আওয়ামী লীগের চ্যালেঞ্জ কোন্দল প্রার্থী ‘সংকট’ বিএনপির

হাওর বার্তা ডেস্কঃ নোয়াখালী জেলা শহর থেকে দক্ষিণে মেঘনাবেষ্টিত হাতিয়া উপজেলা নিয়ে একটি সংসদীয় আসন, যা নোয়াখালী-৬। নদীভাঙন, বিদ্যুৎ না থাকা, যোগাযোগব্যবস্থার দুর্দশা আর জলদস্যু ও বনদস্যুর উৎপাতই এ এলাকার প্রধান সমস্যা। এসব সমস্যা আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচনেও আলোচনার কেন্দ্রে থাকবে—বিভিন্ন দলের নেতাকর্মীদের সঙ্গে কথা বলে এমনটি জানা গেছে।

মাঠপর্যায়ে খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের বর্তমান সংসদ সদস্য আয়েশা ফেরদাউস ছাড়াও আরো কয়েকজন নেতা নির্বাচন করতে চান। এলাকার রাজনীতির প্রেক্ষাপটে ক্ষমতাসীনদের সামনে বড় চ্যালেঞ্জ হলো দলীয় কোন্দল, যার একটি পক্ষ সংসদ সদস্য। অন্য পক্ষ দলের স্থানীয় শাখা।

অন্যদিকে বিএনপিতে রয়েছে প্রার্থী সংকট। অবশ্য দলের একটি অংশ সাবেক সংসদ সদস্য প্রকৌশলী ফজলুল আজিমকে ফিরিয়ে এনে প্রার্থী করার পক্ষে। তিনি নিজেও নির্বাচন করবেন বলে জানিয়েছেন, তবে দলের হয়ে নাকি স্বতন্ত্র হয়ে সেটা পরিষ্কার করেননি।

উল্লেখ্য, এরশাদ সরকারের পতনের পর ১৯৯১ সালের নির্বাচনে জেলায় একটি মাত্র আসন পায় আওয়ামী লীগ। সে আসনটি হলো হাতিয়া। নির্বাচিত হন বর্তমান উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি ওয়ালী উল্লাহ। ১৯৯৬ সালে আসনটি চলে যায় বিএনপির হাতে। তখন নির্বাচিত হন শিল্পপতি ফজলুল আজিম। ২০০১ সালের নির্বাচনে বিএনপি প্রার্থী ফজলুল আজিম ও আওয়ামী লীগের প্রার্থী সাবেক সংসদ সদস্য ওয়ালী উল্লাহকে পরাজিত করে সংসদ সদস্য হন আওয়ামী লীগের বিদ্রোহী প্রার্থী মোহাম্মদ আলী।

সংস্কারপন্থী হিসেবে পরিচিত ফজলুল আজিমকে বিএনপি ২০০৮ সালের নির্বাচনে মনোনয়ন দেয়নি। তিনি স্বতন্ত্র প্রার্থী হন। অন্যদিকে আওয়ামী লীগ মোহাম্মদ আলীকে মনোনয়ন দেয়। কিন্তু ঋণখেলাপের অভিযোগে তাঁর মনোনয়নপত্র বাতিল হয়ে যায়। তখন তাঁর সহধর্মিণী আয়েশা ফেরদাউস স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে নির্বাচন করেন। শেষ পর্যন্ত দুই স্বতন্ত্র প্রার্থীর লড়াইয়ে জয়ী হন ফজলুল আজিম। ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারির নির্বাচনে আওয়ামী লীগের টিকিটে সংসদ সদস্য হন আয়েশা ফেরদাউস। দলের বিদ্রোহী প্রার্থী ছিলেন বর্তমানে নোয়াখালী জেলা আওয়ামী লীগের বন ও পরিবেশ বিষয়ক সম্পাদক আমিরুল ইসলাম আমির।

আওয়ামী লীগ : আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচনে আওয়ামী লীগের মনোনয়ন আলোচনায় থাকা সম্ভাব্য প্রার্থীরা হলেন বর্তমান সংসদ সদস্য আয়েশা ফেরদাউস, তাঁর স্বামী সাবেক সংসদ সদস্য মোহাম্মদ আলী, উপজেলা আওয়ামী লীগের সহসভাপতি মাহমুদ আলী রাতুল, জেলা আওয়ামী লীগের বন ও পরিবেশ বিষয়ক সম্পাদক আমিরুল ইসলাম আমির।

নেতাকর্মীদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, হাতিয়ায় আওয়ামী লীগের অবস্থান ভালো হলেও এখানে দলের দুটি পক্ষের মধ্যে বিরোধ চরমে। বিগত ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনের পর দুই পক্ষের সংঘাতে যুবলীগ নেতাসহ কমপক্ষে ছয়জন নিহত এবং অসংখ্য লোক আহত হয়েছে। এখানে উপজেলা আওয়ামী লীগের সঙ্গে সংসদ সদস্য আয়েশা ফেরদাউস ও তাঁর স্বামী মোহাম্মদ আলীর বিরোধ চরমে। দুই পক্ষের মধ্যে হামলা-পাল্টাহামলা নিয়মিত ঘটনা হয়ে দাঁড়িয়েছে।

উপজেলা আওয়ামী লীগের অনেক নেতাকর্মী অভিযোগ করেছে, সংসদ সদস্যের স্বামী মোহাম্মদ আলীর আশ্রয়ে-প্রশ্রয়ে দস্যুরা বেপরোয়া হয়ে উঠেছে। তবে এই অভিযোগ অস্বীকার করেছেন তিনি। এ ছাড়া এলাকার কাঙ্ক্ষিত উন্নয়ন না হওয়ায় আওয়ামী লীগের অনেক নেতাকর্মীও ক্ষুব্ধ।

আয়েশা ফেরদাউস নদীভাঙন ও বিদ্যুৎ সমস্যার বিষয়ে সাংবাদিককে বলেন, হাতিয়ার বিভিন্ন সমস্যা নিয়ে তিনি বেশ কয়েকবার জাতীয় সংসদে বক্তব্য দিয়েছেন। নলচিরা, হরণী ও চানন্দী ইউনিয়নের নদীভাঙন রোধকল্পে ৪৩৬ কোটি টাকা ব্যয়ে একটি প্রকল্প জাতীয় অর্থনৈতিক পরিষদের নির্বাহী কমিটির (একনেক) অনুমোদনের অপেক্ষায় রয়েছে। ইতিমধ্যে উচ্চক্ষমতাসম্পন্ন জেনারেটর হাতিয়ায় পৌঁছছে। অচিরেই বিদ্যুৎ সমস্যার সমাধান হবে। তিনি আরো বলেন, ‘হাতিয়ার ছয় লক্ষাধিক অধিবাসীর সার্বিক উন্নয়নে প্রধানমন্ত্রী ও জননেত্রী শেখ হাসিনা বেশ সচেতন, যার ধারাবাহিকতায় এখানে উন্নয়নমূলক কাজ চলছে।’

ভোটের রাজনীতিতে গুরুত্বপূর্ণ নিয়ামক মনে করা হয় মোহাম্মদ আলীকে। দলের বাইরেও তাঁর প্রচুর ভোট আছে। বিগত দিনের জাতীয় নির্বাচনে একাধিকবার সেটা প্রমাণিত হয়েছে। আগামী নির্বাচনে তিনিও দলীয় মনোনয়নপ্রত্যাশী।

উপজেলা আওয়ামী লীগের আনা অভিযোগ অস্বীকার করে মোহাম্মদ আলী বলেন, ‘আমি সাধারণ মানুষের রাজনীতি করি, সন্ত্রাসের রাজনীতি করি না।’

এ আসনে আরেক সম্ভাব্য প্রার্থী মাহমুদ আলী রাতুল। রাজনীতিতে নবাগত হলেও ইতিমধ্যে তিনি হাতিয়ায় নিজের অবস্থান তৈরি করেছেন। আগামী নির্বাচন প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ‘মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বিগত সাড়ে ৯ বছরে সারা দেশের উন্নয়ন করেছেন। দুঃখজনক হলেও সত্য, হাতিয়া উপজেলায় কোনো উন্নয়ন হয়নি। এখানে নদীভাঙন সবচেয়ে বড় সমস্যা, সেটা সমাধানে কোনো ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি। হাতিয়া দ্বীপে যাতায়াতব্যবস্থা খুবই খারাপ। ৫০ বছর আগের জাহাজে করে চট্টগ্রাম থেকে যাতায়াত করতে হয়, যা মাঝেমধ্যে অচল হয়ে যায়। দ্বীপে ভালো ঘাটও নেই। তবে সবচেয়ে বড় সমস্যা হচ্ছে সন্ত্রাস। স্থানীয় সংসদ সদস্যের স্বামীর লালিত জলদস্যু-বনদস্যুরা পুরো দ্বীপকে সন্ত্রাসের জনপদে পরিণত করেছে। সরকারি দল ক্ষমতায় থাকলেও তাদের নেতাকর্মীরা নিগৃহীত হয়, এটা মেনে নেওয়া যায় না।’

রাতুল আরো বলেন, ‘দলীয় মনোনয়ন পেলে আমি হাতিয়াবাসীর সার্বিক উন্নয়নে কাজ করে যাব। হাতিয়াবাসী একজন ব্যক্তির কাছে জিম্মি থাকতে পারে না। জননেত্রী প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার হাতকে শত্তিশালী করতে এবং এ এলাকায় জলদস্যু ও বনদস্যু নির্মূল করতে হলে এখানে পরিবর্তন আবশ্যক। হাতিয়ার জনগণও তা চায়।’

উপজেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক মহিউদ্দিন বলেন, হাতিয়াকে দস্যুমুক্ত করতে আগামী নির্বাচনে উপজেলা আওয়ামী লীগ মাহমুদ আলী রাতুলকে মনোনয়ন দেওয়ার দাবি জানাবে।

জেলা আওয়ামী লীগ নেতা আমিরুল ইসলাম বলেন, ‘অবহেলিত হাতিয়াবাসীর সমস্যা সমাধানকল্পে আমি আগামী নির্বাচনে মনোনয়নপ্রত্যাশী। এলাকার জনগণ আমার সঙ্গে আছে। দলীয় মনোনয়ন পেলে বিপুল ভোটের ব্যবধানে আমি জয়লাভ করব।’

বিএনপি : তিনবার সংসদ সদস্য থাকার সময় ফজলুল আজিম হাতিয়ার উন্নয়নে কাজ করার চেষ্টা করেছেন। সামাজিক কাজকর্মের পাশাপাশি তিনি এলাকায় দান-খয়রাত করে দলের পাশাপাশি সাধারণ মানুষের আস্থা অর্জন করেছেন। উপজেলা বিএনপির একটি উল্লেখযোগ্য অংশ প্রকৌশলী ফজলুল আজিমকে বিএনপিতে ফিরিয়ে নেওয়ার বিষয়ে দারুণ আশাবাদী।

ফজলুল আজিম সাংবাদিককে বলেন, ‘আমি হতিয়াবাসীর সঙ্গে আছি। এলাকার উন্নয়নে নিজেকে সম্পৃক্ত করতে চাই। বিগত দিনে আমার উদ্যোগে ব্যাপক উন্নয়নমূলক কাজ হয়েছে। তবে এখন হাতিয়া উন্নয়নের ছোঁয়া থেকে বঞ্চিত। এখানে নদীভাঙন বড় সমস্যা, বিদ্যুৎ সমস্যার পাশাপাশি রয়েছে দস্যুদের দৌরাত্ম্য। যদি সুযোগ হয়, আবার সংসদ সদস্য নির্বাচিত হতে পারি তাহলে এলাকাবাসীর জন্য কাজ করব।’

দল থেকে, নাকি স্বতন্ত্র প্রার্থী হবেন—জানতে চাইলে ফজলুল আজিম বলেন, ‘ভোট করব, এটা নিশ্চিত। তবে দল থেকে, নাকি স্বতন্ত্র—এ মুহূর্তে বলা যাবে না।’

হাতিয়ার বাসিন্দা নোয়াখালী জেলা বিএনপির যুগ্ম সম্পাদক ফজলুল হক খোকন বলেন, ‘সাবেক সংসদ সদস্য ফজলুল আজিমই ধানের শীষ প্রতীক নিয়ে নির্বাচন করবেন। সে বিষয়ে দলীয়ভাবে ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে। আশা করি দল তাঁকে মনোনয়ন দেবে।’

এদিকে জেলা বিএনপির সহসভাপতি ও দলের হাতিয়া উপজেলা শাখার সভাপতি মো. আলাউদ্দিনের দলীয় কর্মকাণ্ডে লক্ষণীয় উপস্থিতি রয়েছে।

বিএনপির নেতাকর্মীরা জানায়, হাতিয়া উপজেলা, পৌরসভা, ইউনিয়ন ও প্রতিটি ওয়ার্ডে বিএনপির কমিটি গঠিত হয়েছে। একসময় স্থানীয় বিএনপি নেতৃত্বশূন্য হয়ে পড়লেও বর্তমানে অনেকটা শক্তিশালী। ধানের শীষের অসংখ্য ভোটার রয়েছে। এখন প্রয়োজন মাঠপর্যায়ে ভোটারদের সংগঠিত করা।

আলাউদ্দিন বলেন, ‘বিএনপির দুর্দিনে আমি নেতৃত্বের হাল ধরেছি। তাই আশা করি, দল আমাকে মনোনয়ন দেবে।’

জাতীয় পার্টি : জাতীয় পার্টি থেকে অ্যাডভোকেট বায়েজিদ নির্বাচন করবেন বলে জানিয়েছেন দলের নোয়াখালী জেলা শাখার যুগ্ম আহ্বায়ক অহিদ উদ্দিন মুকুল। তবে এলাকায় বায়েজিদের কোনো কাজ চোখে পড়েনি, প্রচার-প্রচরণাও দেখা যায়নি।

Print Friendly, PDF & Email

     এ ক্যাটাগরীর আরো খবর