ব্যাংকিং খাত সংস্কারের অংশ হিসেবে সবল ব্যাংকের সঙ্গে দুর্বল ব্যাংককে বাধ্যতামূলক একীভূতকরণের আগে স্বেচ্ছায় একীভূতকরণের সুযোগ দিয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংক। তবে কোনো ব্যাংকই স্বেচ্ছায় একীভূতকরণে আগ্রহী নয় বলে জানা গেছে। এখন পর্যন্ত যতগুলো ব্যাংক একীভূত করার সিদ্ধান্ত হয়েছে, তার সবই কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে চাপিয়ে দেওয়া বলে অভিযোগ রয়েছে। শুধু তাই নয়, কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সিদ্ধান্তের বিরোধিতা করে বেশির ভাগ ব্যাংকই এখন একীভূত হতে চাচ্ছে না। কয়েকটি ব্যাংকের পক্ষ থেকে ইতোমধ্যে মানববন্ধন ও সরকারকে স্মারকলিপি প্রদান করা হয়েছে। এ ছাড়া ব্যাংকগুলোর কর্মকর্তা-কর্মচারী এবং গ্রাহকদের মধ্যে এক ধরনের আতঙ্ক বিরাজ করছে। অনেক ব্যক্তি ও প্রাতিষ্ঠানিক আমানতকারী তাদের জমানো টাকা তুলে নিচ্ছেন। এরই মধ্যে কয়েকটি ব্যাংক থেকে আড়াই হাজার কোটি টাকার বেশি উত্তোলন করা হয়েছে। এমন পরিস্থিতিতে ব্যাংক একীভূতকরণের উদ্যোগ সফল হওয়া নিয়ে আশঙ্কা তৈরি হয়েছে।
সম্প্রতি ব্যাংক একীভূতকরণের নীতিমালা জারি করে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। এতে দুর্বল ব্যাংকগুলোকে স্বেচ্ছায় এবং বাধ্যতামূলকভাবে ভালো ব্যাংকের সঙ্গে একীভূতকরণের বিস্তারিত দিকনির্দেশনা রয়েছে। নীতিমালায় বলা হয়, কোনো ব্যাংক স্বেচ্ছায় একীভূত হতে চাইলে নিজ নিজ পরিচালনা পর্ষদ সিদ্ধান্ত নেবে। একীভূত হলেও সংশ্লিষ্ট ব্যাংক তিন বছর পর্যন্ত পৃথক আর্থিক বিবরণী প্রণয়ন করতে পারবে। এতে অধিগ্রহণকারী ব্যাংকের আর্থিক বিবরণীতে কোনো নেতিবাচক প্রভাব পড়বে না।
জানা যায়, এখন পর্যন্ত সরকারি-বেসরকারি মিলে পাঁচটি দুর্বল ব্যাংককে অপেক্ষাকৃত ভালো পাঁচটি ব্যাংকের সঙ্গে একীভূত করার সিদ্ধান্ত হয়েছে। এর মধ্যে নীতিমালা প্রকাশের আগে তিনটি এবং পরে আরও দুটি ব্যাংক একীভূত করার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। সরকারি যে পাঁচটি ব্যাংক একীভূত করার সিদ্ধান্ত হয়েছে সেগুলো হলো সোনালী ব্যাংক, বাংলাদেশ ডেভেলপমেন্ট ব্যাংক (বিডিবিএল), কৃষি ব্যাংক, রাজশাহী কৃষি উন্নয়ন ব্যাংক (রাকাব) ও বেসিক ব্যাংক। এর মধ্যে সোনালীর সঙ্গে বিডিবিএল, কৃষির সঙ্গে রাকাবকে একীভূত করার সিদ্ধান্ত হয়েছে। আর বেসরকারি যে পাঁচটি ব্যাংকের একীভূত করার সিদ্ধান্ত হয়েছে, তার মধ্যে রয়েছে- এক্সিম ব্যাংক, সিটি ব্যাংক, ইউসিবি, ন্যাশনাল ও পদ্মা ব্যাংক। এর মধ্যে এক্সিমের সঙ্গে পদ্মা, ইউসিবির সঙ্গে ন্যাশনাল এবং সিটির সঙ্গে সরকারি মালিকানাধীন বেসিক ব্যাংককে একীভূত করার সিদ্ধান্ত হয়েছে। তবে এক্সিম ও পদ্মা ব্যাংকের বাইরে একীভূত হওয়ার আনুষ্ঠানিক ঘোষণা কোনো ব্যাংক থেকে দেওয়া হয়নি। সূত্রগুলো বলছে, কে কার সঙ্গে একীভূত হবে, সেই সিদ্ধান্ত ব্যাংকগুলোকে স্বাধীনভাবে নেওয়ার সুযোগ দেওয়া হয়নি। আবার তাদের মতামতও নেওয়া হয়নি। এ কারণে একীভূতকরণের বিপক্ষে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের ওপর চাপ বাড়ছে।
ব্যাংক একীভূতকরণ পদক্ষেপ বাস্তবায়নে কেন্দ্রীয় ব্যাংক যেভাবে এগিয়েছে, সেটা যথাযথ হয়নি বলে মনে করেন বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব ব্যাংক ম্যানেজমেন্টের (বিআইবিএম) সাবেক মহাপরিচালক ড. তৌফিক আহমেদ চৌধুরী। তিনি আমাদের সময়কে বলেন, বাংলাদেশ ব্যাংক যেভাবে এগোচ্ছে, এটা আসলে একীভূতকরণ প্রক্রিয়া (মার্জারের প্রসেস) নয়। এটা এক প্রকার চাপিয়ে দেওয়া সিদ্ধান্ত। মার্জারের বিষয়টি হলো স্বেচ্ছা প্রক্রিয়া। অথচ হচ্ছে সম্পূর্ণ উল্টো। ফলে একীভূতকরণের উদ্যোগ সফলভাবে বাস্তবায়ন হওয়া নিয়ে শঙ্কা থেকেই যাচ্ছে।
এক প্রশ্নের জবাবে বিআইবিএমের সাবেক মহাপরিচালক বলেন, একের পর এক ব্যাংকের লাইসেন্স দেওয়ার সময় ‘এক্সিট পলিসি’ করার তাগাদা দেওয়া হলেও এতদিনে তা হয়নি। এর মধ্যে অনেকগুলো ব্যাংক দুর্বলের কাতারে চলে গেছে। তিনি বলেন, এখন দুর্বল ব্যাংকগুলোকে বাঁচানোর (একীভূত করার) নামে আরেকটা সমস্যা তৈরি করা হচ্ছে। কারণ দুর্বল ব্যাংকগুলোর খারাপ সম্পদ তৃতীয় কোম্পানির কাছে বিক্রি করে দেওয়া হবে। কিন্তু সম্পদ কিনে নেওয়ার প্রক্রিয়াটা কী, সেগুলোর কিছুই নীতিমালায় পরিষ্কার করা হয়নি। এর মানে সরকারি টাকায় এই ঋণগুলো কিনে নেওয়া হবে। অর্থাৎ আরেকটা সুবিধা দেওয়া হবে ঋণখেলাপিদের। এর মাধ্যমে ভালো জিনিসটাকে আরও খারাপ করা হচ্ছে। অন্যদিকে যাদের কারণে ব্যাংকগুলো খারাপ হলো, তাদের শাস্তির পরিবর্তে এক প্রকার দায়মুক্তি দেওয়া হচ্ছে।
অন্যদিকে ‘বাধ্যতামূলক একীভূতকরণ নিয়ে নীতিমালায় বলা হয়, দুর্বল ব্যাংককে ২০২৫ সাল থেকে বাধ্যতামূলক একীভূত করতে পারবে বাংলাদেশ ব্যাংক। কোনো ব্যাংক একীভূত হওয়ার আগে বাংলাদেশ ব্যাংকের তালিকাভুক্ত নিরীক্ষা প্রতিষ্ঠান দিয়ে মূল্যায়ন করতে হবে। এ কাজের খরচ জোগান দেবে বাংলাদেশ ব্যাংক। একীভূত হওয়ার সিদ্ধান্ত হলে সংশ্লিষ্ট ব্যাংকের দায় ও সম্পদ গ্রহণের দরপত্র পত্রিকায় বিজ্ঞপ্তি আকারে প্রকাশ করতে হবে, যাতে ওই ব্যাংকের সব ধরনের তথ্য থাকবে। এতে সাড়া না মিললে যে কোনো ব্যাংকের সঙ্গে ওই ব্যাংককে একীভূত করে দিতে পারবে কেন্দ্রীয় ব্যাংক।
এ বিষয়ে বিশ্বব্যাংকের ঢাকা কার্যালয়ের সাবেক মুখ্য অর্থনীতিবিদ ড. জাহিদ হোসেন বলেন, ‘বাধ্যতামূলক একীভূত করার বিষয়ে নীতিমালায় বলা হয়েছে, দুর্বল ব্যাংকগুলোকে একীভূত করার বিষয়ে প্রথমে পত্রিকায় বিজ্ঞাপন প্রকাশ করা হবে। এরপর কেউ আগ্রহ দেখালে তাদের খারাপ সম্পদের বিষয়ে যাচাই-বাছাইয়ের উদ্যোগ নেওয়া হবে। প্রশ্ন হলো- খারাপ সম্পদের তথ্য আগে না জানলে এসব ব্যাংককে একীভূত করার বিষয়ে কেন এবং কীসের ভিত্তিতে অন্যরা আগ্রহী হবে। এ ছাড়া নীতিমালায় পরিচালকদের পাঁচ বছর পর আবার পর্ষদে ফেরার যে সুযোগ রাখা হয়েছে, তা এক ধরনের দায়মুক্তি। ব্যাংক খাতের সুশাসনের ক্ষেত্রে তা সমস্যা তৈরি করতে পারে।
কয়েকটি ব্যাংকের বিরোধিতা : বেসরকারি সিটি ব্যাংকের সঙ্গে একীভূত হতে চাচ্ছেন না বেসিক ব্যাংকের কর্মকর্তা-কর্মচারীরা। এর পরিবর্তে সরকারি কোনো ব্যাংকের সঙ্গে একীভূত হওয়ার দাবিতে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের গভর্নরকে স্মারকলিপি প্রদান করেছেন ব্যাংকটির কর্মকর্তা-কর্মচারীরা। একই দাবিতে অর্থ মন্ত্রণালয়েও স্মারকলিপি দিয়েছেন তারা। এ ছাড়া বিডিবিএলকে একীভূত না করতে প্রধানমন্ত্রী বরাবর খোলা চিঠি দিয়েছে বিডিবিএল অফিসার্স অ্যাসোসিয়েশন। শুধু তাই নয়, বাংলাদেশ কৃষি ব্যাংক (বিকেবি) ও রাজশাহী কৃষি উন্নয়ন ব্যাংককে (রাকাব) একীভূতকরণ প্রক্রিয়া বন্ধের দাবিতে রাজশাহীতে প্রতিবাদ ও মানববন্ধন কর্মসূচি পালিত হয়েছে। এই দাবি না মানা হলে উত্তরাঞ্চল অচল করে দেওয়ারও হুশিয়ারি দেওয়া হয়েছে।
সম্প্রতি ‘বাংলাদেশ ডেভেলপমেন্ট আপডেট’ বা বাংলাদেশ উন্নয়ন হালনাগাদ শীর্ষক এক প্রতিবেদনে বিশ্বব্যাংক বলেছে, ব্যাংক একীভূত করার ক্ষেত্রে আরও সতর্ক হওয়া প্রয়োজন। আন্তর্জাতিক রীতিনীতি মেনে এই প্রক্রিয়া সম্পন্ন করা দরকার। সম্পদের মান ও সুনির্দিষ্ট নীতিমালার ভিত্তিতে ব্যাংক একীভূত করা উচিত।