ঢাকা ০৭:১৬ পূর্বাহ্ন, শুক্রবার, ১৮ জুলাই ২০২৫, ৩ শ্রাবণ ১৪৩২ বঙ্গাব্দ

ডেঙ্গুতে অকাল মৃত্যু ছবি হাতে মাকে খুঁজে ফিরছে ২ বছরের শিশু ইয়ানা

  • Reporter Name
  • আপডেট টাইম : ১১:৪১:০৪ পূর্বাহ্ন, রবিবার, ১৫ জুন ২০২৫
  • ১৫ বার

কথা বলতে শেখার আগেই মায়ের ভালোবাসা হারিয়েছে দুই বছর বয়সী শিশু ইয়ানা। অপলক দৃষ্টিতে সারাক্ষণ ছবির হাতে মাকে খুঁজে বেড়ায় সে। কখনো আবার কাঁদতে কাঁদতে মায়ের কাছে যাওয়ার বায়না ধরে। তবে মা আর কখনোই ফিরবে না। ডেঙ্গু জ্বরে আক্রান্ত হয়ে হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মারা গেছেন শিশু ইয়ানার মা আজমেরী মোনালিসা জেরিন।

জেরিন বরগুনা-১ আসনের সাবেক সংসদ সদস্য প্রয়াত জাফরুল হাসান ফরহাদের ছোট মেয়ে। তিনি একটি প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়ে এলএলবি অধ্যায়নরত শিক্ষার্থী ও জেরিন ক্রেকার্স নামে কেক তৈরির প্রতিষ্ঠানের উদ্যোক্তা ছিলেন।

খোঁজ নিয়ে জানা যায়, গত ৬ জুন ২৭তম জন্মদিন ছিল বরগুনা পৌরসভার থানাপাড়া এলাকার বাসিন্দা জেরিনের। ডেঙ্গু জ্বরে আক্রান্ত হয়ে ওই রাতেই বরগুনা সদর হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় তার মৃত্যু হয়। এরপরের দিন তৃতীয় বিবাহ বার্ষিকীতে জেরিনের জানাজা ও দাফন সম্পন্ন হয়।

এদিকে স্ত্রীর মৃত্যু শোকে বুক চাপা কষ্টে বিদীর্ণ স্বামী রাকিবুল ইসলাম রাজন। দুই বছর বয়সী শিশু সন্তানকে মায়ের অভাব বুঝতে না দিয়ে আগলে রাখছেন নিজের কাছে। প্রায় সময়ই মা হারানো দুধের সন্তানের কান্না থামাতে গিয়ে নিজের স্ত্রী হারানোর কষ্ট  গোপন করতে হচ্ছে তাকে। রাজনের জীবন এখন আর বেঁচে থাকার নয়, বরং মায়ের ভালোবাসা দিয়ে অবুঝ সন্তানকে বড় করতে টিকে থাকার সংগ্রাম।

সরেজমিনে শিশু ইয়ানার বাড়িতে ঘুরে দেখা যায়, ঘরের বিভিন্ন জায়গায় স্মৃতিবিজড়িত জেরিনের অনেক ছবি। আর এ ছবির দিকে তাকিয়ে মাকে খুঁজে বেড়ায় ছোট ইয়ানা। ইয়ানার খালা সালমা ঢাকা পোস্টকে বলেন, মা হারানো কষ্ট ইয়ানা হয়তো প্রকাশ করতে পারেনা। তবে সব বোঝে, কিন্তু মুখে কিছু বলার ভাষা নাই। রাতে ঘুমায়না, সারাক্ষণ শুধু মাকে খোঁজে। মায়ের কাছে যাওয়ার জন্য বাবাকে ধরে টানাটানিও করে।

ইয়ানার ফুফু হুরুননেসা রুমা ঢাকা পোস্টকে বলেন, হাসপাতালে চিকিৎসকের অবহেলায় আমার ভাইয়ের স্ত্রীকে হারাতে হয়েছে। ডেঙ্গুতে আক্রান্তের পর গুরুতর হলেও উন্নত চিকিৎসার জন্য ঢাকা অথবা বরিশালে নেয়ার পরামর্শ দেয়নি হাসপাতালের চিকিৎসকরা৷ আমরা এখন সবাই চিন্তিত ছোট শিশুটিকে নিয়ে। কে দেখবে, কার কাছে থাকবে ইয়ানা।

রাকিবুল ইসলাম রাজন শিশুটির বাবা ঢাকা পোস্টকে বলেন, জেরিনসহ আমি গত ৪ তারিখ ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়ে হাসপাতালে ভর্তি হই। তবে হাসপাতাল থেকে আমরা তেমন কোনো চিকিৎসা পাইনি, শুধু নাপা ছাড়া। যেদিন ভর্তি হয়েছি ওই দিন জেরিনের প্লাটিলেট ছিল ১ লাখ ৪৫ হাজার। পরবর্তীতে প্লাটিলেট কমে ৪৪ হাজারে পৌঁছায়। তবে ঈদের ছুটি থাকায় হাসপাতালে তেমন কোনো নার্স এবং চিকিৎসক ছিলোনা। এছাড়া জেরিনের দুই হাজার প্লাটিলেট বেড়ে ৪৬ হাজার হলে বাড়িতে চলে আসি আমরা। পরে শ্বাসকষ্ট শুরু হলে আবারও অসুস্থ হয়ে পড়ে জেরিন। এরপর তাকে নিয়ে দ্রুত হাসপাতালে যাই। ওই সময় জেরিনকে অক্সিজেন লাগাতে গিয়ে আমাদেরকে হয়রানির শিকারও হতে হয়েছে। পরে কিছুক্ষনের মধ্যে আমার কোলে বসেই জেরিনের মৃত্যু হয়।

তিনি আরও বলেন, আমার দুই বছরে বাচ্চাটা এখন রাতে ঘুমাতে পারে না। ওর মা যেখানে বসে কেক বানাতো বারবার আমাকে সেখানে নিয়ে যেতে চায়। যেখানে ওর মা ঘুমাতো সেদিকে হাত বাড়িয়ে দিয়ে মায়ের খোঁজ করে, মায়ের স্পর্শ পেতে চায়। বাবা হয়ে বাচ্চার মুখের দিকে এখন আমি তাকাতে পারি না। ও কি বলতে চায় আমি তা বুঝি, কিন্তু ওরে আমি কিছু বোঝাতে পারি না।

উল্লেখ্য, বরগুনায় মহামারী আকার ধারন করেছে ডেঙ্গু। মৃত্যুও বাড়ছে আক্রান্ত রোগীর। বরগুনার ২৫০ শয্যা বিশিষ্ট জেনারেলে হাসপাতালের অথ্য অনুযায়ী, গত ২৪ ঘন্টায় বরগুনার বিভিন্ন হাসপাতালে ভর্তি রোগীর সংখ্যা ৫৪ জন। বর্তমানে হাসপাতালে মোট ভর্তি ডেঙ্গু রোগীর সংখ্যা ২৪১ জন। এবছর এখন পর্যন্ত ১ হাজার ৭৫৯ জন ডেঙ্গু আক্রান্ত রোগী হাসপাতালে চিকিৎসা নিয়েছেন। এর মধ্যে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মৃত্যু হয়েছে ৬ জনের।

Tag :

Write Your Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Save Your Email and Others Information

About Author Information

Haor Barta24

ডেঙ্গুতে অকাল মৃত্যু ছবি হাতে মাকে খুঁজে ফিরছে ২ বছরের শিশু ইয়ানা

আপডেট টাইম : ১১:৪১:০৪ পূর্বাহ্ন, রবিবার, ১৫ জুন ২০২৫

কথা বলতে শেখার আগেই মায়ের ভালোবাসা হারিয়েছে দুই বছর বয়সী শিশু ইয়ানা। অপলক দৃষ্টিতে সারাক্ষণ ছবির হাতে মাকে খুঁজে বেড়ায় সে। কখনো আবার কাঁদতে কাঁদতে মায়ের কাছে যাওয়ার বায়না ধরে। তবে মা আর কখনোই ফিরবে না। ডেঙ্গু জ্বরে আক্রান্ত হয়ে হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মারা গেছেন শিশু ইয়ানার মা আজমেরী মোনালিসা জেরিন।

জেরিন বরগুনা-১ আসনের সাবেক সংসদ সদস্য প্রয়াত জাফরুল হাসান ফরহাদের ছোট মেয়ে। তিনি একটি প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়ে এলএলবি অধ্যায়নরত শিক্ষার্থী ও জেরিন ক্রেকার্স নামে কেক তৈরির প্রতিষ্ঠানের উদ্যোক্তা ছিলেন।

খোঁজ নিয়ে জানা যায়, গত ৬ জুন ২৭তম জন্মদিন ছিল বরগুনা পৌরসভার থানাপাড়া এলাকার বাসিন্দা জেরিনের। ডেঙ্গু জ্বরে আক্রান্ত হয়ে ওই রাতেই বরগুনা সদর হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় তার মৃত্যু হয়। এরপরের দিন তৃতীয় বিবাহ বার্ষিকীতে জেরিনের জানাজা ও দাফন সম্পন্ন হয়।

এদিকে স্ত্রীর মৃত্যু শোকে বুক চাপা কষ্টে বিদীর্ণ স্বামী রাকিবুল ইসলাম রাজন। দুই বছর বয়সী শিশু সন্তানকে মায়ের অভাব বুঝতে না দিয়ে আগলে রাখছেন নিজের কাছে। প্রায় সময়ই মা হারানো দুধের সন্তানের কান্না থামাতে গিয়ে নিজের স্ত্রী হারানোর কষ্ট  গোপন করতে হচ্ছে তাকে। রাজনের জীবন এখন আর বেঁচে থাকার নয়, বরং মায়ের ভালোবাসা দিয়ে অবুঝ সন্তানকে বড় করতে টিকে থাকার সংগ্রাম।

সরেজমিনে শিশু ইয়ানার বাড়িতে ঘুরে দেখা যায়, ঘরের বিভিন্ন জায়গায় স্মৃতিবিজড়িত জেরিনের অনেক ছবি। আর এ ছবির দিকে তাকিয়ে মাকে খুঁজে বেড়ায় ছোট ইয়ানা। ইয়ানার খালা সালমা ঢাকা পোস্টকে বলেন, মা হারানো কষ্ট ইয়ানা হয়তো প্রকাশ করতে পারেনা। তবে সব বোঝে, কিন্তু মুখে কিছু বলার ভাষা নাই। রাতে ঘুমায়না, সারাক্ষণ শুধু মাকে খোঁজে। মায়ের কাছে যাওয়ার জন্য বাবাকে ধরে টানাটানিও করে।

ইয়ানার ফুফু হুরুননেসা রুমা ঢাকা পোস্টকে বলেন, হাসপাতালে চিকিৎসকের অবহেলায় আমার ভাইয়ের স্ত্রীকে হারাতে হয়েছে। ডেঙ্গুতে আক্রান্তের পর গুরুতর হলেও উন্নত চিকিৎসার জন্য ঢাকা অথবা বরিশালে নেয়ার পরামর্শ দেয়নি হাসপাতালের চিকিৎসকরা৷ আমরা এখন সবাই চিন্তিত ছোট শিশুটিকে নিয়ে। কে দেখবে, কার কাছে থাকবে ইয়ানা।

রাকিবুল ইসলাম রাজন শিশুটির বাবা ঢাকা পোস্টকে বলেন, জেরিনসহ আমি গত ৪ তারিখ ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়ে হাসপাতালে ভর্তি হই। তবে হাসপাতাল থেকে আমরা তেমন কোনো চিকিৎসা পাইনি, শুধু নাপা ছাড়া। যেদিন ভর্তি হয়েছি ওই দিন জেরিনের প্লাটিলেট ছিল ১ লাখ ৪৫ হাজার। পরবর্তীতে প্লাটিলেট কমে ৪৪ হাজারে পৌঁছায়। তবে ঈদের ছুটি থাকায় হাসপাতালে তেমন কোনো নার্স এবং চিকিৎসক ছিলোনা। এছাড়া জেরিনের দুই হাজার প্লাটিলেট বেড়ে ৪৬ হাজার হলে বাড়িতে চলে আসি আমরা। পরে শ্বাসকষ্ট শুরু হলে আবারও অসুস্থ হয়ে পড়ে জেরিন। এরপর তাকে নিয়ে দ্রুত হাসপাতালে যাই। ওই সময় জেরিনকে অক্সিজেন লাগাতে গিয়ে আমাদেরকে হয়রানির শিকারও হতে হয়েছে। পরে কিছুক্ষনের মধ্যে আমার কোলে বসেই জেরিনের মৃত্যু হয়।

তিনি আরও বলেন, আমার দুই বছরে বাচ্চাটা এখন রাতে ঘুমাতে পারে না। ওর মা যেখানে বসে কেক বানাতো বারবার আমাকে সেখানে নিয়ে যেতে চায়। যেখানে ওর মা ঘুমাতো সেদিকে হাত বাড়িয়ে দিয়ে মায়ের খোঁজ করে, মায়ের স্পর্শ পেতে চায়। বাবা হয়ে বাচ্চার মুখের দিকে এখন আমি তাকাতে পারি না। ও কি বলতে চায় আমি তা বুঝি, কিন্তু ওরে আমি কিছু বোঝাতে পারি না।

উল্লেখ্য, বরগুনায় মহামারী আকার ধারন করেছে ডেঙ্গু। মৃত্যুও বাড়ছে আক্রান্ত রোগীর। বরগুনার ২৫০ শয্যা বিশিষ্ট জেনারেলে হাসপাতালের অথ্য অনুযায়ী, গত ২৪ ঘন্টায় বরগুনার বিভিন্ন হাসপাতালে ভর্তি রোগীর সংখ্যা ৫৪ জন। বর্তমানে হাসপাতালে মোট ভর্তি ডেঙ্গু রোগীর সংখ্যা ২৪১ জন। এবছর এখন পর্যন্ত ১ হাজার ৭৫৯ জন ডেঙ্গু আক্রান্ত রোগী হাসপাতালে চিকিৎসা নিয়েছেন। এর মধ্যে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মৃত্যু হয়েছে ৬ জনের।