হাওর বার্তা ডেস্কঃ ১৯৭৫ সালের কলঙ্কিত ১৫ আগস্টের ভোরে ধানমন্ডির ৩২ নম্বরের বাড়িতে সপরিবারে নিহত বাঙালি জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের দাফন সম্পন্ন হয়েছিল ১৬ আগস্ট বিকেলে। কড়া সামরিক পাহারার মধ্যে নিভৃত পল্লী গোপালগঞ্জের টুঙ্গিপাড়ায় পিতামাতার কবরের পাশে সমাহিত হন স্বাধীনতার এই মহানায়ক। কয়েকজন প্রত্যক্ষদর্শীর বর্ণনায় জানা যায়, মাত্র দুই ঘণ্টার মধ্যে কাপড় ধোয়ার ‘৫৭০ সাবান’ দিয়ে শেষ গোসলের পর ত্রাণের সাদা শাড়ির কাফন নিয়ে সমাহিত করা হয় তাকে।
১৫ আগস্ট ভোরে নিহত হওয়ার পর সারাদিন ধানমন্ডির ৩২ নম্বর রোডের বাড়িতে পড়ে ছিল বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের মরদেহ। ১৬ আগস্ট হেলিকপ্টারে করে গোপালগঞ্জে ওই মরদেহ নিয়ে যাওয়ার দায়িত্ব পেয়েছিলেন তৎকালীন ডিজিএফআই কর্মকর্তা কাজী হায়দার আলী। পরে তিনি তার এক লেখায় জানিয়েছেন, ওইদিন দুপুর একটার দিকে ডিজিএফআই কনফারেন্স রুমে এক বৈঠকে সংস্থার মহাপরিচালক আবদুর রউফ তাকে ওই দায়িত্ব দেন। নির্দেশ ছিল তৎকালীন কুর্মিটোলা বিমানবন্দর থেকে লাশ নিয়ে দাফন শেষে সন্ধ্যার পূর্বেই তাকে ঢাকায় ফিরতে হবে।
অধ্যাপক রফিকুল ইসলাম সম্পাদিত ‘বঙ্গবন্ধু হত্যার দলিল’ শীর্ষক বইতে নিজের লেখায় কাজী হায়দার আলী এসব তথ্য জানিয়েছেন।
ওই লেখায় তিনি উল্লেখ করেছেন, ‘বঙ্গবন্ধুর নিকট আত্মীয়ের কাছে ম্যাজিস্ট্রেটের সামনে মৃতদেহ হস্তান্তর, গ্রহণ করানো এবং সই করা কাগজ ঢাকায় এনে হস্তান্তর করার দায়িত্বে কোনো অফিসার রাজি না হওয়ায় তাকেই দায়িত্ব দেন তৎকালীন ডিজিএফআই মহাপরিচালক আবদুর রউফ।’
দুপুর দুইটার দিকে কাঠের কফিনে বরফে মোড়া বঙ্গবন্ধুর মরদেহ নিয়ে কয়েকজন অফিসারকে সঙ্গে নিয়ে হেলিকপ্টারে করে রওনা হন হায়দার আলী। ওই হেলিকপ্টার চালিয়ে নিয়ে গিয়েছিলেন ফ্লাইট লে. শমসের।
টুঙ্গিপাড়া হেলিপ্যাডে পৌঁছে ম্যাজিস্ট্রেট, পুলিশ আর অন্যান্য সামরিক অফিসারদের দেখতে পান হায়দার। বঙ্গবন্ধুর বাড়িতে ঢোকার মুখে ডান দিকে কবর খুঁড়ে রাখা দেখতে পেলেও মরদেহ গ্রহণের জন্য কোনো স্বজনকেই না পাওয়ার কথা জানিয়েছেন তিনি। বঙ্গবন্ধুর বাড়িতে থাকা পোস্ট অফিসের পোস্টমাস্টার আনোয়ার হোসেন হাওলাদারের মাধ্যমে এই কবর খুঁড়ে রাখার নির্দেশ সকালেই দিয়ে রেখেছিল স্থানীয় প্রশাসন। হেলিকপ্টার থেকে মরদেহ নামানোর পরে বঙ্গবন্ধুর জ্ঞাতি চাচা পরিচয়ে ৭০ বছরের বৃদ্ধ মোশাররফ হোসেনকে পেয়ে তার কাছেই মরদেহ হস্তান্তর করেন হায়দার আলী।
এই কফিনেই বয়ে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল হাজর বছরের শ্রেষ্ঠ বাঙালি বঙ্গবন্ধুকে। ছবিটি বঙ্গবন্ধু হত্যার দলিল বই থেকে সংগৃহীত
মরদেহ হস্তান্তরের পর শুরু হয় দাফনের তোড়জোড়। কফিনসহ দাফনের প্রস্তাব দিতেই বাধা হয়ে দাঁড়ান বঙ্গবন্ধুর বাড়ির মসজিদের ইমাম মৌলভী আবদুল হালিম। এই মৌলভীর সাহসের বর্ণনা পাওয়া যায় আরেক প্রত্যক্ষদর্শী আবদুল হাই শেখের বর্ণনায়। তিনি জানান, ‘আর্মিরা মরদেহটি শিগগিরই কবর দেওয়ার নির্দেশ দিলে মৌলভী সাহেব বললেন, বঙ্গবন্ধু একজন মুসলমান, ওনাকে গোসল করাতে হবে, কাফন পরাতে হবে এবং জানাজা পড়াতে হবে, আর যদি আপনারা বলেন যে বঙ্গবন্ধু শহিদ হয়েছেন তাহলে এসবের দরকার নেই।’ শিক্ষিত এই মৌলভী নিজের ইংরেজির দক্ষতা কাজে লাগিয়ে সেনা অফিসারদের সঙ্গে এই কথোপকথনের পর বিশ মিনিট সময় পান গোসল আর দাফনের জন্য।
বরফে মোড়া বঙ্গবন্ধুর মরদেহবাহী কফিন খুলতে ব্যর্থ হয়ে ডেকে আনা হয়েছিল হালিম মিস্ত্রী আর আইয়ুব মিস্ত্রীকে। শাবল দিয়ে ওই কফিন খোলার পর বের হয়ে আসে বুলেটে ঝাঁঝরা হয়ে যাওয়া বঙ্গবন্ধুর বিশাল দেহ।
ওই মরদেহের শেষ গোসলের সময় মৌলভী আবদুল হালিমের সঙ্গে ছিলেন আব্দুল মান্নান শেখ। পরে এক স্মৃতিচারণায় তিনি বলেন, ‘বুকে ছিল তার ২৪টি গুলি। ডান হাতের তালুতে একটি, বাঁ পায়ের গোড়ার পাশে একটি, দুই রানের মধ্যখানে ছিল দুইটি গুলি।’
তিনি জানান, গোসলের আগে বঙ্গবন্ধুর গায়ের গেঞ্জি, পাঞ্জাবি, প্লেকার্ড লুঙ্গি, পাঞ্জাবির পকেটে রুমাল, তামাকের কৌটা, পাইপ, একটি তোয়ালে, একটি চাদর পাওয়া যায়। সেদিন সেনা কর্মকর্তাদের চোখ এড়িয়ে এসব সামগ্রী লুকিয়ে ফেলেছিলেন তিনি। পরে খালের পানিতে সেসব ধুয়ে নিজের সংগ্রহে রেখেছিলেন তিনি। তবে দুঃখ রয়ে গেছে তার, ধোয়ার সময় হারিয়ে ফেলেন বঙ্গবন্ধুর পরনে থাকা গেঞ্জি। বেশ কিছুদিন পর এসব সামগ্রী তিনি পাঠিয়ে দেন লন্ডনে থাকা বঙ্গবন্ধুর ছোট মেয়ে শেখ রেহানার কাছে। এসব সামগ্রী এখন প্রদশির্ত হয় বঙ্গবন্ধু স্মৃতি জাদুঘরে।
এই ঐতিহাসিক দায়িত্ব পালনের জন্য সেসময় পুলিশি হয়রানির মুখে পড়তে হয়েছিল আবদুল মান্নান শেখকে।
গোসল শেষে সেদিন বঙ্গবন্ধুর কাফনের কাপড় বানানো হয়েছিল পাশের শেখ সাহের খাতুন রেডক্রিসেন্ট হাসপাতালে রাখা রিলিফের কাপড় দিয়ে। সেসময় অজপাড়া গাঁ টুঙ্গিপাড়ায় কোনো দোকান না থাকায় বাধ্য হয়ে রিলিফের কাপড় ব্যবহার করা হয়েছিল। বঙ্গবন্ধুর মায়ের নামে প্রতিষ্ঠিত সাহের খাতুন হাসপাতালে রিলিফের কাপড়গুলো পাঠিয়েছিলেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানই।
আবদুল হাই শেখ ওই হাসপাতাল থেকে শাড়ি সংগ্রহ করে এনেছিলেন। তিনি বলেন, ‘আমি দৌড়াইয়া হাসপাতালে গিয়ে কর্মরত নার্স দিপালীকে ত্রাণের শাড়ি বের করে দিতে বললে তিনি কয়েকটি শাড়ি আমার হাতে দেন। সাথে থাকা রজ্জব আলীর হাতে কাপড়গুলো দিয়ে দুজনে দৌড়ে ফিরে আসি।’
গোসল শেষে বঙ্গবন্ধুর জানাজা পড়ানো হয়। আশেপাশের এলাকা থেকে বিপুল সংখ্যক মানুষ জানাজায় অংশ নিতে চাইলেও সামরিক বাহিনী ও পুলিশ সদস্যরা নিরাপত্তার অজুহাত দেখিয়ে তাদের কাছে ভিড়তে দেননি। শুধু দাফন কাজে সহায়তা করা ২৫-৩০ জনকে অংশ নিতে দেওয়া হয় জানাজায়। তিন লাইনে দাঁড়ানো মানুষের জানাজা নামাজের ইমামতি করেছিলেন মৌলভী আবদুল হালিম। পরে দাফন শেষে দোয়াও পরিচালনা করেছিলেন তিনি।
উল্লেখ্য, ধানমন্ডির ৩২ নম্বরের বাড়িটিতে ১৫ আগস্টের হত্যাযজ্ঞের শিকার বঙ্গবন্ধু পরিবারের অন্য সদস্যদের কড়া সামরিক পাহারার মধ্যে দাফন করা হয়েছিল রাজধানীর বনানী কবরস্থানে।
তথ্যসূত্র: বঙ্গবন্ধু হত্যার দলিল (১৯৭৬),