এককথায় যুক্তরাষ্ট্রের ফেডারেল রিজার্ভের ভাষ্য এবং অর্থনীতিবিদ ও আর্থিক খাতের বিশ্লেষকদের মতে, অর্থনীতির সব ইন্ডিকেটর ইতিবাচক অবস্থায় আছে প্রায় এক বছর ধরে।
এবারও সমগ্র বিশ্বের কেন্দ্রীয় ব্যাংকগুলো যুক্তরাষ্ট্রের সুদের হার হ্রাসের সিদ্ধান্তের দিকে তাকিয়ে ছিল বছরের শুরু থেকেই। কিন্তু যুক্তরাষ্ট্রের ফেডারেল রিজার্ভ তাদের সিদ্ধান্ত নিতে দেরি করায় ইউরোপীয় ইউনিয়ন, যুক্তরাজ্য, কানাডাসহ আরো অনেক দেশের কেন্দ্রীয় ব্যাংক যুক্তরাষ্ট্রের সিদ্ধান্তের জন্য অপেক্ষা না করে নিজেরাই তাদের নীতি সুদ হার হ্রাস করতে শুরু করে। বলা যেতে পারে যে অন্যান্য দেশের কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সুদের হার হ্রাসের সিদ্ধান্ত কিছুটা হলেও যুক্তরাষ্ট্রের ফেডারেল রিজার্ভের সুদের হার হ্রাসের সিদ্ধান্তকে ত্বরান্বিত করেছে। এখন আশা করা যায়, অন্যান্য দেশ যারা তাদের সুদের হার হ্রাসের সিদ্ধান্ত স্থগিত করে রেখেছিল, তারাও তাদের নীতি সুদ হার হ্রাসের সিদ্ধান্ত অচিরেই গ্রহণ করবে। আন্তর্জাতিক সংবাদমাধ্যম থেকে জানা যায়, আগামী মাসেই ভারতের কেন্দ্রীয় ব্যাংক, রিজার্ভ ব্যাংক অব ইন্ডিয়া তাদের নীতি সুদ হার হ্রাস করতে পারে। দক্ষিণ কোরিয়া এবং দক্ষিণ আফ্রিকাও চলতি বছরের শেষ নাগাদ তাদের নীতি সুদ হার হ্রাস করবে মর্মে আন্তর্জাতিক অঙ্গনে জোর আলোচনা আছে। এভাবে উন্নত ও উন্নয়নশীল দেশের কেন্দ্রীয় ব্যাংক সুদের হার হ্রাস করার কারণে বিশ্বব্যাপী ঋণের সুদ বা বরোইং কস্ট (Borrowing Cost) কমতে শুরু করবে বলে অনুমান করা যায়।
রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে যুক্তরাষ্ট্র তাদের মুদ্রা ডলারকে হার্ড কারেন্সি (অতি চাহিদার মুদ্রা) হিসেবে ধরে রাখার কৌশল অবলম্বন করে। এটি করতে গিয়ে প্রথমেই তারা খুবই দ্রুততম সময়ের মধ্যে তাদের বেঞ্চমার্ক রেট বাড়িয়ে দেয়। ২০০৮ সালের ভয়াবহ আর্থিক মন্দার পর থেকে যুক্তরাষ্ট্রসহ উন্নত বিশ্বের বেশির ভাগ দেশে সুদের হার শূন্যের কাছাকাছি বিরাজ করছিল। সেখানে মাত্র দুই বছরের ব্যবধানে যুক্তরাষ্ট্র এই বেঞ্চমার্ক রেট ৫ শতাংশে বৃদ্ধি করে। অল্প সময়ের ব্যবধানে এই উচ্চ সুদের হার বৃদ্ধির কারণ হিসেবে মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণের যুক্তি দেখানো হলেও মূল উদ্দেশ্য ছিল ডলারকে হার্ড কারেন্সিতে পরিণত করা। ফলে উচ্চ সুদের হারের কারণে যুক্তরাষ্ট্রের সাধারণ মানুষের কষ্ট হলেও যুক্তরাষ্ট্র সুকৌশলে দুটি উদ্দেশ্য হাসিল করতে পেরেছিল। প্রথমত, তারা নিজেদের অর্থনৈতিক মন্দাটা ঠেকাতে পেরেছিল। দ্বিতীয়ত, ডলারনির্ভর দেশগুলোকে সমস্যায় ফেলতে সক্ষম হয়েছিল। কেননা সেসব দেশে ডলার সংকট চরমে পৌঁছেছিল।
যুক্তরাষ্ট্রের উচ্চ সুদের হার নীতির কারণে যেসব উন্নয়নশীল দেশ চরম ডলার সংকটে পড়েছিল, তার মধ্যে আমাদের দেশও ছিল। আমাদের দেশে ডলার সংকট মারাত্মক আকার ধারণ করে। একসময়ের ৪৮ বিলিয়ন ডলারের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ কমে ২০ বিলিয়ন ডলারের নিচে চলে আসে এবং ডলারের বিপরীত টাকার অতি অবমূল্যায়ন ঘটে। বেশ কিছু পদক্ষেপ গ্রহণের মাধ্যমে পরিস্থিতি সামাল দেওয়ার চেষ্টা করা হলেও অবস্থার দৃশ্যমান উন্নতি হয়নি। এখন আগের সরকারের রেখে যাওয়া সংকট কাটানোর চেষ্টা করতে হবে বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকারকে। আশার কথা এই যে দুজন প্রথিতযশা এবং অভিজ্ঞ অর্থনীতিবিদ ও আর্থিক খাতের বিশেষজ্ঞ আছেন অর্থ উপদেষ্টা এবং বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নরের দায়িত্বে। বাংলাদেশের এই দুই ব্যক্তি ডলার সংকটের বিষয় এবং সমাধানের ব্যাপারে অন্য যে কারো চেয়ে অনেক বেশি ভালো জানেন। তাই এই সংকট উত্তরণে সঠিক পদক্ষেপ যে গৃহীত হবে, তাতে কোনো সন্দেহ নেই। এরই মধ্যে আইএমএফ, বিশ্বব্যাংকসহ বিভিন্ন দাতা সংস্থা ভালো অঙ্কের আর্থিক সাহায্যের হাত বাড়িয়েছে।
এসব কারণে আপাতদৃষ্টিতে হয়তো বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভের ওপর চাপ কমবে এবং অবস্থার উন্নতি হবে বলেও আশা করা যায়। এখন প্রশ্ন হচ্ছে, কয়েক বছর পর যুক্তরাষ্ট্রের ফেডারেল রিজার্ভ বেঞ্চমার্ক রেট হ্রাস করায় আমাদের দেশের মতো ইমার্জিং মার্কেটের দেশগুলোর ডলার সংকটের সমাধান হবে কি না। এই প্রশ্নের সরাসরি উত্তর দেওয়ার সুযোগ যেমন নেই, তেমনি সেই উত্তর দেওয়ার মতো উপযুক্ত সময় এখনো হয়নি। প্রথমত, আজকের যে ডলার সংকট, তা মূলত যুক্তরাষ্ট্রে সুদের হার শূন্যের কাছাকাছি থেকে ৫ শতাংশে উন্নীত করার কারণে সৃষ্টি হয়েছে। তাই মাত্র ৫০ বেসিস পয়েন্ট সুদের হার হ্রাস করলেই বিরাজমান ডলার সংকটের উন্নতি হবে, তেমনটি আশা করা কঠিন। তা ছাড়া এই সামান্য সুদের হার হ্রাসের কারণে ডলার রাতারাতি হার্ড কারেন্সি থেকে সফট কারেন্সিতে পরিণত হবে, তেমনটি ভাবার কোনো কারণ নেই। ফেডারেল রিজার্ভের এক কর্মকর্তা তো স্পষ্ট করেই উল্লেখ করেছেন যে এই একটিমাত্র পদক্ষেপের কারণে ডলার তার শক্ত অবস্থান হারাবে না। এ কথা ঠিক যে ডলারে ঋণের ওপর সুদ কিছুটা কমবে, তা-ও সব ধরনের ঋণের ক্ষেত্রে হবে না। তা ছাড়া যেসব কারণে ডলার সংকট দেখা দিয়েছে, তার মধ্যে যুক্তরাষ্ট্রের উচ্চ সুদের হার একটিমাত্র কারণ। তাই অন্যান্য সমস্যার সন্তোষজনক সমাধান করতে না পারলে এই সংকটের টেকসই সমাধান আশা করা কঠিন।
সবচেয়ে বড় কথা, এবারের উচ্চ সুদের হার এবং এর প্রভাবে সৃষ্ট ডলার সংকট যত না অর্থনৈতিক কারণে, তার চেয়ে অনেক বেশি রাজনৈতিক কারণে হয়েছিল। আবার এখন যে সুদের হার হ্রাস করার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে, তা-ও যত না অর্থনৈতিক, তার চেয়ে অনেক বেশি রাজনৈতিক। যুক্তরাষ্ট্রে দেড় মাস পরেই নির্বাচন। তাই যেসব আমেরিকানের উচ্চ সুদের হারের কারণে নাভিশ্বাস অবস্থা, তাদের কিছুটা হলেও কাছে টানার উদ্দেশ্যেই এই সুদের হার হ্রাস করা হয়েছে বলে অনেক বিশ্লেষক মনে করেন। কানাডায়ও একই অবস্থা।
বর্তমান প্রধানমন্ত্রী জাস্টিন ট্রুডোর জনপ্রিয়তায় ধস নামায় সুদের হার হ্রাসের মাধ্যমে জনগণের কাছে গ্রহণযোগ্যতা বাড়ানোর প্রয়াস মাত্র। না হলে আমেরিকান ডলারের বিপরীতে কানাডিয়ান ডলারের বিনিময়মূল্য সর্বনিম্ন পর্যায়ে পড়ে আছে অনেক দিন ধরে। এই অবস্থায় সুদের হার হ্রাসের পেছনে অর্থনৈতিক কারণ খুঁজে পাওয়া কষ্টকর। যে রাজনৈতিক কারণে সুদের হারে ওঠানামা এবং ডলার সংকট, তার সুরাহা এখনো হয়নি। রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ থামার কোনো লক্ষণ নেই। চীন-তাইওয়ান উত্তেজনা মিটছে না। সবচেয়ে ভয়াবহ অবস্থার সৃষ্টি হয়েছে ইসরায়েল-ফিলিস্তিন যুদ্ধকে কেন্দ্র করে সমগ্র মধ্যপ্রাচ্যে। সব কিছু মিলিয়ে অবস্থা মোটেই সুখকর নয় যে খুব শিগগির এই ডলার সংকট কেটে যাবে। তবে যদি সব কিছু স্বাভাবিক থাকে এবং আগামী বছর যদি যুক্তরাষ্ট্রে সুদের হার হ্রাসের ধারা অব্যাহত থাকে, তাহলে আগামী বছরের শেষ দিক থেকে হয়তো এই ডলার সংকটের একটা সন্তোষজনক সমাধান হতে পারে মর্মে ধারণা করা যায়।