বুড়িগঙ্গার পর এবার দেশের আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ নদী ধলেশ্বরীকে মৃত্যুর দিকে ঠেলে দেওয়া হচ্ছে। বুড়িগঙ্গার মতো ধলেশ্বরীও মৃত্যুর দিকে এগিয়ে যাচ্ছে চামড়া শিল্পের কারণে। বুড়িগঙ্গা ট্যানারি মালিকদের কারণে মরে গেলেও ধলেশ্বরী মরতে বসেছে সরকারের অবহেলায়!
বছর খানেক আগেও প্রচুর মাছ পাওয়া যেত ধলেশ্বরীতে। কিন্তু এখন এই নদীতে মাছের দেখাই পাওয়া যায় না। বিষক্রিয়ায় ধীরে ধীরে মরে যাচ্ছে মাছ। ধলেশ্বরী নদীতে মাছ ধরে জীবিকা নির্বাহ করা একাধিক জেলে এই প্রতিবেদককে জানিয়েছেন এসব তথ্য। বিসিকের কাছে এ বিষয়ে লিখিত অভিযোগ করেও কোনও কাজ হয়নি বলে জানিয়েছেন স্থানীয় বাসিন্দারা।
গত বৃহস্পতিবার কথা হয় হেমায়েতপুরের ঝাউচর গ্রামের বাসিন্দা আজগর আলীর সঙ্গে। প্রায় ৮২ বছর বয়সী আজগর আলী একসময় কৃষিকাজ করলেও মাঝে-মাঝে শখ করে ধলেশ্বরী নদীতে মাছ ধরতেন। তিনি জানান, বছর খানেক আগেও ধলেশ্বরীতে ধরা পড়তো আইড়, পাঙ্গাস, বোয়াল, বড় বড় চিংড়ি সহ বিভিন্ন মাছ। কিন্তু ট্যানারি চালু হওয়ার পর বর্জ্য পদার্থের বিষক্রিয়ায় এসব মাছ মরে যাচ্ছে।
আজগর আলী আরও জানান, এখন আর ধলেশ্বরীতে তেমন পানি নেই, স্রোতও কম। আষাঢ়-শ্রাবণ মাসে ভরা থাকলেও শুকনো মৌসুমে পানি অনেকটাই কমে যায়। একদিকে বুড়িগঙ্গা, অন্যদিকে তুরাগ নদী মরে যাওয়ার প্রভাব পড়েছে ধলেশ্বরীতে।
.
বিসিক ট্যানারি শিল্পনগরীর সীমানা দেওয়ালের নিচ দিয়ে বেরিয়ে আসা পাইপসরেজমিনে দেখা গেছে, সাভারের হেমায়েতপুরে ধলেশ্বরীর কোল ঘেঁষে গড়ে উঠেছে বিসিক ট্যানারি শিল্পনগরী। এর উত্তর দিকের সীমানা দেওয়ালের নিচ দিয়ে মোটা পাইপ নদীর গভীরে প্রবেশ করিয়ে দেওয়া হয়েছে। সেই পাইপ দিয়েই কারখানার বিষাক্ত পানি পড়ছে ধলেশ্বরীতে। ভাঙন থেকে রক্ষার জন্য নদীর পাড়ে নির্মাণ করা হয়েছে বাঁধ। সেই বাঁধের দেওয়াল ভেদ করে মাটির নিচ দিয়ে যাওয়া পাইপে নদীতে কী পড়ছে, তা বোঝার কোনও উপায় নেই। কারণ ওপরটা ঢেকে আছে কচুরিপানায়।
জানা গেছে, কেন্দ্রীয় বর্জ্য শোধনাগারে (সিইটিপি) তরল বর্জ্য শোধনের পর পরিশুদ্ধ পানি ধলেশ্বরীতে ফেলার কথা। কিন্তু সিইটিপি নির্মাণের কাজ এখনও শেষ না হওয়ায় নদীতে ফেলা হচ্ছে বিভিন্ন কেমিক্যাল মিশ্রিত পানি। আর এ কারণেই মাছশূন্য হয়ে যাচ্ছে নদীটি, ব্যবহারের অনুপযোগী হয়ে পড়ছে নদীর পানি।
সংশ্লিষ্টরা জানিয়েছেন, হাজারীবাগে বিষাক্ত পানি বুড়িগঙ্গায় ফেলা হতো, আর এখানে তা ফেলা হচ্ছে ধলেশ্বরীতে। ওখানে ট্যানারি মালিকরা ফেললেও এখানে তা পড়ছে সরকারের বিসিক ট্যানারি শিল্পনগরীর অবহেলায়। প্রকল্প সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা অবশ্য জানিয়েছেন, ইতোমধ্যে সিইটিপির ৮০ শতাংশ কাজ শেষে দুটি মডিউল পুরোদমে চালু হয়েছে। তবে ডাম্পিং ইয়ার্ড সহ কিছু কাজ এখনও বাকি। সেগুলো শেষ হলেই সব ঠিক হয়ে যাবে।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, সিইটিপির অনেক যন্ত্রাংশ এখনও বন্দরে আটকা পড়ে আছে। কবে নাগাদ এসব যন্ত্রাংশ সাভারে এসে পৌঁছাবে, তা কেউ বলতে পারছেন না। যন্ত্রাংশগুলো সংযোজিত না হওয়া পর্যন্ত সিইটিপি পুরোপুরি চালু করা যাচ্ছে না। তাই কারখানার বিষাক্ত পানি নদীতে ফেলতে হচ্ছে।
একটি সূত্র জানিয়েছে, সিইটিপি নির্মাণকারী প্রতিষ্ঠানটি চীনের কোম্পানি। সেই কোম্পানির শীর্ষ পর্যায়ের কয়েকজন কর্মকর্তার মধ্যে দ্বন্দ্বের কারণে নির্মাণকাজ অনেকদিন বন্ধ ছিল। এখনও দ্বন্দ্ব পুরোপুরি মেটেনি, তাই কাজও সেভাবে এগোচ্ছে না। বিষয়টি স্পর্শকাতর বলে প্রকল্পের কোনও কর্মকর্তাও দায়িত্ব নিয়ে দ্বন্দ্ব মেটানোর উদ্যোগ নিচ্ছেন না।
হাজারীবাগের ৭০ একর জমিতে অপরিকল্পিতভাবে ট্যানারি পল্লী গড়ে উঠেছিল স্বাধীনতার আগে। কিন্তু সাভারের হেমায়েতপুরে প্রায় ২০০ একর (১৯৯ দশমিক ৪ একর) জমিতে ১ হাজার ৭৮ কোটি ৭১ লাখ টাকা ব্যয়ে পরিকল্পিতভাবে গড়ে তোলা হচ্ছে ট্যানারি শিল্পনগরী। তারপরও নদী এবং পরিবেশ দূষণ ঘটছে।
.
ধলেশ্বরী নদীর তীর ঘেঁষে গড়ে ওঠা বিসিক ট্যানারি শিল্পনগরীএ বিষয়ে সাভার চামড়া শিল্পনগরী প্রকল্পের প্রজেক্ট ইঞ্জিনিয়ার প্রকৌশলী মাঈনুদ্দিন আহমেদ বলেন, ‘এটা সাধারণ কোনও বর্জ্য শোধনাগার নয়, এটা কেন্দ্রীয় বর্জ্য শোধনাগার বা সিইটিপি। এই শিল্প এলাকায় স্থাপিত দেড়শ’ কারখানার বর্জ্য শোধনের ক্ষমতা সম্পন্ন একমাত্র শোধনাগার। এতো বড় বর্জ্য শোধনাগার সম্পর্কে অনেকেরই ধারণা নাই। শোধনাগারের বাকি কাজ শেষ হলে সব কিছু ঠিকঠাক চলবে।’ নদীর পানি দূষণ সম্পর্কে জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘এটা এমন কিছু নয়। সামান্য কিছু পানি হয়তো নদীতে যায়। এতো বড় নদী কি এই সামান্য পানিতে নষ্ট হতে পারে?’
চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের মৎস্য ও সমুদ্র বিজ্ঞান বিভাগের শিক্ষক মিহির রঞ্জন বিশ্বাস অবশ্য এতটা নিশ্চিন্ত হতে পারছেন না। তিনি বলেন, ‘সাভার ট্যানারি শিল্পনগরীতে কেন্দ্রীয় বর্জ্য শোধনাগার কাজ করছে না। সেখানকার কারখানাগুলো পরিত্যক্ত পানি কৌশলে ও গোপনে নদীতে ফেলছে বলে জেনেছি। এটা ঠিক নয়। বিসিক কর্তৃপক্ষের উদাসীনতায় এটা হচ্ছে। যেভাবে হোক, এই মুহূর্ত থেকে নদীতে বিষাক্ত পানি ফেলা বন্ধ করতে হবে। নাহলে মাছ ও নদীর পানি কোনোটাই বাঁচানো যাবে না। এই নদী থেকে মাছ হারিয়ে যাবে।’
পরিবেশ বাঁচাও আন্দোলন (পবা) এর সভাপতি আবু নাসের খানও বিষয়টি নিয়ে চিন্তিত। তিনি বলেন, ‘হাজারীবাগ থেকে ট্যানারি সরানোর মূল কারণ ছিল বুড়িগঙ্গা ও হাজারীবাগ এলাকার পরিবেশ রক্ষা করা। সেজন্য সিইটিপি বসাতে হতো। কিন্তু হাজারীবাগে সিইটিপি বসানো সম্ভব ছিল না। সাভারে অনেক টাকা ব্যয় করে সিইটিপি বসানো হলেও তা কাজে আসছে না। ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান, তত্ত্বাবধানকারী সংস্থা হিসেবে বিসিক ও টেকনিক্যাল সহায়তাকারী প্রতিষ্ঠান বুয়েট এর গাফিলতি এজন্য দায়ী। দূষণ ও দখলের কারণে বুড়িগঙ্গা ও তুরাগ মরে গেছে। একই কারণে মরতে বসেছে ধলেশ্বরী। যে কোনও উপায়ে এ নদীর দখল আর দূষণ রোধ করতে হবে। নাহলে ধলেশ্বরীও মরে যাবে।’
এ প্রসঙ্গে মৎস্য অধিদফতরের মহাপরিচালক সৈয়দ আরিফ আজাদ বলেন, ‘নানা কারণে দেশের খাল-বিল-পুকুর-নদ-নদী থেকে বিভিন্ন প্রজাতির মাছ হারিয়ে যাচ্ছে। এসব জলাশয় ভরাট হয়ে যাওয়া মাছ হারিয়ে যাওয়ার বড় কারণ। মৎস্য বিভাগ থেকে বিভিন্ন গবেষণার মাধ্যমে মাছ রক্ষার কাজ চলছে। গবেষণার মাধ্যমে এখন পাঙ্গাস, পাবদা, টেংরা, শিং, মাগুর সহ বিভিন্ন মাছের চাষ হচ্ছে।’
উল্লেখ্য, ২০০১ সালে দেওয়া আদালতের নির্দেশনা অনুযায়ী হাজারীবাগের সব কারখানা সাভারের হরিণধরায় সরিয়ে নিতে ২০০৩ সালে তিন বছর মেয়াদি প্রকল্প হাতে নেওয়া হয়। এক যুগ আগে শেষ হয়ে গেলেও প্রকল্পের মেয়াদ বাড়ানো হয়েছে সাতবার। শুরুতে প্রকল্পের ব্যয় ১৭৫ কোটি ৭৫ লাখ টাকা নির্ধারণ করা হলেও এখন তা বেড়ে দাঁড়িয়েছে এক হাজার ৭৮ কোটি ৭১ লাখ টাকা। গত মাস পর্যন্ত চামড়া শিল্পনগরীর কাজে আর্থিক অগ্রগতি হয়েছে মাত্র ৫৪ শতাংশ, যা টাকার অংকে মাত্র ৫৭৩ কোটি ৭৮ লাখ টাকা। প্রকল্পের আওতায় এখনও ৫০৪ কোটি ৯৩ লাখ টাকা খরচ করা হয়নি বলে জানিয়েছে পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়ের বাস্তবায়ন, পরীবিক্ষণ ও মূল্যায়ন বিভাগ (আইএমইডি)।