নিখোঁজ বা অন্তর্ধান হয়ে যাওয়ার ঘটনা বিশেষ করে রাজনৈতিক নেতাদের বেলায় নতুন নয়। প্রতিবেশী দেশ ভারতেও এর নজির রয়েছে।
ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলনের অন্যতম নেতা নেতাজি সুভাষ বোসের অন্তর্ধান রহস্য গত ৭০ বছরেও অমীমাংসিত।তবে নেতাজি সুভাষ বোসের জন্য আজো চোখে পানি ফেলছে ভারবাসী।এদিক থেকে বাংলাদেশর রাজনীতিকরা ব্যতিক্রম।
সুভাষ বোসের অন্তর্ধান দিবসে আজো ভারতের পত্রপত্রিকাগুলো সরব হয়ে ওঠে। এ নিয়ে প্রচুর লেখা-লেখি হয়। নানা বিশ্লেষণমূলক প্রতিবেদনও ছাপা হয়।
অন্তর্ধান নিয়ে বাংলাদেশের রাজনীতিকদের মিল থাকলেও অমিল রয়েছে অনেক দিক থেকেই।
দীর্ঘ ৬২ দিন নিখোঁজ থাকার পর বিএনপির যুগ্ন মহাসচিব সালাহ উদ্দিন আহমদকে খুঁজে পাওয়া গেলেও তার অন্তর্ধান নিয়ে রহস্য ধীরে ধীরে আরো ঘনীভূত হচ্ছে।
৬২ দিন পর সালাহ উদ্দিনকে প্রতিবেশি দেশে পাওয়া গেলেও তিন বছরের বেশি সময় পার হলেও ইলিয়াস আলীর অন্তর্ধান রহস্যের কোনো কিনারা হয়নি আজো।
রহস্য জট খোলেনি চৌধুরী আলমের অন্তর্ধান রহস্যও। এর আগে চট্টগ্রামে বিএনপি নেতা নির্বাচনে মনোনয়ন চাওয়ায় চৌধুরী জামাল উদ্দিনের অন্তর্ধান রহস্যের জট দুই বছর পর হলেও খুলেছিল।তবে তা নিয়েও যে কানাঘুষা নেই তা নয়।
দুই বছর পর গহীন জঙ্গলে পাওয়া কিছু হাড়-গোড়ের ডিএনএ পরীক্ষা করে তা জামাল উদ্দিনের বলে শনাক্ত করা হয়।
সাবেক প্রধানমন্ত্রী বেগম খালেদা জিয়ার কার্যালয়ের অত্যন্ত প্রভাবশালী নানা অভিযোগে অভিযুক্ত নেতা হারিছ চৌধুরীর অন্তর্ধান রহস্যের জট খোলেনি আজো।
গত আট বছরের বেশি সময় ধরে সাবেক প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়ার খুব কাছের লোক হিসাবে পরিচিত হারিছ চৌধুরীর খোঁজ নেই।
জোট সরকারের আমালের এই দাপুটে নেতাকে নিয়ে বিএনপিতে কোনো উদ্বেগ-উৎকণ্ঠাও নেই।তবে তিনি কোথায় আছেন কোন দেশে আছেন সে ব্যাপারে পরিষ্কার কোনো ধারণাও নেই কারো কাছে।
কেবল শোনা যায় যে তিনি কখনো যুক্তরাজ্য, কখনো যুক্তরাষ্ট্র, কখনো ইরানে, কখনো ভারতে বা কখনো ইউরোপে অবস্থান করছেন।
হাওয়া ভবনের আশীর্বাদপুষ্ট হয়ে এই হারিছ চৌধুরী পরিণত হয়েছিলেন অসীম ক্ষমতাধর নেতায়। ক্ষমতা থেকে বিএনপি জোটের বিদায়ের সঙ্গে হারিছ চৌধুরীরও নিরুদ্দেশ হয়ে যান। তার অন্তর্ধান অবস্থায়ই বেশ কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ মামলার তার বিচার চলছে।
২০০৭ সালে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সময়ে হঠাৎ তিনি নাই হয়ে যান।সামরিক বাহিনী সমর্থিত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমলে তখন হঠাৎ হঠাৎ রাজনৈতিক নেতাদের অন্তর্ধানের খবর পাওয়া যাচ্ছিল।তখন শোনা যেত অমুক নেতাকে তুলে নিয়ে যাওয়ার পর কয়েক দিন হলো খোঁজ মিলছে না।পরে প্রায় সবারই খোঁজ পাওয়া গেলেও হারিছ চৌধুরীর খোঁজ মেলেনি আজো। তবে হারিছ চৌধুরীকে তুলে নিয়ে যাওয়ার খবর অবশ্য তখন পত্রপত্রিকায় আসেনি।তাই তার অন্তর্ধান নিয়ে রহস্যের জট আজো খোলেনি।
জানা যায়, আলোচিত ওই ব্যক্তির বিরুদ্ধে একাধিক মামলা বিচারের অপেক্ষায়। বিশেষ করে ২১ আগস্ট গ্রেনেড হামলা মামলা ও সাবেক অর্থমন্ত্রী শাহ এএসএম কিবরিয়া হত্যা মামলার সম্পূরক চার্জশিটে তাকে আসামি করা হয়েছে। খালেদার জিয়ার বিরুদ্ধে বিচারাধীন জিয়া চ্যারিটেবল ট্রাস্ট দুর্নীতির মামলারও আসামি এই প্রভাবশালী নেতা। এছাড়া তার বিরুদ্ধে দুদকের মামলাও রয়েছে। এসব মামলার কারণেই তিনি দেশে ফিরছেন না বলে জানা গেছে।
খোঁজ নিয়ে জানা যায়, সেনাসমর্থিত সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকার দুর্নীতিবাজদের বিরুদ্ধে ঝটিকা অভিযান শুরু করলে আত্মগোপনে চলে যান হারিছ চৌধুরী। শোনা যায়, প্রথমে কিছুদিন হবিগঞ্জে আত্মগোপনে ছিলেন।
সে সময় দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) শীর্ষ দুর্নীতিবাজদের তালিকায় হারিছের নাম চলে আসার পরই হঠাৎ তিনি নিরুদ্দেশ হন।
শোনা যায় ২০০৭ সালে ২৯ জানুয়ারি সিলেটের জকিগঞ্জ সীমান্ত দিয়ে নানা বাড়ি ভারতের করিমগঞ্জে পাড়ি জমান হারিছ। ভারত থেকে তিনি যুক্তরাজ্যে চলে যান। এরপর সেখান থেকে ইরানে তার ভাই আবদুল মুকিত চৌধুরীর কাছে যান তিনি। আবদুল মুকিত সেখানকার একটি সরকারি হাসপাতালে চিকিৎসক হিসেবে কর্মরত। এরপর মালোয়েশিয়া ও যুক্তরাষ্ট্র হয়ে আবার ফিরে যান যুক্তরাজ্যে।
কিন্তু বর্তমানে তিনি যুক্তরাজ্যে অবস্থান করছেন কিনা তা কোনো সূত্র থেকেই নিশ্চিত হওয়া যায়নি।
অভিযোগ আছে, চারদলীয় জোট সরকারের সময় প্রভাব খাটিয়ে সিলেটের কানাইঘাটের নিজ বাড়িতে ডাকঘর, স্কুল, পুলিশ ক্যাম্প ও ব্যাংকের শাখা বসিয়েছিলেন হারিছ চৌধুরী। বাড়িতে গড়ে তুলেছিলেন মিনি চিড়িয়াখানা। সিলেটের ‘হাওয়া ভবন’ হিসেবেই পরিচিত ছিল তার বাড়ি।
২০০৭ সালে দেশ জুড়ে জরুরি অবস্থা জারির পর তার বাড়ি থেকে পাঁচটি বন্য হরিণ উদ্ধার করে বনবিভাগ। বর্তমানে ওই বাড়িটি প্রায় জনশূন্য।
ব্যক্তি জীবনে হারিছ চৌধুরীর এক ছেলে ও এক মেয়ের জনক। মেয়ে ব্যারিস্টার ও ছেলে নরওয়ে ভিত্তিক একটি তেল কোম্পানিতে কর্মরত। ওয়ান ইলেভেনের আগে স্ত্রী-সন্তানরা দেশে আসলেও এরপর আর আসেননি।
হারিছ চৌধুরীর উত্থান : ঢাকার নটর ডেম কলেজ ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র হারিছ চৌধুরী শুরুতে ছাত্রলীগের রাজনীতিতে সম্পৃক্ত ছিলেন। পরে ’৭৭ সালে জিয়াউর রহমানের ডাকে সাড়া দিয়ে যোগ দেন জাগদলে। এরপর একে একে সিলেট জেলা বিএনপির প্রথম কমিটির সাধারণ সম্পাদক, কেন্দ্রীয় যুবদলের সেক্রেটারি, সহ-সভাপতিসহ বিএনপির সাংগঠনিক সম্পাদক ও যুগ্ম মহাসচিবের দায়িত্ব পালন করেন তিনি।
১৯৭৯ ও ১৯৯১ সালের জাতীয় সংসদ নির্বাচনে সিলেট-৫ (কানাইঘাট-জকিগঞ্জ) আসনে বিএনপির প্রার্থী হিসেবে নির্বাচন করে পরাজিত হন। পরে প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়ার রাজনৈতিক সচিব হওয়ার পর অনেকটা আলাদিনের চেরাগ হাতে পেয়ে যান তিনি।
হারিছ চৌধুরীর বর্তমান অবস্থান জানতে তার চাচাতো ভাই ও কানাইঘাট পৌর মেয়র আশিক চৌধুরী সঙ্গে যোগাযোগ করা হলেও কথা বলা সম্ভভ হয়নি।