আদিবাসী ও বাঙালি সংস্কৃতির নতুন দেশ

বাধীন-সার্বভৌম বাংলাদেশ রাষ্ট্রে বাঙালি ব্যতীত যেসব মানবগোষ্ঠীর বসবাস; দূর অতীত ইতিহাসের সূচনাকাল থেকে তারা সামাজিক, রাজনৈতিক উদ্দেশ্য হাসিলের নানাবিধ অপপ্রয়াসে শাসক জাতের কাছে আজ আদিবাসী, উপজাতি, ক্ষুদ্র জাতিসত্তা, ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠী ইত্যাদি পরিভাষার আক্রমণে পীড়িত। কতিপয় পোক্ত শিংয়ের অধিকারী সংস্কৃতি রাজ্যের সামন্ত অধিরাজের অবশ্য নৃগোষ্ঠী শব্দটি নিয়ে ঘোর আপত্তি। সে আপত্তির বিষয়ে দীর্ঘ ফিরিস্তি রয়েছে তাদের হাতে। এতদ্বিষয়ে আপত্তি থাকা অস্বাভাবিকও নয়। বিপন্নকে অনুকম্পা দেখানো যতটা সহজ; অধিকার দেয়াটা যে তার সহস্র গুণ কঠিন, তা হুঙ্কার ছুড়ে দেয়া ওই সব সিংহের চেয়ে বেশি কে জানে! তিনি বা তারাও শাসক বাঙালিরই অংশ_ শাসকগোষ্ঠীর রাজনৈতিক স্বার্থচিন্তার শিকড় তার ও তাদেরও অস্তিত্বের গভীরে প্রোথিত। বলাবাহুল্য, মানুষকে হীনভাবে চিহ্নিত ও হতমান করবার উদ্দেশ্যে আবিষ্কৃৃত উপর্যুক্ত পারিভাষিক শব্দগুলো সাম্রাজ্যবাদী ইউরোপ কর্তৃক রফতানিকৃত। শতবর্ষ পূর্বের বাংলা ভাষার কোনো লেখা বা রচনায় যে ওই সকল পারিভাষিক শব্দ অনুসন্ধান করেও পাওয়া যাবে না, তা বলাই বাহুল্য। সাংস্কৃতিক ইতিহাসে বব্যহৃত এমনতর অনেক শব্দ রয়েছে, যা এদেশে আগত পারমাণবিক ও রাসায়নিক অস্ত্রের পূর্ববর্তী ইউরোপীয় সাম্রাজ্যবাদী সংস্করণ। অধীনস্থ দেশের অধিবাসীদের তুচ্ছ করে মানসিকভাবে হত্যার নিমিত্ত সাম্রাজ্যবাদী শক্তি প্রকৃতির সন্তান মানুষকে গাত্রবর্ণ, চক্ষু, নাসিকা, কপাল, চোয়াল, চুল ও গাত্রলোমের মানদণ্ডে বিভাজিত করে ইউরোপয়েডদের শ্রেষ্ঠত্ব প্রমাণ করেছে জগৎ শাসনের অভিপ্রায়ে। শাদা মানুষ ঈশ্বর কর্তৃক কালো মানুষকে শাসনের অধিকার লাভ করেছে_ কালো মানুষের উপর চাপিয়ে দেয়া নিপীড়নের মধ্য দিয়ে যেন সেদিন ইউরোপীয় সাম্রাজ্যবাদী ক্ষমতাবান মানুষ তাই বলতে চেয়েছিল। কালো মানুষের উপর চাপিয়ে দেয়া সেই অমানবিক হিংস্র আক্রমণ, পীড়ন, নিপীড়ন ও শোষণের নিত্যনতুন কৌশল প্রয়োগ এবং ক্রীতদাসে পরিণত করবার ইতিবৃত্ত আফ্রিকা, আমেরিকার কালো মানুষের সাহিত্যে (ব্ল্যাক লিটেরেচার) বিধৃত। সেদিন ওই সকল পারিভাষিক শব্দ তারা ব্যবহার করেছে কালো মানুষকে বর্বর, অসভ্য বলে গাল দিয়ে তাকে হেয় করবার জন্যে; আজ ব্যবহার করছে কালো মানুষ বা অনগ্রসর জনমানুষের অগ্রগতিকে প্রতিহত করতে ব্যর্থ হয়ে তাদের কাছে আপন উদারনৈতিক দৃষ্টিভঙ্গি তুলে ধরবার প্রয়োজনে। এই উদারতাও যে নিঃস্বার্থ, তা তো নয়।

ভালোবাসা নামক বুর্জোয়া প্রত্যয়টি ব্যবহার করে অবহেলিত জনগোষ্ঠীর নিকট নিজকে স্বজাতির বহমান স্রোত থেকে বিশিষ্ট করে দেখানোর প্রয়াস বৈ আর কিছু নয়। এই উদার দৃষ্টিভঙ্গির মধ্যে আছে সেই রাজনীতি, যা দ্বারা অবহেলিত অনগ্রসর জনগোষ্ঠীকে আর একবার বুঝিয়ে দেয়া_ আমি না দিলে আজও কোনো কিছুই তুমি পেতে পারো না। এমনকি তোমার অস্তিত্বের স্বীকৃতি; সেও আমার দয়ায়ই তুমি পেতে পারো। আমার সভ্যতার অজস্র উপকরণের দ্বারা তোমাকে মানুষের সংস্কৃতির জগতে ছাড়পত্র দিয়েছি। তুমি দ্বিপদ পশু ছিলে, তোমাকে মানুষ করে গড়েছি আমি। ভাষা, বিজ্ঞান, আলো-অন্ধকার, জীবন-মরণ, সুখ-দুখের অনুভূতি, খাদ্য-অখাদ্যের ও ভালো-মন্দের জ্ঞান, রোগের চিকিৎসা, পরনের বস্ত্র, সম্পদের জন্য যুদ্ধ-মারণাস্ত্র এ-সবই তোমাদের জন্য আমার উপহার। অতএব তোমরা বংশপরম্পরায় আমার দাসানুদাস।
টহপরারষরংধঃরড়হ, ইধৎনধৎরধহ, ঝধামব, অনড়ৎমবহবড়ঁং_ এই সকল পরিভাষার উদ্ভাবক ইউরোপের ক্ষমতাবান রাষ্ট্রের নাগরিক বিদগ্ধজন। যেদিন তারা অন্য ভৌগোলিক অঞ্চলে নিজেদের উপনিবেশ বা আধিপত্য প্রতিষ্ঠা ভিন্ন আত্মস্বার্থ সিদ্ধির কোনো উপায় খুঁজে পাননি তখন উপর্যুক্ত পারিভাষিক শব্দগুলো ব্যবহারের মাধ্যমে বিজিত নির্বাচিত দেশের জনগণকে মানসিকভাবে দুর্বল করে দিত। সংস্কৃতির শ্রেষ্ঠত্ব দ্বারা বিজিতদের হেয় প্রতিপন্ন করা যতটা সহজ, বল প্রয়োগ বা মারণাস্ত্রের সাহায্যে ঠিত ততটাই কঠিন। ক্ষমতাবান অন্যকে দুর্বল করে শাসন ও শোষণ করে আনন্দ পায় এবং আধিপত্য বজায় রাখার জন্যে নিত্যনতুন কৌশল আবিষ্কার করে। শাসিত রাষ্ট্রের নিজস্ব সংস্কৃতির পরিবর্তে শাসক তাদেরকে নিজ সংস্কৃতির উপর নির্ভরশীল করে তোলে। সাংস্কৃতিক ক্ষমতা হারিয়ে শাসিত জাতি দেউলিয়ায় পরিণত হয়। ঔপনিবেশিক শক্তির কবল থেকে মুক্ত স্বাধীন জাতি যখন আপন সংস্কৃতির বিকাশ সাধনে তৎপর তখন জাতীয়তাবাদ, জাতীয় সংস্কৃতি ইত্যাদি সংকীর্ণতা দোষে দুষ্ট। দুর্বল জাতি বা রাষ্ট্রের উপর ক্ষমতার অধিকারী রাষ্ট্র বা জাতির এক ভয়াবহ চাপ সকল অবস্থায়ই বিদ্যমান থাকে। তাদের সকল কর্মে ক্ষমতারই বাহাদুরি প্রকাশ পায়, কেবল কায়দাটা ভিন্ন ভিন্ন।
প্রাচীন ভারতবর্ষে আধিপত্যবাদী আর্য জাতি নিজেদের শ্রেষ্ঠত্ব জাহির করবার জন্য স্থানীয় অধিবাসীদের অনার্য, বানর, রাক্ষস ইত্যাদি নামে শনাক্ত করে। শ্রমবিমুখ আর্যগণ উৎপাদক শ্রেণীকে চতুর্বর্ণের চাতুরীর ফাঁদে ফেলে অস্পৃশ্য করে রাখে শতাব্দীর পর শতাব্দীকাল। ধর্ম ও সমাজনীতির অমানবিক সেই শোষণ প্রক্রিয়া সহস্র বছর বিচিত্ররূপে অব্যাহত থাকে। ধর্মীয় অনুশাসন, ভাষার আধিপত্য প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে স্থানীয় ভাষার স্বাভাবিক বিকাশকে ব্যাহত করে রাখে বিভিন্ন প্রাকৃতিক ভাষার উন্মেষকাল পর্যন্ত। অষ্টাদশ পুরাণ, উপপুরাণাদি সংস্কৃত ভাষা বা দেবভাষা ভিন্ন অন্য কোনো ভাষায় চর্চা করলে তাদের স্থান হবে রৌরব নামক স্থানে এমন নিষেধবাণী প্রচার করে। এই তো সেদিন সেনবংশের শাসনামলে বাংলা ভাষার বিকাশ রোধ করবার চষ্টা করা হয়েছিল। ভারতীয় জনগণকে বহুবর্ণে বিভক্তকরণের আর্যনীতি ছিল মূলত রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিত। বলার অপেক্ষা রাখে না যে, ধর্ম এবং কঠোর ধর্মীয় অনুশাসন ছিল আর্য জাতির মারণাস্ত্র আধিপত্য বিস্তার ও তা বজায় রাখার নিয়ামক শক্তি। বাঙালি প্রাচীন ভারতবর্ষের আধুনিক উত্তরাধিকার। ভূমধ্যসাগরীয় (দ্রাবিড়), নিগ্রোয়েড, ককেশিয়ান, প্রি-অস্ট্রোলয়েড, মঙ্গোলয়েড মহাজাতির সংমিশ্রণে বহু শতাব্দীর সহাবস্থানের ফলে তাদেরই রক্ত সাঙ্কর্যে বাঙালি জাতির উদ্ভব। অতএব বাঙালির সংস্কৃতিও বিভিন্ন জাতিসত্তার সংস্কৃতির সমন্বিত, পরিশীলিত ও প্রকর্ষণের পরিণাম।
বাঙালি সংস্কৃতি বিভিন্ন জাতিসত্তার সংস্কৃতির নির্যাস প্রসূত হবার পরও আলোচ্য প্রস্তাবনার যৌক্তিকতা এখানেই যে, বিভিন্ন আদিবাসীর নরনারী বাংলাদেশের সীমান্তবর্তী অঞ্চলে একালেও তাদের জীবনলীলা অব্যাহত রেখেছেন। নিজস্ব সমাজ কাঠামোর মধ্যে সুনির্দিষ্ট রীতিনীতি, প্রথা-পদ্ধতি, উৎপাদনের উপায়, উপকরণ, ধর্ম-কৃত্য, লোকাচার, বিশ্বাস-সংস্কার ইত্যাদির অভিব্যক্তিরূপে তারা সংস্কৃতির একটা চলিষ্ণু প্রবাহ সৃজন অব্যাহত রেখেছে। আবার ঐতিহ্যের অনুষঙ্গগুলোও পরিত্যাগ করেনি। কারণ হারাবার ভয়ে সে তা আঁকড়ে থাকে সকল সময়। আর্থনীতিক ও সাংস্কৃতিকভাবে দুর্বল হয়ে পড়ার কারণে পরনির্ভরশীলতা বৃদ্ধি পায়। প্রগতির সড়কের চলমান মিছিলে যোগ দেয়া তাই সম্ভব হয় না। পৃথিবীর প্রতিটি দেশেই এরূপ অনগ্রসর নৃগোষ্ঠীর অস্তিত্ব রয়েছে। কোথাও কোথাও তারা এখনও শিকার যুগ অতিক্রম করতে পারেনি। জুম পদ্ধতির চাষাবাদের উপর অনেকেই নির্ভরশীল। ক্ল্যান, মইট্টি, ফেইট্রির স্তর অতিক্রান্তের পর প্রতিষ্ঠিত হয় রাষ্ট্র। কৃষিজীবী সমাজ থেকেই অবসরভোগী, উৎপাদনবিমুখ এই শাসকগোষ্ঠীর আবির্ভাব। তারা ছিল নিজেদের বুদ্ধিমত্তা দ্বারা অন্যের উপর আধিপত্য বিস্তারে সদা সচেতন। গোত্র বা গোষ্ঠীপতি, পুরোহিত, পুরোহিত-সম্রাট, বীরযোদ্ধা বা সেনাপতি_ অতঃপর সম্রাট বা রাজা। সময়ের ব্যবধান সত্ত্বেও সভ্যতার বিবর্তনের এই ধারাটি পৃথিবীর সর্বত্র অনুসৃত হয়েছে। লক্ষণীয়, শক্তি নয়; ক্ষমতা ও বৌদ্ধিক কৌশল সকল যুগেই নেতৃত্ব বা চালকের আসনে বসে ইচ্ছেমতো নিয়ন্ত্রণ করেছে গোত্র, সমাজ বা রাষ্ট্রের সব কর্মকাণ্ড। পুঁজি সৃষ্টির পূর্বে বীরত্বই ছিল একজন বীরের পুঁজি। তার অসম সাহস, শক্তি ও কৌশলকে পুঁজি করে বীর ভূখণ্ডের পর ভূখণ্ড দখল করেছে_ স্বয়ং পূজিত হয়েছে অধিবাসীদের দ্বারা। নতমস্তকে তার অধীনতা মেনে নিয়ছে পার্শ্ববর্তী ক্ষমতাবান শাসকরা। গ্রিক সম্রাট আলেকজান্ডার দ্য গ্রেট একই পুঁজির উপর ভর করে সাম্রাজ্য বিস্তার করেছিলেন ভারতবর্ষ পর্যন্ত।
প্রাচীন সকল সাম্রাজ্যই এইভাবে পেশিশক্তি ও ক্ষমতার দ্বারা প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। পেশিশক্তি যন্ত্রশক্তিতে রূপান্তরের সঙ্গে সঙ্গে শক্তির স্থান দিয়েছে ক্ষমতা। এবং সেই দৃষ্টিকোণ থেকে বিচার করে দেখা যায় প্রাচীন গোষ্ঠীপতি, পুরোহিত, পুরোহিত-সম্রাট, সেনাপতি ও সম্রাটগণ পেশিশক্তির দ্বারা ক্ষমতাবান হয়েছিলেন। বর্তমানকালে প্রশাসনযন্ত্রের প্রধান ক্ষমতার দ্বারা শক্তিমান হন। একালে শক্তি-অদৃশ্য ক্ষমতাই দৃশ্যমান। জনগণই ক্ষমতার উৎস বলে যে রাষ্ট্রযন্ত্রের পরিচালকের আসনে বসে; আসন অলঙ্কৃত করবার পর সে প্রথমেই প্রমাণ করে_ জনগণ ক্ষমতাহীন। জনগণকে ক্ষমতাহীন করে নিজে শক্তিশালী হয়ে ওঠে ক্ষমতার বিধি অপব্যবহারের মাধ্যমে। ক্ষমতা তাকে শক্তিমান করায় সে স্বয়ং অন্ধ হয়ে পড়ে। সর্বত্র আলো থাকায় তার আসনের চারদিক থাকে অন্ধকারে ঢাকা। জনতার শত্রুরা সেই অন্ধকারে বসে রাষ্ট্রের যারা মালিক সেই জনগণকে হতমান, শক্তিহীন, সম্বলহীন, নিঃস্ব করার যাবতীয় ফাঁদ তৈরি করে। ক্ষমতা-অন্ধ সে কিছুই দেখে না; সে বধির, কিছু শুনতেও পায় না; বোবা, কিছু বলতেও পারে না। এভাবে ক্ষমতা জনগণের কাছে সর্ববিষয়ে অক্ষম একটি প্রতিবন্ধী অস্তিত্বে পরিগণিত হয়। ক্ষমতা বরাবরই চায় নিরঙ্কুশ হতে। হতে চায় অপ্রতিরোধ্য, একাধিপতি। প্রতিপক্ষ কেউ থাক তা কাঙ্ক্ষিত নয় বলেই দমন-পীড়ন দ্বারা ক্ষমতার হিংস্র রূপটি সর্বসমক্ষে তুলে ধরে নির্মমভাবে। দমন-পীড়নের শিকার হয়েই দুর্বল জনগণের একটি অংশ, যারা এককালে ক্ষমতাবান ছিল কিংবা ক্ষমতার কাছাকাছি ছিল তারা প্রান্তিক পর্যায়ে পৌঁছে যেতে বাধ্য হয়। পৃথিবীব্যাপী অস্তিত্বশীল মহাজাতিসমূহের বিভিন্ন গোষ্ঠী উপর্যুক্ত প্রক্রিয়ায় পরিণত হয়েছে সংখ্যালঘু জনগোষ্ঠীতে। ক্ষমতাহীন, আর্থনীতিকভাবে পশ্চাৎপদ, আদিম উৎপাদন ব্যবস্থার গণ্ডিতে আবদ্ধ, আধুনিক ও প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষার আলো থেকে বঞ্চিত, ব্যবহারিক বিজ্ঞানের সংস্পর্শহীন এই সকল জনগোষ্ঠী সবল ক্ষমতাসীনদের চাপে হারিয়েছে ভূমির অধিকার; হারিয়েছে আপন মাতৃভাষা, ধর্মবিশ্বাসে দিতে হয়েছে নানা জোড়াতালি। চরম অবহেলা এবং সংখ্যাগরিষ্ঠ ক্ষমতাবানদের চাপ ও ভয়ে দুর্গম অরণ্য, পাহাড় কিংবা দেশের প্রান্তসীমায় আশ্রয় নিয়েছে অপরাধীর মতো। পৃথিবীর অন্য সব দেশের মতো বাংলাদেশেও সংখ্যালঘু এই জনগোষ্ঠী প্রচণ্ড ঝুঁকির মধ্যে অস্তিত্ব বজায় রেখেছে। অভিন্ন রাষ্ট্রের নাগরিক হওয়া সত্ত্বেও প্রবল ক্ষমতাবান শাসক জাতির দ্বারা নিগৃহীত, উপজাতি বলে অবহেলিত তাদের জীবনের মতোই নিরাপত্তাহীন জনগোষ্ঠীগুলোর ভাষা ও সংস্কৃতি।
বলাবাহুল্য, অভিন্ন দেশসীমায় বসবাসকারী সাঁওতাল, ওঁরাও, মুণ্ডা, রাজবংশী, গারো, হাজং, খাসিয়া, মালপাহাড়ি, মণিপুরি, ত্রিপুরা, ম্রো, পাঙ্খো, বোম, তঞ্চঙ্গ্যা, মারমা, রাখাইন, চাকমা ইত্যাদি আদিবাসী শাসক জাতি বাঙালির সমান্তরালে আর্থ-সামাজিক-রাজনৈতিক, আত্মিক ও আধ্যাত্মিক প্রয়োজনে তাদের নিজ নিজ সংস্কৃতির সীমায় জীবন নির্বাহ করে। সংস্কৃতির সাধারণীকরণ সম্ভব নয় বলেই একই দেশে সংস্কৃতির বিভিন্নতা স্বাভাবিক। পার্বত্য চট্টগ্রামের তিনটি জেলার অধিবাসীরা অভিন্ন ভৌগোলিক ও প্রাকৃতিক পরিবেশে একই আর্থনীতিক উৎপাদন ব্যবস্থার অধীনে জীবন নির্বাহ করা সত্ত্বেও এই সব জেলার অধিবাসী চাকমা, মারমা, ম্রো, বোম প্রভৃতি জনগোষ্ঠীর প্রত্যেকেই স্বতস্ত্র সংস্কৃতির ধারক। উপর্যুক্ত জনগোষ্ঠীর সকলেই আবার মঙ্গোলয়েড মহাজাতির অন্তর্গত। এ দৃষ্টান্ত থেকে এটা অত্যন্ত স্পষ্ট যে, জাতিতাত্তি্বক বা নৃতাত্তি্বক বৈশিষ্ট্যই কেবল সংস্কৃতির নিয়ামক নয়।
ভৌগোলিক পরিবেশ এবং উৎপাদনের উপায় উপকরণ, জনগোষ্ঠীর সামাজিক রীতিনীতি, প্রথা-পদ্ধতি, উৎপাদন ও বণ্টনের নীতি, বাজার ব্যবস্থা, ধর্মী কৃত্য, লোকাচার, আহার-বহার, পোশাক-পরিচ্ছদ, আদব-কায়দা, শিল্প সৃজন-কৌশল, স্থাপত্য নির্মাণ পদ্ধতি, প্রযুক্তিগত উৎকর্ষ, রন্ধনশৈলী, বয়নসৌকর্য, ভাষা, লিপি, আবেগ প্রকাশের ধরন, সামাজিক ও গোষ্ঠীগত রাজনৈতিক চিন্তার অভিব্যক্তি ইত্যাদিও সংস্কৃতির অবয়ব নির্দেশ করে। সঙ্গত কারণেই বলা যায়, বৃহত্তর রংপুর, দিনাজপুর সংস্কৃতির বিচারে বৃহত্তর চট্টগ্রাম, নোয়াখালী অঞ্চল থেকে ভিন্নতর। বৃহত্তর রাজশাহী অঞ্চলের বিভিন্ন জেলার অধিবাসীদের সংস্কৃতিও সম্পূূর্ণ এক নয়। চাকমা ভাষার সঙ্গে মারমা ভাষার পার্থক্য যেমন স্পষ্ট, তেমনি তাদের পোশাক, খাদ্যাভ্যাস, বিবাহ-জন্ম-মৃত্যুর কৃত্য ও লোকাচারে রয়েছে দুস্তর ব্যবধান। বোম এবং ত্রিপুরা, তঞ্চঙ্গ্যা এবং ম্রো জনগোষ্ঠীর পুরাণও এক নয়। শাস্ত্র ধর্ম বৌদ্ধ হলেও পার্বত্য জনগোষ্ঠীর প্রত্যেকের রয়েছে স্বতন্ত্র গোষ্ঠীধর্ম। সেক্ষেত্রে তারা সর্বপ্রাণবাদী। অভিন্ন নিয়মেই শ্রীমঙ্গলে বসবাসরত মণিপুরিদের মীতৈই ও বিষ্ণুপ্রিয়া গোষ্ঠীর সংস্কৃতির অভিন্নতা পরিলক্ষিত হলেও, মীতৈই পাঙ্গানদের সংস্কৃতি ধর্মীয় ভিন্নতার (মুসলিম মণিপুরি) কারণে অনেক ক্ষেত্রেই স্বতন্ত্র। তারা সমতলবাসী, কৃষি উৎপাদনের মাধ্যমে জীবন ও জীবিকা নির্বাহ করে। উৎপাদনের উপায় ও উপকরণ পাহাড়ে বসবাসকারী সকল নৃগোষ্ঠী অপেক্ষা ভিন্নতর। বলার অপেক্ষা রাখে না যে, সেই ভিন্নতাই তার সংস্কৃতিকে অন্য দর্পণে প্রতিবিম্বিত করে।
উপর্যুক্ত বক্তব্য নিঃসন্দেহে এ সত্য প্রতিষ্ঠিত করে যে, বাংলাদেশে বসবাসরত সকল নৃগোষ্ঠীর স্বতন্ত্র সংস্কৃতি তাদের জীবন ও যাপনের স্বাতন্ত্র্যের জন্যেই নিজ নিজ বৈশিষ্ট্যে মূর্ত রূপ পরিগ্রহ করেছে। বিশ্বময় জাতি বা গোষ্ঠীগুলোর সংস্কৃতিও বিকশিত হয়েছে একইভাবে মৌলিক চাহিদা পূরণের অপরিহার্য প্রয়োজনে উৎপাদন, প্রজনন ও প্রযুক্তিগত উৎকর্ষের ধারাবাহিকতায়। উপর্যুক্ত প্রক্রিয়ায় যে জনগোষ্ঠী অপরকে ছাপিয়ে উঠেছে, সে-ই অনগ্রসর জনগোষ্ঠীর উপর আধিপত্য বিস্তার করেছে। আধিপত্যবাদী শক্তি হিসেবে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করতে গিয়েই দখল করেছে ভূখণ্ড, বিজিত জনগোষ্ঠীর নারী ও সংস্কৃতি। অধীনস্থ জনগোষ্ঠী বা জাতির সংস্কৃতি দখলের অর্থ আপন সংস্কৃতিকে তার উপর ধীরে ধীরে চাপিয়ে দেয়া। শাসনদণ্ড বা সর্বময় ক্ষমতা শাসক জাতিকে ভয়ঙ্কর ও প্রতাপশালীরূপে অপর জাতির সম্মুখে উপস্থাপন করে। আপন অস্তিত্ব রক্ষায় শাসিত জাতি তার শাসককে, প্রভুকে খুশি করতে সর্বোচ্চ প্রয়াস অব্যাহত রাখে এবং তা করতে গিয়েই নির্দিষ্ট সময়ের ব্যবধানে শাসকগোষ্ঠীর আচার-সংস্কার-সংস্কৃতি এমনকি ধর্ম পর্যন্ত গ্রহণ করে। ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীদের আজকের অবস্থার জন্য দায়ী প্রকৃত প্রস্তাবে ওই রাষ্ট্রকাঠামো এবং শাসককুলের প্রবল প্রতাপ। স্মর্তব্য, রাষ্ট্রযন্ত্রে শাসক হিসেবে চালকের আসনে বসবার আগে বাঙালিও ক্ষমতার চাপে-তাপে, ক্ষমতার পেষণযন্ত্রে হয়েছে পিষ্ট। সে ইতিহাস সহস্র বছরের। সেই দীর্ঘ সময়ে বাঙালিকেও বির্সজন দিতে হয়েছে তার সংস্কৃতির অনেক মূল্যবান সম্পদ। দুর্ভাগ্যজনক হলেও সত্য যে, ইতিহাসের বিভিন্ন বাঁকে এ ভূখণ্ডবাসী উপমহাদেশীয়, মধ্যএশীয় এবং ইউরোপীয় নানান জাতির অধীন হয়েছে আর্থ-রাজনৈতিক কারণে। আগত প্রবল শক্তিধর জাতি ক্ষমতা বিস্তারের সাথে সাথে স্বজাতির ভাষা-সংস্কৃতিকে ব্যবহার করেছে শাসিত জাতির মানসজগতে আধিপত্য বিস্তারের উদ্দেশ্যে।
ঔপনিবেশিক প্রত্যেক শাসকগোষ্ঠীর সংস্কৃতি নির্বিচারে গ্রহণ করতে বাধ্য হয়েছে বাঙালি। নৈর্ব্যক্তিক ও নিরপেক্ষ দৃষ্টিতে বিচারপূর্বক ড. আহমদ শরীফ সম্রাট কনিষ্ক ব্যতীত তিন হাজার বছরের বাংলার ইতিহাসে আর কোনো বাঙালি শাসকের অস্তিত্ব খুঁজে পাননি। অর্থাৎ ঐতিহাসিককালের তিন হাজার বছর বাঙালি ঔপনিবেশিক শাসকের অধীনে ছিল। আর্য, মৌর্য, সুঙ্গ, কুশান, গুপ্ত, পাল, সেন, তুর্কি, আফগান, মুঘল, ফরাসি, ওলন্দাজ, পর্তুগিজ, ইংরেজ ইত্যাদি জাতির দ্বারা দীর্ঘকাল শাসিত হবার ফলে অনিচ্ছা সত্ত্বেও জীবন-জীবিকা সংক্রান্ত নানাবিধ কারণে উপর্যুক্ত জাতির সাংস্কৃতিক আধিপত্য বরণ করে নিতে বাধ্য হয়। পূর্বেই উলি্লখিত হয়েছে, এক সংকর জাতিসত্তা বাঙালির সংস্কৃতিও সংকর। স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশে বাঙালি নিজস্ব সংস্কৃতির শিকড় সন্ধানী হয়েছে বটে, কিন্তু এককভাবে কোনো সংস্কৃতির জনকের দাবিদার হতে পারেনি। ব্যবহারিক প্রয়োজনেই বাঙালিকে শাসকগোষ্ঠীর সংস্কৃতিকে গ্রহণ করতে হয়েছে আত্তীকরণের নিয়মে। কিন্তু ইংরেজ ঔপনিবেশিক শাসকচক্র এদেশীয় জনসাধারণের উপর প্রথমাবধি সাংস্কৃতিকভাবেই আধিপত্য বিস্তারে সচেষ্ট ছিল। ইউরোপীয় শাসকগোষ্ঠীর ন্যায় মধ্যএশীয় আধিপত্যবাদ এদেশে শাসকের বেশেই ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হয়। অন্যভাবে বলা যায়, রাষ্ট্রক্ষমতা দখলের উদ্দেশ্যে সে ছিল দুর্বল সামন্ততন্ত্রের উপর অপেক্ষাকৃত সবল সামন্ততন্ত্রের বিজয়।
অপরদিকে, ইংরেজ বুর্জোয়া বণিকবৃত্তি থেকে শাসক হয়ে ওঠে রাষ্ট্রশক্তির দুর্বলতার সুযোগে। ততদিনে তার কাছে এটা স্পষ্ট হয়েছে যে, রোমান ক্যাথলিক ধর্ম, ইউরোপীয় রেনেসাঁস-প্রসূত জ্ঞান-বিজ্ঞান-দর্শন ও অষ্টাদশ শতকের এনলাইটেনমেন্ট-জাত প্রগতির প্রতিতুলনায় স্বকালের ভারতবর্ষীয় সমাজ প্রগতি অনগ্রসর। এবং প্রাচীন ভারতীয় ধর্ম-দর্শন, সামাজিক কুসংস্কার ও অমানবিক বিভিন্ন সামাজিক ও ধর্মীয় প্রথার নিগড়ে বাঁধা এদেশীয় জনগণ। ইংরেজ রাষ্ট্রশক্তির আমদানিকৃত ইউরোপীয় সংস্কৃতির বিবিধ উপকরণ তাদের উপর জাদুশক্তির মতো কাজ করবে। রাষ্ট্রক্ষমতাকে দীর্ঘস্থায়ী, নিরঙ্কুশ করবার অভিপ্রায়ে তাই তারা সাংস্কৃতিক আগ্রাসনকেই নিয়ামক নির্ধারণ করেছিল। সেই সূত্রেই ধর্মান্তর ক্রিয়া, আর্থনীতিক সংস্কার (অভ্যন্তরীণ ও বহির্বাণিজ্য করায়ত্ত করা, চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত, সূর্যাস্ত আইন ইত্যাদি), সামম্প্রদায়িক বিরোধের বীজ উপ্ত করে হিন্দু-মুসলমানের মধ্যকার সংহতি ও সম্প্রীতি বিনষ্ট করার মতো বিভিন্ন কূটরাজনীতির আশ্রয় গ্রহণ করে। একই সঙ্গে ভারতবর্ষীয়দের নিকট অপরিচিত ইউরোপীয় সংস্কৃতির উৎকৃষ্ট, অপকৃষ্ট সকলই সুকৌশলে উপস্থাপন করে। সেই সর্বনাশকালে এতদঞ্চলের মানুষের পক্ষে নিজস্ব সংস্কৃতির কতটা গেল, কতটা রক্ষা পেল তা বিচার করবার অবকাশ ছিল না। স্বদেশী যুগের পূর্বে বাবু কালচারের বিচিত্র অনাচারকালেই কেবল সাংস্কৃতিক প্রতিরোধচিন্তার উন্মেষ ঘটেছিল_ এ কথা বলাই বাহুল্য। বলা যায়, ইউরোপীয় ভিন্নধর্মী সংস্কৃতির তরঙ্গাভিঘাতে বাঙালি মানস উন্নততর সচেতনতায় পেঁৗছাবার যোগ্যতা হারিয়ে ফেলে অকস্মাৎ। যে বস্তুটি হারালে মানুষের আত্মার অপঘাত মৃত্যু ঘটে। আন্তোনিও গ্রামসির দৃষ্টিতে দেখলে স্পষ্ট হয় সংস্কৃতি মানব অস্তিত্বের কত বড় শক্তি। _সংস্কৃতি একটা সম্পূর্ণ ভিন্ন ধরনের জিনিস। এ একটা সংগঠন, আমাদের ভেতরের অহংকে নিয়ন্ত্রণে আনা, আমাদের ব্যক্তিত্বের ওপর কর্তৃত্ব বিস্তার করা এবং একটা উন্নততর সচেতনতায় পেঁৗছানো যার মাধ্যমে আমরা আমাদের স্বকীয় ভূমিকা এবং আমাদের নিজস্ব অধিকার ও কর্তব্য উপলব্ধি করতে সক্ষম হই। (খন্দকার সাখাওয়াত আলী, ২০২১, ৯৫)
অর্থাৎ অহংকে নিয়ন্ত্রণে এনে, আপন ব্যক্তিত্বের উপর কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে উন্নততর সচেতনতার স্তরে পেঁৗছানো এবং স্বীয় অধিকার ও কর্তব্য সম্বন্ধে উপলব্ধি করবার ক্ষমতা জোগায় সংস্কৃতি। আত্মপরিচয় ও আত্মোপলব্ধির ব্যক্তিক ক্ষমতাটা যে জাতি বা গোষ্ঠী বিসর্জন দিয়ে বসে, তার বিপন্ন অস্তিত্ব রক্ষার কোনো উপায় থাকে না। বাঙালি অষ্টাদশ শতক থেকে উনিশ শতকের প্রথম এক দশক পর্যন্ত তার সাংস্কৃতিক প্রতিরোধ ক্ষমতা হারিয়ে বিজাতীয় সংস্কৃতির প্লাবনস্রোতে ভেসে গিয়েছিল। সেই জাতীয়তার বোধের পুনর্জাগরণ ঘটে বিশ শতকের দ্বিতীয়ার্ধে। ভাষার অধিকার, স্বাধিকারের চেতনা প্রবল ও অপ্রতিরোধ্য হলে গণঅভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠায় পরিণতি খোঁজে। গণতান্ত্রিক অধিকার বাস্তবায়নের প্রতিবন্ধতা উপড়ে ফেলতে সশস্ত্র মুক্তিযুদ্ধ ছিল অনিবার্য। ভৌগোলিক স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্ব অর্জন করবার পরও মনস্তাত্তি্বক ও ব্যবহারিক জীবনে পূর্বতন সাংস্কৃতিকবোধ স্বাধীন বাংলাদেশে অবশেষ রূপে থেকে যায়। ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর থেকে ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট পর্যন্ত সময় স্বাধীন বাংলাদেশের একটি ছোট্ট অধ্যায়। মানস-সাংস্কৃতিক ক্ষেত্রের কর্মী শিল্পী-সাহিত্যিক-কবি-নৃত্য ও সঙ্গীত শিল্পীরা নিজ নিজ ক্ষেত্রে বাঙলি সংস্কৃতির গৌরবময় ঐতিহ্যের ভিতে নতুন আগামী সৃজন প্রয়াসে সক্রিয় হলেন এ সময়েই।

Print Friendly, PDF & Email

     এ ক্যাটাগরীর আরো খবর