আন্তর্জাতিক নারী দিবস নারীর মর্যাদা প্রতিষ্ঠায় যত্নবান হতে হবে : হেলেনা জাহাঙ্গীর

আজ আন্তর্জাতিক নারী দিবস। ১৯১০ সালে ডেনমার্কে অনুষ্ঠিত নারীদের দ্বিতীয় আন্তর্জাতিক সম্মেলনে এ দিনটিকে আন্তর্জাতিক নারী দিবস হিসেবে পালনের সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। তার পর থেকেই দিনটি ঘটা করে পালন করা হতো সমাজতন্ত্রী শিবিরে। সোভিয়েত বিপ্লবের পর পরই নারী দিবস সমাজতান্ত্রিক বিশ্বের নারীমুক্তি আন্দোলনের প্রত্যয়দীপ্ত দিন হয়ে দাঁড়ায়। ১৯৮৪ সালে জাতিসংঘ ৮ মার্চকে আন্তর্জাতিক নারী দিবস হিসেবে পালনের স্বীকৃতি দেয় এবং তার পর থেকে জাতিসংঘভুক্ত প্রায় সব দেশেই এই দিনটি বিশেষ গুরুত্বের সাথে পালন করা হয়।

নারী অধিকার প্রতিষ্ঠায় সমাজের অগ্রগতি কতখানি সে বিশ্লেষণও করা হয় এই দিনে। বাংলাদেশে নারী উন্নয়নকে টেকসই উন্নয়নের পথ হিসেবে বেছে নেওয়া হয়েছে। দেশের মোট জনসংখ্যার অর্ধেক নারীর উন্নয়ন ছাড়া যে জাতীয় উন্নয়ন সম্ভব নয়, এটি অনুধাবন করেই দেশের নারী উন্নয়নের ক্ষেত্রে প্রতিটি সরকার ইতিবাচক পদক্ষেপ নেওয়ার চেষ্টা করেছে। এর ফলে দেশের রাজনীতিতে যেমন নারীরা দ্রুত স্থান করে নিতে সক্ষম হচ্ছেন তেমন জাতীয় অর্থনীতিতেও নারীর ভূমিকা ক্রমান্বয়ে বাড়ছে। দেশের প্রধান রপ্তানি পণ্য তৈরি পোশাকশিল্পে যে ৪০ লাখ শ্রমিক কর্মরত আছেন তাদের সিংহভাগই নারী।

গত দুই যুগেরও বেশি সময় ধরে দেশের সরকারপ্রধান এবং বিরোধীদলীয় প্রধানের পদ নারী রাজনীতিকদের দখলে। এ মুহূর্তে দেশের প্রধানমন্ত্রী, বিরোধীদলীয় নেতা, স্পিকার ও সংসদ উপনেতা পদে যারা আছেন তারা নারী। বর্তমান সরকারের দুই মেয়াদে স্বরাষ্ট্র, পররাষ্ট্র, কৃষির মতো গুরুত্বপূর্ণ মন্ত্রণালয় পরিচালনার কৃতিত্ব দেখিয়েছেন এ দেশের নারীরা। অর্থনীতি ও রাজনীতিতে নারীর ভূমিকা উন্নত দেশগুলোর তুলনায় খুব বেশি পিছিয়ে না থাকলেও এখনো এ দেশের নারীরা ধর্মীয় গোঁড়ামি এবং সামাজিক অনাচারের শিকার।

অভিযোগ করা হয়, দেশের ৮০ ভাগ নারীই কোনো না কোনোভাবে সহিংসতার শিকার। পুরুষতান্ত্রিক মনোভাব নারীর ক্ষমতায়নে এখনো অন্তরায় হয়ে বিরাজ করছে। নারীর প্রতি সহিংসতার ক্ষেত্রে তাদের কারো কারো আচরণ ‘আইয়ামে জাহেলিয়াকে’-ও হার মানায়। নিজেদের সভ্যসমাজের অংশ হিসেবে বিবেচনা করতে চাইলে নারীর অধিকার এবং মর্যাদা প্রতিষ্ঠায় যত্নবান হতে হবে।

জাতীয় উন্নয়ন ও অগ্রগতির অন্যতম পূর্ব শর্ত হচ্ছে নারী উন্নয়ন। বর্তমান সরকার নারীর সার্বিক অধিকার প্রতিষ্ঠা, ক্ষমতায়ন ও উন্নয়নের মূল ধারায় সম্পৃক্তকরণের লক্ষ্যে বিভিন্ন কর্মসূচি বাস্তবায়ন করছে। অতীতে আমাদের সমাজে নারীশিক্ষার বিষয়টি ছিল উপেক্ষিত। কিন্তু সরকারের নানামুখী পদক্ষেপের ফলে আমাদের দেশে নারী শিক্ষায় ব্যাপক পরিবর্তন এসেছে, এ কথা আজ জোর দিয়েই বলা যায়। কর্মসংস্থানের ক্ষেত্রে দেশের নিরাপত্তা বাহিনীসহ প্রশাসনের বিভিন্ন ক্ষেত্রে নারীর অংশগ্রহণ দেশের সামগ্রিক উন্নয়নকেই চিহ্নিত করে।

নারী-পুরুষ নিজ অবস্থানে সমুজ্জ্বল। পরিবার ও সমাজে কন্যা-জায়া-জননী হিসেবে নারীর ভূমিকা বৈচিত্র্য ও বৈশিষ্ট্যপূর্ণ। একই সঙ্গে নারীর মানবিক মর্যাদা ও ভূমিকাও অনস্বীকার্য। আসলে একটি আধুনিক সমাজে নারী-পুরুষের আলাদা আলাদা ভূমিকার কথা অস্বীকার করা যায় না।

নারী এবং পুরুষ পরস্পরের প্রতিপক্ষ তো নয়ই, বরং একে অপরের পরিপূরক।

সমকালীন বিশ্বে নারী নেতৃত্ব অনেকটাই সুপ্রতিষ্ঠিত। বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে এ কথা আরও সত্যি। এ দেশের দুটি বড় রাজনৈতিক দলের প্রধান নারী। বর্তমান প্রধানমন্ত্রী, স্পীকার, বিরোধীদলীয় নেত্রীও নারী। সরকার, প্রশাসনসহ বিভিন্ন পেশায় নারীদের অবস্থান সুদৃঢ়। নারীরা পুরুষের পাশাপাশি কর্মক্ষেত্রে সমানতালে এগিয়ে যাচ্ছে। কোথাও কোথাও তারা অগ্রগণ্য। কিন্তু তারপরও কোন কোন ক্ষেত্রে নারী এখনও বৈষম্যের শিকার।

নারীর অধিকার ও ক্ষমতায়ন বৃদ্ধি পেলেও দেশের অর্ধেক জনসংখ্যা নারীসমাজ এখনও অনেকটাই পিছিয়ে। যৌতুকসহ নানাবিধ কারণে এখনও অনেক নারীকে নির্যাতিত হতে হয়, কখনও কখনও জীবনও দিতে হয়। কর্মক্ষেত্রেও নারীর বৈষম্য সেভাবে কমেনি। কর্মক্ষেত্রে যৌন হয়রানির শিকার নারী, এমন অভিযোগ প্রায়ই শোনা যায়। বাংলাদেশের অর্থনৈতিক চালিকাশক্তির অন্যতম গার্মেন্টস সেক্টরে শ্রমিকদের বেশিরভাগই নারী। আর কৃষিক্ষেত্রে নারীর অংশগ্রহণ তো সেই অতীতকাল থেকে।

এদেশের নারীরা এখনও বহুবিধ সমস্যায় জর্জরিত। পরিবার, সমাজ, বাইরের কর্মজগৎ ও রাষ্ট্রীয়ভাবে অধিকার আদায়ে প্রতিনিয়ত সংগ্রাম করতে হচ্ছে তাদের। সামাজিক অবক্ষয়, ধর্মান্ধতা এবং অশিক্ষার কারণেও নারী তার প্রাপ্য অধিকার থেকে বঞ্চিত হচ্ছে। বেসরকারি চাকরির ক্ষেত্রে নারীর মজুরি নির্ধারণের ক্ষেত্রে বৈষম্য আমরা দেখছি। এছাড়া যৌতুক, বাল্যবিবাহ, একাধিক কন্যাসন্তানের জন্মদানের কারণে স্ত্রী তালাক, পারিবারিক সহিংসতা, এসিড নিক্ষেপ বা হত্যা করে আত্মহত্যা বলে চালিয়ে দেয়ার ঘটনা ক্রমেই বাড়ছে।

আমি মনে করি, নারীর সত্যিকার উন্নয়ন করতে হলে রাষ্ট্রীয় সব ক্ষেত্রে নারীর অংশগ্রহণ বৃদ্ধির পাশাপাশি নারীর প্রতি আমাদের দৃষ্টিভঙ্গির পরিবর্তন করতে হবে।

Print Friendly, PDF & Email

     এ ক্যাটাগরীর আরো খবর