দেশে উচ্চ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান থেকে শুরু করে প্রাথমিক পর্যায়ের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান পর্যন্ত নানা সময়ে, নানা কারণে একাডেমিক কার্যক্রম পরিচালনায় বিঘ্ন ঘটতে দেখা যায়। এর মধ্যে কিছু কারণ থাকে অনিবার্য অথচ প্রয়োজনীয়। যেমন, সম্প্রতি সরকারি চাকরিতে কোটা সংস্কার আন্দোলন ছিল অনিবার্য অথচ বাংলাদেশ রাষ্ট্রের জন্য ছিল অতি প্রয়োজনীয়।
পরিস্থিতি পর্যালোচনায় দেখা যায়, কোটা সংস্কার আন্দোলনের প্রেক্ষাপটে দেশের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোয় যে স্থবিরতার সৃষ্টি হয়েছিল, তা এখনো পুরোপুরি কাটিয়ে ওঠা যায়নি। শিক্ষার্থীরা আন্দোলনে যোগদান করায় কার্যত শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান আপনাআপনিই অচল হয়ে পড়ে। যদিও শিক্ষার্থীদের আন্দোলন প্রবাহে বাধা সৃষ্টি করার উদ্দেশ্যে তৎকালীন সরকারই প্রথম শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ করে দিয়েছিল। এমনকি ছাত্রছাত্রীদের দুর্ভোগের বিষয়টি কোনোরূপ বিবেচনা না করে আকস্মিকভাবে বিশ্ববিদ্যালয়ের আবাসিক হলগুলোও বন্ধ ঘোষণা করে দেওয়া হয়েছিল। পরবর্তীকালে বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকার শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খুলে দিলেও বহু প্রতিষ্ঠানে এখনো শিক্ষার্থীদের উপস্থিতি আশানুরূপ নয়। এমনকি অনেক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে এখনো নিয়মিত একাডেমিক কার্যক্রম শুরুই করা যায়নি। এ পরিস্থিতিতে শিক্ষার্থীরা যে অপূরণীয় ক্ষতির মুখোমুখি হচ্ছে, সেটা আমাদের গুরুত্বের সঙ্গে ভেবে দেখতে হবে। কারণ দীর্ঘদিন ধরে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে একাডেমিক কার্যক্রম পরিচালনায় বিঘ্ন ঘটলে শিক্ষার্থীদের ক্ষতি হবে; প্রকারান্তরে দেশই ক্ষতিগ্রস্ত হবে।
বিগত কয়েক বছরের ঘটনাবলি পর্যালোচনা করলে দেখা যায়, বেশ কয়েক বছর ধরে দেশের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোয় স্বাভাবিক শিক্ষা কার্যক্রম ব্যাহত হয়ে আসছে। প্রথমত, দেশে যখন করোনাভাইরাসের সংক্রমণ প্রথম ধরা পড়ে, তখন সংক্রমণের কয়েকদিনের মধ্যেই শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থী, শিক্ষক ও কর্মকর্তা-কর্মচারীদের নিরাপত্তার বিষয়টি গুরুত্বের সঙ্গে বিবেচনা করে সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ করে দেওয়া হয়। এ অবস্থা প্রায় বছরদেড়েক ধরে চলে। তবে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ ঘোষণার কিছুদিনের মধ্যে সরকারের পক্ষ থেকে অনলাইনে পাঠদান কার্যক্রম চালিয়ে নেওয়ার উদ্যোগ গ্রহণ করা হয়। এর ফলে অনেক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, বিশেষ করে রাজধানী ঢাকাসহ শহর এলাকায় অবস্থিত শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলো শিক্ষা কার্যক্রম কোনোভাবে এগিয়ে নিয়ে গেলেও গ্রামাঞ্চলে অবস্থিত শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলো পর্যাপ্ত সুযোগ-সুবিধার অভাবে অনলাইনে পড়ালেখার কাজ চালিয়ে নিতে পারেনি। গ্রামাঞ্চলের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের শিক্ষকদেরও অনলাইনে পাঠদান পরিচালনার জন্য যথেষ্ট দক্ষতা ছিল না। এমনকি তাদের নিজেদের অনলাইনে পাঠদান সামগ্রীরও অভাব ছিল। ফলে করোনাকালে শহর ও গ্রামের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলো শুরু থেকেই এক ধরনের বৈষম্যের শিকার হয়।
শহরাঞ্চলের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোয় যে অনলাইনে পড়ালেখা স্বাভাবিক গতিতে ছিল বা শিক্ষকরা যে পুরোপুরি পাঠদান করতে সক্ষম হয়েছিল, তা-ও নয়। শহরেও অনেক শিক্ষার্থী অনলাইন কার্যক্রমের বাইরে থাকতে একরকম বাধ্য হয়েছিল। এর পেছনের কারণ পর্যালোচনা করলে দেখা যায়, বহু পরিবার শহরে বসবাস করলেও অনলাইনে পরিচালিত শিক্ষা কার্যক্রমে সন্তানের অংশগ্রহণের জন্য যেসব সামগ্রী ও ইন্টারনেট ব্যবহারের সুযোগ থাকা দরকার, অনেক পরিবার তাদের আর্থিক সামর্থ্যরে অভাবে তা নিশ্চিত করতে পারেনি। ফলে এ ধরনের পরিবারের সন্তানরা কার্যত অনলাইন কার্যক্রমের বাইরে থেকে যায়। এসব কারণে অনেক শিক্ষার্থী নিয়মিতভাবে শিক্ষা কার্যক্রম থেকে ঝরে পড়ে। অথচ বছর শেষে দেখা যায়, পরীক্ষা ছাড়াই পরবর্তী শ্রেণিতে শিক্ষার্থীদের উত্তীর্ণ করতে হয়। দ্বিতীয়ত, প্রায় প্রতিবছর প্রচণ্ড গরম কিংবা অত্যধিক শৈত্যপ্রবাহের কারণেও নির্ধারিত ছুটির বাইরে গিয়ে আকস্মিকভাবে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ রাখতে হয়। এটিও শিক্ষার্থীদের পড়ালেখায় বিঘ্ন সৃষ্টির আরেকটি কারণ।
শিশুদের পড়ালেখার ওপর স্কুল বন্ধ থাকার প্রভাব কতটুকু, তা খুঁজতে গিয়ে বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো ও ইউনিসেফের যৌথ উদ্যোগে একটি জরিপ কার্যক্রম পরিচালিত হয়। ‘ন্যাশনাল সার্ভে অন চিলড্রেন’স এডুকেশন ইন বাংলাদেশ ২০২১’ শীর্ষক ওই জরিপ প্রতিবেদনে (মার্চ ২০২৩) দেখা যায়, কোভিড-১৯-এর সময় সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে প্রান্তিক পর্যায়ের শিশুরা। তাদের ইন্টারনেট ও টেলিভিশন ব্যবহারের সুযোগ সীমিত ছিল। এমনকি তাদের বাড়িতে কম্পিউটার বা স্মার্টফোনের মতো অনলাইন সহায়ক ডিভাইসেরও অভাব ছিল। জরিপে আরও দেখা যায়, শহর এলাকায় ২৮.৭ শতাংশ শিশু এবং গ্রামাঞ্চলে ১৫.৯ শতাংশ শিশু অনলাইন ক্লাসে অংশগ্রহণ করে। অর্থাৎ শহর এলাকায় ৭১.৩ শতাংশ এবং গ্রামাঞ্চলে ৮৪.১ শতাংশ শিশু অনলাইনের ক্লাসের সুযোগ থেকে বঞ্চিত হয়। দেখা যায়, করোনাকালে শহর ও গ্রাম উভয় এলাকার শিক্ষার্থীদের এক বিরাট অংশ অনলাইনে পড়ালেখার সুযোগ থেকে বঞ্চিত হয়। করোনাভাইরাসের সংক্রমণের কারণে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ থাকায় সবচেয়ে কমবয়সি শিশুরা বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিশুদের অনলাইনে অংশগ্রহণ ছিল ১৩.১ শতাংশ, নিম্নমাধ্যমিকে ২০.৩ শতাংশ আর মাধ্যমিক স্তরের ২৩.৭ শতাংশ শিক্ষার্থীর অংশগ্রহণ ছিল। এ চিত্র থেকেই দেখা যায়, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ থাকলে পড়ালেখায় বিপুলসংখ্যক শিক্ষার্থীর অংশগ্রহণ থাকে না। প্রকারান্তরে তারা শিক্ষালাভের সুযোগ থেকে বঞ্চিত হয়। এ ধরনের শিক্ষাবঞ্চনা যে কেবল নিম্নস্তরের শিক্ষার্থীদের ক্ষেত্রেই ঘটে, তা নয়। বরং সব স্তরের শিক্ষার্থীরাই কম-বেশি শিক্ষায় অংশগ্রহণের সুযোগ থেকে বঞ্চিত হয়।
এ পরিস্থিতিতে দেশ গঠনের পাশাপাশি শিক্ষা কার্যক্রম পরিচালনায় স্বাভাবিক গতি ফিরিয়ে আনার বিষয়ে সংশ্লিষ্ট মহলকে গুরুত্ব দিতে হবে জরুরি ভিত্তিতে। প্রয়োজনে স্কুল পর্যায়ের শিক্ষার্থীদের অভিভাবকদের সহযোগিতা কামনায় তাদের নিয়ে মতবিনিময় সভার আয়োজন করা যেতে পারে। বাস্তব পরিস্থিতিতে অভিভাবকদের সঙ্গে স্বল্প পরিসরে মতবিনিময় সভা আয়োজনের উদ্যোগ নিতে হবে। এটি হতে পারে শ্রেণিভিত্তিক অভিভাবক, শিক্ষার্থী ও সংশ্লিষ্ট শ্রেণিশিক্ষকের উপস্থিতিতে মতবিনিময় সভা। এ ধরনের সভা আয়োজনের লক্ষ্যে পৃথক পৃথক শ্রেণির জন্য পৃথক পৃথক দিবস নির্ধারণ করা যেতে পারে। তবে অনলাইনেও মতবিনিময় সভা করা যেতে পারে। এতে আশা করা যায়, স্কুলগুলো আগের মতো শিক্ষার্থীদের উপস্থিতিতে আনন্দমুখর ও কর্মচঞ্চল হয়ে উঠবে। এ ব্যাপারে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান থেকেই কার্যকর উদ্যোগ নিতে হবে আগে। এক্ষেত্রে সরকারি নির্দেশনা স্কুলগুলোর কার্যক্রমে গতি বাড়াবে, সন্দেহ নেই।