বঙ্গবন্ধুর শাসনামলে ১১ হাজার যুদ্ধাপরাধী ছিল, তারা এখন কোথায়

ডা. আবদুল আলীম চৌধুরী ছিলেন প্রখ্যাত চক্ষু বিশেষজ্ঞ। মুক্তিযুদ্ধের সময় বিভিন্ন ফার্মেসি ও ওষুধ কোম্পানির কাছ থেকে ওষুধ সংগ্রহ করতেন। তারপর গাড়ির বনেট ভর্তি করে সেগুলো পৌঁছে দিতেন মুক্তিযোদ্ধাদের গোপন ঘাঁটিতে। মুক্তিযোদ্ধাদের চিকিৎসার জন্য একটি গোপন হাসপাতালও ছিল। সেখানে ডা. আলীম, ডা. ফজলে রাব্বি এবং আরো অনেকেই মুক্তিযোদ্ধাদের চিকিৎসা সেবা দিতেন।
১৯৭১ সালের ১৫ ডিসেম্বর বিকেল সাড়ে চারটায় আল-বদর বাহিনী ‘হ্যান্ডস আপ’ করা অবস্থায় চোখ বেঁধে বাসা থেকে ধরে নিয়ে যায় তাকে। সারারাত নির্যাতনের পর ভোররাতে হত্যা করা হয়। তিনদিন পর ১৮ ডিসেম্বর রায়ের বাজার বধ্যভূমিতে বরেণ্য এই বুদ্ধিজীবীর ক্ষত-বিক্ষত লাশটির সন্ধান মেলে। তার বুকে ছিল অনেকগুলো গুলির ও সারা শরীরে নির্যাতনের চিহ্ন। কপালের বাঁ-দিকে এবং তলপেটে ছিল বেয়নেটের গভীর ক্ষত। পরে তাকে আজিমপুর কবরস্থানে দাফন করা হয়। ডা. আবদুল আলীম চৌধুরীকে নিয়ে শহীদজায়া শ্যামলী নাসরীন চৌধুরীর সঙ্গে কথা বলেছেন পূর্বপশ্চিমবিডি’র প্রতিবেদক সিয়াম সারোয়ার জামিল।

মুক্তিযুদ্ধের সময় কীভাবে কাজ করতেন?

‘ঢাকায় কারফিউ চলছে। এক ধরনের সুনসান অবস্থা। তার মধ্যে গোপনে অর্থ সংগ্রহ করে তা মুক্তিযুদ্ধের কাজে লাগিয়েছি আমরা৷ খাবার ও ওষুধ সংগ্রহ করেছি৷ মুক্তিযোদ্ধারা আমাদের বাড়ি থেকে সেগুলো নিয়ে যেতেন৷ বিভিন্ন কারখানা থেকে ওষুধ সংগ্রহ করে মুক্তিযোদ্ধাদের কাছে পৌঁছে দিয়েছি৷ এরপর শীত চলে আসলে মুক্তিযোদ্ধা এবং শরণার্থীদের জন্য নিজ হাতে সোয়েটার বুনেছি। আমাদের বাড়ি থেকে মুক্তিযোদ্ধারা এসব শীতের কাপড় নিয়ে যেতেন৷’

আপনার স্বামী শহীদ বুদ্ধিজীবী ডা: আব্দুল আলীম চৌধুরী কীভাবে ধরে নিয়ে গিয়েছিল? কারা নিয়েছিল?
আমার স্বামীকে আলবদররা ধরে নিয়ে যায়। ১৪ ডিসেম্বর রাতে আলবদরের কর্মীরা বাসায় এসেছিল। মাওলানা আব্দুল মান্নান আমাদের বাসার নিচতলায় থাকতো। আমার স্বামীই তাকে আশ্রয় দিয়েছিল। সবার হাতে অস্ত্র। অস্ত্রের মুখে তারা আমার স্বামীকে বলল, তাদের সঙ্গে যেতে। তিনি বললেন, কাপড়টা পরে আসি। তিনি কাপড় পরলেন। ওরা বলল, কাজ শেষ হলে ফেরত দিয়ে যাব। সেই যে গেল, চলে আসবে বলে। কিন্তু এলো না।’

তার স্বপ্ন কী ছিল?
তার স্বপ্ন ছিল, দেশের মানুষকে পাকিস্তানের শাসন শোষণ থেকে মুক্ত করা। তিনি ছাত্রাবস্থায় ছাত্র রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। ছাত্র ইউনিয়ন করতেন। তিনি সবসময়ই দরিদ্র মানুষের জন্য চিকিৎসা সেবা কিভাবে নিশ্চিত করা যায়- তা ভাবতেন। চিকিৎসা বিজ্ঞানের উন্নয়নে ভূমিকা রাখার চেষ্টা করতেন। আলীম পাকিস্তান মেডিকেল অ্যাসোসিয়েশনের অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা ছিলেন। আফসোস, তিনি দেশের স্বাধীনতা দেখে যেতে পারলেন না।

খুনি নিজামীর শাস্তি হয়েছে, কতটুকু আনন্দ পান?

নিজামী মুজাহিদের বিচারের পর আনন্দ হলেও এখনও সবার বিচার শেষ হয়নি। বঙ্গবন্ধু শাসনামলে ১১ হাজার যুদ্ধাপরাধী ছিল। তারা কোথায়? সবার তো বিচার হয়নি। এদের খুঁজে বের করে যতটা সম্ভব স্বচ্ছতার সঙ্গে বিচারগুলো করতে হবে। কষ্টের কথা হলো, এই রাজাকার-আলবদর-আলশামসদের পুনর্বাসিত করেছিলেন জিয়া। রাজকারকে প্রধানমন্ত্রী বানিয়েছে। এরশাদও এদের বিচার করেনি, জিয়ার নীতি অনুসরণ করেছে। ২০০২ থেকে নিজামী-মুজাহিদকে ক্ষমতার চেয়ারে বসানো হলো। মন্ত্রী বানিয়ে এদের গাড়িতে জাতীয় পতাকাও ওড়ানো হলো। এগুলো দেখে আমরা ভীষণ কষ্ট পেয়েছি। দীর্ঘশ্বাস ফেলেছি। কিন্তু দমে যাইনি। বিশ্বাস রেখেছিলাম, একদিন বিচার হবেই। যুদ্ধাপরাধীদের অনেকেই এমন ভাব করেছে, তাদের কোনো অপরাধ নেই, তারা কিছু করেনি। রায় হওয়ার পরও মুজাহিদ সে তার ছেলেকে দিয়ে বলে পাঠিয়েছে যে, তার কোনো দোষ নেই, সে নির্দোষ। তাকে যে বিচার করা হয়েছে তা অন্যায় বিচার। কত বড় ধৃষ্টতা তার!’

বিচার প্রক্রিয়া নিয়ে কতটা সন্তষ্ট আপনি?

আমরা আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার প্রতি কৃতজ্ঞ। তিনি কথা দিয়েছিলেন বিচার করবেন, কথা রেখেছেন। আমরা তার প্রতি সন্তষ্ট।

বাংলাদেশকে নিয়ে প্রত্যাশার জায়গা কি?

খুব আফসোস হয়, কষ্টের এবং ত্যাগের বিনিময়ে দেশ স্বাধীনের পর জাতির প্রতিটি মানুষের হৃদয়ে কেন স্বাধীনতার চেতনা জাগ্রত নেই? তাই গোটা জাতির মাঝে সেই চেতনা জাগিয়ে তুলতে এবং প্রিয় মাতৃভূমির সার্বভৌমত্ব বজায় রাখতে আমরা এখনও লড়াই চালিয়ে যাচ্ছি৷ এই লড়াইয়েও আমরা সফল হবো সেটিই আমাদের প্রত্যাশা৷

Print Friendly, PDF & Email

     এ ক্যাটাগরীর আরো খবর