আবদুস সালাম : ষড়যন্ত্রকারীরা বর্তমান সরকারকে ব্যর্থ করতে পাঁয়তারা করছে। এই ষড়যন্ত্র যেন সফল না হয়, এজন্য সবাইকে সচেতন থাকতে হবে। আর এটা শুধু একা বিএনপির দায়িত্ব নয়; সব রাজনৈতিক দলকেই ভূমিকা রাখতে হবে। কারণ রাজনীতিবিদরাই রাষ্ট্রের দায়িত্ব নেবেন।
আবদুস সালাম : জনগণই ঠিক করবে, কে ক্ষমতায় যাবে, আর কে বিরোধী দলে। ধারণার ওপর সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেললে আবার সেই শেখ হাসিনার ফ্যাসিস্ট আমলের মতোই অবস্থা হবে। হাসিনা বলতো, ‘একটা বিরোধী দল তো পাইলাম না।
আবদুস সালাম : ছাত্ররাজনীতি করেই আজকে আমরা এই পর্যায়ে এসেছি। ছাত্ররাজনীতি করেই দেশের জন্য যুদ্ধ করেছি। গণতান্ত্রিক আন্দোলনগুলোতেও আছি। দেশ স্বাধীন করার সময় যে স্লোগান দিয়েছি, সেই একই স্লোগান নব্বইয়ের গণ অভ্যুত্থানের সময় জনগণকে দিতে হয়েছে। সেই একই স্লোগান দিতে হয়েছে চব্বিশের গণ অভ্যুত্থানেও। এজন্যই বলব, যারা নতুন প্রজন্ম তাদের দায়দায়িত্ব অনেক বেশি। আমাদের আয়ুষ্কাল ফুরোচ্ছে। প্রাকৃতিকভাবেই আমাদের পক্ষে আর বেশি দিন দেশের রাজনীতিতে অবদান রাখা সম্ভব হবে না। কিন্তু তরুণদের হাতে অফুরন্ত সময় আছে। তাদের ওপরই নির্ভর করবে আগামীর বাংলাদেশ কোন পথে যাবে। চব্বিশের এই চেতনা যদি নষ্ট হয়ে যায়, তবে যতই তারা সিনিয়রদের সমালোচনা করুন না কেন, দিন শেষে এর দায় তাদের কাঁধেই বেশি আসবে। তারা তাদের কথাবার্তা, আচার-আচরণ, চলাফেরায় এমনভাবে এগোতে হবে যেন জনগণের মধ্যে হতাশা চেপে না বসে। একাত্তরে-নব্বইয়ে তরুণরা যেভাবে ব্যর্থ হয়েছে চব্বিশেও যদি তাই হয় তবে এই ব্যর্থতার গ্লানি জনগণ আর বইতে পারবে না। এই দায়ভার তারা আমাদের কাঁধে দিতে পারবে না। এটা তাদের ওপরই বর্তাবে।
দেশের ব্যবসাবাণিজ্য ও বিনিয়োগে সংকট চলছে। এ থেকে উত্তরণের উপায় কী?
আবদুস সালাম : অন্তর্বর্তী সরকারের শাসনামলে বিদেশিরা বিনিয়োগে ভরসা পাচ্ছে না। এই সমস্যার স্থায়ী সমাধান দিতে পারে গণতান্ত্রিকভাবে নির্বাচিত একটি রাজনৈতিক সরকার। আপনি যখন কোনো দেশে ব্যবসা করতে যাবেন তখন প্রথমেই দেখবেন দেশ পরিচালনার দায়িত্বে যারা আছে তারা কী ক্ষণস্থায়ী না দীর্ঘস্থায়ী। যখন দেখবেন ক্ষণস্থায়ী তখন স্বাভাবিকভাবেই আপনি সেখানে ব্যবসা করতে চাইবেন না। পরবর্তী সময়ে নির্বাচিত সরকারের সময়কালে বর্তমান সরকারের তৈরি করা সরকারব্যবস্থা কতটুকু বহাল থাকবে, সেটা নিয়েও ব্যবসায়ীদের মধ্যে অনিশ্চয়তা রয়েছে। এদিকে ফ্যাসিস্ট রেজিমের প্রধান পলাতক শেখ হাসিনা এখনো নিজেকে দেশের প্রধানমন্ত্রী দাবি করছেন। এমতাবস্থায় জনগণের ভোটে একটা নির্বাচিত-সাংবিধানিক সরকার প্রতিষ্ঠা করা জরুরি হয়ে পড়েছে।
বিএনপি যদি পরের নির্বাচনে ক্ষমতায় যেতে পারে তবে আওয়ামী শাসনামলের সঙ্গে পার্থক্য কী হবে?
আবদুস সালাম : বিএনপির জন্মই হয়েছিল তখন, যখন আওয়ামী লীগ ব্যর্থ হয়েছিল। শহীদ রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমান প্রতিটি পদক্ষেপে প্রমাণ করেছেন এ দেশের মানুষের স্বাধীনতার স্বপ্নকে বাস্তবায়নের জন্য বিএনপি কাজ করে যাচ্ছে। সেই লক্ষ্যেই তিনি ১৯ দফা দিয়েছিলেন। এর মধ্য দিয়ে সমাজ ও রাষ্ট্রের প্রতিটি অঙ্গ-প্রত্যঙ্গের মধ্যে তিনি পরিবর্তন এনেছিলেন। তারই ধারাবাহিকতায় বেগম খালেদা জিয়াও তাঁর শাসনামলে প্রতিটি খাতে সংস্কার করেছিলেন। মুক্তিযুদ্ধের স্বপ্ন বাস্তবায়নের জন্য মুক্তিযুদ্ধ মন্ত্রণালয়সহ আরও অনেক কাজ তিনি করেছেন। চূড়ান্ত পর্যায়ে বেগম খালেদা জিয়াই বিভিন্ন রাজনৈতিক দল ও অনেকের দাবি মেনে নিয়ে তত্ত্বাবধায়কের বিল সংসদে পেশ করেছিলেন। নির্বাচিত প্রধানমন্ত্রী থাকার পরও তিনি এই আইনের মধ্য দিয়ে ক্ষমতা ছেড়ে দিয়েছেন। কাজেই বিএনপি সব সময় প্রমাণ করেছে তারা সংস্কারের পক্ষে। জনগণ ও গণতন্ত্রের পক্ষে। সর্বোপরি বাংলাদেশের স্বাধীনতা রক্ষার জন্য বিএনপি একটা চিরস্থায়ী রাজনৈতিক দল।
সরকার বলছে ডিসেম্বর থেকে জুনের মধ্যে নির্বাচন। কিন্তু অনেকের কথাবার্তায় এই টাইমলাইনের মধ্যে নির্বাচন অনুষ্ঠিত না হওয়ার আশঙ্কা দেখা দিচ্ছে। সে ক্ষেত্রে বিএনপি কী ভাবছে?
আবদুস সালাম : অন্তর্বর্তী সরকারকে ইতিহাস থেকে শিক্ষা নিতে হবে। এই উপমহাদেশে আমরা এমন একটি জাতি যারা অস্ত্র হাতে যুদ্ধ করে দেশ স্বাধীন করেছি। এই দেশের মানুষ মুখের ভাষাকে প্রতিষ্ঠিত করতে বুকের তাজা রক্ত ঢেলে দিয়েছে। বারবার গণতন্ত্রকে রক্ষা করার জন্য রক্ত দিতে হয়েছে। এ দেশের মানুষ ফ্যাসিবাদকে কখনোই মেনে নেয়নি। পাকিস্তান আমল থেকে নির্বাচনের জন্য লড়াই করেছে। অন্তর্বর্তী সরকারকে ক্ষমতায় বসানো হয়েছে দীর্ঘকাল ধরে জনগণের কাছ থেকে কেড়ে নেওয়া ভোটাধিকার ফিরিয়ে দিতে। এ দেশের জনগণ বিশেষ করে যুবসমাজ ভুলেই গেছে কবে তারা ভোট দিতে পেরেছিল। মানুষ আগ্রহের সঙ্গে অপেক্ষা করে আছে তারা কখন ভোট দিতে পারবে। অন্তর্বর্তী সরকারের অন্যতম প্রধান দায়িত্ব হলো, তাদের ভোটাধিকার ফিরিয়ে দেওয়া। জনগণ তাদের রায় দিতে কখনো ভুল করে না। আমরা যারা রাষ্ট্রপরিচালনার দায়িত্বে ছিলাম, আছি কিংবা ভবিষ্যতে আসব তাদের ভুল হতে পারে। কিন্তু জনগণ কখনো ভুল করে না। দেশ কীভাবে পরিচালনা করতে হবে, তা জানার জন্য জনগণের রায় জানাটা খুব জরুরি। জনগণ কাকে কীভাবে চাইছে, সেই রায় নিতে তাদের কাছে ফিরে যেতে হবে।
নির্বাচন ও সংস্কার ইস্যুতে জামায়াতের সঙ্গে বিএনপির সম্পর্ক এখন কেমন?
আবদুস সালাম : আধিপত্যবাদী শক্তিকে রুখে দিতেই বিএনপির জন্ম হয়েছে। বিএনপি সবাইকে নিয়ে পথ চলেছে। সবাইকে নিয়ে পথ চলতে গিয়ে বিএনপিকে অনেক কিছু ছাড় দিতে হয়েছে। ত্যাগ করতে হয়েছে। অনেক সমালোচনাও সহ্য করতে হয়েছে। বিএনপি এসব করেছে দেশ ও গণতন্ত্রের স্বার্থে। আমরা যারা দীর্ঘদিন ফ্যাসিবাদের বিরুদ্ধে লড়াই করেছি তাদের মধ্যকার চিন্তা-চেতনার পার্থক্য ও বিভক্তির কারণে ফ্যাসিবাদের শক্তির উত্থান ঘটেছিল। আবারও আমাদের বিভেদের সাহায্য নিয়ে তাদের উত্থান ঘটতে পারে। আমাদের এই বিভেদের সাহায্য নিয়ে আধিপত্যবাদী ফ্যাসিবাদী শক্তি ও তাদের দোসররা যেন আবার বাংলাদেশে ফিরে আসতে না পারে, এটি নিয়ে সতর্ক থাকতে হবে। এজন্য আমাদের যত দ্রুত সম্ভব জনগণের কাছে ফিরে যেতে হবে। জনগণ যে রায় দেবে, তা মেনে নিয়ে, দলীয় সংকীর্ণতার ঊর্ধ্বে উঠে সবাইকে ঐক্যবদ্ধভাবে দেশ পরিচালনায় ইতিবাচক ভূমিকা রাখতে হবে। তার আগপর্যন্ত নিজেদের মধ্যে বিভক্তি তৈরি না করে ঐক্যবদ্ধ থাকতে হবে। আমাদের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানও বলেছেন, বিএনপি নির্বাচিত হলেও আমরা সবাইকে নিয়েই রাষ্ট্র পরিচালনা করব।
অন্তর্বর্তী সরকারের কাছে এখন আপনাদের প্রত্যাশা কী?
আবদুস সালাম : আমরা কোনোভাবেই চাই না এই সরকার ব্যর্থ হোক। অনেক ত্যাগ-তিতিক্ষা ও রক্তের বিনিময়ে এই সরকার প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। শুধু চব্বিশের জুলাই নয়, এর আগের দীর্ঘ ১৫ বছরের সংগ্রামে অবদান রাখা প্রতিটি নির্যাতিত মানুষের অবদানের ওপর অন্তর্বর্তী সরকার গঠিত হয়েছে। যে স্বপ্ন নিয়ে আমরা ফ্যাসিবাদকে তাড়িয়েছি সেই স্বপ্নটা যাতে ভূলুণ্ঠিত না হয়। সেদিকে লক্ষ রেখে তাদের সবচেয়ে বড় সাফল্য হবে একটা গ্রহণযোগ্য নির্বাচনের মাধ্যমে নির্বাচিত সরকারের কাছে দায়িত্ব অর্পণ করা। নির্বাচনের মাধ্যমে জনগণের ক্ষমতা জনগণের কাছে ফিরিয়ে দেওয়া, এটাই তাদের জন্য সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ।
অসংখ্য ধন্যবাদ সময় দেওয়ার জন্য।
আবদুস সালাম : ধন্যবাদ।