ঢাকা ০৩:১১ অপরাহ্ন, শুক্রবার, ১৪ নভেম্বর ২০২৫, ৩০ কার্তিক ১৪৩২ বঙ্গাব্দ

আচরণের আয়নায় ঈমানের প্রতিচ্ছবি

  • Reporter Name
  • আপডেট টাইম : ১১:১২:৪৫ পূর্বাহ্ন, রবিবার, ২ নভেম্বর ২০২৫
  • ২২ বার
ইসলাম এমন এক পরিপূর্ণ জীবনব্যবস্থা, যা মানুষের প্রতিটি সম্পর্ক শৃঙ্খলিত করে। সেই সম্পর্কটি আল্লাহর সঙ্গে হোক, মানুষের সঙ্গে হোক বা সমাজের সঙ্গে হোক। কারণ একজন মুমিনের ঈমান শুধু মুখের স্বীকারোক্তিতে সীমাবদ্ধ নয়; তার আচরণ, কথাবার্তা ও পারস্পরিক ব্যবহারেও সেই ঈমানের প্রতিফলন ঘটতে হয়। রাসুলুল্লাহ (সা.) এই হাদিসে ঈমানের তিনটি গুরুত্বপূর্ণ সামাজিক প্রতিফলন তুলে ধরেছেন।

সেগুলো হচ্ছে- অতিথিসেবায় সৌজন্য, প্রতিবেশীর প্রতি সদ্ব্যবহার এবং শিষ্টাচারপূর্ণ বাক্যব্যবহার-

عَنْ أَبِي هُرَيْرَةَ، قَالَ قَالَ رَسُولُ اللَّهِ صلى الله عليه وسلم ‏ “‏ مَنْ كَانَ يُؤْمِنُ بِاللَّهِ وَالْيَوْمِ الآخِرِ فَلاَ يُؤْذِ جَارَهُ، وَمَنْ كَانَ يُؤْمِنُ بِاللَّهِ وَالْيَوْمِ الآخِرِ فَلْيُكْرِمْ ضَيْفَهُ، وَمَنْ كَانَ يُؤْمِنُ بِاللَّهِ وَالْيَوْمِ الآخِرِ فَلْيَقُلْ خَيْرًا أَوْ لِيَصْمُتْ ‏”‏‏.‏

আবু হুরাইরাহ (রা.) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন— যে ব্যক্তি আল্লাহ ও আখিরাতের দিনে বিশ্বাস রাখে, সে যেন তার মেহমানকে সম্মান করে। যে আল্লাহ ও শেষ দিনে বিশ্বাস রাখে, সে যেন তার প্রতিবেশীকে জ্বালাতন না করে। যে লোক আল্লাহ ও শেষ দিনে বিশ্বাস রাখে, সে যেন ভালো কথা বলে, অথবা চুপ থাকে। (বুখারি, হাদিস : ৬০১৮)

হাদিসের ব্যাখ্যা
ঈমান ও আচরণের সম্পর্ক

ইমাম নববী (রহ.) বলেন,  ‘এই হাদিসে রাসুলুল্লাহ (সা.) মানুষকে নৈতিকতা ও আদবের শিক্ষা দিয়েছেন এবং তা ঈমানের সঙ্গে যুক্ত করেছেন যেন বোঝা যায় যে, যার মধ্যে এই গুণগুলো নেই, তার ঈমান অসম্পূর্ণ।

অর্থাৎ এই হাদিস এ শিক্ষা দেয় যে ঈমানকে শুধু বিশ্বাসের বিষয় নয়, বরং তা বাস্তব আচরণের মাধ্যমে পরিপূর্ণ হয়।

অতিথিসেবায় সম্মান

হাদিসের বাক্য— ‘যে ব্যক্তি আল্লাহ ও আখিরাতে বিশ্বাস রাখে, সে যেন তার মেহমানকে সম্মান করে।’ ইবনে হাজার আল-আসকালানি (রহ.) বলেন,  ‘অতিথিকে সম্মান করার অর্থ হলো তাকে আনন্দের সঙ্গে গ্রহণ করা, সদ্ব্যবহার করা এবং তার প্রয়োজনমতো আতিথ্য করা। এটি ইসলামী সমাজে পরস্পর ভালোবাসা ও সংহতি প্রতিষ্ঠার একটি উপায়।

 

রাসুলুল্লাহ (সা.) নিজে অতিথিসেবায় ছিলেন অনন্য উদাহরণ। সহিহ বুখারিতে আছে, একবার এক সাহাবি অতিথি এলে মহানবী  (সা.) নিজের ঘরে কিছুই না থাকায় সাহাবিদের বললেন : ‘যে তাকে আজ রাতে অতিথি করবে, আল্লাহ তাকে রহমত দান করবেন।’ (বুখারি, হাদিস : ৩৭৯৮)

প্রতিবেশীর প্রতি সদ্ব্যবহার

হাদিসের বাক্য— ‘যে আল্লাহ ও শেষ দিনে বিশ্বাস রাখে, সে যেন তার প্রতিবেশীকে জ্বালাতন না করে।’ ইবনে হাজার রাহিমাহুল্লাহ ব্যাখ্যা করেছেন— ‘প্রতিবেশীকে কষ্ট দেওয়া শুধু শারীরিক নয়; কথায়, কাজে, আচরণে বা অবজ্ঞায়ও হতে পারে।’ (ফাতহুল বারী, খণ্ড ১০, পৃ. ৪৪৩)

রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন— ‘জিবরিল আমাকে প্রতিবেশীর অধিকার সম্পর্কে এত বেশি উপদেশ দিয়েছেন যে, আমি ভেবেছিলাম তিনি হয়তো প্রতিবেশীকেও উত্তরাধিকারী বানিয়ে দেবেন।

ইমাম নববী (রহ.) বলেন, ‘প্রতিবেশীর প্রতি সদ্ব্যবহার ঈমানের প্রকাশ। যে তার প্রতিবেশীর ক্ষতি করে, তার ঈমান দুর্বল।’ (শরহে মুসলিম, হাদিস : ৪৭)

বাক্য নিয়ন্ত্রণ ও নৈতিক সংযম

হাদিসের বাক্য— ‘যে লোক আল্লাহ ও শেষ দিনে বিশ্বাস রাখে, সে যেন ভালো কথা বলে অথবা চুপ থাকে।’ ইবনে রজব হাম্বলি (রহ.) বলেন, ‘ভালো কথা হলো এমন কথা, যা উপকার বয়ে আনে। যেমন জিকির, দাওয়াত, উপদেশ বা প্রশংসা। আর চুপ থাকা উত্তম যখন কথায় গুনাহ, পরনিন্দা, বা অহেতুক সময় নষ্ট হওয়ার আশঙ্কা থাকে ‘ (জামি’উল উলুম ওয়াল হিকাম, হাদিস : ১৫)

তিনি আরও বলেন, ‘মুমিনের জিহ্বা তার অন্তরের নিয়ন্ত্রণে থাকে; আর মুনাফিকের অন্তর থাকে তার জিহ্বার বন্দী।
(একই সূত্র)

ইমাম নববীও বলেন, ‘কথা বলা ও চুপ থাকা দুটিই ইবাদত হতে পারে, যদি তা নিয়ত ও উদ্দেশ্যের ওপর নির্ভর করে’। (শরহ মুসলিম, হাদিস : ৪৭)

এই হাদিসটি মানবজীবনের তিনটি প্রধান ক্ষেত্রকে পরিশুদ্ধ করতে আহ্বান জানায়—
১. অতিথি গ্রহণে উদারতা– সমাজে মমতা ও আতিথেয়তার সংস্কৃতি গড়ে তোলে।
২. প্রতিবেশীর সঙ্গে সুসম্পর্ক– শান্তিপূর্ণ সহাবস্থানের ভিত্তি স্থাপন করে।
৩. বাক্য শুদ্ধতা ও সংযম– ব্যক্তি ও সমাজ উভয়কেই বিভেদ থেকে রক্ষা করে।

ইমাম ইবনে আব্দুল বার (রহ.) বলেন— ‘যে ব্যক্তি এই তিন আদর্শকে বাস্তবায়ন করে, সে প্রকৃত ঈমানদারদের অন্তর্ভুক্ত হয়; আর যে তা ত্যাগ করে, তার ঈমান দুর্বল হয়ে পড়ে।’ (আত-তমহীদ, খণ্ড ১৭, পৃ. ২২১)

রাসুলুল্লাহ (সা.) এই সংক্ষিপ্ত হাদিসের মাধ্যমে আমাদের শিখিয়েছেন—
ঈমান শুধু মুখের কথা নয়; বরং এটি অতিথি, প্রতিবেশী ও সমাজের প্রতি দায়িত্ববোধে প্রতিফলিত হয়। যে ব্যক্তি আল্লাহ ও আখিরাতে বিশ্বাস রাখে, সে তার কথায়, আচরণে এবং আচার-ব্যবহারে তা প্রমাণ করে।

Tag :

Write Your Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Save Your Email and Others Information

About Author Information

Haor Barta24

আচরণের আয়নায় ঈমানের প্রতিচ্ছবি

আপডেট টাইম : ১১:১২:৪৫ পূর্বাহ্ন, রবিবার, ২ নভেম্বর ২০২৫
ইসলাম এমন এক পরিপূর্ণ জীবনব্যবস্থা, যা মানুষের প্রতিটি সম্পর্ক শৃঙ্খলিত করে। সেই সম্পর্কটি আল্লাহর সঙ্গে হোক, মানুষের সঙ্গে হোক বা সমাজের সঙ্গে হোক। কারণ একজন মুমিনের ঈমান শুধু মুখের স্বীকারোক্তিতে সীমাবদ্ধ নয়; তার আচরণ, কথাবার্তা ও পারস্পরিক ব্যবহারেও সেই ঈমানের প্রতিফলন ঘটতে হয়। রাসুলুল্লাহ (সা.) এই হাদিসে ঈমানের তিনটি গুরুত্বপূর্ণ সামাজিক প্রতিফলন তুলে ধরেছেন।

সেগুলো হচ্ছে- অতিথিসেবায় সৌজন্য, প্রতিবেশীর প্রতি সদ্ব্যবহার এবং শিষ্টাচারপূর্ণ বাক্যব্যবহার-

عَنْ أَبِي هُرَيْرَةَ، قَالَ قَالَ رَسُولُ اللَّهِ صلى الله عليه وسلم ‏ “‏ مَنْ كَانَ يُؤْمِنُ بِاللَّهِ وَالْيَوْمِ الآخِرِ فَلاَ يُؤْذِ جَارَهُ، وَمَنْ كَانَ يُؤْمِنُ بِاللَّهِ وَالْيَوْمِ الآخِرِ فَلْيُكْرِمْ ضَيْفَهُ، وَمَنْ كَانَ يُؤْمِنُ بِاللَّهِ وَالْيَوْمِ الآخِرِ فَلْيَقُلْ خَيْرًا أَوْ لِيَصْمُتْ ‏”‏‏.‏

আবু হুরাইরাহ (রা.) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন— যে ব্যক্তি আল্লাহ ও আখিরাতের দিনে বিশ্বাস রাখে, সে যেন তার মেহমানকে সম্মান করে। যে আল্লাহ ও শেষ দিনে বিশ্বাস রাখে, সে যেন তার প্রতিবেশীকে জ্বালাতন না করে। যে লোক আল্লাহ ও শেষ দিনে বিশ্বাস রাখে, সে যেন ভালো কথা বলে, অথবা চুপ থাকে। (বুখারি, হাদিস : ৬০১৮)

হাদিসের ব্যাখ্যা
ঈমান ও আচরণের সম্পর্ক

ইমাম নববী (রহ.) বলেন,  ‘এই হাদিসে রাসুলুল্লাহ (সা.) মানুষকে নৈতিকতা ও আদবের শিক্ষা দিয়েছেন এবং তা ঈমানের সঙ্গে যুক্ত করেছেন যেন বোঝা যায় যে, যার মধ্যে এই গুণগুলো নেই, তার ঈমান অসম্পূর্ণ।

অর্থাৎ এই হাদিস এ শিক্ষা দেয় যে ঈমানকে শুধু বিশ্বাসের বিষয় নয়, বরং তা বাস্তব আচরণের মাধ্যমে পরিপূর্ণ হয়।

অতিথিসেবায় সম্মান

হাদিসের বাক্য— ‘যে ব্যক্তি আল্লাহ ও আখিরাতে বিশ্বাস রাখে, সে যেন তার মেহমানকে সম্মান করে।’ ইবনে হাজার আল-আসকালানি (রহ.) বলেন,  ‘অতিথিকে সম্মান করার অর্থ হলো তাকে আনন্দের সঙ্গে গ্রহণ করা, সদ্ব্যবহার করা এবং তার প্রয়োজনমতো আতিথ্য করা। এটি ইসলামী সমাজে পরস্পর ভালোবাসা ও সংহতি প্রতিষ্ঠার একটি উপায়।

 

রাসুলুল্লাহ (সা.) নিজে অতিথিসেবায় ছিলেন অনন্য উদাহরণ। সহিহ বুখারিতে আছে, একবার এক সাহাবি অতিথি এলে মহানবী  (সা.) নিজের ঘরে কিছুই না থাকায় সাহাবিদের বললেন : ‘যে তাকে আজ রাতে অতিথি করবে, আল্লাহ তাকে রহমত দান করবেন।’ (বুখারি, হাদিস : ৩৭৯৮)

প্রতিবেশীর প্রতি সদ্ব্যবহার

হাদিসের বাক্য— ‘যে আল্লাহ ও শেষ দিনে বিশ্বাস রাখে, সে যেন তার প্রতিবেশীকে জ্বালাতন না করে।’ ইবনে হাজার রাহিমাহুল্লাহ ব্যাখ্যা করেছেন— ‘প্রতিবেশীকে কষ্ট দেওয়া শুধু শারীরিক নয়; কথায়, কাজে, আচরণে বা অবজ্ঞায়ও হতে পারে।’ (ফাতহুল বারী, খণ্ড ১০, পৃ. ৪৪৩)

রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন— ‘জিবরিল আমাকে প্রতিবেশীর অধিকার সম্পর্কে এত বেশি উপদেশ দিয়েছেন যে, আমি ভেবেছিলাম তিনি হয়তো প্রতিবেশীকেও উত্তরাধিকারী বানিয়ে দেবেন।

ইমাম নববী (রহ.) বলেন, ‘প্রতিবেশীর প্রতি সদ্ব্যবহার ঈমানের প্রকাশ। যে তার প্রতিবেশীর ক্ষতি করে, তার ঈমান দুর্বল।’ (শরহে মুসলিম, হাদিস : ৪৭)

বাক্য নিয়ন্ত্রণ ও নৈতিক সংযম

হাদিসের বাক্য— ‘যে লোক আল্লাহ ও শেষ দিনে বিশ্বাস রাখে, সে যেন ভালো কথা বলে অথবা চুপ থাকে।’ ইবনে রজব হাম্বলি (রহ.) বলেন, ‘ভালো কথা হলো এমন কথা, যা উপকার বয়ে আনে। যেমন জিকির, দাওয়াত, উপদেশ বা প্রশংসা। আর চুপ থাকা উত্তম যখন কথায় গুনাহ, পরনিন্দা, বা অহেতুক সময় নষ্ট হওয়ার আশঙ্কা থাকে ‘ (জামি’উল উলুম ওয়াল হিকাম, হাদিস : ১৫)

তিনি আরও বলেন, ‘মুমিনের জিহ্বা তার অন্তরের নিয়ন্ত্রণে থাকে; আর মুনাফিকের অন্তর থাকে তার জিহ্বার বন্দী।
(একই সূত্র)

ইমাম নববীও বলেন, ‘কথা বলা ও চুপ থাকা দুটিই ইবাদত হতে পারে, যদি তা নিয়ত ও উদ্দেশ্যের ওপর নির্ভর করে’। (শরহ মুসলিম, হাদিস : ৪৭)

এই হাদিসটি মানবজীবনের তিনটি প্রধান ক্ষেত্রকে পরিশুদ্ধ করতে আহ্বান জানায়—
১. অতিথি গ্রহণে উদারতা– সমাজে মমতা ও আতিথেয়তার সংস্কৃতি গড়ে তোলে।
২. প্রতিবেশীর সঙ্গে সুসম্পর্ক– শান্তিপূর্ণ সহাবস্থানের ভিত্তি স্থাপন করে।
৩. বাক্য শুদ্ধতা ও সংযম– ব্যক্তি ও সমাজ উভয়কেই বিভেদ থেকে রক্ষা করে।

ইমাম ইবনে আব্দুল বার (রহ.) বলেন— ‘যে ব্যক্তি এই তিন আদর্শকে বাস্তবায়ন করে, সে প্রকৃত ঈমানদারদের অন্তর্ভুক্ত হয়; আর যে তা ত্যাগ করে, তার ঈমান দুর্বল হয়ে পড়ে।’ (আত-তমহীদ, খণ্ড ১৭, পৃ. ২২১)

রাসুলুল্লাহ (সা.) এই সংক্ষিপ্ত হাদিসের মাধ্যমে আমাদের শিখিয়েছেন—
ঈমান শুধু মুখের কথা নয়; বরং এটি অতিথি, প্রতিবেশী ও সমাজের প্রতি দায়িত্ববোধে প্রতিফলিত হয়। যে ব্যক্তি আল্লাহ ও আখিরাতে বিশ্বাস রাখে, সে তার কথায়, আচরণে এবং আচার-ব্যবহারে তা প্রমাণ করে।