প্রাপ্তির স্মারক গ্রন্থে স্বর্ণালী অধ্যায়

গত বছরের শেষ দিক থেকে শুরু হয়েছিল সাফল্যের পথচলা। আর চলতি বছরে এখন অব্দি সেই সাফল্যের কক্ষপথেই রয়েছে বাংলাদেশের ক্রিকেট। গত কয়েকটি মাস যেন স্বর্ণালী অধ্যায় হয়ে রইল দেশের ক্রিকেটের জন্য। এ তো এখন অব্দি দেশের ক্রিকেট ইতিহাসের সেরা সময়ও বটে।

ক্যারিবিয়ান মাটিতে ২০১৪ সালের ২০ আগস্ট শুরু হওয়া তিন ম্যাচের ওয়ানডে সিরিজে হোয়াইটওয়াশ হতে হয়েছিল বাংলাদেশকে। একমাত্র টোয়েন্টি২০ ম্যাচটিও বৃষ্টিতে পরিত্যক্ত হয়ে যায়। এরপর ওয়েস্ট ইন্ডিজের বিপক্ষেই সেপ্টেম্বরে শুরু হওয়া দুই ম্যাচের টেস্ট সিরিজেও হোয়াইটওয়াশ হয়েছিল মুশফিকুর রহিমের দল। তবে টেস্ট সিরিজ হারলেও ওই সময়ের প্রাপ্তি ছিল তাইজুল ইসলামের মতো একজন সম্ভবনাময়ী বাঁহাতি স্পিনার দেখা পাওয়া। অভিষেক ম্যাচেই ৫ উইকেট নিয়ে সাড়া ফেলেছিলেন বাংলাদেশের এই তরুণ স্পিনার।

এই সফরের মধ্যেই বাংলাদেশের সঙ্গে সম্পৃক্ততা শুরু দলের বর্তমান প্রধান কোচ শ্রীলংকার চন্ডিকা হাথুরসিংহের। এটিও একটি পাওয়া; কেননা, হাথুরুসিংহের ছোঁয়ায় যেন আমূল পাল্টে গিয়েছে বাংলাদেশ জাতীয় ক্রিকেট দলের চেহারা।

ওয়েস্ট ইন্ডিজ সফর শেষ হওয়ার পর পরই সীমিত ওভারের ক্রিকেটে মুশফিকুর রহিমকে সরিয়ে অভিজ্ঞ মাশরাফি বিন মর্তুজাকে দ্বিতীয় মেয়াদে দেওয়া হয় অধিনায়কের দায়িত্ব। দলের সেরা ব্যাটসম্যান মুশফিকের ওপর থেকে চাপ কমাতেই ছিল এমন সিদ্ধান্ত। আর তখন থেকেই শুরু বাংলাদেশের সাফল্যের গল্প।

গত অক্টোবর-নভেম্বরে বাংলাদেশ সফর করে জিম্বাবুয়ে জাতীয় ক্রিকেট দল। এবারই বাংলাদেশ ঘরের মাঠে প্রথম ও সর্বসাকুল্যে তৃতীয়বারের মতো ৩ ম্যাচের টেস্ট সিরিজ খেলে। তিনটি ম্যাচেই জয়ী হয়ে ওয়ানডের জন্য বেশ ভাল রসদ সংগ্রহ করে টাইগাররা। টেস্ট সিরিজে নব আবিষ্কার হিসেবে দেখা দেন লেগস্পিনার জুবায়ের হোসেন লিখন।

টেস্টের পর বাংলাদেশ ৫ ম্যাচের ওয়ানডে সিরিজেও জিম্বাবুয়েকে হোয়াইটওয়াশ করে প্রতিপক্ষের সঙ্গে নিজেদের শক্তির তারতম্যটা বেশ ভালই বুঝিয়ে দেয়। মাশরাফির নেতৃত্বে টাইগারদের দেখা যায় ‘টিম বাংলাদেশ’ হয়ে উঠতে। বিশ্বকাপের আগে এটাই ছিল বাংলাদেশের শেষ ওয়ানডে সিরিজ। এই সিরিজে তরুণ অনেক ক্রিকেটারকেই পরীক্ষার আসনে বসতে হয়েছিল। নিরাশ হতে হয়নি বাংলাদেশকে। জাতীয় দল পায় একজন হার্টহিটার ব্যাটসম্যান ও দুর্দান্ত ফিল্ডার সাব্বির রহমানকে। পঞ্চম ও শেষ ওয়ানডে ম্যাচে অভিষিক্ত সৌম্য সরকার ২০ রানের এক ছোট্ট ইনিংস খেললেও দৃষ্টি কেড়ে নেন সবার; ঐ এক ম্যাচ খেলেই বিশ্বকাপগামী দলে জায়গা করে নেন তিনি। এই ম্যাচে অভিষেকেই হ্যাটট্রিকসহ ১১ রানে ৪ উইকেট নিয়ে হৈ চৈ ফেলে দেন তাইজুল ইসলাম। যদিও টিম কম্বিনেশনের কারণে বিশ্বকাপে যাওয়া হয়নি তার।

বাংলাদেশ ক্রিকেট দলের ২০১৫ সালের শুরুটাই হয়েছিল অস্ট্রেলিয়া-নিউজিল্যান্ডে অনুষ্ঠিত বিশ্বকাপের মাধ্যমে। ২৪ জানুয়ারি অস্ট্রেলিয়ার উদ্দেশে দেশ ছেড়েছিল মাশরাফিবাহিনী। ১৪ ফেব্রুয়ারি শুরু হওয়া টুর্নামেন্টে বিশ্ব দেখেছিল নতুন বাংলাদেশকে। এটাই এখন পর্যন্ত বাংলাদেশের সেরা বিশ্বকাপ হিসেবে আখ্যায়িত। গ্রুপ পর্বে ৬ ম্যাচের ৩টিতে জিতে প্রথমবারের মতো বিশ্বকাপের কোয়ার্টার ফাইনালে উঠে টাইগাররা। গ্রুপপর্বে শক্তিশালী ইংল্যান্ডকে হারানোর পর নিউজিল্যান্ডকেও প্রায় হারিয়ে দিয়েছিল তারা।

কোয়ার্টার ফাইনালে দুর্ভাগ্যবশত (আম্পায়ারদের কিছু বিতর্কিত সিদ্ধান্তে) ভারতের কাছে হেরে আসর থেকে বিদায় নিয়েছিল বাংলাদেশ। বিশ্বকাপে বাংলাদেশ নতুন করে খুঁজে পেয়েছিল অভিজ্ঞ ব্যাটসম্যান মাহমুদুল্লাহ রিয়াদকে। টানা ২ ম্যাচে সেঞ্চুরি করেছিলেন তিনি। ব্যাট হাতে মুশফিকুর রহিম ছিলেন দুর্দান্ত ধারাবাহিক। ইংল্যান্ডের বিপক্ষে অসাধারণ দুটি বল করে নায়ক বনে যান বিশ্বকাপের আগে ব্যক্তিগত জটিলতায় পড়া পেসার রুবেল হোসেন। দারুণ ব্যাটিং করে আস্থার প্রতিদান দেন সৌম্য সরকারও।বিশ্বকাপের মঞ্চে মাশরাফি-তাসকিনের ‘চেস্ট বাম্প’ হয়ে যায় ক্রিকেটের অন্যতম সেরা উদযাপনের অংশ।

বিশ্বকাপের পর বাংলাদেশের প্রথম চ্যালেঞ্জ ছিল উপমহাদেশের অন্যতম পরাশক্তি পাকিস্তান। হোমসিরিজে ওই চ্যালেঞ্জও টপকে যায় বাংলাদেশ। ১৯৯৯ সালের বিশ্বকাপে পাকিস্তানকে হারানো যেখানে ছিল বাংলাদেশের একমাত্র সুখস্মৃতি; সেই পাকিস্তানকেই ওয়ানডে সিরিজের প্রতিটি ম্যাচেই বাংলাদেশ বিশাল ব্যবধানে পরাজিত করেছে; দিয়েছে বাংলাধোলাই। একমাত্র টোয়েন্টি২০ ম্যাচেও জিতে নেয় বাংলাদেশ। এই ম্যাচেই আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে অভিষিক্ত হন বর্তমানে দেশের ক্রিকেটের সবচাইতে আলোচিত তারকায় পরিণত হওয়া বাঁহাতি পেসার মুস্তাফিজুর রহমান। শহীদ আফ্রিদি ও মোহাম্মদ হাফিজের মতো দুই অভিজ্ঞ ব্যাটসম্যান ছিলেন তার অভিষেক ম্যাচের দুই শিকার। তখনও অবশ্য মুস্তাফিজকে চেনেনি বিশ্ব!

দুই ম্যাচের টেস্ট সিরিজে অবশ্য বাংলাদেশ অভিজ্ঞ পাকিস্তানের কাছে ১-০-তে হেরে যায়। তবে খুলনায় সিরিজের প্রথম টেস্টের দ্বিতীয় ইনিংসে ৩১২ রানের এক কালজয়ী উদ্বোধনী জুটি গড়েন তামিম ইকবাল ও ইমরুল কায়েস। আর তাতে করে প্রথম ইনিংসে পিছিয়ে পড়া বাংলাদেশ পায় অসাধারণ এক ড্র।

ইমরুল ১৫০ রানে আটকে গেলেও তামিম ২০৬ রান করে ক্যারিয়ারের প্রথম ডাবল সেঞ্চুরির স্বাদ পেয়েছিলেন; সঙ্গে টেস্টে বাংলাদেশের সর্বোচ্চ ব্যক্তিগত ইনিংসের মালিকও হয়েছেন। পরবর্তীতে ঢাকা টেস্টে ব্যাটিং ব্যর্থতায় বাংলাদেশ ৩২৮ রানে হেরে গেলে সফরে প্রথম জয় পায় পাকিস্তান।

এরপর জুনে বাংলাদেশ সফরে আসে ভারত। তাদের বিপক্ষে ফতুল্লার একমাত্র টেস্টটি ছিল বৃষ্টিবিঘ্নিত। প্রথম ইনিংসে ৪৫ বলে ৪৪ রান করে অভিষেকেই নিজের আগমনী বার্তার জানান দিয়েছেন তরুণ উইকেটকিপার ব্যাটসম্যান লিটন দাস। প্রায় ১৯৫ ওভার খেলা হওয়া ম্যাচে প্রথম ইনিংসের ব্যর্থতার কারণে বাংলাদেশ ফলোঅনও করে। তবে বৃষ্টির বিড়ম্বনায় ড্র ছাড়া এই টেস্টের ভাগ্যে তখন আর কিছু লেখা ছিল না।

এরপর ভারতীয়দের বিপক্ষে তিন ম্যাচের ওয়ানডে সিরিজের প্রথম দুটিতে জিতে বাংলাদেশ সিরিজ নিজেদের করে নেয়। ওয়ানডেতে অভিষেক হয় ‌’বিস্ময় বালক’ মুস্তাফিজুর রহমানের। তার বিখ্যাত হয়ে যাওয়া ‘কাটারে’ অভিষেক ম্যাচেই নেন ৫ উইকেট। দ্বিতীয় ম্যাচে নেন ৬টি। সিরিজে মোট ১৩ উইকেট নিয়ে ৩ ম্যাচের ওয়ানডে সিরিজে কোনো বোলারের সর্বোচ্চ সংখ্যক উইকেট নেওয়ার বিশ্বরেকর্ডও গড়েছেন এই বাঁহাতি পেসার; হয়েছেন সিরিজ সেরাও।

অতঃপর দারুণ ভারসাম্যপূর্ণ দল দক্ষিণ আফ্রিকার বিপক্ষে এসেছে সর্বশেষ সাফল্যটি। টোয়েন্টি২০ সিরিজের দুটি ম্যাচেই হারার পর ঢাকাতে প্রথম ওয়ানেডে ম্যাচেও অতিথি দক্ষিণ আফ্রিকানদের কাছে হেরে হঠাৎই পথ ভুলতে বসে বাংলাদেশ! কিন্তু এর পরই ঢাকা ও চট্টগ্রামের মাটিতে দ্বিতীয় ও তৃতীয় ওয়ানডেতে জিতে সিরিজ ২-১ ব্যবধানে জিতে নেয় মাশরাফির দল; গৌরবোজ্জ্বল এক কীর্তি লেখা হয় বাংলাদেশের নামের পাশে।

চট্টগ্রামে প্রোটিয়াদের বিপক্ষে সিরিজের প্রথম টেস্টে খেলার মধ্য দিয়ে ক্রিকেটের দীর্ঘ পরিসরেও অভিষেক হয়ে যায় নতুন সেনশেসন মুস্তাফিজুর রহমানের। টেস্ট অভিষেকেও চমকে দেন তিনি। এক ওভারে চার বলের মধ্যেই ৩ উইকেট নেন মুস্তাফিজ; এর সুবাদে ম্যাচে প্রথম ইনিংস লিড নেয় বাংলাদেশ। কিন্তু শেষ দুই দিন বৃষ্টিতে খেলা না হওয়ায় ম্যাচ ড্র হয়। তবে ইতিহাসের প্রথম ক্রিকেটার হিসেবে ওয়ানডে ও টেস্ট অভিষেকে ম্যাচসেরা হওয়ার কীর্তি গড়েন মুস্তাফিজ। ঢাকায় সিরিজের দ্বিতীয় টেস্টের শেষ চার দিন বৃষ্টিতে পরিত্যক্ত হওয়ায় দুই দলের টেস্ট সিরিজটাই সমাপ্ত হয় ড্র দিয়ে; এই তো গত সোমবার।

সব মিলিয়ে তাই গত কয়েকটি মাস হয়ে থেকেছে বাংলাদেশের ক্রিকেটের জন্য দারুণ কিছু প্রাপ্তির সময়কাল; গৌরবোজ্জ্বল অধ্যায়। আর এই অধ্যায় সামনে অটুট থাকবে তেমনটাই কামনা করছেন দেশের সাবেক-বর্তমান ক্রিকেট তারকা, বোর্ড কর্মকর্তা ও ক্রিকেট বিশ্লেষকরা; ভক্তরা তো বটেই।

Print Friendly, PDF & Email

     এ ক্যাটাগরীর আরো খবর