হাওর বার্তা ডেস্কঃ রোহিঙ্গাদের দুর্দশা দেখে কাঁদলেন কক্সবাজার সফররত জাতিসংঘ নিরাপত্তা পরিষদের প্রতিনিধি। আজ রবিবার উখিয়ার কুতুপালং শরণার্থী শিবির পরিদর্শনে গিয়ে রোহিঙ্গাদের সঙ্গে কথা বলার একপর্যায়ে এ আবেগঘন মুহূর্তের সৃষ্টি হয়। এ সময় রোহিঙ্গারা তাদের ওপর চালানো মিয়ানমার সেনাবাহিনীর নৃশংসতার ভয়াবহ বর্ণনা তুলে ধরেন। একইসঙ্গে মিয়ানমারের নাগরিকত্ব নিয়েই নিজেদের দেশে ফেরার দাবি জানান। আজ রবিবার দুপুরে রোহিঙ্গাদের পরিস্থিতি দেখতে সফররত জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদের প্রতিনিধি দল কুতুপালং শরণার্থী শিবির পরিদর্শন করেন। তারা ক্যাম্প ঘুরে ঘুরে রোহিঙ্গাদের সঙ্গে কথা বলেন।
এর আগে সকাল সাড়ে ৯টায় প্রতিনিধি দলটি বাংলাদেশ-মিয়ানমার সীমান্তের তুমব্রু শূন্যরেখায় আশ্রিত রোহিঙ্গাদের পরিদর্শন করেন।
বাংলাদেশের পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী শাহরিয়ার আলম, সরকারি পদস্থ ও বিভিন্ন সংস্থার কর্মকর্তারা জাতিসংঘের প্রতিনিধি দলের সঙ্গে আছেন।
৩০ সদস্যের প্রতিনিধি দলে জাতিসংঘে নিযুক্ত যুক্তরাজ্যের স্থায়ী প্রতিনিধিসহ ১০ জন স্থায়ী এবং পাচঁজন উপ-স্থায়ী প্রতিনিধি রয়েছেন। দলটির নেতৃত্ব দিচ্ছেন নিরাপত্তা পরিষদে পেরুর স্থায়ী প্রতিনিধি, যিনি একইসঙ্গে নিরাপত্তা পরিষদের সভাপতিও।
এর আগে শনিবার বিকাল সাড়ে চারটা নাগাদ কুয়েত থেকে সরাসরি একটি চার্টার বিমানে করে ৩০ জনের প্রতিনিধি দলটি কক্সবাজার বিমানবন্দর পৌঁছায়। এ সময় পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মেরিটাইম অ্যাফেয়ার্স ইউনিটের সচিব খোরশেদ আলম তাদের স্বাগত জানান। এই প্রথমবারের মতো জাতিসংঘ নিরাপত্তা পরিষদের কোনো প্রতিনিধি দল বাংলাদেশ সফর করছে।
রবিবার বিকালের মধ্যেই ঢাকায় ফিরবেন তারা। সোমবার প্রতিনিধি দলটি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গে সৌজন্য সাক্ষাৎ করবেন। একইদিন বিকালে তারা মিয়ানমারের রাজধানী নেপিদোর উদ্দেশ্যে ঢাকা ছাড়বেন।
মিয়ানমার সরকারের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের সঙ্গে রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন নিয়ে আলোচনা করবে প্রতিনিধি দলটি। পরে বিশেষ হেলিকপ্টারে করে তারা রোহিঙ্গা অধ্যুষিত রাখাইনের ক্ষতিগ্রস্ত এলাকাও পরিদর্শন করবেন।
নিরাপত্তা পরিষদের প্রতিনিধিদের সফরে আশাবাদী স্থানীয়রা
রোহিঙ্গা সংকটকে কেন্দ্র করে জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদের স্থায়ী প্রতিনিধিদের বাংলাদেশ সফরে আশাবাদী কক্সবাজারের স্থানীয় বাসিন্দারা। তাদের এই সফরের পর জাতিসংঘের কার্যকর উদ্যোগে রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন আলোর মুখ দেখবে বলে প্রত্যাশা করছেন তারা।
একইসঙ্গে মিয়ানমার থেকে প্রাণ বাঁচাতে আগত লাখ লাখ রোহিঙ্গার চাপে স্থানীয়ভাবে সৃষ্ট নানা সমস্যার কথা জাতিসংঘের প্রতিনিধি দলের সামনে তুলে ধরতে সরকারের প্রতি আহ্বান জানিয়েছেন। স্থানীয় জনগণের চাওয়াকে মাথায় রেখে প্রতিনিধি দলের এ সফরকে ঘিরে সরকারও তৎপর রয়েছে বলে জানিয়েছে কক্সবাজার জেলা প্রশাসন।
কক্সবাজারের উখিয়া-টেকনাফের বিভিন্ন শরণার্থী শিবিরে আশ্রয় নেয়া ১১ লাখ রোহিঙ্গার চাপে নানামুখী সমস্যায় পড়েছে স্থানীয়রা। এমনকি অনেকের চাষের জমিও চলে গেছে রোহিঙ্গা অস্থায়ী শিবিরের আওতায়। এছাড়া পরিবেশে বিরূপ প্রভাব পড়ার পাশাপাশি স্থানীয় বাসিন্দাদের সামাজিক, অর্থনৈতিকসহ দৈনন্দিন জীবনে নানা রকম চাপ তৈরি হয়েঢছে। এ অবস্থায় রোহিঙ্গাদের দ্রুত তাদের নিজ দেশে ফেরত পাঠানোর দাবি তাদের।
রোহিঙ্গা সংকটের শুরু থেকে সরকার তাদের ফেরত পাঠাতে নানা তৎপরতা অব্যাহত রাখলেও এখনও আলোর মুখ দেখেনি রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন। তবে প্রথমবারের মতো জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদের প্রতিনিধিদের কক্সবাজার সফরে এবার কার্যকর কোনও উদ্যোগ নেওয়া হবে বলেই স্থানীয়রা মনে করছেন।
প্রসঙ্গত, শতকের পর শতক ধরে রাখাইন রাজ্যে বসবাসকারী রোহিঙ্গাদের নাগরিকত্বের স্বীকৃতি দেয় না মিয়ানমার। গত চার দশক ধরে নিজেদের রাজ্যেও তাদের চলাচলের অধিকার ছিল সীমিত। এমনকি দেশটির শিক্ষা, চাকরি ও স্বাস্থ্য সেবায়ও তাদের প্রবেশাধিকার নেই।
১৯৮২ সালে মিয়ানমারের নাগরিকত্ব আইনে রোহিঙ্গাদের দেশটির নাগরিক হিসেবে অস্বীকার করে দেশটির তৎকালীন সামরিক সরকার। তখন থেকে নিজভূমে সেনাবাহিনী ও বৌদ্ধ জাতীয়তাবাদীদের হাতে নানাভাবে নিপীড়নের শিকার হতে থাকে রোহিঙ্গারা।
সর্বশেষ ২০১৭ সালের আগস্টে রাখাইন রাজ্যে একটি নিরাপত্তা চৌকিতে হামলার কথিত অভিযোগ তুলে সেনা অভিযানের নামে নৃশংসতা শুরু হলে লাখ লাখ রোহিঙ্গা পালিয়ে বাংলাদেশে আশ্রয় নেয়। এদের সংখ্যা ১১ লাখ ছাড়িয়ে যায়। বাংলাদেমে আসা এসব রোহিঙ্গাদের আশ্রয় হয়েছে কক্সবাজারে উখিয়া উপজেলার বিভিন্ন ক্যাম্পে।
জাতিসংঘ বলেছে, কথিত ওই হামলার আগে থেকেই সেখানে রোহিঙ্গাবিদ্বেষী প্রচারণা চলছে। বিশ্ব সংস্থাটি রোহিঙ্গা নিধনের বর্বর ঘটনাকে পাঠ্যপুস্তকের জন্য ‘জাতিগত নির্মূলের’ একটি উদাহরণ বলেও অভিহিত করেছে। আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংস্থা অ্যামনেস্টির এক প্রতিবেদনেও ‘রোহিঙ্গা নিধনযজ্ঞের সামরিক প্রচারণা’কে সেখানকার সংকটের জন্য দায়ী করা হয়েছে।
রোহিঙ্গাদের স্রোত শুরু হওয়ার পর বিষয়টি জাতিসংঘে বাংলাদেশ তোলে। আন্তর্জাতিক চাপের মুখেও প্রথমে রোহিঙ্গা নির্যাতনের কথা স্বীকার না করলেও পরে ‘কিছু হত্যার’ বিষয়টি স্বীকার করেন দেশটির সেনাপ্রধান।
এ পরিপ্রেক্ষিতে বাংলাদেশে আশ্রয় নেয়া রোহিঙ্গাদের ফিরিয়ে দিতে মিয়ানমারের সঙ্গে প্রথমে সমঝোতা স্মারক এবং পরে ফিজিক্যাল অ্যারাঞ্জমেন্ট নামে চুক্তিও হয়েছে। প্রত্যাবাসনের প্রথম ধাপ হিসেবে গত ১৬ ফেব্রুয়ারি মিয়ানমারকে আট হাজার ৩২ জন রোহিঙ্গার তালিকাও দেয়া হয়। যদিও মিয়ানমার কর্তৃপক্ষ যাচাই বাছাইয়ের নামে সেখান থেকে মাত্র তিনশ জনের মতো রোহিঙ্গাকে তাদের নাগরিক বলে দাবি করে।
মিয়ানমার রোহিঙ্গাদেরকে ফিরিয়ে না নিয়ে নানা তালবাহানা করছে- একথা জানিয়েছেন খোদ প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। এই বাস্তবতায় রোহিঙ্গাদের জন্য মানসম্পন্ন আশ্রয় প্রকল্প নির্মাণে সরকারকে বিপুল অংকের টাকাও ব্যয় করতে হচ্ছে।