ঢাকা ০৫:০৪ অপরাহ্ন, রবিবার, ২২ ডিসেম্বর ২০২৪, ৮ পৌষ ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

হাওরে শ্রমিকের অভাবে কাটতে পারছেন না পাকা ধান

  • Reporter Name
  • আপডেট টাইম : ০২:০৮:৩২ অপরাহ্ন, বৃহস্পতিবার, ৩ মে ২০১৮
  • ৩৭০ বার

হাওর বার্তা ডেস্কঃ কষ্টের ফলান্যা ধান। জমিতে পাইক্কা পড়তাছে। কাটবার লোক নাই। আসমানে সাজ করলে ঐ বুক ধড়ফড় করে। কোনো সময় জানি দুর্যোগ নাইম্যা আসে। দুশ্চিন্তায় রাইতে ঘুমাইতে পারি না। মুখে হতাশার ছাপ নিয়ে কথাগুলো বলছিলেন বানিয়াচং দৌলতপুর গ্রামের কৃষক অলি মিয়া। গত বোরো মৌসুমে অকাল বন্যায় সর্বস্ব হারিয়ে অনেকটা নিস্ব কৃষক অলি মিয়া। অনাহারে-অর্ধাহারে কোন রকমে চালিয়েছেন ৫ সদস্যের সংসার। তারপরও আবার আশায় বুক বেঁধেছেন এ কৃষক। ধার-কর্জ করে চাষ করেছেন ৮ একর জমি। বাম্পার ফলনও হয়েছে জমিতে। এতে অনেকটাই খুশি তিনি। ভাবছেন এবার অন্তত ধান উত্তোলন করে গত বছরের ক্ষতি পুষিয়ে নিতে পারবেন।

কিন্তু তার এ ভাবনায় বাদ সেধেছে তীব্র শ্রমিক সংকট। শ্রমিকের অভাবে কাটতে পারছেন না পাকা ধান। তারপর আবার বন্যা ও শিলাবৃষ্টির ভয়ে আতঙ্কে দিন কাটছে তার। শুধু কাছন মিয়া নয়, এ এলাকার অধিকাংশ কৃষকরাই এখন শ্রমিক সংকটে ধান উত্তোলন করতে পারছেন না। নিজেরা একটু আধটু করে কাটছেন ক্ষেতের ধান। কিন্তু এতে এগুচ্ছে না ধান উত্তোলনের কাজ। পার্শ্ববর্তী নোয়াগাঁও গ্রামের কৃষক রুস্তম আলী জানান, ‘অনেক কষ্টে ধান ফলাইছি। এখন কামলার লাগি ধান কাটতে ফারতাছিনা। দিনদিন কামলার সংকট বাড়তাছে। সরকার খালি কয় উন্নত ধান কাটার মেশিন আইব। কিন্তু আমরার এলাকায়তো একটা মেশিনও আইল না। অখন লোকের অভাবে আমরার পাকনা ধান ঝইড়া পড়তাছে”।

একই গ্রামের কৃষানী মরিয়ম বিবি জানান, “আমরা গরিবের আর শান্তি নাই। খগল বছরঐ একটা না একটা সমস্যা অইবই। গতবার নিল বন্যায় আর ইবারতো কাটবার মানুষঐ নাই। কোন সময় কোনো গজব আয় এই ভয়েঐ দিন-রাত কাটতাছে। ইবার যদি ধান তুলতে না ফারি তাঐলে না খাইয়া মরণ ছাড়া আর কোনো ফত তাকত না” সরেজমিনে বানিয়াচং উপজেলার নোয়াগাঁও, দৌলতপুর, হারনি, মার্কুলী, রত্না বলাকিপুরসহ বিভিন্ন এলাকা ঘুরে দেখা যায় একই চিত্র। অধিকাংশ এলাকায় শ্রমিক সংকটের কারণে ব্যাহত হচ্ছে বোরো ধান সংগ্রহের কাজ। বাধ্য হয়ে অনেক পরিবারের নারী-পুরুষ সকলে মিলে চেষ্টা করছেন ধান কাটা ও সংগ্রহের।

তবে চলমান বৈরি আবহাওয়া ও টানা বর্ষণে মারাত্মক ব্যাহত হচ্ছে ধান কাটার কাজ। এলাকার স্থানীয় কৃষকরা জানান, কৃষি বিভাগ থেকে বিভিন্ন এলাকায় আধুনিক ধান কাটার মেশিন সরবরাহের কথা বলা হলেও বাস্তবে এসব মেশিনের দেখা মিলছেনা। এছাড়া সরকার ৭৫% ভর্তুকী দিয়ে ধান কাটার রিপার বিতরণের উদ্যোগ নিলেও প্রকৃত কৃষকরা এ সুবিধা পাচ্ছেন না। কৃষি বিভাগের কর্মকর্তা ও স্থানীয় ক্ষমতাসীন দলের নেতাদের অবৈধ সুবিধা প্রদান করে গোটা কয়েক লোক এ মেশিন ক্রয় করেছেন। ফলে এর সুফল পাচ্ছেন না তৃণমূল কৃষকরা। সাধারণ কৃষকরা অতিরিক্ত টাকা দিতেও পারেনি, মেশিনও পায়নি।

শ্রমিক সমস্যা রয়েছে জেলার অন্য উপজেলায়ও। আজমিরীগঞ্জ উপজেলার শিবপাশা, পশ্চিমবাক, বিরাট, জলসুখা, বদলপুরসহ বিভিন্ন গ্রাম ঘুরে দেখা গেছে একই চিত্র। প্রতিটি এলাকায় রয়েছে তীব্র শ্রমিক সংকট। শ্রমিকের অভাবে বিলম্বিত হচ্ছে ধান সংগ্রহের কাজ। জলসুখা গ্রামের কৃষক নুরুল আমীন জানান, “এ বছর জমি করেছিলাম ২০ কেদার। মাশাআল্লাহ ফলনও হইছে খুব ভালো। কিন্তু কাটবার লোকের বড় অভাব। যেভাবে ঝড় বৃষ্টি অইতাছে, বুক ধরফর করে কোনো সময় জানি বিপদ আয়। ইবার ধান না ফাইলে আর বাচবার উফায় নাই”। এলাকা ঘুরে চোখে পড়ে কৃষকদের মুখে হতাশার ছাপ। পাকা ধান না কাটতে পেরে অনেকের মনেই রয়েছে অজানা শঙ্কা। সকলের মনেই একই চিন্তা কিভাবে জমির পাকা ধান সংগ্রহ করা যায়।

হবিগঞ্জ কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর সূত্রে জানা যায়, জেলায় এবার বোরো ধান আবাদের লক্ষ্যমাত্রা ছিল এক লাখ ১৫ হাজার ৭৪ হেক্টর জমি। কিন্তু এ লক্ষ্যমাত্রা ছাড়িয়ে এক লাখ ২১ হাজার ৪৩০ হেক্টর জমিতে চাষ করা হয়েছে। জেলায় মোট উৎপাদন লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছে ৬ লাখ ৬০ হাজার টন ধান। বোরো চাষে  এবার বাম্পার ফলনের ফলে লক্ষ্যমাত্রা ছাড়িয়ে যাওয়ার আশা করছে কৃষি বিভাগ। তাদের মতে এ লক্ষ্যমাত্রা অর্জন অনেকটা সাফল্যের।
জেলা উপসহকারী কৃষি কর্মকর্তা মো. জিয়াউর রহমান মানব জমিনকে জানান, শুধু  চুনারুঘাট উপজেলা ছাড়া বাকী ৮ উপজেলায়ই পুরোদমে চলছে ধান কাটার কাজ।

তবে এ বছর হবিগঞ্জে ধান কাটার শ্রমিক সংকট রয়েছে। সেজন্য সরকারের পক্ষ থেকে ৭৫% ভর্তুকি দিয়ে ধান কাটার রিপার বিতরণ করা হচ্ছে পুরো জেলায়। স্থানীয় শ্রমিকরা এলাকায় চলে যাওয়ায় এ সংকট দেখা দিয়েছে। স্থানীয়রা সবাই নিজ এলাকায় ফিরে আসলে সেই অভাব থাকবে না বলেও আশাবাদী তিনি। হবিগঞ্জ কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপপরিচালক মোহাম্মদ আলী সাংবাদিকদের জানান, শ্রমিক সংকটের কারণে ধান কাটার কাজ কিছুটা বিলম্বিত হলেও আমরা আশা করছি এ সংকট কেটে যাবে। দ্রুত গতিতে ধান কাটার জন্য আমরা জেলায় ৪৫ টি কম্বাইন্ড হারভেষ্টার মেশিন দিয়েছি। যা দিয়ে দ্রুত গতিতে ধান কেটে একবারে বস্তাবন্দি করা সম্ভব। এছাড়া জেলায় ১৫০টি ধান কাটার রিপার প্রদান করেছি। এতে শ্রমিক সংকট মোকাবেলা করে ধান কাটা এগিয়ে চলছে। বড় ধরণের কোন প্রাকৃতিক দুর্যোগ দেখা না দিলে এ বছর হবিগঞ্জ জেলায় লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে বেশি ধান উ’পাদন হবে।

Tag :

Write Your Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Save Your Email and Others Information

About Author Information

Haor Barta24

হাওরে শ্রমিকের অভাবে কাটতে পারছেন না পাকা ধান

আপডেট টাইম : ০২:০৮:৩২ অপরাহ্ন, বৃহস্পতিবার, ৩ মে ২০১৮

হাওর বার্তা ডেস্কঃ কষ্টের ফলান্যা ধান। জমিতে পাইক্কা পড়তাছে। কাটবার লোক নাই। আসমানে সাজ করলে ঐ বুক ধড়ফড় করে। কোনো সময় জানি দুর্যোগ নাইম্যা আসে। দুশ্চিন্তায় রাইতে ঘুমাইতে পারি না। মুখে হতাশার ছাপ নিয়ে কথাগুলো বলছিলেন বানিয়াচং দৌলতপুর গ্রামের কৃষক অলি মিয়া। গত বোরো মৌসুমে অকাল বন্যায় সর্বস্ব হারিয়ে অনেকটা নিস্ব কৃষক অলি মিয়া। অনাহারে-অর্ধাহারে কোন রকমে চালিয়েছেন ৫ সদস্যের সংসার। তারপরও আবার আশায় বুক বেঁধেছেন এ কৃষক। ধার-কর্জ করে চাষ করেছেন ৮ একর জমি। বাম্পার ফলনও হয়েছে জমিতে। এতে অনেকটাই খুশি তিনি। ভাবছেন এবার অন্তত ধান উত্তোলন করে গত বছরের ক্ষতি পুষিয়ে নিতে পারবেন।

কিন্তু তার এ ভাবনায় বাদ সেধেছে তীব্র শ্রমিক সংকট। শ্রমিকের অভাবে কাটতে পারছেন না পাকা ধান। তারপর আবার বন্যা ও শিলাবৃষ্টির ভয়ে আতঙ্কে দিন কাটছে তার। শুধু কাছন মিয়া নয়, এ এলাকার অধিকাংশ কৃষকরাই এখন শ্রমিক সংকটে ধান উত্তোলন করতে পারছেন না। নিজেরা একটু আধটু করে কাটছেন ক্ষেতের ধান। কিন্তু এতে এগুচ্ছে না ধান উত্তোলনের কাজ। পার্শ্ববর্তী নোয়াগাঁও গ্রামের কৃষক রুস্তম আলী জানান, ‘অনেক কষ্টে ধান ফলাইছি। এখন কামলার লাগি ধান কাটতে ফারতাছিনা। দিনদিন কামলার সংকট বাড়তাছে। সরকার খালি কয় উন্নত ধান কাটার মেশিন আইব। কিন্তু আমরার এলাকায়তো একটা মেশিনও আইল না। অখন লোকের অভাবে আমরার পাকনা ধান ঝইড়া পড়তাছে”।

একই গ্রামের কৃষানী মরিয়ম বিবি জানান, “আমরা গরিবের আর শান্তি নাই। খগল বছরঐ একটা না একটা সমস্যা অইবই। গতবার নিল বন্যায় আর ইবারতো কাটবার মানুষঐ নাই। কোন সময় কোনো গজব আয় এই ভয়েঐ দিন-রাত কাটতাছে। ইবার যদি ধান তুলতে না ফারি তাঐলে না খাইয়া মরণ ছাড়া আর কোনো ফত তাকত না” সরেজমিনে বানিয়াচং উপজেলার নোয়াগাঁও, দৌলতপুর, হারনি, মার্কুলী, রত্না বলাকিপুরসহ বিভিন্ন এলাকা ঘুরে দেখা যায় একই চিত্র। অধিকাংশ এলাকায় শ্রমিক সংকটের কারণে ব্যাহত হচ্ছে বোরো ধান সংগ্রহের কাজ। বাধ্য হয়ে অনেক পরিবারের নারী-পুরুষ সকলে মিলে চেষ্টা করছেন ধান কাটা ও সংগ্রহের।

তবে চলমান বৈরি আবহাওয়া ও টানা বর্ষণে মারাত্মক ব্যাহত হচ্ছে ধান কাটার কাজ। এলাকার স্থানীয় কৃষকরা জানান, কৃষি বিভাগ থেকে বিভিন্ন এলাকায় আধুনিক ধান কাটার মেশিন সরবরাহের কথা বলা হলেও বাস্তবে এসব মেশিনের দেখা মিলছেনা। এছাড়া সরকার ৭৫% ভর্তুকী দিয়ে ধান কাটার রিপার বিতরণের উদ্যোগ নিলেও প্রকৃত কৃষকরা এ সুবিধা পাচ্ছেন না। কৃষি বিভাগের কর্মকর্তা ও স্থানীয় ক্ষমতাসীন দলের নেতাদের অবৈধ সুবিধা প্রদান করে গোটা কয়েক লোক এ মেশিন ক্রয় করেছেন। ফলে এর সুফল পাচ্ছেন না তৃণমূল কৃষকরা। সাধারণ কৃষকরা অতিরিক্ত টাকা দিতেও পারেনি, মেশিনও পায়নি।

শ্রমিক সমস্যা রয়েছে জেলার অন্য উপজেলায়ও। আজমিরীগঞ্জ উপজেলার শিবপাশা, পশ্চিমবাক, বিরাট, জলসুখা, বদলপুরসহ বিভিন্ন গ্রাম ঘুরে দেখা গেছে একই চিত্র। প্রতিটি এলাকায় রয়েছে তীব্র শ্রমিক সংকট। শ্রমিকের অভাবে বিলম্বিত হচ্ছে ধান সংগ্রহের কাজ। জলসুখা গ্রামের কৃষক নুরুল আমীন জানান, “এ বছর জমি করেছিলাম ২০ কেদার। মাশাআল্লাহ ফলনও হইছে খুব ভালো। কিন্তু কাটবার লোকের বড় অভাব। যেভাবে ঝড় বৃষ্টি অইতাছে, বুক ধরফর করে কোনো সময় জানি বিপদ আয়। ইবার ধান না ফাইলে আর বাচবার উফায় নাই”। এলাকা ঘুরে চোখে পড়ে কৃষকদের মুখে হতাশার ছাপ। পাকা ধান না কাটতে পেরে অনেকের মনেই রয়েছে অজানা শঙ্কা। সকলের মনেই একই চিন্তা কিভাবে জমির পাকা ধান সংগ্রহ করা যায়।

হবিগঞ্জ কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর সূত্রে জানা যায়, জেলায় এবার বোরো ধান আবাদের লক্ষ্যমাত্রা ছিল এক লাখ ১৫ হাজার ৭৪ হেক্টর জমি। কিন্তু এ লক্ষ্যমাত্রা ছাড়িয়ে এক লাখ ২১ হাজার ৪৩০ হেক্টর জমিতে চাষ করা হয়েছে। জেলায় মোট উৎপাদন লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছে ৬ লাখ ৬০ হাজার টন ধান। বোরো চাষে  এবার বাম্পার ফলনের ফলে লক্ষ্যমাত্রা ছাড়িয়ে যাওয়ার আশা করছে কৃষি বিভাগ। তাদের মতে এ লক্ষ্যমাত্রা অর্জন অনেকটা সাফল্যের।
জেলা উপসহকারী কৃষি কর্মকর্তা মো. জিয়াউর রহমান মানব জমিনকে জানান, শুধু  চুনারুঘাট উপজেলা ছাড়া বাকী ৮ উপজেলায়ই পুরোদমে চলছে ধান কাটার কাজ।

তবে এ বছর হবিগঞ্জে ধান কাটার শ্রমিক সংকট রয়েছে। সেজন্য সরকারের পক্ষ থেকে ৭৫% ভর্তুকি দিয়ে ধান কাটার রিপার বিতরণ করা হচ্ছে পুরো জেলায়। স্থানীয় শ্রমিকরা এলাকায় চলে যাওয়ায় এ সংকট দেখা দিয়েছে। স্থানীয়রা সবাই নিজ এলাকায় ফিরে আসলে সেই অভাব থাকবে না বলেও আশাবাদী তিনি। হবিগঞ্জ কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপপরিচালক মোহাম্মদ আলী সাংবাদিকদের জানান, শ্রমিক সংকটের কারণে ধান কাটার কাজ কিছুটা বিলম্বিত হলেও আমরা আশা করছি এ সংকট কেটে যাবে। দ্রুত গতিতে ধান কাটার জন্য আমরা জেলায় ৪৫ টি কম্বাইন্ড হারভেষ্টার মেশিন দিয়েছি। যা দিয়ে দ্রুত গতিতে ধান কেটে একবারে বস্তাবন্দি করা সম্ভব। এছাড়া জেলায় ১৫০টি ধান কাটার রিপার প্রদান করেছি। এতে শ্রমিক সংকট মোকাবেলা করে ধান কাটা এগিয়ে চলছে। বড় ধরণের কোন প্রাকৃতিক দুর্যোগ দেখা না দিলে এ বছর হবিগঞ্জ জেলায় লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে বেশি ধান উ’পাদন হবে।