ঢাকা ০২:৫০ অপরাহ্ন, শুক্রবার, ১৫ নভেম্বর ২০২৪, ১ অগ্রহায়ণ ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

প্রেমে কি আমি, জিততে জিততে হেরে যাবো

  • Reporter Name
  • আপডেট টাইম : ০৪:৪৭:২২ অপরাহ্ন, শনিবার, ১০ ডিসেম্বর ২০১৬
  • ৩৮৯ বার

পীর হাবিবুর রহমান

তিনদিন ধরে কোল্ড অ্যাটাকে আক্রান্ত হয়ে জ্বরে ভুগছি। শয্যা থেকে মাথা তুলতে পারছি না। অসহ্য যন্ত্রণা। শরীরের যন্ত্রণা সহনীয় হলেও মনের যন্ত্রণা বইতে পারিনা। তবুও উজানে সাঁতার কাটা মানুষ আমি। পাথর কেটে কেটে পথ চলতে গিয়ে মনের যন্ত্রণাই বেশি ভোগ করেছি। তবুও দমিনি কখনো। ক্লান্ত হইনি কখনো। হারতে শিখিনি। কঠিন বিপর্যয় থেকে উঠে এসে ঘুরে দাঁড়িয়েছি। কিন্তু জ্বরের শয্যায় শুয়ে হেডেক নিয়ে প্রেমে ক্ষত বিক্ষত হৃদয়ে উচ্চারিত হচ্ছে এইবার কি আমার প্রেমে জিততে জিততে হারতে যাচ্ছি? এ লেখা শেষ হওয়ার কিছু সময় পর আমার প্রেম, আমার স্বপ্ন, আমার সাধনা, আমার চ্যালেঞ্জ, অনলাইন নিউজপোর্টাল পূর্বপশ্চিমবিডি.নিউজের একবছর পূর্তি হচ্ছে। এক বছর অনেকের কাছে সামান্য সময় হলেও কর্পোরেট সংস্কৃতির আগ্রাসনের যুগে এটি টানতে উপলব্দি করেছি, এর ভার কতটা!

জমকালো আয়োজনে, ব্যাপক প্রচারে অসংখ্য সংবাদকর্মী নিয়ে যে পূর্বপশ্চিমের যাত্রা শুরু করেছিলাম, আজ প্রতিষ্ঠা বার্ষিকীর দিনে কোনো আয়োজন করার সামর্থ্য আমার নেই। আমার জীবনের সকল সঞ্চয় এখানে ব্যয় করেছি। আমার সন্তানের এফডিআর পর্যন্ত এখানে দিয়েছি। বন্ধু-স্বজনের কাছে আর্থিকভাবে ঋণগ্রস্ত হয়েছি। তবুও আমি হাল ছাড়ছি না। শুরুতে অনেকে সহযোগিতার অঙ্গীকার করে সঙ্গে থাকেননি। নানামহলের হিসেবে নিকেশ করেছেন। অনেকে পাশে ছিলেন। অনেক সংবাদকর্মী সঙ্গে নেই। কিন্তু আছেন আমার পাঠক, একদল হাল না ছাড়া সংবাদকর্মী আর অসংখ্য শুভাকাঙ্খী।

কেউ কেউ আশপাশ থেকে অন্ধকারে পিঠে ছুরি চালালেও অনেকেই সাহস দিতে ভুলেননি। সন্তান থেকে প্রিয়জন, প্রিয়জন থেকে বন্ধু-শুভাকাঙ্খী অনেকেই বলেন, আপনার মতো শক্তিমান লেখক বড় কাগজে থাকা উচিত। বড় কাগজে লেখা উচিত। আমি তাদেরকে বুঝাতে পারিনা, আমি যা লিখতে চেয়েছি, তা লিখতে পারছি না। আমি যা বলতে চেয়েছি, তা বলতে পারছি না। একজন সাংবাদিক লেখকের জন্য লিখতে না পারার বেদনা কতটুকু তা শুধু প্রসবকালে সন্তান হারানো মায়েরাই বুঝতে পারবেন। পাখি যেমন আকাশে উড়ে আনন্দ পায়, একজন লেখক-সাংবাদিক তা পায় লেখায়।

নিউজপোর্টাল শুরুর আগে আমার অভিজ্ঞতা ছিল না। আমি প্রিন্ট মিডিয়ার লোক। তাই কখনো ইলেকট্রনিক মিডিয়াতেও যাইনি। আমি আত্নমর্যাদা এবং অহম ধুলোয় মিশিয়ে দিয়ে শিল্পপতিদের দুয়ারে দুয়ারে ঘুরতে পারিনি। জীবনে কখনো সম্মানি ছাড়া কোথাও লিখিনি। সেখানে আমার লেখকদের আমি সম্মানি দিতে পারি না বলে লেখা চাইতে পারি না। আমার আপনজনরা আমাকে বড় বড় গণমাধ্যমে দেখতে চান। তারা জানেন না কর্পোরেট সংস্কৃতির যুগে তোফাজ্জল হোসেন মানিক মিয়া থেকে বজলুর রহমানদের যুগ বাসী হয়ে গেছে। গণমাধ্যমে বিশাল পুঁজির বিনিয়োগ যেমন সংবাদকর্মীদের জীবনকে স্বচ্ছল করেছে তেমনি সাংবাদিকতাকে শ্রেফ ‘চাকরি’ তে এনে দাঁড় করিয়েছে। কোনো কোনো জায়গায় মালিকশ্রেণী সম্পাদক ও নির্বাহী সম্পাদকদের তাদের কোনো ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের জিএম অথবা ডিজিএমদের কাতারেই ধরেন। আর আমরা হয়ে যাচ্ছি তাদের পুঁজির পাহারাদার।

চারপাশ তাকালে মনে হয়, আগামী কয়েক বছরের মধ্যে প্রিন্ট মিডিয়ার জায়গায় অনলাইন যেমন শক্তিশালী রূপ নেবে তেমনি কর্পোরেট মিডিয়ায় পেশাদার সংবাদকর্মীরা সম্পাদক হিসেবে থাকতে পারবেন কিনা এ নিয়ে আমার আশংকা রয়েছে। আমার আপনজনরা আমার কল্যাণের জন্য পরামর্শ দিতে এসে কার্যত আমাকে যে দুর্বল করেন, হতাশ করেন সেটি তারা বুঝেন না। হতাশাই জিতে যাওয়া মানুষকে হারিয়ে দেয়। তাদের কাছে আমার প্রশ্ন, আমি কি তবে জিততে জিততে হেরে যাচ্ছি? তারা কি দেখেননি, এই কর্পোরেট সংস্কৃতির যুগে আপোস করেও আমি শুধু লেখার সুখটুকু নিয়ে বাঁচতে চেয়েছিলাম।

যাক, যতবার দহন আমাকে পুড়িয়েছে। এই বলেই স্বান্তনা খুঁজেছি পৃথিবীর তাবৎ অনুভূতিপ্রবণ সৃষ্টিশীল মানুষেরাই অন্তহীন বেদনা সয়েছেন। অতৃপ্তি, হাহাকার নিয়ে পৃথিবী থেকে চিরবিদায় নিয়েছেন। কিন্তু কৈশর থেকে তারুণ্যের ছাত্র রাজনীতিতে জড়িয়ে পরার স্বপ্ন, মোহ ও নেশা থেকে বেরিয়ে আসার পর রিপোর্টারের যে জীবন বেছে নিয়েছিলাম সকল আবেগ, অনুভূতি দিয়ে তাকে ভালোবেসেছিলাম।

আমার জীবনে সবচে রোমাঞ্চকর, ঘটনাবহুল, আনন্দময় সময় কেটেছে রিপোর্টিং জীবনে। রিপোর্ট হলো গণমাধ্যমের হৃদপিণ্ড। রিপোর্টার হলো গণমাধ্যমের নায়ক। আর এই উপমহাদেশে রাজনৈতিক রিপোর্টাররা হলেন পাঠকের সামনে শাহেন শাহ। পেশার তারে জড়ানো জীবনে শুরু থেকেই সংসদ ও রাজনৈতিক বিটে শোলক সন্ধানীর মতো তন্ন তন্ন করে খবর খুজেঁ বেরিয়েছি। রাজনীতির অন্দরমহল হাতরে এনেছি অনেক এক্সক্লুুসিভ রিপোর্ট। রাজনৈতিক বিশ্লেষণমূলক রিপোর্টে পাঠককে বরাবর দিতে পেরেছি রাজনীতির গতিপ্রবাহ সম্পর্কে আগাম পূর্বাভাস।

সম্পাদক কখনো হতে চাইনি। চেয়েছিলাম রিপোর্টার হতে, হয়েছি। চেয়েছিলাম রাজনৈতিক বিশ্লেষক হতে, হয়েছি। এই আমিত্ব কোনো অহংকার নয়, আত্নবিশ্বাস। এখানে আমার আত্নবিশ্বাসের শক্তি আমার পাঠকগণ। তাদের সঙ্গে দীর্ঘ পেশাগত জীবনে যে সম্পর্ক গড়ে উঠেছে সেটির দর্শন মিলে দেশে বিদেশে যেখানে যাই সেখানেই। দুহাত খুলে লেখা, মুক্তকণ্ঠে কথা বলা আরেকটু নিরাপদ আত্নমর্যাদার সঙ্গে মধ্যবিত্তের স্বচ্ছল জীবনযাপনের চেয়ে বেশি কিছু চাইনি।

একজন রোমান্টিক কিশোর যে আবেগ নিয়ে তার প্রথম প্রেমের বালিকাকে ভালোবেসেছিলো সেভাবেই আমি আমার পেশাগত জগতকে ভালোবেসে উপভোগ করেছি। নানা অনিশ্চয়তার টানাপোড়েন, উত্থান, পতন আমার পায়ে পায়ে হেঁটেছে। আমাকে কখনো আটকাতে পারেনি, দমাতে পারেনি। প্রবাসে বসে এক পা কবরে রাখা ফরমায়েসি লেখকই নন জীবন্ত কিংবদন্তী এক প্রবীণকে দেখেছি আমার পাঠকপ্রিয়তা দেখে কতটা ঈর্ষায় ভরা সমাজে বসে নিজের মুখ জ্বালিয়ে পুড়িয়েছেন। এসব কোনো কিছুই আমলে নেইনি। বাকিদের কথা নাই বা বললাম। এদের উল্টোপিঠে সংখ্যাগরিষ্ঠরাই দিয়েছেন ভালোবাসা।

মুক্তিযুদ্ধের মহান অঙ্গীকার একটি অসাম্প্রদায়িক, গণতান্ত্রিক, শোষণমুক্ত বাংলাদেশের স্বপ্ন থেকে এখনো বিচ্যুত হইনি। জীবনে উপলব্দি করেছি, মানুষের জন্য সবচে কষ্টকর হলো মনের ইচ্ছার বিরুদ্ধে কিছু করা, হাসতে পারা, কাঁদতে পারাও এক দুর্লভ বিষয়। স্ববিরোধী চরিত্র নিয়ে মন মানে না, যুক্তি মানে না, কোনো ব্যক্তি বা দলের প্রতি আনুগত্য প্রদর্শন করে কখনো কিছু বলিনি, লিখিনি। সময়ের তালে তালে নিজেকে বদলাই নি। যেকোনো কথা, যেকোনো লেখা যে কারো পক্ষে যেতে পারে; যে কারো বিপক্ষেও যেতে পারে। সে আমার দায় নয়। আমি বিশ্বাসও করি না, আমার কথাই শেষ কথা নয়। গণতান্ত্রিক সমাজে শতফুল ফুটতে দেয়ার মতো সকল মত প্রকাশের স্বাধীনতা থাকতে হয়।

ফরাসি দার্শনিক ভলতেয়ারের সেই মহান উক্তি, ‘আমি তোমার মতের সঙ্গে একমত নাও হতে পারি, কিন্ত তোমার মত প্রকাশের স্বাধীনতার জন্য জীবন দিতে পারি।’ এ কথা হৃদয়ে লালন করে পথ হেঁটেছি। কবিগুরু রবি ঠাকুরের ‘সত্য সে যে কঠিন, কঠিনেরে ভালোবাসিলাম আমি। কারণ সত্য করে না বঞ্চণা।’ এটি লালন ও ধারণ করে কাফফারা কম দেয়া হয়নি। তবুও নিজের সঙ্গে নিজের যে অঙ্গিকার, নিজের সঙ্গে নিজের যে বুঝাপড়া; তার সঙ্গে কখনো বিশ্বাসঘাতকতা করিনি। পেশার জায়গাটিকে গভীর প্রেম ও ইবাদতের মতো নিতে গিয়ে বহু আগেই রাজনীতি, দলাদলি, ভণ্ডামি, কপটতা, ধুর্ততার মতো কঠিন বিষয়গুলো আশ্রয় নেয়া নির্বাচন বহু আগে ছেড়েছি। জীবনে ভুল করলেও পাপ করিনি।

রাজনৈতিক দলের লেজুরভিত্তিক ফোরাম থেকেও নিজেকে মুক্ত করেছি। বিশ্বাস করি বাঙালির মহত্বম নেতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান আমার হৃদয় ও চেতনা জুড়ে বাস করেন। তিনিই আমার নেতা। মানুষই আমার দল। বঙ্গবন্ধু, দেশ, মানুষ ও মুক্তিযুদ্ধের অঙ্গিকার লালনের জন্য একজন লেখক বা সংবাদকর্মীর কোনো দলীয় দাসত্বের প্রয়োজন পরে না। সংবিধান, আইন ও বিধিবিধান অনুযায়ী রাষ্ট্র পরিচালনায় বরাবর কাম্য।

দেড় বছর আগে কর্পোরেট সংস্কৃতির যুগে পেশাদারিত্বের মর্যাদা নিয়ে টিকে থাকা। অনেক কঠিন তারচেয়েও বেশি কঠিন নিজের মতো করে স্বাধীনভাবে বেঁচে থাকা- এই কথা বলে অনলাইন নিউজ পোর্টাল পূর্বপশ্চিমবিডি.নিউজ নিয়ে যাত্রা শুরু করেছিলাম। লিমিটেড কোম্পানি করে স্নেহভাজনেষু আইটি বিশেষজ্ঞ মেধাবী, পরিচ্ছন্ন তরুণ সৈয়দ সায়োরার রহমান প্রিন্সকে সঙ্গে নিয়ে যাত্রা করেছিলাম। আইটি ফার্মের কর্ণধার প্রিন্স ২০১০ সালে শেয়ার বাজারে বিনিয়োগ করতে গিয়ে ৮ কোটি টাকা লোকসান দিয়ে এসেছেন। একজন সৎ, সম্ভাবনাময় তরুণ উদ্যেক্তারও দহন রয়েছে।

আজ এক বছরের মাথায় আমার মিনার মাহমুদের কথা মনে পড়ে। আমাদের প্রজন্মের সাহসী, মেধাবী সাংবাদিক ও লেখক মিনার মাহমুদ দেশ ছেড়ে আমেরিকায় পাড়ি জমিয়েছিলেন। দীর্ঘ প্রবাস জীবন কাটিয়ে দেশে ফিরে প্রতিভাদীপ্ত সাহসী মানুষটি কিছু করতে না পারার বেদনা নিয়ে গভীর হতাশায় ডুবে আত্নহত্যা করেছিলেন। আত্নহত্যার মতো ঘটনা ঘটিয়ে জীবন থেকে পালাবার মানুষ আমি নই। আমি জানি, যুদ্ধই আমার জীবন। যুদ্ধে হেরে গেলে আমার স্বপ্নের পূর্বপশ্চিম বন্ধ হয়ে যাবে।

শরৎ চন্দ্রের বড় প্রেম শুধু কাছেই না টানে না, দূরে ও ঠেলে দেয়ার মতো প্রেমিকার সঙ্গে যে বিচ্ছেদ যন্ত্রণা সেটিই বাকি জীবন ভোগ করবো। কিন্তু আমি আমার বিশ্বাস, আমার আত্নমর্যাদা নিয়ে বেঁচে থাকার সংগ্রামটিই করে যাবে। আমার বছর পূর্তিতে পাঠকদের কাছে আশ্রয় চাইছি। আমার পাঠকেরাই উপলব্ধি করতে পারবেন, প্রেম চাইলেও পৃথিবীতে আমি করুণা চাইতে আসিনি। আমার পূর্বপশ্চিমবিডি.নিউজের সঙ্গে একটি স্বপ্ন জড়িত। যে স্বপ্ন দেশ ও মানুষের কল্যাণে ক্রিয়াশীল। যে স্বপ্নের সঙ্গে একদল সংবাদকর্মীর মহব্বত ও রুটি-রুজি জড়িয়ে গেছে। পাঠকদের কাছে আমার আবদার দু’টি-আমাদের বেঁচে থাকার, টিকে থাকার জন্য আপনারা নিয়মিত যেকোনো বিষয় নিয়ে লিখুন। আপনারা নিয়মিত নিউজপোর্টালটি পাঠ করুন। আপনাদের নিয়ে আমরাতো জিততেই এসেছিলাম, হারতে আসিনি।

লেখক: প্রধান সম্পাদক, পূর্বপশ্চিমবিডি.নিউজ

Tag :

Write Your Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Save Your Email and Others Information

About Author Information

Haor Barta24

জনপ্রিয় সংবাদ

প্রেমে কি আমি, জিততে জিততে হেরে যাবো

আপডেট টাইম : ০৪:৪৭:২২ অপরাহ্ন, শনিবার, ১০ ডিসেম্বর ২০১৬

পীর হাবিবুর রহমান

তিনদিন ধরে কোল্ড অ্যাটাকে আক্রান্ত হয়ে জ্বরে ভুগছি। শয্যা থেকে মাথা তুলতে পারছি না। অসহ্য যন্ত্রণা। শরীরের যন্ত্রণা সহনীয় হলেও মনের যন্ত্রণা বইতে পারিনা। তবুও উজানে সাঁতার কাটা মানুষ আমি। পাথর কেটে কেটে পথ চলতে গিয়ে মনের যন্ত্রণাই বেশি ভোগ করেছি। তবুও দমিনি কখনো। ক্লান্ত হইনি কখনো। হারতে শিখিনি। কঠিন বিপর্যয় থেকে উঠে এসে ঘুরে দাঁড়িয়েছি। কিন্তু জ্বরের শয্যায় শুয়ে হেডেক নিয়ে প্রেমে ক্ষত বিক্ষত হৃদয়ে উচ্চারিত হচ্ছে এইবার কি আমার প্রেমে জিততে জিততে হারতে যাচ্ছি? এ লেখা শেষ হওয়ার কিছু সময় পর আমার প্রেম, আমার স্বপ্ন, আমার সাধনা, আমার চ্যালেঞ্জ, অনলাইন নিউজপোর্টাল পূর্বপশ্চিমবিডি.নিউজের একবছর পূর্তি হচ্ছে। এক বছর অনেকের কাছে সামান্য সময় হলেও কর্পোরেট সংস্কৃতির আগ্রাসনের যুগে এটি টানতে উপলব্দি করেছি, এর ভার কতটা!

জমকালো আয়োজনে, ব্যাপক প্রচারে অসংখ্য সংবাদকর্মী নিয়ে যে পূর্বপশ্চিমের যাত্রা শুরু করেছিলাম, আজ প্রতিষ্ঠা বার্ষিকীর দিনে কোনো আয়োজন করার সামর্থ্য আমার নেই। আমার জীবনের সকল সঞ্চয় এখানে ব্যয় করেছি। আমার সন্তানের এফডিআর পর্যন্ত এখানে দিয়েছি। বন্ধু-স্বজনের কাছে আর্থিকভাবে ঋণগ্রস্ত হয়েছি। তবুও আমি হাল ছাড়ছি না। শুরুতে অনেকে সহযোগিতার অঙ্গীকার করে সঙ্গে থাকেননি। নানামহলের হিসেবে নিকেশ করেছেন। অনেকে পাশে ছিলেন। অনেক সংবাদকর্মী সঙ্গে নেই। কিন্তু আছেন আমার পাঠক, একদল হাল না ছাড়া সংবাদকর্মী আর অসংখ্য শুভাকাঙ্খী।

কেউ কেউ আশপাশ থেকে অন্ধকারে পিঠে ছুরি চালালেও অনেকেই সাহস দিতে ভুলেননি। সন্তান থেকে প্রিয়জন, প্রিয়জন থেকে বন্ধু-শুভাকাঙ্খী অনেকেই বলেন, আপনার মতো শক্তিমান লেখক বড় কাগজে থাকা উচিত। বড় কাগজে লেখা উচিত। আমি তাদেরকে বুঝাতে পারিনা, আমি যা লিখতে চেয়েছি, তা লিখতে পারছি না। আমি যা বলতে চেয়েছি, তা বলতে পারছি না। একজন সাংবাদিক লেখকের জন্য লিখতে না পারার বেদনা কতটুকু তা শুধু প্রসবকালে সন্তান হারানো মায়েরাই বুঝতে পারবেন। পাখি যেমন আকাশে উড়ে আনন্দ পায়, একজন লেখক-সাংবাদিক তা পায় লেখায়।

নিউজপোর্টাল শুরুর আগে আমার অভিজ্ঞতা ছিল না। আমি প্রিন্ট মিডিয়ার লোক। তাই কখনো ইলেকট্রনিক মিডিয়াতেও যাইনি। আমি আত্নমর্যাদা এবং অহম ধুলোয় মিশিয়ে দিয়ে শিল্পপতিদের দুয়ারে দুয়ারে ঘুরতে পারিনি। জীবনে কখনো সম্মানি ছাড়া কোথাও লিখিনি। সেখানে আমার লেখকদের আমি সম্মানি দিতে পারি না বলে লেখা চাইতে পারি না। আমার আপনজনরা আমাকে বড় বড় গণমাধ্যমে দেখতে চান। তারা জানেন না কর্পোরেট সংস্কৃতির যুগে তোফাজ্জল হোসেন মানিক মিয়া থেকে বজলুর রহমানদের যুগ বাসী হয়ে গেছে। গণমাধ্যমে বিশাল পুঁজির বিনিয়োগ যেমন সংবাদকর্মীদের জীবনকে স্বচ্ছল করেছে তেমনি সাংবাদিকতাকে শ্রেফ ‘চাকরি’ তে এনে দাঁড় করিয়েছে। কোনো কোনো জায়গায় মালিকশ্রেণী সম্পাদক ও নির্বাহী সম্পাদকদের তাদের কোনো ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের জিএম অথবা ডিজিএমদের কাতারেই ধরেন। আর আমরা হয়ে যাচ্ছি তাদের পুঁজির পাহারাদার।

চারপাশ তাকালে মনে হয়, আগামী কয়েক বছরের মধ্যে প্রিন্ট মিডিয়ার জায়গায় অনলাইন যেমন শক্তিশালী রূপ নেবে তেমনি কর্পোরেট মিডিয়ায় পেশাদার সংবাদকর্মীরা সম্পাদক হিসেবে থাকতে পারবেন কিনা এ নিয়ে আমার আশংকা রয়েছে। আমার আপনজনরা আমার কল্যাণের জন্য পরামর্শ দিতে এসে কার্যত আমাকে যে দুর্বল করেন, হতাশ করেন সেটি তারা বুঝেন না। হতাশাই জিতে যাওয়া মানুষকে হারিয়ে দেয়। তাদের কাছে আমার প্রশ্ন, আমি কি তবে জিততে জিততে হেরে যাচ্ছি? তারা কি দেখেননি, এই কর্পোরেট সংস্কৃতির যুগে আপোস করেও আমি শুধু লেখার সুখটুকু নিয়ে বাঁচতে চেয়েছিলাম।

যাক, যতবার দহন আমাকে পুড়িয়েছে। এই বলেই স্বান্তনা খুঁজেছি পৃথিবীর তাবৎ অনুভূতিপ্রবণ সৃষ্টিশীল মানুষেরাই অন্তহীন বেদনা সয়েছেন। অতৃপ্তি, হাহাকার নিয়ে পৃথিবী থেকে চিরবিদায় নিয়েছেন। কিন্তু কৈশর থেকে তারুণ্যের ছাত্র রাজনীতিতে জড়িয়ে পরার স্বপ্ন, মোহ ও নেশা থেকে বেরিয়ে আসার পর রিপোর্টারের যে জীবন বেছে নিয়েছিলাম সকল আবেগ, অনুভূতি দিয়ে তাকে ভালোবেসেছিলাম।

আমার জীবনে সবচে রোমাঞ্চকর, ঘটনাবহুল, আনন্দময় সময় কেটেছে রিপোর্টিং জীবনে। রিপোর্ট হলো গণমাধ্যমের হৃদপিণ্ড। রিপোর্টার হলো গণমাধ্যমের নায়ক। আর এই উপমহাদেশে রাজনৈতিক রিপোর্টাররা হলেন পাঠকের সামনে শাহেন শাহ। পেশার তারে জড়ানো জীবনে শুরু থেকেই সংসদ ও রাজনৈতিক বিটে শোলক সন্ধানীর মতো তন্ন তন্ন করে খবর খুজেঁ বেরিয়েছি। রাজনীতির অন্দরমহল হাতরে এনেছি অনেক এক্সক্লুুসিভ রিপোর্ট। রাজনৈতিক বিশ্লেষণমূলক রিপোর্টে পাঠককে বরাবর দিতে পেরেছি রাজনীতির গতিপ্রবাহ সম্পর্কে আগাম পূর্বাভাস।

সম্পাদক কখনো হতে চাইনি। চেয়েছিলাম রিপোর্টার হতে, হয়েছি। চেয়েছিলাম রাজনৈতিক বিশ্লেষক হতে, হয়েছি। এই আমিত্ব কোনো অহংকার নয়, আত্নবিশ্বাস। এখানে আমার আত্নবিশ্বাসের শক্তি আমার পাঠকগণ। তাদের সঙ্গে দীর্ঘ পেশাগত জীবনে যে সম্পর্ক গড়ে উঠেছে সেটির দর্শন মিলে দেশে বিদেশে যেখানে যাই সেখানেই। দুহাত খুলে লেখা, মুক্তকণ্ঠে কথা বলা আরেকটু নিরাপদ আত্নমর্যাদার সঙ্গে মধ্যবিত্তের স্বচ্ছল জীবনযাপনের চেয়ে বেশি কিছু চাইনি।

একজন রোমান্টিক কিশোর যে আবেগ নিয়ে তার প্রথম প্রেমের বালিকাকে ভালোবেসেছিলো সেভাবেই আমি আমার পেশাগত জগতকে ভালোবেসে উপভোগ করেছি। নানা অনিশ্চয়তার টানাপোড়েন, উত্থান, পতন আমার পায়ে পায়ে হেঁটেছে। আমাকে কখনো আটকাতে পারেনি, দমাতে পারেনি। প্রবাসে বসে এক পা কবরে রাখা ফরমায়েসি লেখকই নন জীবন্ত কিংবদন্তী এক প্রবীণকে দেখেছি আমার পাঠকপ্রিয়তা দেখে কতটা ঈর্ষায় ভরা সমাজে বসে নিজের মুখ জ্বালিয়ে পুড়িয়েছেন। এসব কোনো কিছুই আমলে নেইনি। বাকিদের কথা নাই বা বললাম। এদের উল্টোপিঠে সংখ্যাগরিষ্ঠরাই দিয়েছেন ভালোবাসা।

মুক্তিযুদ্ধের মহান অঙ্গীকার একটি অসাম্প্রদায়িক, গণতান্ত্রিক, শোষণমুক্ত বাংলাদেশের স্বপ্ন থেকে এখনো বিচ্যুত হইনি। জীবনে উপলব্দি করেছি, মানুষের জন্য সবচে কষ্টকর হলো মনের ইচ্ছার বিরুদ্ধে কিছু করা, হাসতে পারা, কাঁদতে পারাও এক দুর্লভ বিষয়। স্ববিরোধী চরিত্র নিয়ে মন মানে না, যুক্তি মানে না, কোনো ব্যক্তি বা দলের প্রতি আনুগত্য প্রদর্শন করে কখনো কিছু বলিনি, লিখিনি। সময়ের তালে তালে নিজেকে বদলাই নি। যেকোনো কথা, যেকোনো লেখা যে কারো পক্ষে যেতে পারে; যে কারো বিপক্ষেও যেতে পারে। সে আমার দায় নয়। আমি বিশ্বাসও করি না, আমার কথাই শেষ কথা নয়। গণতান্ত্রিক সমাজে শতফুল ফুটতে দেয়ার মতো সকল মত প্রকাশের স্বাধীনতা থাকতে হয়।

ফরাসি দার্শনিক ভলতেয়ারের সেই মহান উক্তি, ‘আমি তোমার মতের সঙ্গে একমত নাও হতে পারি, কিন্ত তোমার মত প্রকাশের স্বাধীনতার জন্য জীবন দিতে পারি।’ এ কথা হৃদয়ে লালন করে পথ হেঁটেছি। কবিগুরু রবি ঠাকুরের ‘সত্য সে যে কঠিন, কঠিনেরে ভালোবাসিলাম আমি। কারণ সত্য করে না বঞ্চণা।’ এটি লালন ও ধারণ করে কাফফারা কম দেয়া হয়নি। তবুও নিজের সঙ্গে নিজের যে অঙ্গিকার, নিজের সঙ্গে নিজের যে বুঝাপড়া; তার সঙ্গে কখনো বিশ্বাসঘাতকতা করিনি। পেশার জায়গাটিকে গভীর প্রেম ও ইবাদতের মতো নিতে গিয়ে বহু আগেই রাজনীতি, দলাদলি, ভণ্ডামি, কপটতা, ধুর্ততার মতো কঠিন বিষয়গুলো আশ্রয় নেয়া নির্বাচন বহু আগে ছেড়েছি। জীবনে ভুল করলেও পাপ করিনি।

রাজনৈতিক দলের লেজুরভিত্তিক ফোরাম থেকেও নিজেকে মুক্ত করেছি। বিশ্বাস করি বাঙালির মহত্বম নেতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান আমার হৃদয় ও চেতনা জুড়ে বাস করেন। তিনিই আমার নেতা। মানুষই আমার দল। বঙ্গবন্ধু, দেশ, মানুষ ও মুক্তিযুদ্ধের অঙ্গিকার লালনের জন্য একজন লেখক বা সংবাদকর্মীর কোনো দলীয় দাসত্বের প্রয়োজন পরে না। সংবিধান, আইন ও বিধিবিধান অনুযায়ী রাষ্ট্র পরিচালনায় বরাবর কাম্য।

দেড় বছর আগে কর্পোরেট সংস্কৃতির যুগে পেশাদারিত্বের মর্যাদা নিয়ে টিকে থাকা। অনেক কঠিন তারচেয়েও বেশি কঠিন নিজের মতো করে স্বাধীনভাবে বেঁচে থাকা- এই কথা বলে অনলাইন নিউজ পোর্টাল পূর্বপশ্চিমবিডি.নিউজ নিয়ে যাত্রা শুরু করেছিলাম। লিমিটেড কোম্পানি করে স্নেহভাজনেষু আইটি বিশেষজ্ঞ মেধাবী, পরিচ্ছন্ন তরুণ সৈয়দ সায়োরার রহমান প্রিন্সকে সঙ্গে নিয়ে যাত্রা করেছিলাম। আইটি ফার্মের কর্ণধার প্রিন্স ২০১০ সালে শেয়ার বাজারে বিনিয়োগ করতে গিয়ে ৮ কোটি টাকা লোকসান দিয়ে এসেছেন। একজন সৎ, সম্ভাবনাময় তরুণ উদ্যেক্তারও দহন রয়েছে।

আজ এক বছরের মাথায় আমার মিনার মাহমুদের কথা মনে পড়ে। আমাদের প্রজন্মের সাহসী, মেধাবী সাংবাদিক ও লেখক মিনার মাহমুদ দেশ ছেড়ে আমেরিকায় পাড়ি জমিয়েছিলেন। দীর্ঘ প্রবাস জীবন কাটিয়ে দেশে ফিরে প্রতিভাদীপ্ত সাহসী মানুষটি কিছু করতে না পারার বেদনা নিয়ে গভীর হতাশায় ডুবে আত্নহত্যা করেছিলেন। আত্নহত্যার মতো ঘটনা ঘটিয়ে জীবন থেকে পালাবার মানুষ আমি নই। আমি জানি, যুদ্ধই আমার জীবন। যুদ্ধে হেরে গেলে আমার স্বপ্নের পূর্বপশ্চিম বন্ধ হয়ে যাবে।

শরৎ চন্দ্রের বড় প্রেম শুধু কাছেই না টানে না, দূরে ও ঠেলে দেয়ার মতো প্রেমিকার সঙ্গে যে বিচ্ছেদ যন্ত্রণা সেটিই বাকি জীবন ভোগ করবো। কিন্তু আমি আমার বিশ্বাস, আমার আত্নমর্যাদা নিয়ে বেঁচে থাকার সংগ্রামটিই করে যাবে। আমার বছর পূর্তিতে পাঠকদের কাছে আশ্রয় চাইছি। আমার পাঠকেরাই উপলব্ধি করতে পারবেন, প্রেম চাইলেও পৃথিবীতে আমি করুণা চাইতে আসিনি। আমার পূর্বপশ্চিমবিডি.নিউজের সঙ্গে একটি স্বপ্ন জড়িত। যে স্বপ্ন দেশ ও মানুষের কল্যাণে ক্রিয়াশীল। যে স্বপ্নের সঙ্গে একদল সংবাদকর্মীর মহব্বত ও রুটি-রুজি জড়িয়ে গেছে। পাঠকদের কাছে আমার আবদার দু’টি-আমাদের বেঁচে থাকার, টিকে থাকার জন্য আপনারা নিয়মিত যেকোনো বিষয় নিয়ে লিখুন। আপনারা নিয়মিত নিউজপোর্টালটি পাঠ করুন। আপনাদের নিয়ে আমরাতো জিততেই এসেছিলাম, হারতে আসিনি।

লেখক: প্রধান সম্পাদক, পূর্বপশ্চিমবিডি.নিউজ