পাখি কমছে কেন? কীভাবে পাখিদের আবাসস্থল বাড়ানো যায়? কী করলে পাখির সংখ্যা বাড়তে পারে? এসব বিষয়ে এবার ডয়চে ভেলের সঙ্গে কথা বলেছেন পাখি বিশেষজ্ঞ ইনাম আল-হক। দেশি-বিদেশি নয়, যে পাখি এক দিন এদেশে দেখা যায় সেটাও এদেশের পাখি। কিছু পাখি এ দেশে সারা বছর থাকে কিছু থাকে না। পাখি এ রকমই হয়। পাখির খাবার সারা বছর এক মহাদেশেও হয় না। কিছু পাখি আছে গ্রীষ্মে বা শীতে খাবারের জন্য একেক জায়গায় থাকে। আবার প্রজননের জন্য আলাদা জায়গায় থাকে। তাহলে কোন পাখি কোন দেশের?
সারা বিশ্ব যেটি মেনে নেয় সেটি হলো পাখিরা এক দিনের জন্য যে দেশকে নিয়মিত ব্যবহার করে পাখিরা সেই দেশের। এক পাখি বহু দেশের হতে পারে। যেমন ধরেন সুমচাও নামের পাখি গ্রীষ্মে বাংলাদেশে জন্মায়, শীতে তাদের কিন্তু খাবার নেই তাই তারা দক্ষিণে যেমন-মালয়েশিয়া, ইন্দোনেশিয়ায় চলে যায়। আবার তারা গ্রীষ্মে এই দেশে ফিরে আসে। এই পাখি তাহলে কোন দেশের? এটা বাংলাদেশেরও মালয়েশিয়ারও।
আবার অনেক পাখি আছে যারা শীতে বাংলাদেশে আসে। এরপর প্রজননের জন্য হিমালয়ে চলে যায়, তিব্বতে চলে যায় বা তুন্দ্রা অঞ্চলে চলে যায়। তারা কি তাহলে বাংলাদেশের পাখি নয়? অবশ্যই বাংলাদেশের পাখি। ওরা সাইবেরিয়ারও পাখি। এই হিসেবে আমাদের যে ৭০০ প্রজাতির পাখি আছে এর মধ্যে ৩৫০ প্রজাতির পাখি সারা বছর বাংলাদেশে থাকে না। শীতের মৌসুমে তো অনেক পাখি বাংলাদেশে আসে। এই ধরনের কত প্রজাতি আছে যারা একটা নির্দিষ্ট মৌসুমে বাংলাদেশে আসে?
প্রায় ৩৫০ প্রজাতির পাখি শীতে বাংলাদেশে থাকে কিন্তু প্রজনন করে না। প্রজননের স্থান হলো উত্তর গোলার্ধের গ্রীষ্মম-ল। তখন তারা উত্তরে চলে যায়। হিমালয়, তিব্বত, মঙ্গোলিয়া বা আরো উত্তরে সাইবেরিয়ায় চলে যায়। আর ১০ থেকে ১২ প্রজাতির পাখি আছে, যারা গ্রীষ্মেই শুধু বাংলাদেশে থাকে, শীতে এখানে থাকে না, দক্ষিণে চলে যায়, যেখানে শীতেও কিছুটা আর্দ্রতা আছে।
বাংলাদেশে আসা পাখির সংখ্যা কমছে, নাকি বাড়ছে? কমে যাচ্ছে, কারণ সারা বিশ্বেই পাখির সংখ্যা কমছে। তবে এক বছরের চেয়ে আরেক বছর বেশি হতে পারে। আমরা এবার যে গণনা করেছি, তাতে দেখা যাচ্ছে গত বছরের চেয়ে এবার পাখির সংখ্যা বেশি হবে। কিন্তু আমরা যদি গত ৩০ বছরের হিসাব করি তাহলে ট্রেন্ডটা কমতির দিকেই।
কেন কমে যাচ্ছে? বাংলাদেশে কমে যাচ্ছে কারণ সারা বিশ্বেই কমে যাচ্ছে। গত ৩০ বছরের হিসাব অনুযায়ী বিশ্বেই পাখির সংখ্যা কমে যাচ্ছে। আর আমরা এশিয়া মহাদেশে হিসাব করে দেখেছি এ অঞ্চল অনেক বেশি উন্নত হচ্ছে। উন্নত বলতে আমরা বুঝছি, এখানে রাস্তাঘাট হচ্ছে, দালানকোঠা হচ্ছে। ফলে পাখির বসবাসের জায়গা কমে যাচ্ছে। আমাদের যেমন বসবাসের জায়গা লাগে তেমনি পাখিরও বসবাসের জায়গা লাগে। পাশাপাশি আমরা যে পরিবেশ দূষণ করছি তার কারণে অনেক পাখি মারা যাচ্ছে। মোট কথা, সবাই ধরে নেয় পাখি কমে যাচ্ছে তাদের জায়গা কমে যাচ্ছে। তাদের তো প্রজননের জায়গা লাগে থাকার জায়গা লাগে।
বাংলাদেশের কোন অঞ্চলে পাখি সবচেয়ে বেশি দেখা যায়? যেখানে মানুষের বসতি কম, সেখানেই পাখির বসবাস বেশি। যেমন ধরেন, উপকূলে মানুষের বসতি কম, কারণ সেখানে মানুষ বসবাস করতে পারে না। সেখানে পাখির বসতি বেশি। আবার সিলেটের বিস্তীর্ণ হাওর অঞ্চলে মানুষের পক্ষে বসবাস করা কঠিন সেখানেও পাখির বেশি বসবাস। অর্থাৎ যেখানে মানুষের বসবাস বা চলাফেরা কম সেখানেই পাখির বসবাস বেশি।
পাখির অভয়ারণ্যের জন্য সরকার কী ধরনের পদক্ষেপ নিতে পারে? বাংলাদেশের সরকার কিছু শক্তিশালী পদক্ষেপ নিয়েছে বলেই এখনো কিছু পাখি টিকে আছে। এ ব্যাপারে সরকারের প্রশংসা না করলেই নয়। কিছু এলাকায় সরকার মানুষের যাতায়াত নিয়ন্ত্রিত করেছে। হাওর অঞ্চলের কিছু এলাকা সংরক্ষিত করেছে। কিছু বন সরকার সংরক্ষিত করেছে। ফলে সেখানে কিছু পাখি বসবাস করতে পারছে। সুন্দরবনকে সরকার সংরক্ষিত করেছে।
আমি প্রতিবেশী দেশ থাইল্যান্ড ও মালয়েশিয়ায় গিয়ে দেখেছি তারা কীভাবে তাদের ম্যানগ্রোভ ফরেস্টকে নষ্ট করে সেখানে লবণ চাষ করছে। কিন্তু আমাদের সরকার সুন্দরবনকে রক্ষার জন্য নানা ধরনের উদ্যোগ নিয়েছে। আমরা কিন্তু আমাদের সুন্দরবনকে নষ্ট করিনি। কিছু কিছু যে নষ্ট হয়নি তা নয়। মানুষ সেখানে ঢুকছে। কিন্তু সরকারের তরফ থেকে আমরা দেখছি গত ৪০ বছরে সরকার এটিকে রক্ষা করারই চেষ্টা করছে। আপনি যদি পশ্চিমবঙ্গেও যান সেখানে দেখবেন সুন্দরবনের মধ্যেও মানুষের বসতি আছে। কিন্তু আমাদের দেশে এত মানুষের বাস তারপরও সুন্দরবনের মধ্যে সরকার কাউকে বসতি গড়তে দেয়নি।
উইকিপিডিয়ার তথ্য মতে, বাংলাদেশে পাখির প্রজাতির সংখ্যা ৬৫০টি। এর মধ্যে ৩০টি বাংলাদেশ থেকে বর্তমানে বিলুপ্ত। অবশিষ্ট ৬২০টি প্রজাতির মধ্যে ৪৭৭ প্রজাতির পাখি বাংলাদেশে নিয়মিত দেখা যায়, বাকি ১৪৩ প্রজাতি অনিয়মিত দেখা যায়। নিয়মিত ৪৭৭ প্রজাতির মধ্যে ৩০১টি বাংলাদেশের ‘আবাসিক’ এবং ১৭৬ প্রজাতি ‘পরিযায়ী’ পাখি।