ঢাকা ০৭:৩৮ অপরাহ্ন, মঙ্গলবার, ০১ অক্টোবর ২০২৪, ১৬ আশ্বিন ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

জঙ্গিবাদ দমনে জাতীয় ঐক্য জরুরী

  • Reporter Name
  • আপডেট টাইম : ১১:৪২:০২ পূর্বাহ্ন, শুক্রবার, ৯ অক্টোবর ২০১৫
  • ২৭৬ বার

গেল কয়েক বছর থেকেই আমাদের দেশে গুম-খুন-নিখোঁজ নিত্যদিনের ঘটনায় পরিণত হয়েছে। বন্দুকযুদ্ধ আর ক্রসফায়ারের নামে চলছে বিচার বহি:র্ভূত হত্যাকাণ্ড। পাশাপাশি গণতান্ত্রিক সব মূল্যবোধ দমিত করে চলছে রাজনৈতিক হানাহানি। দোষারোপের রাজনীতিতে জাতীয় স্বার্থও জলাজ্জ্বলি দেয়া হচ্ছে। তবে গেল ক’বছরে সরকার বিরোধীমত দমনে যতটা দক্ষতার পরিচয় দিয়েছে সন্ত্রাস দমনে এর কিয়দাংশও দিতে পারেনি। বরং বিরোধীদের জঙ্গি বানিয়ে সাইজ করার যে প্রক্রিয়া -প্রপােগান্ডা চালিয়ে আসছিল তা আজ হিতে বিপরীত হিসেবে দেখা দিয়েছে। আজ যখন দুইজন বিদেশী নাগরিক হত্যাকাণ্ডের ঘটনা ঘটলো তখন এ নিয়ে আন্তর্জাতিক মহল এমনভাবে প্রচারে নেমে যেন দেশটা জঙ্গি রাষ্ট্র হয়ে গেছে। এ সবকিছু কি, আর কিসের আলামত?

ইতিহাসের বেশি দূর যাওয়ার দরকার নেই।আমরা যদি পাকিস্তান, আফগানিস্তান ও সিরিয়ার নিকট অতীতের দিকে লক্ষ্য করি তবেই বুঝতে পারবো তাদেরকে কিভাবে ব্যর্থ রাষ্ট্রে পরিণত করা হয়েছে। ফলে আজকে বাংলাদেশে যে পরিস্থিত সৃষ্টি করা হচ্ছে তা খুবই উদ্বেগজনক। একটি রাষ্ট্রকে যেভাবে ব্যর্থ রাষ্ট্রে পরিণত করা হয় সেসব আলামত ক্রমেই ফুটিয়ে তোলার চেষ্টা করা হচ্ছে। পরিস্থিতি দেখে মনে হচ্ছে- বাংলাদেশের গায়ে জঙ্গি তকমা লাগিয়ে দেয়ার এক বড় ধরনের ষড়যন্ত্র চলছে। দেশী-বিদেশী একাধিক চক্র পরিকল্পিতভাবে যে এ তৎপরতা চালাচ্ছে তা সহজে অনুমেয়। এসব ব্যাপারে আমাদের রাষ্ট্র-সরকার ও রাজনৈতিক নেতারা সতর্ক হবেন কি, তাদের বোধোদয় হবে কি?

সম্প্রতি দুই বিদেশী নাগরিক খুনের ঘটনায় ইনিয়ে-বিনিয়ে বারবার জঙ্গি সম্পৃক্ততা টেনে আনছে বিদেশীরা। এক্ষেত্রে তারা গণমাধ্যম ও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ব্যবহার করছে। নিজস্ব প্রকাশ্য তৎপরতাও কম নয়। আমরা কি দেখলাম- অস্ট্রেলিয়ার ক্রিকেট দলের বাংলাদেশ সফর নিয়ে চলতে থাকা টানাপোড়েনের মধ্যে ২৮ সেপ্টেম্বর রাতে গুলশানে সন্ত্রাসীদের গুলিতে নিহত হন ইতালির নাগরিক সিজারি তাভেল্লা। নিরাপত্তার অজুহাতে তারা শেষ মুহূর্তে সফর স্থগিত করে। এরপর রংপুরে জাপানের নাগরিক খুন হয়। এরপর একযোগে পূর্ব-পশ্চিমের প্রায় সব রাষ্ট্রদূতেরা রের্ড এলার্ট জারি করে এমন ভীতিকর পরিস্থিতি সৃষ্টি করলো যে, বাংলাদেশ যেন রাতারাতি ‘বিশ্বের সবেচেয়ে নিরাপত্তা ঝুঁকিপূর্ণ জনপদে’পরিণত হয়েছে।

এরই মধ্যে সাউথ আফ্রিকার নারী ক্রিকেট দলের বাংলাদেশ সফর স্থগিত হয়ে যায়। তৈরি পোশাক শিল্পের ক্রেতা প্রতিষ্ঠানের প্রতিনিধিদের সংগঠন বায়ার্স ফোরামের পূর্বনির্ধারিত বৈঠক নিজেরাই স্থগিত করে দেয়। এছাড়া বিভিন্ন দেশের দূতাবাস ও হাইকমিশন বিদেশী নাগরিকদের চলাচলের ওপর সতর্কতা জারি করায় নিরাপত্তা ঝুঁকির বিষয়টি মাথায় রেখে অনেক পর্যটক ইতোমধ্যে তাদের সফর বাতিল করেছে। বিদেশী কিছু গণমাধ্যমে দুই বিদেশী নাগরিক হত্যার পর নিরাপত্তা ইস্যুটি এখনো ফলাও করে প্রচার করছে। সবমিলেই যেন বাংলাদেশকে জঙ্গি রাষ্ট্রে পরিণত করার এক বিরাট মহড়া চলছে।

অবশ্য এই সুযোগটা আমরা নিজেরাই করে দিয়েছি। কারণ মহাজোট সরকার ক্ষমতায় আসার পর থেকেই সরকারের হর্তকর্তারা জঙ্গিবাদের জিকির তুলে বিরোধীদের সাইজ করার চেষ্টা করে আসছে। এ ক্ষেত্রে আমাদের জঙ্গিবাদ বিশেষজ্ঞ তথ্যমন্ত্রী হাসানুল হক ইনুর কথা সর্বাগ্রে উল্লেখ না করলে তার প্রতি একটু অবিচার হয়ে যাবে। কেননা, বিগত কয়েক বছরে এমন কোন দিন যায়নি যেদিন তিনি বিরোধীদের জঙ্গি আখ্যা দিয়ে বক্তব্য দেননি। এছাড়া রাষ্ট্রের নির্বাহী প্রধানসহ সরকারের অন্যান্য মন্ত্রীরা তো আছেনই। যদিও হাসানুল হক ইনু সাহেব অজ্ঞাত কারণে আজ নীরব দর্শকের ভুমিকা পালন করছেন।

একথাও সত্য যে, পশ্চিমারা জঙ্গি ও সন্ত্রাসবাদের বিরুদ্ধে। এ বিষয়টি মাথায় রেখে পশ্চিমাদের সমর্থন ও সহানুভূতি আদায়ে সরকার প্রথম থেকেই দেশে জঙ্গি আছে বলে প্রচারণা চালিয়েছে। এখন আবার তারাই বলছে দেশে জঙ্গি নেই। সরকারের জঙ্গি প্রচারণা এখন তাদের জন্য যেমন তেমন দেশের জন্য গলার কাঁটা হয়েছে।

আরো বেশি উদ্বেগের বিষয় হলো- যে মুহূর্তে দেশ চরম সঙ্কটময় সময় অতিবাহিত করছে তখনও আমাদের রাজনীতিবিদদের হুশ হয়নি। আমরা কী দেখলাম- দুই বিদেশী নাগরিক হত্যার পর প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা দেশে ফিরেই বললেন, ‘এ ঘটনার পেছনে নিশ্চয়ই বিএনপি-জামায়াতের মদদ আছে। আমাদের অর্জনগুলো ম্লান করার জন্য এ ঘটনাগুলো ঘটানো হয়। এটার পেছনে নিশ্চয়ই একটা উদ্দেশ্য আছে। তাদের হাত আছে।’এ অবস্থায় এই রাজনৈতিক বক্তব্যে যেমন তদন্ত বাধাগ্রস্ত হতে পারে তেমনি অন্যদেরকে কথা বলার সুযোগ করে দিচ্ছে।

প্রধানমন্ত্রী বিদেশী নাগরিক হত্যার ঘটনায় সন্দেহের তীর বিএনপি জামায়াতের দিকে ছুড়ে দিলেও দেশী-বিদেশী একাধিক চক্র দুটি খুনই জঙ্গি তৎপরতার অংশ হিসেবে প্রমাণ করার জন্য মরিয়া হয়ে উঠেছে। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীসহ আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর কর্তাব্যক্তিরাও বিষয়টি এখনও স্পষ্ট করতে পারছে না, যা পরোক্ষভাবে কাজে লাগছে ষড়যন্ত্রকারীদের। আইনশৃঙ্খলা বাহিনী একদিকে দাবি করছেন দেশে জঙ্গি নেই। অন্যদিকে আইএস সন্দেহে ময়মনসিংহসহ দেশের বিভিন্ন এলাকা থেকে আটককৃতদের ফলাও করে প্রচার করছে। এতে করে দিন দিন পরিস্থিতি আরও ঘোলাটে হয়ে উঠছে। দেশ ও সরকারের ভাবমূর্তিও হুমকির মধ্যে পড়ছে।

বিশ্লষকদের মতে, দুই বিদেশী হত্যার পর সরাসরি বিএনপি-জামায়াতকে দোষারোপ করা চরম অদক্ষতার বহিঃপ্রকাশ। একইভাবে যারা জঙ্গি তৎপরতার কথা বলছেন তারাও নিজস্ব এজেন্ডা বাস্তবায়নের জন্য পরিকল্পিতভাবে এ কাজটি করছেন। যাতে করে সিরিয়া, পাকিস্তান-আফগানিস্তানের মতোন বাংলাদেশকেও ধীরে ধীরে ব্যর্থ রাষ্ট্র বানানো যায়।

লক্ষ্যনীয় যে, আমাদের এখান থেকেই অনেকে জঙ্গি জঙ্গি বলে প্রচারণা চালাচ্ছেন। রাতের টকশোতে বেশির ভাগ টেলিভিশন চ্যানেলে দেখা যায় আলোচনা হচ্ছে জঙ্গি নিয়ে। আমরাই জঙ্গি জঙ্গি বলে চেঁচামেচি করছি। যার সুযোগ নিচ্ছে বিদেশীরা।
অন্যদিকে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীও এসব খুনের সঙ্গে জড়িত অপরাধীদের আইনের আওতায় আনতে পারছে না।

নিরাপত্তা ও রাজনৈতিক বিশ্লেষক এবং সুশীল সমাজের প্রতিনিধিরা মনে করছেন এই দেশী ও বিদেশী চক্রের নিজস্ব এজেন্ডা আছে। লক্ষ্য বাস্তবায়নের অংশ হিসেবে তারা বাংলাদেশকে জঙ্গি রাষ্ট্র বানাতে চাচ্ছে। এর অংশ হিসেবে আইএসসহ নানা ধরনের জঙ্গি সংগঠন বাংলাদেশে সক্রিয় এটা প্রমাণ করতে চাচ্ছে। এদের এখনই রোধ করতে হবে। প্রকৃত অপরাধীকে শনাক্ত করে তাদের শাস্তির আওতায় আনতে হবে। অন্যথায় বহির্বিশ্বে দেশের ভাবমূর্তি ধ্বংসের আশংকা রয়েছে।

ষড়যন্ত্রকারীরা দুই বিদেশী নাগরিক হত্যার সঙ্গে আইএসের মতো জঙ্গি সংগঠনের সম্পৃক্ততা প্রমাণের চেষ্টা করছে। জঙ্গি ইস্যুতে সরকারের নীতিনির্ধারকদের দেয়া আগেকার বক্তব্যকে কাজে লাগাচ্ছে তারা। এখন সরকার বলার চেষ্টা করছে দেশে জঙ্গি নেই। কিন্তু তা কেউ বিশ্বাস করতে চাচ্ছে না। এ পরিস্থিতিতে দেশের গায়ে জঙ্গি তকমা লাগানো অনেকটা সহজ হয়ে গেছে চক্রের জন্য।

বাস্তবতা হচ্ছে একবার এ ধরনের নেতিবাচক ‘সিল’ দেশের গায়ে পড়লে তা শুধু সরকারের ভাবমূর্তিই ক্ষুণ্ণ করবে না। দেশের ভাবমূর্তিও ক্ষুণ্ণ হবে। ব্যবসা-বাণিজ্য-বিনিয়োগ-উন্নয়ন-অগ্রগতি-কর্মসংস্থান-শ্রমবাজার-তৈরি পোশাক খাত, পর্যটন শিল্পসহ সবকিছু থমকে দাঁড়াবে। অর্থনীতিতে ভয়াবহ ধস নামবে। এই গ্লানি বর্তমান সরকারের পাশাপাশি আগামীর সরকারগুলোকেও টেনে নিতে হবে। সিরিয়া, পাকিস্তান-আফগানিস্তানের মতো বাংলাদেশও ধীরে ধীরে ব্যর্থ রাষ্ট্রের দিকে ধাবিত হবে যে তাতে কোনো সন্দেহ নেই। এটা আমাদের জন্য অশনি সংকেত।

তাই বর্তমান পরিস্থিতি মোকাবিলায় রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দকে জাতীয় স্বার্থে হানাহানি বন্ধ করে ঐক্যের মোহনায় দাঁড়িয়ে রাষ্ট্রের ভাবমূর্তি রক্ষায় ভুমিকা পালনের কোনো বিকল্প নেই। সেই সাথে বাংলাদেশকে জঙ্গি তথা ব্যর্থ রাষ্ট্রে পরিণত করার যে ষড়যন্ত্র শুরু হয়েছে তা রুখতে হবে। বন্ধ করতে হবে বাংলাদেশ বিরোধী সব প্রচার-প্রপোগান্ডা। পাশাপাশি সব ধরনের অগণতান্ত্রিক চর্চা পরিহার করে গণতান্ত্রিক মূল্যবোধকে ধারণ করে হাঁটতে হবে একই পথে। তবেই আশা করা যায়- বর্তমান পরিস্থিতি থেকে দেশকে মুক্ত করা। অন্যথা, রাজনীতিবিদদের এই ব্যর্থতার গ্লানি যে গোটা জাতিকে দীর্ঘ সময় টানতে এতে কোনো সন্দেহ নেই।
লেখক: গবেষক ও কলামলেখক, ই-মেইল- sarderanis@gmail.com

Tag :

Write Your Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Save Your Email and Others Information

About Author Information

Haor Barta24

জঙ্গিবাদ দমনে জাতীয় ঐক্য জরুরী

আপডেট টাইম : ১১:৪২:০২ পূর্বাহ্ন, শুক্রবার, ৯ অক্টোবর ২০১৫

গেল কয়েক বছর থেকেই আমাদের দেশে গুম-খুন-নিখোঁজ নিত্যদিনের ঘটনায় পরিণত হয়েছে। বন্দুকযুদ্ধ আর ক্রসফায়ারের নামে চলছে বিচার বহি:র্ভূত হত্যাকাণ্ড। পাশাপাশি গণতান্ত্রিক সব মূল্যবোধ দমিত করে চলছে রাজনৈতিক হানাহানি। দোষারোপের রাজনীতিতে জাতীয় স্বার্থও জলাজ্জ্বলি দেয়া হচ্ছে। তবে গেল ক’বছরে সরকার বিরোধীমত দমনে যতটা দক্ষতার পরিচয় দিয়েছে সন্ত্রাস দমনে এর কিয়দাংশও দিতে পারেনি। বরং বিরোধীদের জঙ্গি বানিয়ে সাইজ করার যে প্রক্রিয়া -প্রপােগান্ডা চালিয়ে আসছিল তা আজ হিতে বিপরীত হিসেবে দেখা দিয়েছে। আজ যখন দুইজন বিদেশী নাগরিক হত্যাকাণ্ডের ঘটনা ঘটলো তখন এ নিয়ে আন্তর্জাতিক মহল এমনভাবে প্রচারে নেমে যেন দেশটা জঙ্গি রাষ্ট্র হয়ে গেছে। এ সবকিছু কি, আর কিসের আলামত?

ইতিহাসের বেশি দূর যাওয়ার দরকার নেই।আমরা যদি পাকিস্তান, আফগানিস্তান ও সিরিয়ার নিকট অতীতের দিকে লক্ষ্য করি তবেই বুঝতে পারবো তাদেরকে কিভাবে ব্যর্থ রাষ্ট্রে পরিণত করা হয়েছে। ফলে আজকে বাংলাদেশে যে পরিস্থিত সৃষ্টি করা হচ্ছে তা খুবই উদ্বেগজনক। একটি রাষ্ট্রকে যেভাবে ব্যর্থ রাষ্ট্রে পরিণত করা হয় সেসব আলামত ক্রমেই ফুটিয়ে তোলার চেষ্টা করা হচ্ছে। পরিস্থিতি দেখে মনে হচ্ছে- বাংলাদেশের গায়ে জঙ্গি তকমা লাগিয়ে দেয়ার এক বড় ধরনের ষড়যন্ত্র চলছে। দেশী-বিদেশী একাধিক চক্র পরিকল্পিতভাবে যে এ তৎপরতা চালাচ্ছে তা সহজে অনুমেয়। এসব ব্যাপারে আমাদের রাষ্ট্র-সরকার ও রাজনৈতিক নেতারা সতর্ক হবেন কি, তাদের বোধোদয় হবে কি?

সম্প্রতি দুই বিদেশী নাগরিক খুনের ঘটনায় ইনিয়ে-বিনিয়ে বারবার জঙ্গি সম্পৃক্ততা টেনে আনছে বিদেশীরা। এক্ষেত্রে তারা গণমাধ্যম ও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ব্যবহার করছে। নিজস্ব প্রকাশ্য তৎপরতাও কম নয়। আমরা কি দেখলাম- অস্ট্রেলিয়ার ক্রিকেট দলের বাংলাদেশ সফর নিয়ে চলতে থাকা টানাপোড়েনের মধ্যে ২৮ সেপ্টেম্বর রাতে গুলশানে সন্ত্রাসীদের গুলিতে নিহত হন ইতালির নাগরিক সিজারি তাভেল্লা। নিরাপত্তার অজুহাতে তারা শেষ মুহূর্তে সফর স্থগিত করে। এরপর রংপুরে জাপানের নাগরিক খুন হয়। এরপর একযোগে পূর্ব-পশ্চিমের প্রায় সব রাষ্ট্রদূতেরা রের্ড এলার্ট জারি করে এমন ভীতিকর পরিস্থিতি সৃষ্টি করলো যে, বাংলাদেশ যেন রাতারাতি ‘বিশ্বের সবেচেয়ে নিরাপত্তা ঝুঁকিপূর্ণ জনপদে’পরিণত হয়েছে।

এরই মধ্যে সাউথ আফ্রিকার নারী ক্রিকেট দলের বাংলাদেশ সফর স্থগিত হয়ে যায়। তৈরি পোশাক শিল্পের ক্রেতা প্রতিষ্ঠানের প্রতিনিধিদের সংগঠন বায়ার্স ফোরামের পূর্বনির্ধারিত বৈঠক নিজেরাই স্থগিত করে দেয়। এছাড়া বিভিন্ন দেশের দূতাবাস ও হাইকমিশন বিদেশী নাগরিকদের চলাচলের ওপর সতর্কতা জারি করায় নিরাপত্তা ঝুঁকির বিষয়টি মাথায় রেখে অনেক পর্যটক ইতোমধ্যে তাদের সফর বাতিল করেছে। বিদেশী কিছু গণমাধ্যমে দুই বিদেশী নাগরিক হত্যার পর নিরাপত্তা ইস্যুটি এখনো ফলাও করে প্রচার করছে। সবমিলেই যেন বাংলাদেশকে জঙ্গি রাষ্ট্রে পরিণত করার এক বিরাট মহড়া চলছে।

অবশ্য এই সুযোগটা আমরা নিজেরাই করে দিয়েছি। কারণ মহাজোট সরকার ক্ষমতায় আসার পর থেকেই সরকারের হর্তকর্তারা জঙ্গিবাদের জিকির তুলে বিরোধীদের সাইজ করার চেষ্টা করে আসছে। এ ক্ষেত্রে আমাদের জঙ্গিবাদ বিশেষজ্ঞ তথ্যমন্ত্রী হাসানুল হক ইনুর কথা সর্বাগ্রে উল্লেখ না করলে তার প্রতি একটু অবিচার হয়ে যাবে। কেননা, বিগত কয়েক বছরে এমন কোন দিন যায়নি যেদিন তিনি বিরোধীদের জঙ্গি আখ্যা দিয়ে বক্তব্য দেননি। এছাড়া রাষ্ট্রের নির্বাহী প্রধানসহ সরকারের অন্যান্য মন্ত্রীরা তো আছেনই। যদিও হাসানুল হক ইনু সাহেব অজ্ঞাত কারণে আজ নীরব দর্শকের ভুমিকা পালন করছেন।

একথাও সত্য যে, পশ্চিমারা জঙ্গি ও সন্ত্রাসবাদের বিরুদ্ধে। এ বিষয়টি মাথায় রেখে পশ্চিমাদের সমর্থন ও সহানুভূতি আদায়ে সরকার প্রথম থেকেই দেশে জঙ্গি আছে বলে প্রচারণা চালিয়েছে। এখন আবার তারাই বলছে দেশে জঙ্গি নেই। সরকারের জঙ্গি প্রচারণা এখন তাদের জন্য যেমন তেমন দেশের জন্য গলার কাঁটা হয়েছে।

আরো বেশি উদ্বেগের বিষয় হলো- যে মুহূর্তে দেশ চরম সঙ্কটময় সময় অতিবাহিত করছে তখনও আমাদের রাজনীতিবিদদের হুশ হয়নি। আমরা কী দেখলাম- দুই বিদেশী নাগরিক হত্যার পর প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা দেশে ফিরেই বললেন, ‘এ ঘটনার পেছনে নিশ্চয়ই বিএনপি-জামায়াতের মদদ আছে। আমাদের অর্জনগুলো ম্লান করার জন্য এ ঘটনাগুলো ঘটানো হয়। এটার পেছনে নিশ্চয়ই একটা উদ্দেশ্য আছে। তাদের হাত আছে।’এ অবস্থায় এই রাজনৈতিক বক্তব্যে যেমন তদন্ত বাধাগ্রস্ত হতে পারে তেমনি অন্যদেরকে কথা বলার সুযোগ করে দিচ্ছে।

প্রধানমন্ত্রী বিদেশী নাগরিক হত্যার ঘটনায় সন্দেহের তীর বিএনপি জামায়াতের দিকে ছুড়ে দিলেও দেশী-বিদেশী একাধিক চক্র দুটি খুনই জঙ্গি তৎপরতার অংশ হিসেবে প্রমাণ করার জন্য মরিয়া হয়ে উঠেছে। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীসহ আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর কর্তাব্যক্তিরাও বিষয়টি এখনও স্পষ্ট করতে পারছে না, যা পরোক্ষভাবে কাজে লাগছে ষড়যন্ত্রকারীদের। আইনশৃঙ্খলা বাহিনী একদিকে দাবি করছেন দেশে জঙ্গি নেই। অন্যদিকে আইএস সন্দেহে ময়মনসিংহসহ দেশের বিভিন্ন এলাকা থেকে আটককৃতদের ফলাও করে প্রচার করছে। এতে করে দিন দিন পরিস্থিতি আরও ঘোলাটে হয়ে উঠছে। দেশ ও সরকারের ভাবমূর্তিও হুমকির মধ্যে পড়ছে।

বিশ্লষকদের মতে, দুই বিদেশী হত্যার পর সরাসরি বিএনপি-জামায়াতকে দোষারোপ করা চরম অদক্ষতার বহিঃপ্রকাশ। একইভাবে যারা জঙ্গি তৎপরতার কথা বলছেন তারাও নিজস্ব এজেন্ডা বাস্তবায়নের জন্য পরিকল্পিতভাবে এ কাজটি করছেন। যাতে করে সিরিয়া, পাকিস্তান-আফগানিস্তানের মতোন বাংলাদেশকেও ধীরে ধীরে ব্যর্থ রাষ্ট্র বানানো যায়।

লক্ষ্যনীয় যে, আমাদের এখান থেকেই অনেকে জঙ্গি জঙ্গি বলে প্রচারণা চালাচ্ছেন। রাতের টকশোতে বেশির ভাগ টেলিভিশন চ্যানেলে দেখা যায় আলোচনা হচ্ছে জঙ্গি নিয়ে। আমরাই জঙ্গি জঙ্গি বলে চেঁচামেচি করছি। যার সুযোগ নিচ্ছে বিদেশীরা।
অন্যদিকে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীও এসব খুনের সঙ্গে জড়িত অপরাধীদের আইনের আওতায় আনতে পারছে না।

নিরাপত্তা ও রাজনৈতিক বিশ্লেষক এবং সুশীল সমাজের প্রতিনিধিরা মনে করছেন এই দেশী ও বিদেশী চক্রের নিজস্ব এজেন্ডা আছে। লক্ষ্য বাস্তবায়নের অংশ হিসেবে তারা বাংলাদেশকে জঙ্গি রাষ্ট্র বানাতে চাচ্ছে। এর অংশ হিসেবে আইএসসহ নানা ধরনের জঙ্গি সংগঠন বাংলাদেশে সক্রিয় এটা প্রমাণ করতে চাচ্ছে। এদের এখনই রোধ করতে হবে। প্রকৃত অপরাধীকে শনাক্ত করে তাদের শাস্তির আওতায় আনতে হবে। অন্যথায় বহির্বিশ্বে দেশের ভাবমূর্তি ধ্বংসের আশংকা রয়েছে।

ষড়যন্ত্রকারীরা দুই বিদেশী নাগরিক হত্যার সঙ্গে আইএসের মতো জঙ্গি সংগঠনের সম্পৃক্ততা প্রমাণের চেষ্টা করছে। জঙ্গি ইস্যুতে সরকারের নীতিনির্ধারকদের দেয়া আগেকার বক্তব্যকে কাজে লাগাচ্ছে তারা। এখন সরকার বলার চেষ্টা করছে দেশে জঙ্গি নেই। কিন্তু তা কেউ বিশ্বাস করতে চাচ্ছে না। এ পরিস্থিতিতে দেশের গায়ে জঙ্গি তকমা লাগানো অনেকটা সহজ হয়ে গেছে চক্রের জন্য।

বাস্তবতা হচ্ছে একবার এ ধরনের নেতিবাচক ‘সিল’ দেশের গায়ে পড়লে তা শুধু সরকারের ভাবমূর্তিই ক্ষুণ্ণ করবে না। দেশের ভাবমূর্তিও ক্ষুণ্ণ হবে। ব্যবসা-বাণিজ্য-বিনিয়োগ-উন্নয়ন-অগ্রগতি-কর্মসংস্থান-শ্রমবাজার-তৈরি পোশাক খাত, পর্যটন শিল্পসহ সবকিছু থমকে দাঁড়াবে। অর্থনীতিতে ভয়াবহ ধস নামবে। এই গ্লানি বর্তমান সরকারের পাশাপাশি আগামীর সরকারগুলোকেও টেনে নিতে হবে। সিরিয়া, পাকিস্তান-আফগানিস্তানের মতো বাংলাদেশও ধীরে ধীরে ব্যর্থ রাষ্ট্রের দিকে ধাবিত হবে যে তাতে কোনো সন্দেহ নেই। এটা আমাদের জন্য অশনি সংকেত।

তাই বর্তমান পরিস্থিতি মোকাবিলায় রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দকে জাতীয় স্বার্থে হানাহানি বন্ধ করে ঐক্যের মোহনায় দাঁড়িয়ে রাষ্ট্রের ভাবমূর্তি রক্ষায় ভুমিকা পালনের কোনো বিকল্প নেই। সেই সাথে বাংলাদেশকে জঙ্গি তথা ব্যর্থ রাষ্ট্রে পরিণত করার যে ষড়যন্ত্র শুরু হয়েছে তা রুখতে হবে। বন্ধ করতে হবে বাংলাদেশ বিরোধী সব প্রচার-প্রপোগান্ডা। পাশাপাশি সব ধরনের অগণতান্ত্রিক চর্চা পরিহার করে গণতান্ত্রিক মূল্যবোধকে ধারণ করে হাঁটতে হবে একই পথে। তবেই আশা করা যায়- বর্তমান পরিস্থিতি থেকে দেশকে মুক্ত করা। অন্যথা, রাজনীতিবিদদের এই ব্যর্থতার গ্লানি যে গোটা জাতিকে দীর্ঘ সময় টানতে এতে কোনো সন্দেহ নেই।
লেখক: গবেষক ও কলামলেখক, ই-মেইল- sarderanis@gmail.com