কেমন আছেন আরিফুল হক চৌধুরী?

দরজায় দাঁড়ানো পুলিশ। অনুমতি ছাড়া কারো ভেতরে ঢোকার সুযোগ নেই। দুটো বাক্যের এ বর্ণনায় যে কেউ হয়তো ভাববেন ভেতরে থাকা ব্যক্তিটি খুবই ক্ষমতাধর কেউ। তাদের ভাবনাগুলো মোটেও ঠিক নয়। ভেতরের ব্যক্তিটি ক্ষমতাধর কেউ নন। এমনকি কাউকে ভেতরে আসার অনুমতি দেয়ার ক্ষমতাটুকুও তার নেই। অফিসে কিংবা বাসায় নয়, তিনি আছেন হাসপাতালের বেডে, বন্দি হিসেবে। বাইরের পুলিশ নিরাপত্তা দিতে নয়, আছে বন্দির পাহারা হিসেবে। শরীরের অবস্থা ভীষণ রকম খারাপ তাই আছেন হাসপাতালে। নইলে কারাগারেই থাকতেন। কারণ তিনি এক হত্যা মামলায় অভিযুক্ত। ক্ষমতা তারও ছিল। ভালবেসেই সে ক্ষমতা তাকে তুলে দিয়েছিল সাধারণ জনগণ। ছিলেন সিলেট সিটি করপোরেশনের মেয়র, থাকতেনও। তবে সাবেক অর্থমন্ত্রী ও খ্যাতিমান অর্থনীতিবিদ শাহ্‌ এএমএস কিবরিয়া হত্যা মামলায় অভিযুক্ত হওয়ায় সাময়িকভাবে সে পরিচয় হারাতে হয়েছে তাকে। কারাবন্দি হিসেবে আরিফুল হক চৌধুরীর দিন এখন কাটছে ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের ৪৭ নং কেবিনে। অসুস্থ শরীর নিয়ে হাসপাতালের বিছানায় একদম একা নিঃসঙ্গ দিন কাটছে তার। কেউ আসেন না, খোঁজও নেন না। না তার দলের কেউ, না তার ‘শুভাকাঙ্ক্ষী’-কেউই হাসপাতালের পথ মাড়ান না। অথচ আরিফুল হক চৌধুরী যখন নগর ভবনে মেয়রের চেয়ারজুড়ে বসতেন তার কাছাকাছি অসংখ্য মুখের আনাগোনা ছিল। কেউ কারণে, কেউ অকারণেই ভিড় করতেন তার পাশে। আরিফুল হক চৌধুরীর স্ত্রী শামা হক চৌধুরী জানান, গত এক মাসের মধ্যে কেউই দেখতে যাননি তার স্বামীকে।
শরীরের অবস্থাও খুব একটা ভাল নয় আরিফুল হক চৌধুরীর। গায়ে টি-শার্ট আর ক্যাজুয়াল প্যান্ট-সাদাসিধে এমন পোশাকে যিনি পুরো নগর দাপিয়ে বেড়িয়েছেন-হয়তো আর কোনদিন হাঁটতেই পারবেন না তিনি। চিকিৎসকদের আশঙ্কা যথাযথ চিকিৎসা না হলে পঙ্গুত্ব অপেক্ষা করছে তার জন্য। তার চিকিৎসার জন্য গঠিত হাসপাতালের জরুরি মেডিক্যাল বোর্ড পরীক্ষা-নিরীক্ষার পরই এমন আশঙ্কা করছে। মস্তিষ্কের উন্নত স্ক্যানের (এমআরআই) পর আরিফুল হকের মাথা ও মেরুদণ্ডের মাঝামাঝি স্থানে কয়েকটি ফাটল ধরা পড়েছে। ফাটলগুলো যে কোন মুহূর্তেই ঝুঁকির কারণ হয়ে উঠতে পারে। আরিফুল হকের মাথা ও মেরুদণ্ডে এ ফাটলগুলো অবশ্য হঠাৎ করেই হয়নি। ১৬ বছর আগের পুরনো এক আঘাতের যন্ত্রণা অনেকদিন ধরেই বয়ে বেড়াচ্ছিলেন তিনি। ১৯৯৯ সালের ২০শে সেপ্টেম্বর ঢাকা থেকে প্লেনে চেপে সিলেট আসার কথা ছিল আরিফুল হকের। বিমানবন্দর আসার পথে দুর্ঘটনার মুখে পড়ে তাকে বহনকারী গাড়িটি। মারাত্মক আহত হন আরিফুল হক। বেঁচে যে ফিরবেন- এমনটি কেউই আশা করেননি। নেহায়েত ভাগ্যের জোরেই বেঁচে ফিরেছিলেন তিনি। তখনই তিনি মাথা-ঘাড়ে-মেরুদণ্ডে প্রচণ্ড আঘাত পেয়েছিলেন। উন্নত চিকিৎসার কারণে আঘাতগুলো চাপাই ছিল এতোদিন। কারাগারে বন্দি জীবন, সুচিকিৎসার অভাব আর মামলা সংক্রান্ত টানা-হেঁচড়ার কারণে পুরনো সেই আঘাতই আবার মাথাচাড়া দিয়ে উঠেছে। তার উপর ডায়াবেটিস আর অতি উচ্চরক্তচাপের (হাইপার টেনশন) ধকল শরীর যেন সইতে পারছে না। সব মিলিয়ে মোটেও ভাল নেই আরিফুল হক চৌধুরী- যাকে সিলেটের বাসিন্দারা ভালবেসে নগরীর অভিভাবক হিসেবে বেছে নিয়েছিলেন।
একদিকে আরিফুল হক চৌধুরী বন্দি হিসেবে হাসপাতালের বিছানায়। অন্যদিকে একমাত্র ছেলের চিন্তায় শয্যাশায়ী মা আমিনা খাতুনও। এমনিতেই অসুস্থ তিনি, ছেলের ভাবনায় আরও দুর্বল হয়ে পড়েছে তাঁর বয়েসী শরীর। দিনরাত এখন শুধুই কাঁদেন তিনি। যাকে দেখেন তাকেই ছেলের কথা জিজ্ঞেস করেন, ঘুরেফিরে একটাই প্রশ্ন তার মুখে, ‘আরিফ না থাকলে আমার কি হবে?’
‘আরিফ না থাকলে আমার কি হবে?’- একই প্রশ্ন যেন সিলেট নগরীরও। আরিফুল হক চৌধুরীর অবর্তমানে ভাল নেই নগরজীবন। পথে পথে অভিভাবকহীনতার চিহ্ন। উন্নয়ন কাজ থমকে আছে। নৈমিত্তিক কাজ ছাড়া নির্বাহী ক্ষমতাধারীর তেমন কিছু করার নেই। মেয়রের অবর্তমানে তার যেটুকু করার সাধ্য রয়েছে তাও যে খুব ভালভাবে হচ্ছে এমনটি নয়। ‘পিতা’র অভাব ঠিকই বুঝছে নগরী। নাগরিক যন্ত্রণাগুলো আবারও জেগে উঠছে। এখন সন্ধ্যার আগেই নগরীর পথে-ঘাটে ময়লার স্তূপ জমে। নাক চেপে পথ পেরোনোই আবার অভ্যাস করে নিতে হচ্ছে নগরের বাসিন্দাদের। যেমন করে অভ্যাস করে নিতে হচ্ছে হকারের ফাঁক গলে পথচলার কৌশল। নাগরিক দুর্ভোগ মেটাতে আরিফুল হক চৌধুরী ফুটপাত থেকে যে হকারদের উঠিয়ে দিয়েছিলেন তারা আবার ফুটপাতে তো ফিরেই এসেছে, দখল করেছে রাজপথের অর্ধেকও। হকারদের কারণে আগে পায়ে হাঁটা মানুষেরই দুর্ভোগ পোহাতে হতো এখন গাড়িগুলোও পথে পথে থমকে যাচ্ছে। যানজট নিরসনের জন্য রাস্তায় রিকশার জন্য যে আলাদা লেনের ব্যবস্থা করেছিলেন আরিফুল হক-রক্ষণাবেক্ষণ করতে না পারার দোহাই দিয়ে তাও উঠিয়ে নেয়া হয়েছে। উদ্ধার করা ছড়া খালগুলো দখল হয়ে আবারও জলাবদ্ধতার আতঙ্ক জাগাচ্ছে নগরজীবনে।
নির্বাচিত হওয়ার আগে-পরে নগরবাসীকে যেসব স্বপ্ন দেখিয়েছিলেন আরিফুল হক চৌধুরী সে স্বপ্নগুলোও যেন ডানা ভেঙে পড়ে আছে। স্বপ্নগুলোর ডানা মেলে যখনই উড়ার কথা, তখনই কারাগারের অন্ধকার জীবনের বাসিন্দা হতে হয় আরিফুল হক চৌধুরীকে। আর তাই ওয়াইফাই নগরী, কসমোপলিটন সিটি, ভূ-গর্ভস্থ বিদ্যুৎ সরবরাহ ব্যবস্থা- থমকে আছে সবকিছুই। নিরাপত্তার জন্য গুরুত্বপূর্ণ পয়েন্টে স্থাপিত সিসি ক্যামেরাগুলোও চোখ বুজে আছে। যেন চোখ বুজলেই সবকিছু এড়িয়ে যাওয়া যায়।

Print Friendly, PDF & Email

     এ ক্যাটাগরীর আরো খবর