পুষ্পিত এই বরষায়

হাওর বার্তা ডেস্কঃ আষাঢ়ের প্রথম দিন। কদমগাছে একটি ফুলও নেই। চারপাশে কদমের জন্য হাহাকার। রিপোর্টাররা ছুটে এলেন। এ কেমন কথা? তবে কী খেই হারিয়েছে প্রকৃতি! নাকি জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব! বললাম, কোনোটাই নিশ্চিত নয়। এই নগরে গ্রীষ্মের মাঝামাঝি সময়েও কদম ফুটতে দেখেছি। আমার প্রতিদিনের হাঁটাপথের ধারে বেশ কয়েকটি গাছে সোনার বলের মতো ফুলগুলো আলো করে ফুটেছিল। এ বছর আরো দু-একবার ফুটবে নিশ্চিত। এমনকি আষাঢ়ের শেষভাগেই কোথাও কোথাও কদম ফুটেছে। আবার কোনো কোনো গাছে শ্রাবণেও ফুটবে কদম। রবীন্দ্রনাথ কী বলেছেন দেখা যাক :

‘আষাঢ়ের আর্দ্রবায়ুভরে

কদম্ব কেশরে

চিহ্ন তার পড়ে ঢাকা। ’

অন্যত্র আছে :

‘কদম্বেরই কানন ঘেরি

আষাঢ় মেঘের ছায়া খেলে। ’

পঙিক্তদ্বয় থেকে স্পষ্ট যে কদম আষাঢ়ের ফুল। কারণ কবি ফুলটিকে আষাঢ়েই প্রত্যক্ষ করেছেন। তবে এর ব্যতিক্রমও আছে। আমি অন্তত ১৫ বছর ধরে নিবিড় পর্যবেক্ষণ করে দেখেছি, বর্ষা ছাড়া বছরের অন্য সময়েও কদম ফোটে। যে কদমকে আমরা এত দিন শুধু বর্ষার ফুল হিসেবে জেনেছি, সে কদম কি কোনো অজ্ঞাত কারণে তার প্রস্ফুটনকাল বদলে ফেলেছে? নাকি বিষয়টি এত দিন লোকচক্ষুর অন্তরালেই ছিল। এ নিয়ে অবশ্য কোনো উচ্চতর গবেষণা হয়নি। এই বিতর্ক এখন থাকুক। আমরা বরং কদমের রূপসুধা পান করার চেষ্টা করি। এদিকে আবার জীবনানন্দ দাশ বেদনার রঙে আঁকা কদমের কথা বলেছেন :

‘করবীর রাঙা রঙ কঙ্কণঝংকারসুরে মাখা,

কদম্বকেশরগুলি নিদ্রাহীন বেদনায় আঁকা। ’

সাদা পদ্ম

কদম বর্ষার প্রধান অনুষঙ্গ। কদমহীন বর্ষার কথা ভাবা যায় না। বর্ষণমুখর কোনো একটি মুহূর্তের কথা, এমন একটি দৃশ্য আমার সঙ্গে ঘুরে বেড়ায় সারাক্ষণ— আষাঢ়ের কোনো একদিন। কালো মেঘে ঢাকা পড়েছে আকাশ। কমে এসেছে দিনের আলো। বাইরে তুমুল বৃষ্টি। জলকণাগুলো চারপাশ ঝাপসা করে রেখেছে। হঠাত্ একপশলা বাতাস ঢুকল ঘরে। সেই বাতাস বয়ে আনল দারুণ সুবাস। কিন্তু সুবাসটা কোন ফুলের? ধারে-কাছে তো দোলনচাঁপাও নেই। মনে পড়ল পুকুরপাড়ের কদমগাছটির কথা। বৃষ্টিতে ভিজেই চলে গেলাম গাছটির কাছে। আমার ভাবনাই ঠিক। ফুলে ফুলে ভরে আছে গাছটি। পাপড়ির গা বেয়ে গড়িয়ে পড়ছে বৃষ্টির জল।

এমন অঝোর বর্ষণে প্রথমেই মনে পড়ে রবীন্দ্রনাথের সেই বিখ্যাত কবিতা—

বাদলের ধারা ঝরে ঝর-ঝর,

     আউশের ক্ষেত জলে ভর-ভর,

     কালি-মাখা মেঘে ওপারে আঁধার

           ঘনিয়েছে দেখ্ চাহি রে।

        ওগো, আজ তোরা যাস নে ঘরের বাহি রে।

বর্ষার এই গভীর চিত্ররূপ হুমায়ুন কবির অনূদিত ‘শোন্ মা আমিনা’ কবিতায়ও প্রত্যক্ষ করা যায়।

আষাঢ়ের প্রথম কোনো বৃষ্টির কথা মনে পড়ে? গ্রীষ্মের প্রচণ্ড দাবদাহে মাঠ-ঘাট যখন ফেটে চৌচির, তখন একপশলা বৃষ্টি দারুণ স্বস্তির। কয়েক দিনের টানা বৃষ্টিতে মাঠক্ষেত ও ডোবা-নালায় ঘোলা জল জমে। এই অল্প জলেই শুরু হয় ব্যাঙের উত্সব। বিচিত্র শব্দে ডেকে ডেকে তারা বর্ষাকে আহ্বান জানায়।

আষাঢ় পেরিয়ে শ্রাবণে বর্ষা আবার ভিন্ন রূপে আবির্ভূত হয়। তত দিনে চারপাশের জলাশয়গুলো টলটলে পানিতে ভরে ওঠে। শিশুরা দলবেঁধে শাপলা তুলতে নামে। কাটা হয় আউশ ধান আর পাট। কৃষক অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করেন ফসলের জন্য। একসময় দেশের জলা মাঠগুলোতে আউশ ধান হতো। পানির সঙ্গে পাল্লা দিয়ে বাড়ত এই ধান।

কাঠালচাঁপা

বর্ষার সবচেয়ে আকর্ষণীয় দিক তার মায়াবী পুষ্পজগত্। বৃষ্টির একটানা ঝিরিঝিরি ছন্দ আমাদের এলোমেলো ভাবনাগুলো প্রকৃতিমুখী করে। সেই অন্তরঙ্গ ভাবনাগুলো বৃষ্টিভেজা পেলব বাতাসের সঙ্গী হয়ে আমাদের উড়িয়ে নিয়ে যেতে চায় দূরে কোথাও। বর্ণিল প্রকৃতি তার চারপাশে কতটা বিচিত্র রঙের মেলা বসিয়েছে, সেটাই তখন আমাদের একমাত্র দেখার বিষয় হয়ে ওঠে। বর্ষার ভেজা বাতাসে ভেসে বেড়ায় বিচিত্র ফুলের সুবাস। আষাঢ়ের প্রথম ভাগেই কেয়া ফুল ফুটতে শুরু করে। বেশ কয়েক বছর রমনা পার্কের কাকরাইল মসজিদ লাগোয়া শিশু কর্নারের ভেতর একটি গাছে নিয়মিত কেয়া ফুটতে দেখেছি। আমাদের হাতের কাছে এই একটি কেয়াগাছই ছিল। কয়েক বছর আগে যত্নের অভাবে গাছটি মরে যায়। এই নগরী এখন প্রায় কেয়াশূন্য। কেয়া বা কেতকী বর্ষার উল্লেখযোগ্য ফুল। বাংলাদেশের দক্ষিণাঞ্চলে উপকূলবর্তী এলাকায় এই ফুল সহজেই চোখে পড়ে। সবচেয়ে বেশি দেখা যায় সেন্ট মার্টিনস দ্বীপে। সেখানে বেশ বড়সড় কেয়াবন আছে। ঢাকায় বলধা গার্ডেন এবং বোটানিক্যাল গার্ডেনেও দেখা যায়। অনন্য সৌরভের কারণে এই ফুলের স্নিগ্ধ সৌরভ ছড়িয়ে পড়েছে আমাদের গান, কবিতা, গল্প, উপন্যাস ও উপমায়। এ কারণেই কেয়া ফুলকে বর্ষার রানি বলা হয়। রবীন্দ্রনাথ লিখেছেন—

কেতকীকেশরে কেশপাশ করো সুরভী,

ক্ষীণ কটিতটে গাঁথি লয়ে পরো করবী।

একসময় আমাদের বনবাদাড়ে, পথের ধারে অসংখ্য কলাবতী ও লিলি ফুল ফুটত। এখন খুব বেশি দেখা যায় না। সবচেয়ে কম দেখা যায় স্পাইডার লিলি। গ্রামে ফুলটির নাম গো-রসুন বা বন-রসুন। কবিরাজরা জন্ডিস ও লিভারের সমস্যায় এর কন্দ (গাছের মূল, দেখতে পেঁয়াজের মতো) কাজে লাগান। মূলত কন্দ তুলে নেওয়ায় গাছটি ক্রমেই হারিয়ে যাচ্ছে। ফুলটি তীব্র সুগন্ধিযুক্ত। বৃষ্টিভেজা বাতাসে এর মধুগন্ধ ছড়িয়ে পড়ে অনেক দূর অবধি।

বর্ষার খাল-বিল, জলামাঠ, পুকুর-ডোবা—সব কিছুই সুন্দর। তাতে থাকে নানা ধরনের জলজ ফুল। এদের সৌন্দর্যও কম নয়। তবে সব সৌন্দর্যের কেন্দ্রবিন্দু আমাদের জাতীয় ফুল শাপলা। ভোরের স্নিগ্ধ আলোয় তার সৌন্দর্য অসাধারণ। শুধু তা-ই নয়, তখন শাপলা বিলের মিষ্টি সুবাসও ছড়িয়ে পড়ে। এই মৌসুমে জলজ ফুলের মধ্যে আরো ফোটে শালুক, রক্তকমল, পদ্ম, মাখনা ও চাঁদমালা ইত্যাদি।

মালতী

রবীন্দ্রনাথ বলেছেন—‘বাদল বাতাস মাতে মালতীর গন্ধে। ’ অর্থাত্ বাদল দিনে মালতী ফুলের গন্ধে ভরে ওঠে চারপাশ। আষাঢ় মাসে অঝোর বৃষ্টিধারার মধ্যেই মালতী ফুল ফোটে। সামান্য মোড়ানো পাঁচ পাপড়ির অপূর্ব সুগন্ধি এ ফুল সাদা রঙের। লতানো এই গাছ অসংখ্য পাতায় বেশ ঝোপালো দেখায়। রবীন্দ্রনাথ অন্যত্র লিখেছেন—‘ওই মালতী লতা দোলে’। বাস্তবে এই পঙিক্তর সঙ্গে এখন ‘না’ শব্দটি যুক্ত করতে হবে। কারণ মালতী এখন অনেকটাই দুর্লভ। তিনি মালতী নিয়ে অন্তত ১৭টি পঙিক্ত রচনা করেছেন। ঝুমকো লতা বর্ষার আরেক রূপসী ফুল। লতানো গাছের এই ফুল দেখতে মেয়েদের কানের ঝুমকোর মতো বলেই এমন নামকরণ। তিন কোনা আকৃতির পাতা দেখেও গাছটি খুব সহজে চেনা যায়। ফুল দেখতে ভারি সুন্দর। মোটা সুতার মতো পাপড়িগুলো চারদিকে বর্গাকারে সাজানো থাকে। পাপড়ির গোড়া নীল, আগার দিক ক্রমশ সাদা। এদের আরেক প্রজাতির গাছ থেকে ট্যাং ফল হয়। এবার কাঁঠালিচাঁপার কথা শোনা যাক। ফুলটি অনেকেরই প্রিয়। ফুল যখন পরিপূর্ণভাবে বিকশিত হয়, তখন মনে হবে আশপাশে কোথাও কাঁঠাল পেকেছে। এ জন্যই ফুলটির এমন নামকরণ। এমন মিষ্টি সৌরভের এই ফুল পাতার আড়ালে লুকানো থাকে বলে সব সময় আমাদের চোখে পড়ে না। তখন কাঁঠালের গন্ধ অনুসরণ করেই তাকে খুঁজে বের করতে হয়। ফল আঙুরের থোকার মতো ঝুলে থাকে।

চালতা

জ্যৈষ্ঠ মাসের কয়েকটা দিন হাতে থাকতেই চালতা ফুল ফুটতে শুরু করে। ফলের উপযোগিতার কারণে মোহনীয় এই ফুলের সৌন্দর্য আমাদের কাছে অনেকটাই উপেক্ষিত। কিন্তু জীবনানন্দ দাশ এই সৌন্দর্যমণ্ডিত ফুলটির কথা ভোলেননি। তিনি লিখেছেন—

‘আমি চলে যাব ব’লে চালতা ফুল কি আর ভিজিবে না শিশিরের জলে নরম গন্ধের ঢেউয়ে?…’

রূপসী বাংলায় তিনি আরো পাঁচবার চালতার প্রসঙ্গ এনেছেন। বর্ষার ভেজা বাতাসকে যে কয়টি ফুল মধুরিম করে তোলে, সুলতানচাঁপা তার মধ্যে অন্যতম। ঢাকায় দুর্লভ এই গাছ, শুধু মিরপুর বোটানিক্যাল গার্ডেনে কয়েকটি আছে। রমনা নার্সারি ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা অনুষদ প্রাঙ্গণে দুটি গাছ লাগিয়েছি। ফুল ও পাতার সৌন্দর্যে অনন্য এই গাছ পুন্নাগ বা কন্ন্যাল নামেও পরিচিত। একসময় এ গাছের বীজ বাজারে বিক্রি হতে দেখা যেত।

বর্ষায় কিছু ঔষধি গাছেও ফুল ফোটে। সে রকম দুটি ফুল সর্পগন্ধা ও উলটচণ্ডাল। শুধু ঔষধি গুণই নয়, সৌন্দর্যেও এরা অনন্য। এ মৌসুমে সারা দেশে কিছু বিদেশি ফুলও ফোটে। তার মধ্যে বিচিত্র রঙের ক্রেব বা ফুরুস এবং ল্যাংকাস্টারি ফুরুস বা ছোট জারুল অন্যতম। এদের সাদা, গোলাপি, লালচে-গোলাপি ও বেগুনি রঙের ফুলগুলো ভারি সুন্দর। বিদেশি ফুলের মধ্যে বলধা গার্ডেনে ফোটে পোর্টল্যান্ডিয়া আর রমনা পার্কে বাওবাব। বর্ষার আরো কিছু ফুলের মধ্যে দোলনচাঁপা, বিলাতি জারুল, কামিনী, বেলি, অপরাজিতা, নিশিপদ্ম, জুঁই, সুখদর্শন, চামেলি, হংসলতা ইত্যাদি অন্যতম।

Print Friendly, PDF & Email

     এ ক্যাটাগরীর আরো খবর