্যাপ্ত প্রোটিনজাতীয় খাবার দেওয়া প্রয়োজন। দুই বছর বয়স থেকে শিশুকে নিজ হাতে খাওয়ানোর অভ্যাস করতে হবে। প্রথম প্রথম নষ্ট করলেও একসময় সে নিজেই খাওয়া শিখে যায়। এ সময় থেকেই তিন বেলা মূল খাবারের পাশাপাশি সকাল, দুপুর ও বিকালে নাশতা হিসেবে মৌসুমি ফল, দুধ, পুডিং প্রভৃতি শিশুকে দেওয়া যেতে পারে। শিশুর খাবার এমনভাবে পরিবেশন করতে হবে, যাতে সে সহজে খেতে পারে। মাংস ছোট ছোট টুকরো করে দিতে হবে, ফল কেটে ছোট টুকরো করে দিতে হবে। শিশুর খাবার, থালা, বাটি, চামচ পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন ও তার উপযোগী হলে শিশু খেতে আগ্রহবোধ করে। খাবার থালা, বাটি, রঙিন গ্লাস হলে শিশু খেতে আকৃষ্টবোধ করে। পরিবারে একাধিক শিশু থাকলে তাদের একসঙ্গে খেতে দিলে শিশু অন্যদের সঙ্গে খেতে উৎসাহী হয় এবং নিজে খেতে শিখে। বাইরের কোনো খাবার বাচ্চাকে খাওয়ানো ঠিক নয়। বাচ্চারা বেশি খাবার গ্রহণ করতে পারে না, তাই তাদের খাবার পরিমাণে অল্প কিন্তু উচ্চ ক্যালোরি সম্পন্ন হওয়া উচিত। বাচ্চাদের কম্পিউটার, মোবাইল থেকে দূরে রাখতে হবে। শিশুদের এমন খেলনা খেলতে দিতে হবে, যা খেললে শারীরিকভাবে তার শক্তি খরচ হবে এবং ক্ষুধা বৃদ্ধি পায়।
শিশুদের খাবার বাসি, ঠাণ্ডা বা বেশি গরম যেন না হয়, সেদিকেও খেয়াল রাখতে হবে। শিশুকে খাবার সুন্দরভাবে পরিবেশন করতে হবে। শিশুর খাওয়ার সময় তাকে গল্প বলে, ছড়া বলে খাওয়াতে আকৃষ্ট করতে হবে। অনেক সময় বেশি খাবার দেখলে বাচ্চারা বিরক্ত হয়, তাই তাকে অল্প অল্প করে খাবার দেওয়া উচিত। শিশু যদি পরিবারের কাউকে খেতে দেখলে খেতে চায়, তবে শিশুকে পরিবারের সবাই যখন খায়, সে সময় শিশুকে সঙ্গে নিয়ে খাবার খাওয়া উচিত। এতে করে অন্যদের দেখে সে খেতে শিখবে এবং তার খাদ্যাভ্যাস তৈরি হবে।
শিশুকে কখনও জোর করে কিংবা মারধর করে খাওয়ানো যাবে না। উৎসাহ দিয়ে, প্রশংসা করে শিশুকে খাওয়াতে হবে। শিশুকে তার বয়স অনুযায়ী খাবার খেতে দেওয়া উচিত। শিশুকে সব ধরনের খাবার খেতে উৎসাহ দেওয়া প্রয়োজন। অনেক সময় শিশুরা খাবার খেতে খেতে জামাকাপড় নোংরা করে ফেলে। এমন করলে তাকে শাসন বা বকাঝকা না করে তার নিজের মতো করে খেতে দেওয়া উচিত।
শিশুদের খাবারের মেন্যু প্রতিদিন একই রকম করা ঠিক নয়, কারণ শিশুরা সবসময় একরকম খাবার খেতে বিরক্তবোধ করে। তারা খাবারে নতুনত্ব চায়। তাই মাঝে মাঝে খাবারে পরিবর্তন আনা প্রয়োজন। পিপাসার্ত শিশু কখনও খাবার খেতে চায় না। তাই প্রথমে তাকে পানি খেতে দিতে হবে এবং তার কিছুক্ষণ পর খাবার খেতে দিতে হবে। এতে করে তার খিদে আর হজমশক্তি দুই-ই বাড়বে।
শিশু খেতে চাইছে না অজুহাতে তাকে ঘণ্টায় ঘণ্টায় খাওয়ানো ঠিক নয়। শিশুকে খাওয়ার ব্যাপারে তাড়াহুড়া করা ঠিক নয়। হাতে সময় নিয়ে শিশুকে খাওয়ানো প্রয়োজন। ক্ষুধা পাওয়ার সময় দিতে হবে। খাবার নিয়ে শিশুর পেছনে দৌড়ানো বন্ধ করতে হবে। শিশুকে খাবার খাওয়ার সময় আনন্দ দিতে চেষ্টা করা উচিত।
শিশু খায় না বলে তা নিয়ে শিশুর সামনে সমালোচনা করা যাবে না এবং বিরক্তভাব প্রকাশ করা যাবে না। ক্ষুধা পেলে সে নিজেই খাবে এবং খাবার চাইবে। মনে রাখতে হবে শিশু ছোট হলেও তার নিজস্ব পছন্দ-অপছন্দ থাকতে পারে খাবারের ব্যাপারে। খাবার সুস্বাদু না হলে আমাদের যেমন খাবার প্রতি আগ্রহ কমে যায়, বাচ্চাদেরও একই রকম হতে পারে। তাই শিশুর পুষ্টিকর খাবার যেন সুস্বাদু হয় তা খেয়াল রাখতে হবে। একটু সময় নিয়ে খাবার খাওয়ালেই শিশু সুস্থ ও সুন্দরভাবে বেড়ে উঠবে। এ ক্ষেত্রে প্রয়োজন শুধু মায়েদের ধৈর্য ও সচেতনতা।পিআইডি প্রবন্ধ স্মরণ
মাওলানা জালাল উদ্দিন মুহাম্মদ রুমি কাজী সালমা সুলতানা

তেরো শতকের মুসলিম কবি, আইনজ্ঞ, ইসলামি ব্যক্তিত্ব, ধর্মতাত্ত্বিক ব্যক্তিত্ব জালাল উদ্দিন মুহাম্মদ রুমি এবং সুফি রুমির প্রভাব দেশের সীমানা ও জাতিগত পরিমল ছাড়িয়ে বিশ্বদরবারে ছড়িয়ে পড়েছে ফার্সি, তাজাকিস্তানি, তুর্কি, গ্রিক, পশতু, মধ্য এশিয়া এবং দক্ষিণ এশিয়ার মুসলমানরা যুগ যুগ ধরে তার আধ্যাত্মিক উত্তরাধিকারকে যথাযথভাবে সমাদৃত করেছে।
রুমির কবিতা সারা বিশ্বে বিভিন্ন ভাষায় অনূদিত হয়েছে এবং বিভিন্ন শ্রেণিতে রূপান্তরিত করা হয়েছে। তার সাহিত্যকর্ম বেশিরভাগই ফার্সি ভাষায় রচিত হলেও তিনি অনেক স্তবক তুর্কি, আরবি এবং গ্রিক ভাষায় রচনা করেছেন। তার লেখা মসনবীকে ফার্সি ভাষায় লেখা শ্রেষ্ঠ কাব্যগ্রন্থ হিসেবে তুলনা করা হয়। তার রচিত কবিতা ফার্সি সাহিত্য ছাড়াও তুর্কি সাহিত্য, উসমানীয় তুর্কি সাহিত্য, আজারবাইজান সাহিত্য, পাঞ্জাবের কবিতা, হিন্দি সাহিত্য, উর্দু সাহিত্যকেও অনেক প্রভাবিত করেছে।
মাওলানা বা কবি জালাল উদ্দিন রুমির ১২০৭ খ্রিষ্টাব্দের ৩০ সেপ্টেম্বর, আনাতোলিয়া উপদ্বীপের বালখ (বর্তমান আফগানিস্তান) শহরে জগ্রহণ করেন। তার পিতা সেই সময়ের বিখ্যাত ওলামা এবং আইনজ্ঞ হওয়ার কারণে ছোটবেলা থেকেই রুমির সুযোগ ঘটে ইসলামি শাস্ত্রের বিভিন্ন বিষয়ে গভীরভাবে জ্ঞান অর্জন করার। রুমির বয়স যখন ১১ বছর, বালখ শহরের রাজার সঙ্গে এক বিবাদের জের ধরে বাহাউদ্দিন ওয়ালাদ তার পরিবার আর কয়েকশ অনুসারী নিয়ে মধ্যপ্রাচ্যের বিভিন্ন দেশে হিজরতের জন্য বের হয়ে যান। আর এই হিজরত চলাকালেই রুমির সঙ্গে সাক্ষাৎ ঘটতে থাকে সে সময়ের বিখ্যাত সব মনীষীদের। তার ১৮ বছর বয়সে মক্কা যাওয়ার পথে নিশাপুরে তাদের সঙ্গে দেখা হয় পারস্যের বিখ্যাত আধ্যাত্মিক কবি আত্তারের। তার সঙ্গে কবি আত্তারের সখ্য গড়ে ওঠে। ২৫ বছর বয়সে রুমি কোনিয়ার মসজিদের মৌলবি সাহেব বা মাওলানা সাহেব হিসেবে পরিচিত হয়ে ওঠেন এবং একসময় তিনি কোনিয়ার মসজিদের প্রধান বিচারক হয়ে ওঠেন।
তিনি সব স্তরের মানুষের সঙ্গে অবলীলায় মিশতেন। শ্রেণিবৈষম্য তার মধ্যে ঠাঁই পায়নি। রুমির কবিতার সতেজ ভাষা এবং ছন্দ সহজেই মানুষের মনে জায়গা করে নিত। তার প্রতিটি শব্দ শুনে মনে হতো এগুলো সাধারণ ভাষা নয়, মানুষের হদয়ের প্রতিটি স্পন্দনের অনুবাদ, প্রতিটি মানুষের হদয়ের ভাষা। তিনি বিশ্বাস করতেন, সৃষ্টিকর্তার খোঁজ কোনো মসজিদ বা গির্জায় পাওয়া সম্ভব নয়, সৃষ্টিকর্তার খোঁজ করতে হয় নিজের হদয়ে। তাই তিনি বলেছিলেন, ‘আমি সৃষ্টিকর্তাকে খুঁজছিলাম। তাই আমি মন্দিরে গেলাম, সেখানে তাকে খুঁজে পেলাম না। আমি গির্জায় গেলাম, সেখানেও তাকে পেলাম না। এরপর আমি মসজিদে গেলাম সেখানেও তাকে পেলাম না। এরপর আমি নিজের হ দয়ে তাকে খুঁজলাম, সেখানে তাকে খুঁজে পেলাম।’ রুমি প্রায়ই তার অনুসারীদের নিয়ে প্রাকৃতিক সৌন্দর্য উপভোগ করতে যেতেন। তিনি বিশ্বাস করতেন যে, প্রকৃতির মাঝে ঈশ্বর অদৃশ্য জগতের বার্তা ছড়িয়ে দেন। তিনি বলেছিলেন, ‘প্রত্যেক বৃক্ষপত্র অদৃশ্য জগতের বার্তা বহন করে। চেয়ে দেখো, প্রতিটি ঝরা পাতায় কল্যাণ রয়েছে।’”
তার কবিতা বা লেখাগুলো আসলে বিভিন্ন রহস্যময় ও বিচিত্র অভিজ্ঞতায় মানুষের অভিব্যক্তিরই প্রতিফলন, যেখানে মানুষ তার প্রাত্যহিক জীবনের বিভিন্ন অনুভূতিকে খুঁজে পায়। তাই তো জালাল উদ্দিন মুহাম্মদ রুমিকে কোনো নির্দিষ্ট জাতি বা গোষ্ঠী দিয়ে বেঁধে ফেলা সম্ভব নয়। মাওলানা জালাল উদ্দিন মুহাম্মদ রুমি ১২৭৩ সালের ১৭ ডিসেম্বর মৃত্যুবরণ করেন। তাকে তার পিতার কাছে সমাহিত করা হয়। তার সমাধিফলকে লেখা
যখন আমি মৃত, পৃথিবীতে আমার সমাধি না খুঁজে, আমাকে মানুষের হদয়ে খুঁজে নাও।

Tag :

Write Your Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Save Your Email and Others Information

About Author Information

Haor Barta24

শিশুর খাওয়া-দাওয়া ও মায়ের ভাবনা

আপডেট টাইম : ০৩:০১:০৩ অপরাহ্ন, সোমবার, ৩০ সেপ্টেম্বর ২০১৯

হাওর বার্তা ডেস্কঃ আঠারো মাসের সিদরাত। খাওয়ার প্রতি খুবই অনীহা। মা লাভলী আক্তার সারাক্ষণ সন্তানকে খাওয়াতে না পারার টেনশনে ভোগেন। বিভিন্ন কৌশলে কিছু খাওয়াতে পারলেও তা যথেষ্ট মনে করেন না সিদরাতের মা। তাই বাজারের বিভিন্ন মজাদার খাবার খাওয়াতে চেষ্টা করেন। সিদরাতের বাবা জিএম এরশাদ সন্তানের পছন্দমতো খাবার আনতে ভুল করেন না।
ইদানীং প্রায় সব মাকেই বলতে শোনা যায়, আমার শিশু খেতে চায় না। খেলছে, পড়ছে, দুষ্টুমি করছে কিন্তু খেতে চাইছে না। খাবার গ্রহণে শিশুর এই অনীহা কেন? কেন শিশু খেতে চায় না? অনেক মা অনুযোগের সুরে বলেন, আমার বাচ্চা খাবার মুখে নিয়ে বসে থাকে গিলে না, আবার কেউ বা বলেন, আমার বাচ্চা শুধু চকোলেট, মিষ্টি জাতীয় খাবার, চিপস ও কোক খেতে চায়। কেউ বলেন, আমার বাচ্চা ফাস্টফুড পাগল, বিজ্ঞাপন, কার্টুন বা গান না দেখালে বাচ্চা খায় না।
অনেক মা বাচ্চাদের কার্টুন, কোক, চিপস, চকোলেট, ফাস্টফুড দেখিয়ে খাওয়ার অভ্যাস করেন। আসলে অনেক মায়েরা তাদের বাচ্চাদের খাবার নিয়ে একটু বেশি চিন্তিত থাকেন বলে খাবারের ক্ষেত্রে কোনো রুটিন মেনে চলেন না। আর এই অনিয়মিত খাদ্যাভ্যাসের দরুন ধীরে ধীরে খাবারের প্রতি শিশুর অনীহা তৈরি হয়। আমাদের মনে রাখা প্রয়োজন, শিশুর শরীর ছোট, তার চাহিদা কম ও তার হজম শক্তিও কম। অতএব শিশুর চাহিদা অনুযায়ী তাকে খেতে দিতে হবে। তার ক্ষিদে লাগলে সে নিজেই চেয়ে খাবে।
শিশু বিশেষজ্ঞ ডাক্তারদের মতে, খাওয়ার ব্যাপারে শিশুকে চাপ প্রয়োগ ঠিক নয়। ক্ষুধা লাগলে শিশু খাবে এটাই স্বাভাবিক, আর খাবার হজম হলেই শিশুর খিদে লাগবে। যদি খাওয়ার সুনির্দিষ্ট সময় ছাড়া অন্য সময়ে শিশুকে কিছু খাওয়ানো হয়, তবে তা ঠিকমতো হজম হবে না। হজম না হলে খিদে পাবে না। খিদে না পেলে শিশু খেতে চাইবে না। শিশুর খেতে না চাওয়া নিয়ে মায়েদের দুশ্চিন্তার কিছু নেই। আসলে শিশুর এই খেতে না চাওয়াটা খুব সাধারণ একটি সমস্যা।
প্রতিটা শিশুই আলাদা, আর তাদের খাবারের চাহিদাও ভিন্ন। এমনকি এ কথাও বলা হয়ে থাকে, দিনভেদে একই শিশুর খাবারের প্রতি চাহিদা বা আগ্রহের রকমফের ঘটে। মাঝেমধ্যে শিশু কোনো রকম ঝামেলা ছাড়াই তার জন্য বরাদ্দ খাবার খেয়ে ফেলে। আবার অন্যদিন হয়তো একদমই খেতে চায় না। এতে মা-বাবা চিন্তিত হয়ে পড়েন। ধারণা করে থাকেন যে, এটা বুঝি শিশুর বৃদ্ধি ও বিকাশকে বাধাগ্রস্ত করছে। আসলে ব্যাপারটি তা নয়। বাচ্চা যদি স্বাভাবিক চলাফেরা ও খেলাধুলায় ক্লান্ত না হয়ে পড়ে, তবে চিন্তার কোনো কারণ নেই। সাধারণত যেসব কারণে শিশু খেতে চায় না তার মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো জোরপূর্বক খাওয়ানো। জোর করে খাওয়ানোর ফলে শিশুর মধ্যে প্রচণ্ডভাবে খাদ্য অনীহা দেখা দেয়। অনেক সময় শক্ত খাবার, অপছন্দের খাবার এবং একই খাবারের পুনরাবৃত্তি করে খাওয়ালে খাবারের প্রতি শিশুর অনীহা তৈরি হয় এবং সে খাবার দেখলে শিশু ভয় পায় বা বমি করে ফেলে। ছোট শিশুদের ঘ্রাণেন্দ্রিয় বেশ স্পর্শকাতর। খাবারের গন্ধ এবং রঙ যদি ভালো না হয় বাচ্চারা সে খাবার খেতে চায় না, মুখ থেকে ফেলে দেয়। অনেক সময় শরীরের জিনঘটিত কারণে কিছু কিছু খাবারের গন্ধ বা স্বাদ বাচ্চারা সহ্য করতে পারে না। এর ফলে তারা সব ধরনের খাবার খেতে চায় না, বেছে বেছে খায়। হজম প্রক্রিয়ায় সমস্যা থাকায় অনেক বাচ্চার খিদে কম পায় এবং খাবার ইচ্ছা থাকে না। এ কারণেও অনেক বাচ্চা খাবার নিয়ে বায়না করতে পারে।
শিশুর খাবার না খেতে চাওয়ার পেছনে অনেক সময় সাইকোলজিক্যাল ব্যাপার কাজ করে। যেসব বাচ্চার মা অতিরিক্ত আদর বা শাসন করে, সে বাচ্চাদের মধ্যে খাবার নিয়ে ঝামেলা করার প্রবণতা বেশি দেখা যায়। অনেক মা শিশুকে নিয়মমাফিক খাওয়ানোর মাঝে কান্নামাত্রই মায়ের দুধ খাওয়ান বা অন্যের খাবার খাওয়ান। এই অনিয়মিত খাবারের দরুন শিশুর খাবারের রুচি ও খিদে নষ্ট হয়ে যায়। ফলে সে খাবার খেতে অনীহা প্রকাশ করে। কোনো কোনো বাড়িতে শিশু নিজের খাবার সময় ছাড়া অন্য সময়ও পরিবারের অন্যান্য সদস্য বা আত্মীয়স্বজন সবার সঙ্গে খায়। আবার অনেক মা তার শিশু ৭টার সময় পেটভরে খায়নি বলে ৮টার সময় তাকে আরেকবার খাবার দেন, ৯টার সময় আবার চেষ্টা করেন এবং এমনিভাবে সারাদিন ধরেই প্রচেষ্টা চলতে থাকে। এসব অভ্যাসই শিশুর খাবারের প্রতি অনীহা তৈরি করে।
শিশু বিশেষজ্ঞদের মতে, শিশুর মূল খাদ্যাভ্যাস তৈরি করতে হবে ছয় মাস বয়স থেকে, যখন সে মায়ের বুকের দুধের পাশাপাশি পরিপূরক খাবার খেতে শুরু করে। শিশুকে দৈনিক চার-পাঁচবার অল্প অল্প করে পরিপূরক খাবার খেতে দিতে হবে। শিশুর পরিপূরক খাবার অবশ্যই সুষম হতে হবে। এজন্য সবজি, ডাল, মাছ বা মাংস এবং খিচুড়ি রান্না করে দিলে ভালো হয়। তবে শিশুকে দুই বছর পর্যন্ত অন্য খাবারের পাশাপাশি বুকের দুধ খাওয়াতে হবে। শিশু যখন থেকে বাড়তি খাবার খেতে শিখে তখন থেকেই শিশুকে সব ধরনের খাবার খাওয়ার অভ্যাস করাতে হবে।
একটি শিশুর সঠিকভাবে বেড়ে ওঠার জন্য পুষ্টি সমৃদ্ধ খাবার খুবই গুরুত্বপূর্ণ। তাই তাকে ছোটবেলাতেই এসব মাছ, মাংস, ডিম, দুধ ও শাকসবজি খাবার দিতে হবে। এক বছর বয়স থেকে শিশুর খাবারের পরিমাণ ও সময় নির্দিষ্ট করতে হবে। কিছুদিন একই সময়ে খাওয়ালে শিশু এতে অভ্যস্ত হয়ে যাবে। দুই বছর পর্যন্ত শিশুর মস্তিষ্কের বৃদ্ধি ঘটে, তাই এ সময় শিশুকে পর্যাপ্ত প্রোটিনজাতীয় খাবার দেওয়া প্রয়োজন। দুই বছর বয়স থেকে শিশুকে নিজ হাতে খাওয়ানোর অভ্যাস করতে হবে। প্রথম প্রথম নষ্ট করলেও একসময় সে নিজেই খাওয়া শিখে যায়। এ সময় থেকেই তিন বেলা মূল খাবারের পাশাপাশি সকাল, দুপুর ও বিকালে নাশতা হিসেবে মৌসুমি ফল, দুধ, পুডিং প্রভৃতি শিশুকে দেওয়া যেতে পারে। শিশুর খাবার এমনভাবে পরিবেশন করতে হবে, যাতে সে সহজে খেতে পারে। মাংস ছোট ছোট টুকরো করে দিতে হবে, ফল কেটে ছোট টুকরো করে দিতে হবে। শিশুর খাবার, থালা, বাটি, চামচ পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন ও তার উপযোগী হলে শিশু খেতে আগ্রহবোধ করে। খাবার থালা, বাটি, রঙিন গ্লাস হলে শিশু খেতে আকৃষ্টবোধ করে। পরিবারে একাধিক শিশু থাকলে তাদের একসঙ্গে খেতে দিলে শিশু অন্যদের সঙ্গে খেতে উৎসাহী হয় এবং নিজে খেতে শিখে। বাইরের কোনো খাবার বাচ্চাকে খাওয়ানো ঠিক নয়। বাচ্চারা বেশি খাবার গ্রহণ করতে পারে না, তাই তাদের খাবার পরিমাণে অল্প কিন্তু উচ্চ ক্যালোরি সম্পন্ন হওয়া উচিত। বাচ্চাদের কম্পিউটার, মোবাইল থেকে দূরে রাখতে হবে। শিশুদের এমন খেলনা খেলতে দিতে হবে, যা খেললে শারীরিকভাবে তার শক্তি খরচ হবে এবং ক্ষুধা বৃদ্ধি পায়।
শিশুদের খাবার বাসি, ঠাণ্ডা বা বেশি গরম যেন না হয়, সেদিকেও খেয়াল রাখতে হবে। শিশুকে খাবার সুন্দরভাবে পরিবেশন করতে হবে। শিশুর খাওয়ার সময় তাকে গল্প বলে, ছড়া বলে খাওয়াতে আকৃষ্ট করতে হবে। অনেক সময় বেশি খাবার দেখলে বাচ্চারা বিরক্ত হয়, তাই তাকে অল্প অল্প করে খাবার দেওয়া উচিত। শিশু যদি পরিবারের কাউকে খেতে দেখলে খেতে চায়, তবে শিশুকে পরিবারের সবাই যখন খায়, সে সময় শিশুকে সঙ্গে নিয়ে খাবার খাওয়া উচিত। এতে করে অন্যদের দেখে সে খেতে শিখবে এবং তার খাদ্যাভ্যাস তৈরি হবে।
শিশুকে কখনও জোর করে কিংবা মারধর করে খাওয়ানো যাবে না। উৎসাহ দিয়ে, প্রশংসা করে শিশুকে খাওয়াতে হবে। শিশুকে তার বয়স অনুযায়ী খাবার খেতে দেওয়া উচিত। শিশুকে সব ধরনের খাবার খেতে উৎসাহ দেওয়া প্রয়োজন। অনেক সময় শিশুরা খাবার খেতে খেতে জামাকাপড় নোংরা করে ফেলে। এমন করলে তাকে শাসন বা বকাঝকা না করে তার নিজের মতো করে খেতে দেওয়া উচিত।
শিশুদের খাবারের মেন্যু প্রতিদিন একই রকম করা ঠিক নয়, কারণ শিশুরা সবসময় একরকম খাবার খেতে বিরক্তবোধ করে। তারা খাবারে নতুনত্ব চায়। তাই মাঝে মাঝে খাবারে পরিবর্তন আনা প্রয়োজন। পিপাসার্ত শিশু কখনও খাবার খেতে চায় না। তাই প্রথমে তাকে পানি খেতে দিতে হবে এবং তার কিছুক্ষণ পর খাবার খেতে দিতে হবে। এতে করে তার খিদে আর হজমশক্তি দুই-ই বাড়বে।
শিশু খেতে চাইছে না অজুহাতে তাকে ঘণ্টায় ঘণ্টায় খাওয়ানো ঠিক নয়। শিশুকে খাওয়ার ব্যাপারে তাড়াহুড়া করা ঠিক নয়। হাতে সময় নিয়ে শিশুকে খাওয়ানো প্রয়োজন। ক্ষুধা পাওয়ার সময় দিতে হবে। খাবার নিয়ে শিশুর পেছনে দৌড়ানো বন্ধ করতে হবে। শিশুকে খাবার খাওয়ার সময় আনন্দ দিতে চেষ্টা করা উচিত।
শিশু খায় না বলে তা নিয়ে শিশুর সামনে সমালোচনা করা যাবে না এবং বিরক্তভাব প্রকাশ করা যাবে না। ক্ষুধা পেলে সে নিজেই খাবে এবং খাবার চাইবে। মনে রাখতে হবে শিশু ছোট হলেও তার নিজস্ব পছন্দ-অপছন্দ থাকতে পারে খাবারের ব্যাপারে। খাবার সুস্বাদু না হলে আমাদের যেমন খাবার প্রতি আগ্রহ কমে যায়, বাচ্চাদেরও একই রকম হতে পারে। তাই শিশুর পুষ্টিকর খাবার যেন সুস্বাদু হয় তা খেয়াল রাখতে হবে। একটু সময় নিয়ে খাবার খাওয়ালেই শিশু সুস্থ ও সুন্দরভাবে বেড়ে উঠবে। এ ক্ষেত্রে প্রয়োজন শুধু মায়েদের ধৈর্য ও সচেতনতা।পিআইডি প্রবন্ধ স্মরণ
মাওলানা জালাল উদ্দিন মুহাম্মদ রুমি কাজী সালমা সুলতানা

তেরো শতকের মুসলিম কবি, আইনজ্ঞ, ইসলামি ব্যক্তিত্ব, ধর্মতাত্ত্বিক ব্যক্তিত্ব জালাল উদ্দিন মুহাম্মদ রুমি এবং সুফি রুমির প্রভাব দেশের সীমানা ও জাতিগত পরিমল ছাড়িয়ে বিশ্বদরবারে ছড়িয়ে পড়েছে ফার্সি, তাজাকিস্তানি, তুর্কি, গ্রিক, পশতু, মধ্য এশিয়া এবং দক্ষিণ এশিয়ার মুসলমানরা যুগ যুগ ধরে তার আধ্যাত্মিক উত্তরাধিকারকে যথাযথভাবে সমাদৃত করেছে।
রুমির কবিতা সারা বিশ্বে বিভিন্ন ভাষায় অনূদিত হয়েছে এবং বিভিন্ন শ্রেণিতে রূপান্তরিত করা হয়েছে। তার সাহিত্যকর্ম বেশিরভাগই ফার্সি ভাষায় রচিত হলেও তিনি অনেক স্তবক তুর্কি, আরবি এবং গ্রিক ভাষায় রচনা করেছেন। তার লেখা মসনবীকে ফার্সি ভাষায় লেখা শ্রেষ্ঠ কাব্যগ্রন্থ হিসেবে তুলনা করা হয়। তার রচিত কবিতা ফার্সি সাহিত্য ছাড়াও তুর্কি সাহিত্য, উসমানীয় তুর্কি সাহিত্য, আজারবাইজান সাহিত্য, পাঞ্জাবের কবিতা, হিন্দি সাহিত্য, উর্দু সাহিত্যকেও অনেক প্রভাবিত করেছে।
মাওলানা বা কবি জালাল উদ্দিন রুমির ১২০৭ খ্রিষ্টাব্দের ৩০ সেপ্টেম্বর, আনাতোলিয়া উপদ্বীপের বালখ (বর্তমান আফগানিস্তান) শহরে জগ্রহণ করেন। তার পিতা সেই সময়ের বিখ্যাত ওলামা এবং আইনজ্ঞ হওয়ার কারণে ছোটবেলা থেকেই রুমির সুযোগ ঘটে ইসলামি শাস্ত্রের বিভিন্ন বিষয়ে গভীরভাবে জ্ঞান অর্জন করার। রুমির বয়স যখন ১১ বছর, বালখ শহরের রাজার সঙ্গে এক বিবাদের জের ধরে বাহাউদ্দিন ওয়ালাদ তার পরিবার আর কয়েকশ অনুসারী নিয়ে মধ্যপ্রাচ্যের বিভিন্ন দেশে হিজরতের জন্য বের হয়ে যান। আর এই হিজরত চলাকালেই রুমির সঙ্গে সাক্ষাৎ ঘটতে থাকে সে সময়ের বিখ্যাত সব মনীষীদের। তার ১৮ বছর বয়সে মক্কা যাওয়ার পথে নিশাপুরে তাদের সঙ্গে দেখা হয় পারস্যের বিখ্যাত আধ্যাত্মিক কবি আত্তারের। তার সঙ্গে কবি আত্তারের সখ্য গড়ে ওঠে। ২৫ বছর বয়সে রুমি কোনিয়ার মসজিদের মৌলবি সাহেব বা মাওলানা সাহেব হিসেবে পরিচিত হয়ে ওঠেন এবং একসময় তিনি কোনিয়ার মসজিদের প্রধান বিচারক হয়ে ওঠেন।
তিনি সব স্তরের মানুষের সঙ্গে অবলীলায় মিশতেন। শ্রেণিবৈষম্য তার মধ্যে ঠাঁই পায়নি। রুমির কবিতার সতেজ ভাষা এবং ছন্দ সহজেই মানুষের মনে জায়গা করে নিত। তার প্রতিটি শব্দ শুনে মনে হতো এগুলো সাধারণ ভাষা নয়, মানুষের হদয়ের প্রতিটি স্পন্দনের অনুবাদ, প্রতিটি মানুষের হদয়ের ভাষা। তিনি বিশ্বাস করতেন, সৃষ্টিকর্তার খোঁজ কোনো মসজিদ বা গির্জায় পাওয়া সম্ভব নয়, সৃষ্টিকর্তার খোঁজ করতে হয় নিজের হদয়ে। তাই তিনি বলেছিলেন, ‘আমি সৃষ্টিকর্তাকে খুঁজছিলাম। তাই আমি মন্দিরে গেলাম, সেখানে তাকে খুঁজে পেলাম না। আমি গির্জায় গেলাম, সেখানেও তাকে পেলাম না। এরপর আমি মসজিদে গেলাম সেখানেও তাকে পেলাম না। এরপর আমি নিজের হ দয়ে তাকে খুঁজলাম, সেখানে তাকে খুঁজে পেলাম।’ রুমি প্রায়ই তার অনুসারীদের নিয়ে প্রাকৃতিক সৌন্দর্য উপভোগ করতে যেতেন। তিনি বিশ্বাস করতেন যে, প্রকৃতির মাঝে ঈশ্বর অদৃশ্য জগতের বার্তা ছড়িয়ে দেন। তিনি বলেছিলেন, ‘প্রত্যেক বৃক্ষপত্র অদৃশ্য জগতের বার্তা বহন করে। চেয়ে দেখো, প্রতিটি ঝরা পাতায় কল্যাণ রয়েছে।’”
তার কবিতা বা লেখাগুলো আসলে বিভিন্ন রহস্যময় ও বিচিত্র অভিজ্ঞতায় মানুষের অভিব্যক্তিরই প্রতিফলন, যেখানে মানুষ তার প্রাত্যহিক জীবনের বিভিন্ন অনুভূতিকে খুঁজে পায়। তাই তো জালাল উদ্দিন মুহাম্মদ রুমিকে কোনো নির্দিষ্ট জাতি বা গোষ্ঠী দিয়ে বেঁধে ফেলা সম্ভব নয়। মাওলানা জালাল উদ্দিন মুহাম্মদ রুমি ১২৭৩ সালের ১৭ ডিসেম্বর মৃত্যুবরণ করেন। তাকে তার পিতার কাছে সমাহিত করা হয়। তার সমাধিফলকে লেখা
যখন আমি মৃত, পৃথিবীতে আমার সমাধি না খুঁজে, আমাকে মানুষের হদয়ে খুঁজে নাও।